অলী-আল্লাহগণের আগমন ও উদ্দেশ্য
ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা
পর্ব-০১
নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল এবং এরই ধারবাহিকতায় বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহগণের সান্নিধ্যে গিয়ে মানুষকে বায়েত গ্রহণ করে ইমানের নুর নিজ হৃদয়ে ধারণ করে এলমে তাসাউফের শিক্ষার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করত চরিত্রবান হতে হয়। তাই আমাদেরকে অলী-আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে বায়েত গ্রহণ করতে হবে। এই বায়েত প্রথা সৃষ্টির শুরু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এটাই মু’মিন হওয়ার পদ্ধতি।
‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ গ্রন্থের (১ম খণ্ডে) বায়েত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এ তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, বায়েত শব্দের অর্থ মুরিদ হওয়া, আত্মসমর্পণ করা, শপথ করা, আনুগত্য করা, নিজের অস্তিত্বকে বিক্রি করা, আনুগত্যের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ- মহান রাব্বুল আলামিনকে পাওয়ার জন্য মোর্শেদের কাছে আনুগত্যের শপথ করে যাবতীয় পাপ কর্ম হতে বিরত থেকে মোর্শেদের মাধ্যমে আল্লাহতে আত্মসমর্পিত হওয়া।
সৃষ্টির আদি থেকে সকল যুগে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য মানুষকে সমকালীন যুগের মোর্শেদ তথা নবি-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে আনুগত্যের শপথ নিয়ে বায়েত গ্রহণ করে ইমানদার বা মু’মিন হতে হয়েছে। এটিই আল্লাহকে পাওয়ার একমাত্র বিধান। যার ফলশ্রুতিতে, হযরত রাসুল (সা.)-এর হাতে হাত দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম বায়েত গ্রহণ করে পূর্ণ আনুগত্যের শপথ করেছিলেন। কেননা, নবি-রাসুল এবং আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমেই আল্লাহকে পেতে হয়। এজন্য বায়েতের বিধান সৃষ্টির আদি হতে অদ্যাবধি চলে আসছে এবং কিয়ামত অবধি চলতে থাকবে। কারবালার প্রান্তরে হযরত রাসুল (সা.)-এর ধর্মের জ্বলন্ত প্রদীপ ইমাম হোসাইন (রা.)-কে শহিদ করার পর রাজতন্ত্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এজিদ ইবনে মাবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান। তখন থেকেই হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া মোহাম্মদী ইসলাম চক্রান্তের বেড়াজালে পড়ে। ইসলাম দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। যথা-
১। হেরা গুহা হতে উৎসারিত তাসাউফ ও বায়েত নির্ভর হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম।
২। তাসাউফ ও বায়েত বিবর্জিত এজিদের ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় ইসলাম, যা এজিদি ইসলাম।
তাসাউফের বিধান মতে, প্রত্যেক যুগে মুক্তিকামী মানুষকে তার যুগের মোর্শেদ তথা নবি-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের সান্নিধ্যে গিয়ে ইমানের নুর স্বীয় ক্বালবে ধারণ করে মু’মিন হতে হয়। নচেৎ তার ইমানের দাবী আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “মরুবাসীরা বলে- আমরা ইমান এনেছি। আপনি বলে দিন: তোমরা ইমান তো আননি, বরং বলো- আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি। আর ইমান তো এখনো তোমাদের ক্বালবে প্রবেশ করেনি। কাজেই যদি তোমরা আল্লাহ্ ও রাসুলের আনুগত্য করো, তবে তিনি তোমাদের কর্মসমূহ থেকে একটুও কম করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও অসীম দয়াময়।” (সূরা আল হুজুরাত ৪৯: আয়াত ১৪)
এজন্য ইসলামে বায়েত হওয়াকে ফরজ করা হয়েছে। কেননা, বই-পুস্তক ও কিতাবাদি পড়াশুনা করে ধর্মীয় ব্যাপারে পাণ্ডিত্য অর্জন করা যায়, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস ও মুফতি হওয়া যায়, কিন্তু মু’মিন হওয়া যায় না। মু’মিন হওয়ার জন্য মোর্শেদের সহবতে গিয়ে ক্বালবে আল্লাহর নুর ধারণ করে ইমানদার হতে হয়। যেভাবে হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবতে গিয়ে বায়েত গ্রহণ করে মক্কা ও মদীনার অগণিত মানুষ মু’মিন হয়ে সাহাবির মর্যাদা লাভ করেছেন।
