আত্মার উৎপত্তি ও গন্তব্যস্থল
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ
মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
মানবের যে অংশটি তার দেহের অস্তিত্ব ও সত্তার বিকাশ ঘটায়, এটিই আত্মা বা রূহ। আত্মা ব্যতীত মানবদেহ বিকল। এ মহামূল্যবান আত্মার উৎপত্তি হয়েছে- খোদ আল্লাহর জাত-পাক থেকে যেমন, হযরত আদম (আ:)-এর সৃষ্টি প্রক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে মহান আল্লাহ্ বলেন- আমি আমার রূহকে আদমের (মানুষ) ভেতর ফুঁকে দিয়েছি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরাআনে এরশাদ হয়েছে- “ফাইযা সাওয়্যাইতুহূ ওয়া নাফাখতু ফীহি মির রূহী ফাক্বা‘ঊ লাহূ সাজিদীন।” অর্থাৎ- “তারপর যখন আমি তাকে ঠিকঠাকমত গঠন করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ থেকে রূহ ফুঁকে দেবো, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদাবনত হবে।” (সূরা-আল হিজর ১৫: আয়াত ২৯)
মহিমান্বিত আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-এর ন্যায় আদম সন্তান, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের মাঝে স্বীয় রূহ থেকে রূহ ফুঁকে দিয়ে মানবজীবনের সূচনা করে দিয়েছেন। আসলে রূহ বা আত্মা এতই মূলবান, রূহ যতদিন মানবদেহে বিরাজ করে, ততদিনই মানবজীবন। দেহ থেকে রূহ বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই মানব জীবনের অবসান হয়ে যায়, অর্থাৎ মৃত্যু সংঘটিত হয়ে যায়। বিষয়টি সুমহান আল্লাহ্ তাঁর পাক জবানেই বলে দিয়েছেন, এরশাদ হচ্ছে- “ছুম্মা জা‘আলা নাসলাহূ মিন সুলালাতিম মিম মাইম মাহীনিন, ছুম্মা সাওয়্যাহু ওয়া নাফাখা ফীহি মির রূহিহী ওয়া জা‘আলা লাকুমুস সাম’আ ওয়াল আবসারা ওয়াল আফইদাতা, ক্বালীলাম মা তাশকুরূন।” অর্থাৎ- “তারপর মহান আল্লাহ্ আদম (আ.)-এর বংশধর (মানুষ)-কে সৃষ্টি করেন দুর্বল পানির নির্যাস থেকে। অতঃপর তিনি তাকে সুঠাম করেন, এবং তার মাঝে নিজের রূহ থেকে রূহ ফুঁকে দেন। আর তোমাদেরকে দান করেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। কিন্তু তোমরা খুব কমই শোকর করো।” (সূরা-আস সাজদাহ ৩২: আয়াত ৮ ও ৯)
আর মানুষের মাঝে বিরাজমান আল্লাহ্ থেকে ফুঁকে দেওয়া এ রূহের গন্তব্য হলো আল্লাহ্তে বিলীন হওয়া। অর্থাৎ সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, আল্লাহর গুণে গুণী হওয়া। তাসাউফের ভাষায় এ স্তরকে ফানাফিল্লা’র স্তর বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়াকে ফানাফিল্লাহ বলে। আর মানুষ যে সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়, সে প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- “ওয়ালা ইয়াঝালু আবদী ইতাক্বাররাবু ইলাইয়্যা বিন নাওয়াফিলি হাত্তা আহবাবতুহূ ফাকুনতু সাম‘আহুল্লাযী ইয়াসমা‘উ বিহী ওয়া বাসারাহুল্লাযী ইউবসিরু বিহী ওয়া ইয়াদাহুল্লাতী ইয়াবতিশু বিহা ওয়া রিজলাহুল্লাতী ইয়ামশী বিহা ওয়াইন সাআলানী লাউ‘তিইয়ান্নাহূ ওয়ালা ইনিসতা‘আযানী লাউ‘ঈযান্নাহূ।” অর্থাৎ- “আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারা আমার এত নিকটবর্তী হয়ে যায় যে, আমি তাকে ভালোবাসতে থাকি; আর যখন আমি তাকে ভালোবাসতে থাকি, তখন আমি তার কর্ণ হয়ে যাই, যে কর্ণ দ্বারা সে শুনে; চক্ষু হয়ে যাই, যে চক্ষু দ্বারা সে দেখে; হাত হয়ে যাই, যে হাত দ্বারা সে ধরে; পা হয়ে যাই, যে পা দ্বারা সে হাঁটে; কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করা মাত্র আমি অবশ্যই তা দান করে থাকি এবং কোনো বিষয়ে প্রার্থনা করা মাত্র আমি অবশ্যই তা দান করে থাকি এবং কোনো বিষয়ে আশ্রয় চাওয়া মাত্র, আমি অবশ্যই তাঁকে আশ্রয় দিয়ে থাকি।” (বোখারী শরীফ-২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৬৩; মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৯৭; মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক-১০ নং খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৯৮ এবং তাফসীরে মাজহারী-১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৮)
মানুষ মাত্রই এ গন্তব্যের দিকে লক্ষ্য রেখে পথ চলা উচিত। কারণ, এখানেই তার সাধনার শেষ ও পরম কাঙ্খিত মুক্তি। মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন- “কাইফা তাকফুরূনা বিল্লাহি ওয়া কুনতুম আমওয়াতান ফাআহইয়াকুম, ছুম্মা ইউমীতুকুম ছুম্মা ইউহয়ীকুম ছুম্মা ইলাইহি তুরজা‘ঊন।” অর্থাৎ- “কীরূপে তোমরা আল্লাহ্র বিষয়ে কুফরি করছ? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তারপর তিনি প্রাণ দান করলেন তোমাদের, আবার তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং পুনরায় তিনিই তোমাদের জীবন দান করবেন। পরিণামে তোমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাবে।” (সূরা-আল বাকারাহ ২: আয়াত ২৮)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি‘ঊন।”
