সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী: মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী ও রক্ষাকারী
মুহাম্মদ জহিরুল আলম
দয়াল রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) সুদীর্ঘ ১৫ বছর হেরাগুহায় ধ্যান সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে যে ধর্ম লাভ করেছেন, তাই মোহাম্মদী ইসলাম। হযরত রাসুল (সা.) আপন ক্বালব বা অন্তরে সত্যের এ বাণী লাভ করেছিলেন, তাই মোহাম্মদী ইসলামের মূল শিক্ষা হলো- মোরাকাবার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা। সকল নবি-রাসুল এলমে তাসাউফ বা ক্বালবের বিদ্যায় বিদ্বান ছিলেন। তাঁরা মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের ভিতর আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছেন। নবি-রাসুলগণ যেমন আল্লাহর অস্তিত্বের ধারক ও বাহক, তেমনি অলী-আল্লাহগণ বেলায়েতের যুগেও আল্লাহর অস্তিত্বের ধারক ও বাহক। তাই তাসাউফ সকল নবি-রাসুল, অলী-আল্লাহর মাঝে বিদ্যমান। অর্থাৎ আল্লাহকে পেতে হলে তাসাউফের মাধ্যমেই পেতে হবে। এলমে তাসাউফের ইসলামই মোহাম্মদী ইসলাম।
হযরত আদম (আ.) হতে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবি-রাসুল ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। সকল নবি-রাসুলই তাঁদের স্ব স্ব উম্মতদের আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বন্ধু রাসুল (সা.)-এর আগমনের শুভ সংবাদ দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, “স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন নবিদের কাছ থেকে যে, যা কিছু আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দিয়েছি এবং তোমাদের কাছে যা আছে, তার সত্যায়নকারীরূপে একজন রাসুল আসবেন, তখন অবশ্যই তোমরা তাঁর প্রতি ইমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ্) বলেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এই সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তাঁরা বলল- আমরা স্বীকার করলাম।’ তিনি বললেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও সাক্ষী রইলাম’।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৮১)। হযরত আদম (আ.) হতে হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবি-রাসুল এসেছেন। সবার মৌলিক বিষয়ে মিল রয়েছে। দয়াল রাসুল (সা.) আগমনের মাধ্যমে আমাদের ইসলাম ধর্ম পূর্ণতা পেয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আজ হতে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম”। (সূরা আল মায়িদাহ ৫ : আয়াত ৩)। দয়াল রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহর কাছ থেকে যে নিয়ামত লাভ করে, মানব জাতির মুক্তির জন্য জগতের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাই মোহাম্মদী ইসলাম। এ প্রসঙ্গে যুগের ইমাম, মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, “সকল নবি রাসূল ইসলাম প্রচার করেছেন, কিন্তু রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবি ও রাসুলগণের প্রচারিত সেই ইসলামকে পূর্ণতা দান করেন। যেহেতু আমরা পূর্ববর্তী কোনো নবির ধর্ম অনুসরণ না করে বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দেওয়া ইসলামী বিধান অনুসরণ করি, সুতরাং আমাদের এই ধর্মের নাম ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ নামকরণ করা অধিক যুক্তিসংগত।” তিনি আরো বলেন- ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন মাজহাব ও তরিকাগুলো এসব মাজহাব ও তরিকার ইমামগণের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। যারা পবিত্র কুরআনের তাফসির করেছেন, তাঁদের স্বনামে তাফসির গ্রন্থগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। যারা হযরত রাসুল (সা.)-এর হাদিস সংগ্রহ করে সংকলন করেছেন, তাঁদের স্বনামে হাদিস গ্রন্থসমূহের নামকরণ করা হয়েছে। আর হযরত মুহাম্মদ (সা.) মানবমুক্তির জন্য এলমে শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত ও মারেফত সংবলিত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব ‘আল কুরআন’ প্রাপ্ত হয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী মানুষকে পরিচালিত করেছেন, তাই তাঁর প্রবর্তিত ইসলামকে ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ বলা অপরিহার্য।