এ বায়েত প্রথা সৃষ্টির শুরু থেকে মহামানবগণের মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। সর্বশেষ নবি হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগেও এ বায়েত প্রথা চালু ছিল। পরবর্তীতে কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতবরণের পর কুখ্যাত এজিদ রাষ্ট্রিয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আহলে বাইত প্রেমিকদের প্রতি অত্যাচার শুরু করে দেয়। মুলত কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ নবি পরিবারকে হত্যার মাধ্যমে মোহাম্মদী ইসলামকে কবরস্থ করা হয়। তখন থেকেই বায়েত প্রথা বিলুপ্ত হয়। উমাইয়াদের পর পরবর্তী আব্বাসিয় শাসকবৃন্দও তৎকালীন যুগের স্বনামধন্য অলী-আল্লাহ্গণের উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। এরপরও ইসলাম যতটুকু প্রসার লাভ করেছে তা অলী-আল্লাহগণের মাধ্যমেই। অলী-আল্লাহগণের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন এবং বিধর্মীদেরকে মুসলমানে পরিণত করেন। তাঁরা বায়েতের মাধ্যমে মানুষকে ইমানদার তথা মু’মিন বানিয়েছিলেন।
এজিদের বংশধর (উমাইয়া বংশ) দীর্ঘ ৮৯ বছর এবং আব্বাসিয়গণ সুদীর্ঘ ৫০৮ বছর ধরে রাজত্ব করে। এছাড়াও স্পেনে মুসলমানগণ প্রায় ৭৫০ বছর এবং মিশরে ফাতেমিগণ প্রায় ২৫০ বছর ধরে রাজ্য শাসন করে। শাসনক্ষেত্রে বিভিন্ন মুসলমান শাসক দক্ষতার পরিচয় দিলেও তাদের অধিকাংশই ছিলেন তাসাউফ বিরোধী। যার ফলে বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত তাসাউফপন্থী মহামানবগণ নির্মমভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম শাফেয়ি (রহ.), ইমাম আহ্মদ ইবনে হাম্বল (রহ.), হযরত মনছুর হাল্লাজ (রহ.), হযরত যুন্নুন মিশরি (রহ.) প্রমুখ মহামানবগণের মধ্যে অনেকেই অত্যাচারী ও তাসাউফ বিরোধী মুসলমান শাসকদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন এবং অনেকেই লাঞ্ছিত হন। কিন্তু সেই পরাক্রমশালী রাজাদের রাজ্যও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। বাগদাদের মুসলিম শাসন ধ্বংস করেছে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান (১২৫৮ খ্রি.), স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ধ্বংস হয় খ্রিষ্টান রাজা ফার্ডিনান্ডের হাতে (১৪৯২ খ্রি.) এবং খ্রিষ্টানদের হাতে মিশরে ফাতেমিদের পতন ঘটে (১১৭১ খ্রি.)। মোটকথা, এভাবে একের পর এক পরাজয়ের কারণে মুসলমানদের দীর্ঘদিনের শাসন ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তারা চরম ধ্বংসের সম্মুখীন হন।
তাই মুসলনাদের ধ্বংসের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘ইব্র’-এ মন্তব্য করেন- “Islam was risen in Makkah, was spread out in Madinah, was fallen sick in Kufa, was expired in damascus and it was put into the grave in Baghdad.” অর্থাৎ- ইসলামের অভ্যুদয় ঘটেছে মক্কায়, পরিপূর্ণতা লাভ করেছে মদীনায়, রোগাগ্রস্ত হয়েছে কুফায়, মৃত্যুবরণ করেছে দামেস্কে এবং কবরস্থ হয়েছে বাগদাদে।
হেরা গুহা থেকে উৎসারিত তাসাউফ ও বায়েত নির্ভর মোহাম্মদী ইসলামের অভ্যুদয় ঘটে মক্কায়। পরবর্তীতে এর পরিপূর্ণতা লাভ হয় মদীনায়। অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.)-এর ২৩ বছর এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের ৩০ বছর এই মোট ৫৩ বছর বায়েত প্রথা বিদ্যমান ছিল। তাঁদের সময় বায়েতের যে ইসলাম ছিল, তা এজিদ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বায়েত প্রথার বিলুপ্ত ঘটে। তখন হতেই মোহাম্মদী ইসলাম থেকে ইসলামের কাণ্ডারী হযরত রাসুল (সা.)-এর নাম বাদ দিয়ে শুধু ইসলাম পালন হয়ে আসছে, যে ইসলামের কোনো প্রাণ নেই। উমাইয়াদের শাসনামল ছিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। উমাইয়া শাসনামলের পত্তনের পর আসে আব্বাসিয় শাসনামল। তখন এর রাজধানী দামেস্ক হতে ইরাকের দজলা নদীর তীরে বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের ৫শত বছর পর মোহাম্মদী ইসলামের সংকটময় মুহূর্তে দুনিয়ায় আবির্ভূত হন গাউছুল আজম মহিউদ্দিন হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.), যাঁর মাধ্যমে মোহাম্মদী ইসলাম পুনর্জীবন লাভ করে। তাঁকে মহান আল্লাহ্ ‘মহিউদ্দিন’ তথা ধর্মের পুনর্জীবনদানকারী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তখন থেকেই তরিকার প্রবর্তন শুরু হয়। যেমন, বড়ো পির মহিউদ্দিন হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর প্রবর্তিত তরিকার নাম ছিল কাদেরিয়া তরিকা। পরবর্তীতে ভারতবর্ষে হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর প্রবর্তিত চিশতিয়া তরিকা, উজবেকিস্তানে হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)-এর প্রবর্তিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং ভারতের পাঞ্জাবে হযরত শেখ আহমদ সেরহিন্দি আল-ফারুকী মোজাদ্দেদ আল্-ফেসানি (রহ.)-এর নামানুসারে মোজাদ্দেদিয়া তরিকার প্রবর্তন হয়।