অর্থাৎ : “নিশ্চয় আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং তাঁরই নিকট আমরা ফিরে যাবো।” (সূরা-আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৫৬) সুতরাং রূহ বা আত্মার উৎপত্তি যেমন মহান আল্লাহর কাছ থেকে হয়ে থাকে, তদ্রুপ এ রূহ বা আত্মার গন্তব্যস্থল ও ঐ মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া।
আত্মার মুক্তির অন্তরায়
আল্লাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন রূহ বা আত্মা পুনরায় আল্লাহ্তে বিলীন হয়ে মুক্তির স্বাদ উপলব্ধি করার জন্য সদা উদগ্রীব। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে- “কুল্লু শাইয়িন ইয়ারজি‘উ ইলা আসলিহী।” অর্থাৎ- “প্রতিটি জিনিসই তার মূলের দিকে ধাবিত হয়।” তবে রূহ বা আত্মা পুনরায় আল্লাহ্তে মিলিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় মানুষের ষড়রিপু। এ রিপুসমূহের প্ররোচনায়ই মানুষ পাপ কাজ করে, এবং আল্লাহ্ থেকে দূরে সরে যায়। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা:) এরশাদ করেন- “ইন্নাশ শাইত্বানা ওয়াদ্বি‘উন খাত্বমাহূ ‘আলা ক্বালবি ইবনি আদামা ফাইন যাকারাল্লাহা খানাস ওয়া ইন নাসিইয়া ইলতাক্বামা ক্বালবাহূ ফাযালিকাল ওয়াসওয়াসুল খান্নাস।” অর্থাৎ- “নিশ্চয় শয়তান আদম সন্তানের ক্বালবে নিজের মুখ বা ঠোঁট লাগিয়ে রাখে। যখন ক্বালব আল্লাহর জিকির করে, তখন শয়তান দূরে সরে যায়। আর যদি সে আল্লাহর জিকির করেন, তখন শয়তান তার ক্বালবে গ্রাস করে নেয়। এটিই খান্নাস বা শয়তানের কুমন্ত্রণা।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর-৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮১৩)
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা:) এরশাদ করেন- “ইন্নাশ শাইত্বানা ইয়াজরী মিন ইবনি আদামা মাজরাদ দাম। অর্থাৎ “নিশ্চয় শয়তান চলাচল করে আদম সন্তানের রক্ত চলাচলের পথ ধরে।” (মুসনাদে আহমদ ও মুসলিম শরীফের সূত্রে তাফসীরে কুরতুবী-২২ নং খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫৮২) আসলে মানব অন্তরে শয়তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকায় মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় প্রভাবিত হয়ে পাপাচারে লিপ্ত হয়, এবং পাপের কালিমার দ্বারা নিজ ক্বালবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে, ফলে মানুষ মুক্তির স্বাদ উপলব্ধি করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “ইন্নাল মু’মিনা ইযা আযনাবা কানাত নুকতাতুন সাওদাউ ফী ক্বালবিহী ফাইন তাবা ওয়াসতাগফারা সুক্বিলা ক্বালবুহূ ওয়া ইন ঝাদা ঝাদাত হাত্তা তা‘লুওয়া ক্বালবাহূ ফাযালিকুমুর রানুল্লাযী যাকারাল্লাহু তা‘আলা “কাল্লা বাল, রানা ‘আলা ক্বুলূবিহিম মা কানূ ইয়াকসিবূন।” অর্থাৎ “নিশ্চয় মু’মিন ব্যক্তি যখন কোনো গুনাহ করে, তার ক্বালবে একটি কালো দাগ পড়ে যায়।
অতঃপর যদি সে তওবা করে ও ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে ক্বালবের কালো দাগ সাফ হয়ে যায়। আর যদি গুনাহ বেশি হয়, তবে কালো দাগের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে কালো দাগসমূহ ক্বালবকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর এটিই সে মরিচা, যার বর্ণনা সুমহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরাআনে উল্লেখ করেছেন- ‘না, কখনো এরূপ নয়, তারা বরং যা করে, তা তাদের ক্বালবে মরিচা ধরিয়েছে।” (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ’র সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-২০৪)
এ কারণে মহিমান্বিত আল্লাহ্ অহির বাণী আল কুরাআনে এরশাদ করেন- “ক্বাদ আফলাহা মান তাযাক্কা, ওয়া যাকারাসমা রাব্বিহী ফাসাল্লা।” অর্থাৎ : “নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে, এবং স্বীয় প্রতিপালকের নামের জিকির করে ও নামাজ আদায় করে।” (সূরা-আল আ‘লা ৮৭: আয়াত ১৪ ও ১৫)
প্রকৃতপক্ষে মানুষ যখন সাধনার মাধ্যমে ষড়রিপুর বেড়াজাল ছিন্ন করতে পারে এবং আপন হৃদয়কে পবিত্র করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়, তখনই সে মুক্তির পরমান্দ লাভ করে।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী; দেওয়ানবাগ শরীফ]