দয়াল রাসুল (সা.) ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা বিজয় করেন। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে আরবে মোহাম্মদী ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও পৌত্তলিকতার অবসান হয়। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত রাসুল (সা.) বিদায় হজে অংশগ্রহণ করেন। হজ সম্পন্ন করে মদীনায় ফেরার পথে ‘গাদিরে খুম’ নামক স্থানে উটের জিনগুলোকে একত্রিত করে তৈরি মঞ্চে উঠে সোয়া লক্ষ সাহাবিদের সামনে ঘোষণা করেন, “আমি যার মাওলা (অভিভাবক), আলী-ও তার মাওলা।” (তিরমিজি শরিফ, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২১২)। বিশিষ্ট ইসলামি গবেষক ও লেখক ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.) বলেন, “এই ঘোষণার পর হযরত রাসুল (সা.) যখন মদিনায় ফিরে আসলেন, তখন দেখলেন সাহাবাদের মধ্যে মতানৈক্য শুরু হয়ে গেছে। এই মতানৈক্য তাঁদের মধ্যে ফাটলের সৃষ্টি করে। এই ফাটলের অনেকগুলো কারণ ছিল, তন্মধ্যে অন্যতম হলো- হযরত রাসুল (সা.) ছিলেন কুরাইশ বংশের হাশেমি গোত্রের। শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-ও ছিলেন একই গোত্রের এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান।… কিন্তু হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-কে খলিফা ঘোষণা করা উমাইয়ারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। উমাইয়ারা চেয়েছিল তাদের বংশ হতেই খলিফা মনোনীত হোক। এই বিষয়টি উপলব্ধি করেই হযরত রাসুল (সা.) ওফাতের ৪ দিন আগে তাঁর নির্দেশনা লিখে দিতে চেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তারা যদি গাদিরে খুমে হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ মেনে নিতো, তাহলে তো হযরত রাসুল (সা.) কাগজ আনতে বলতেন না। পরবর্তিতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনায় আসতো না, ‘হায় বৃহস্পতিবার! হায় বৃহস্পতিবার! যারা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে লিখতে বাধা দিয়েছিল।’ কাফেররা ২৭টা যুদ্ধ করেও হযরত রাসুল (সা.)-কে ধর্ম প্রচারে থামাতে পারেনি, কিন্তু এই কাফেরেরা-ই পরবর্তিতে রঙ বদলিয়ে ইসলামের ভিতরে ঢুকে ইসলামকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে।… ওফাতের ৪ দিন পূর্বে হযরত রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমাকে কাগজ দাও।’ অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, হযরত ওমর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর মানসিক অবস্থা ঠিক নাই! তিনি জ্বরে প্রলাপ বকছেন। আমাদের কাছে কুরআন আছে। আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট।’ হযরত ওমর (রা.)-এর চিন্তাধারাটি ছিল সত্যিই খুব বেদনাদায়ক। যে রাহমাতুল্লিল আলামিনকে সৃষ্টি না করলে মহান আল্লাহ কিছুই সৃষ্টি করতেন না; যাঁকে জগৎসমূহের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করলেন; যিনি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু; যাঁর মাধ্যমে মানুষ পেল পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান আল্ কুরআন, আর তাঁকেই বাদ দিয়ে পবিত্র কুরআন অনুসরণ!” (আত্মার বাণী, ফেব্রুয়ারী ২০২০, পৃষ্ঠা ৯-১০) নবুয়তের যুগের সমাপ্তিতে দয়াল রাসুল (সা.) গাদিরে খুমের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-কে ইমামের সুমহান দায়িত্ব দিয়ে ইমামতের যুগের সূচনা করেন। কিন্তু মুসলমানগণ বিভ্রান্তিতে পড়ে খিলাফতের ধারায় অগ্রসর হয়। আমরা লক্ষ্য করি, ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ সূচনা থেকেই চক্রান্তের স্বীকার, চক্রান্তকারীদের দ্বারা হযরত আবু বকর (রা.) ছাড়া মুসলিম জাহানের বাকি তিন খলিফাই শহীদ হন।
রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) একাদশ হিজরির ১ রবিউল আউয়াল সোমবার দারুল বাকায় তশরিফ গ্রহণ করেন। ওফাতের কিছুদিন আগে হযরত রাসুল (সা.) একটি স্বপ্ন দেখেন, যা তাফসিরে কাবিরে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) স্বপ্নে দেখেন, বনি উমাইয়ারা একের পর এক তাঁর পবিত্র মিম্বর পদদলিত করছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে, উমাইয়া বংশের বানরগুলো একের পর এক লাফিয়ে লাফিয়ে তাঁর মিম্বরে উঠছে আর নামছে। এ স্বপ্ন দেখার পর রাসুল (সা.) মনে খুব কষ্ট পান। বাস্তবে আমরা তাই দেখতে পাই। মুসলিম জাহানের এক অরাজক পরিস্থিতিতে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বিশিষ্ট সাহাবিদের অনুরোধে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু খলিফা হন। কিন্তু মুসলমান নামধারী চক্রন্তকারীদের হাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। মোহাম্মদী ইসলামের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলতেই থাকে। ইমাম হাসান (রা) ৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মুয়াবিয়া এবং তার পুত্র এজিদের চক্রান্তে স্বীয় স্ত্রী জায়েদা দ্বারা বিষ প্রয়োগে মর্মান্তিকভাবে শাহাদত বরণ করেন। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে এজিদ বাহিনীর ২২ হাজার সৈন্যের সাথে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ৭২ জন আশেকে রাসুলের এক অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কারবালার যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ ৭২ জন নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পূর্বেই তাঁর পুত্র ইমাম জয়নাল আবেদিন (রহ.)-কে ‘ইমামত’-এর সুমহান দায়িত্ব অর্পণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে মোহাম্মদী ইসলামের সূর্য অস্তমিত হয়।
চরিত্রহীন, লম্পট, মদ্যপায়ী এজিদ ক্ষমতা দখল করে নিজেকে খলিফা বলে ঘোষণা করে। তার উদ্দেশ্যই ছিল মোহাম্মদী ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও চরিত্র জগতের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করা। ইসলামী জীবন বিধানের প্রতি চরম অবজ্ঞা করে নতুন নতুন আইন, অনুশাসন ও রীতি-নীতি তৈরী করে এবং সেগুলোকে ইসলামের বিধান বলে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করো – এটাই হল তাদের মনগড়া দ্বিন ইসলাম। আহলে বাইতের বিরুদ্ধে তখনও তাদের ঘৃণ্য চক্রান্ত থেমে থাকেনি। উমাইয়ারা ৮৯ বছর (৬৬১-৭৫০খ্রি) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে আব্বাসিয়রা ৫০৮ বছর (৭৫০-১২৫৮খ্রি.) শাসন ক্ষমতায় ছিল। তারাও আহলে বাইত ও তাঁদের অনুসারীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। এ দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় যে ইসলাম সমাজে প্রচলিত হয়, তাতে দয়াল রাসুল (সা.)-এর প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ অনুপস্থিত থেকে যায়।
বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার এ ক্রান্তি লগ্নে দয়াল রাসুল (সা.)-এর ওফাতের ১৩১৭ বছর পর জগতের বুকে আগমন করেন বেলায়েতের যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম, মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান। জগতশ্রেষ্ঠ এ মহামানব ১৯৪৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলাধীন বাহাদুরপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর ৩৬তম অধঃস্তন মহামানব। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র মহামানব, যিনি মহান আল্লাহর প্রকৃত স্বরূপ জগতবাসীর নিকট তুলে ধরে প্রমাণ করেছেন; মহান আল্লাহ নিরাকার নন, তাঁর নুরের রূপ রয়েছে এবং এ বিষয়ে ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ নামক ৮ খন্ড তাফসীর শরীফ রচনা করেছেন। তিনি ১৯৮৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর রহমতের সময় মহান আল্লাহর পক্ষ হতে জামানার ‘মোজাদ্দেদ’ বা সংস্কারকের দায়িত্ব পান; ১৯৮৮ সালের ২৪ আগষ্ট যুগের ইমামের দায়িত্ব লাভ করেন; পরবর্তীতে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) তাঁকে ১৯৮৯ সালের ৫ এপ্রিল রহমতের সময় ‘মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী’ খেতাবে বিভূষিত করেন; ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর সমস্ত নবি-রাসুলের বেলায়েত ও তাঁদের ধর্ম পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর, শাওয়াল মাসের পূর্ণিমার চাঁদে আল্লাহ তাঁকে স্বরূপে প্রকাশ করেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজও তাঁর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি পূর্ণিমার চাঁদে দেখতে পাচ্ছেন।