মোহাম্মদী ইসলাম তথা হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ টিকিয়ে রাখতে এবং তা প্রতিষ্ঠিত করতে বহু সুফি সাধক এবং অলী-আল্লাহ্ নিজের হৃদয়ে নুরে মোহাম্মদী ধারণ করে মানুষকে মু’মিন বানিয়েছিলেন। সেজন্য বহু সুফি সাধক এবং অলী-আল্লাহকে অনেক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে আউলিয়ায়ে কেরাম এই উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে খানকাহ নির্মাণ করেন এবং এদেশের ভাষা শিখে আপন চরিত্র মাধুর্য দিয়ে মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ তাঁদের কাছে বায়েত গ্রহণ করে ইমানের নুর হৃদয়ে প্রজ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছে। অলী-আল্লাহগণ আরব ও পারস্য অঞ্চল থেকে আগমন করে এ উপ-মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে খানকাহ নির্মাণ করে মোরাকাবা বা ধ্যানের শিক্ষাসহ সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসা অর্জন করে উত্তম চরিত্র গঠনের শিক্ষা দিয়েছিলেন।
মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, “এ উপমহাদেশে মূলত অলী-আল্লাহণই হিন্দু-বৌদ্ধদেরকে মুসলমান করেছিলেন। আউলিয়ায়ে কেরামের কাছে বায়েত গ্রহণ করে কালেমা পড়েই তারা মুসলমান হয়েছিলেন। আমাদের পূর্ব-পুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে অলী-আল্লাহণের কাছ থেকে। এখনও তার প্রমাণস্বরূপ দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য অলী-আল্লাহর মাজার রয়েছে। তৎকালীন যুগের বেশির ভাগ অলী-আল্লাহই এ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন এবং তাঁদের মাধ্যমেই এ উপমহাদেশে ইসলামের আলো প্রজ্বলিত হয়েছে, বহু অমুসলমান ইসলামের সুশীতল ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত অলী-আল্লাহগণই ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় আগমন করেন এবং অমুসলিমদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। এ ভারতবর্ষে ইসলামের আদর্শ প্রচার একমাত্র অলী-আল্লাহগণের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই সম্ভব হয়েছে। এভাবে বেলায়েতের যুগে অসংখ্য অলী-আল্লাহ্, পাপী-তাপী মানুষকে ইসলামের সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন।”
এরই ধারাবাহিকতায় মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানের পূর্ব পুরুষগণও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুদূর মদীনা হতে কাতার হয়ে এ বাংলায় আগমন করেন। আল্লাহর একত্ববাদ তথা ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অলী-আল্লাহগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যাদের জন্য এ মহামানবগণ জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে থাকেন, তারা তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন করা তো দূরের কথা বরং নানাবিধ কটাক্ষ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। নবিদের জীবন ইতিহাস গবেষণা করলে দেখা যায়, আল্লাহ্ যখনই কোনো নবিকে পাঠিয়েছেন, পথভোলা মানুষেরা তাঁকে বিশ্বাস না করে নানাবিধ ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও অত্যাচার করেছে। এমনকি অনেককে হত্যা পর্যন্ত করেছে।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “তাঁদের নিকট এমন কোনো রাসুল আসেনি, যাকে তারা ঠাট্টা করতো না।” (সূরা হিজর ১৫: আয়াত ১১)। অলী-আল্লাহগণের অবস্থাও তদ্রুপ। যুগে যুগে তাঁরা অত্যাচারী শাসকদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবুও তাঁরা ধর্ম প্রচারে ক্ষান্ত হননি। কোনো কোনো সময় নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গমন করেছেন। এ সকল অলী-আল্লাহর আদর্শ চরিত্র-মাহাত্ম্য ও কঠোর আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের জাগরণ সূচিত হয়েছে, উড্ডীন হয়েছে কালেমার ঝাণ্ডা। দয়াল রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পরে একদল রাসুল প্রেমিক হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ মোহাম্মদী ইসলাম প্রচারের জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাঁদের অসিলায় মানুষ মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর সন্ধান লাভ করতে পেরেছে। তাঁরা এদেশে এসে হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য অমুসলিম উপজাতীয়দের মধ্যে ইসলামের আদর্শ প্রচার করেন। ফলে বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপরে পুনরায় এদেশে যাঁরা ধর্ম প্রচারের জন্য আগমন করেন, তাঁরা হলেন-
১। হযরত হামিদুদ্দীন (রহ.), ২। হযরত হোসেন উদ্দীন (রহ.), ৩। হযরত মুর্তাজা (রহ.), ৪। হযরত আবদুল্লাহ্ (রহ.) ও ৫। হযরত আবু হালিব (রহ.)
মোট ৫টি দল পর পর বাংলাদেশে আগমন করেন। তাঁদের সাথে কোনো অস্ত্র-শস্ত্র ও কিতাবাদি ছিল না। তাঁরা রাজক্ষমতার সাহায্য গ্রহণ করেননি। এ সকল সাধকের লক্ষ্য ছিল- ইসলামের আদর্শ ও উন্নত চরিত্র দিয়ে অমুসলিমদের আকৃষ্ট করা এবং সংখ্যায় কম হলেও প্রকৃত ইমানদার মুসলমান তৈরি করা। কেননা, নামধারী মুসলমান বহু থাকার চেয়ে আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি পূর্ণ ইমানদারের সংখ্যা কম হলেও উত্তম। এ সাধকেরা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করতেন এবং মাঝে মাঝে বিভিন্ন এলাকার সফর করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। তাঁদের পরে মিশর ও পারস্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আরো ৫টি দল আগমন করেন। তাঁদের বলা হতো ‘আবিদ’। তাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় খানকাহ্ স্থাপন করে ধর্ম প্রচার অব্যাহত রেখেছেন।
উপমহাদেশে মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব থেকেই ইসলাম প্রচার শুরু হয়। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে মুসলিম মনীষী ও অলী-আল্লাহগণ এদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন আরবের, বিশেষ করে ইয়েমেনের বাসিন্দা। ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তৎকালীন যুগের অমুসলিম রাজা-বাদশাহদের সাথে তাঁদের সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বিধর্মী শক্তির নিকট নানাভাবে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। আবার অনেকে শাহাদতবরণও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁঁদের ইমানি শক্তি ও আদর্শ চরিত্র তৎকালীন হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে। সুদূর আরব ও পারস্য থেকে বহু অলী-আল্লাহ্ বাংলাদেশে আগমন করে ইসলামের সত্যবাণী প্রচার করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-
১। হযরত শাহ্জালাল (রহ.), ২। হযরত শাহ্ পরান (রহ.), ৩। হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহ.), ৪। হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.), ৫। হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রহ.) ও ৬। হযরত খানজাহান আলী (রহ.)। তাঁরা প্রত্যেকেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রচারক ছিলেন।
এই প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, “বাংলা-ভারত উপমহাদেশে ধর্ম প্রচার করতে কোনো নবি-রাসুল আসেননি। আমাদের পূর্ব পুরুষ অলী-আল্লাহগণের কাছ থেকে কালেমা শিখে মুসলমান হয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে শান্তির বাণী গ্রহণ করে রাসুল প্রেমিক হয়েছেন। অলী-আল্লাহর কথা অস্বীকার করলে আমরা পিতার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবো। কারণ তাঁদের সান্নিধ্যে গিয়ে আমাদের পূর্ব পুরুষ মুসলমান হয়েছিলেন। সুতরাং আমাদেরকে অলী-আল্লাহগণের অনুসরণ করতে হবে। অলী-আল্লাহর সান্নিধ্য ব্যতীত ইবাদত-বন্দেগি নিস্ফল। শিক্ষক ছাড়া যেমন লেখাপড়া হয় না, তেমনি মোর্শেদ তথা অলী-আল্লাহ্ ছাড়া ইবাদত-বন্দেগি শুদ্ধ হয় না। আমরা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যা করি, অলী-আল্লাহগণের সংস্পর্শ ছাড়া তা সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব নয়।”
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের পর থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। মূলত ধর্ম প্রচারে মুসলিম সুফি-সাধকগণই প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। এভাবে আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যায় প্রায় ৯০ শতাংশই মুসলমান এবং বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। (চলবে)
[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম, পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]