তিনি দেড় হাজার বছরে হারিয়ে যাওয়া, দয়াল রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা, আদর্শ ও চরিত্র তথা মোহাম্মদী ইসলাম-কে জগতের বুকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইতঃপূর্বে আর কোনো মহামানব তা করেন নি। তিনি এজিদি ইসলামের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ধর্মে প্রবিষ্ট কুসংস্কারগুলো মানবজাতির নিকট উপস্থাপন করে তিনি এর সংস্কার সাধন করেছেন। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, মোহাম্মদী ইসলাম বিলুপ্ত হলো কিভাবে এবং তিনি তার পুনর্জীবনদানকারী কীভাবে? আলোচ্য প্রবন্ধে নিশ্চয় এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
মোহাম্মদী ইসলামের বিলুপ্তি:
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইবর’-এ মন্তব্য করেন, “ইসলামের অভ্যুদয় ঘটেছে মক্কায়, পরিপূর্ণতা লাভ করেছে মদিনায়, রোগাগ্রস্ত হয়েছে কুফায়, মৃত্যুবরণ করেছে দামেস্কে এবং কবরস্থ হয়েছে বাগদাদে।” সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী উল্লেখ করেন, আহলে বাইতের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করে এজিদ ও তার অনুসারীদের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে বিকৃত যে ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা পায় তা ছিল ভোগের, প্রতারণা ও নিষ্ঠুরতার, জুলুম ও অত্যাচারের, লেবাসের, মৌখিক স্বীকৃতির, মিথ্যা, অশান্তি, হানাহানি, লোক দেখানো, স্বেচ্ছাচারিতা, ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সুকৌশলে নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার। প্রকৃত অর্থে যখন থেকে ইসলামে সুফিবাদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তখন থেকেই মোহাম্মদী ইসলাম বিলুপ্ত হয়েছে, শুধু মুখোশটা আছে। যেমন রূহ আর দেহ। রূহ না থাকলে দেহটা লাশ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) রূহের ইসলাম চালু করেছিলেন, রূহের ইসলামটা নেই। পরে দেহের ইসলাম চালু হয়েছে। যে ইসলামে তাসাউফ নেই সে ইসলাম প্রাণহীন।
মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদান:
মোহাম্মদী ইসলাম এসেছে হেরাগুহা থেকে। দয়াল রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) ১৫ বছর হেরাগুহায় ধ্যান সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ-কে পেয়েছেন। আল্লাহকে পাওয়ার পর, আল্লাহর নির্দেশে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহকে ও তাঁর রাসুল-কে পাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেন। তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতিদিন ছয়বার মোরাকাবা করতে হয়। তিনি আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা, নামাজে হুজুরি এবং আশেকে রাসুল হওয়ার শিক্ষা দেন। ইসলাম থেকে যখন তাসাউফ বিলুপ্ত হয়েছে, তখনই ইসলাম প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের সবক নিলে ক্বালবে জিকির চালু হয়, তাঁর স্পর্শে ক্বালব প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠে। তাঁর শিক্ষা নিলে মানুষ স্বপ্ন ও মোরাকাবায় দয়াল রাসুলের সাক্ষাৎ পায়, হৃদয়ে রাসুলের প্রেম জাগ্রত হয় এবং আশেকে রাসুল হয়। সুতরাং তিনিই মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী। রাসুল কালেমা পড়ালে ক্বালব জিন্দা হয়েছে, পরবর্তিতে তা আর হয়নি। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলার স্পর্শে ক্বালব জিন্দা হয়ে আল্লাহ্ নামের জিকির জারি হয়। কাজেই তিনিই মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী।
আজ বিশ্বের ১৩২টি দেশে মোহাম্মদী ইসলামের জাগরণ এসেছে। সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বাংলাদেশে ১১টি দরবার শরীফ, অসংখ্য খানকাহ শরীফ ও আশেকে রাসুল মজলিশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কোটি কোটি মানুষ তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করেছে এবং প্রতিনিয়ত করছে। এক বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে মোহাম্মদী ইসলাম সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনিই মোহাম্মদী ইসলামের মোর্শেদ। মোহাম্মদী ইসলাম রক্ষাকল্পে তিনি অত্যন্ত সচেতন, সর্বদাই তিনি সবাইকে সচেতন করে দিচ্ছেন। সূফী সম্রাট বলেন, “হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইসলাম যেখানে গিয়েছে, সেখানেই ফেতনাকারীরা ফেতনা করেছে। ফেতনাকারীরা হযরত রাসুল (সা.)-এর আশেকদের নিয়ে ফেতনা, সাহাবিদের মধ্যে দলাদলি, মারামারি, কাটাকাটি সৃষ্টি করেছে।” আশেকে রাসুলদের ভবিষ্যত দিকনির্দেশনা দিয়ে সূফী সম্রাট বলেন, “আমি একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই- আমি কোনো তরিকা করি না। আমি মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার করি। সুতরাং আমার এখানে কোনো তরিকা নেই। তরিকার পথ বেয়ে, তরিকা শিক্ষা করে মহান আল্লাহ ও হযরত রাসুল (সা.)-কে পেয়েছি। এরপর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদী ইসলাম জগদ্বাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য। আপনারা পরিষ্কার মনে রাখবেন, ভবিষ্যতে মোহাম্মদী ইসলামে কেউ পির হবে না। হযরত রাসুল (সা.)-এর পরে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে কেউ পির ছিলেন না। পির হলে আবার এটা তরিকায় চলে যাবে। ইসলাম হলো গাছ, আর তরিকা হলো গাছের শাখা-প্রশাখা। যদি পির হয় তাহলে মোহাম্মদী ইসলামটা রক্ষা হবে কীভাবে? তবে খলিফাতুল মুসলেমিনদের মতো আমার এখানেও ইমাম হবে। এখন ইমামতের যুগ। সুতরাং আমার এখানে কোনো পির হবে না। যদি কখনো কেউ পির দাবি করে আপনারা পাত্তাই দিবেন না। পির হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।” (৯ এপ্রিল, ২০১০ খ্রি. বাবে রহমত দেওয়ানবাগ শরীফে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান প্রদত্ত বাণী মোবারক থেকে সংকলিত)।
মোহাম্মদী ইসলামের ভবিষ্যত কর্ম পন্থা নিয়ে অসংখ্যবার তিনি আশেকে রাসুলদের নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বারবার বলেন, “আমরা পালন করি মোহাম্মদী ইসলাম। আমাদের দরবারে কোনো পির হবে না। কারণ হযরত রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলামে পির হওয়ার কোনো সিস্টেম নেই। পরবর্তীতে যদি পির হয় তাহলে মোহাম্মদী ইসলাম থাকবে না।” (সাপ্তাহিক দেওয়ানবাগ, ১৭ অক্টোবর ২০১৪)।
সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান, দয়াল রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম শুধু প্রতিষ্ঠাই নয়, একইসাথে রক্ষাকল্পে তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। মোহাম্মদী ইসলামে ফেতনা করলে, সে যেই হোক তিনি কোনো প্রকার ছাড় দিবেন না। সে হবে মোহাম্মদী ইসলাম হতে বিতাড়িত, দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ হতে বহিষ্কৃত। আশেকে রাসুলদের জন্য তিনি ঘোষণা দেন “কোনো পরামর্শের প্রয়োজন হলে আমার ছেলেদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তাঁরাই বলে দিবে, কারণ তাঁরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দিবে না।” (১৫ নভেম্বর, ২০১৯ খ্রি. বাবে রহমত দেওয়ানবাগ শরীফে সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান প্রদত্ত বাণী মোবারক থেকে সংকলিত)।
আশেকে রাসুলদের মোর্শেদ ও হৃদয়ের স্পন্দন হলেন- সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান। সর্বাবস্থায় আশেকে রাসুলগণ তাঁর প্রতি সমর্পিত। তিনিও তাদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন, শত সহস্র মাইল দূরে থেকেও আশেকের ডাকে সাড়া দেন। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি দয়াময় আল্লাহ ও তাঁর হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রকৃত পরিচয় জগতের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একজন যুগশ্রেষ্ঠ মহামানব হওয়ার কারণেই চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাওয়া মোহাম্মদী ইসলাম-কে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজ মোহাম্মদী ইসলাম ফুলে ফুলে সুশোভিত। তাই তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দেন, কোনো ফেতনাকারীর ঠাঁই মোহাম্মদী ইসলামে হবে না। অতীতে ভুলের কারণে মোহাম্মদী ইসলামের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি আর হবে না।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]