আধ্যাত্ম প্রেম
ড. মুহাম্মদ নাছিরউদ্দীন (সোহেল):
‘আধ্যাত্ম প্রেম’ তাসাউফ জগতের এক তাৎপর্যমণ্ডিত শব্দ। আধ্যাত্ম প্রেম বলতে বুঝায় মাশুক (মোর্শেদ) ও আশেকের মাঝে পারস্পরিক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এই ভালোবাসা পৃথিবীর সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে। মাশুকের প্রতি আশেকের আধ্যাত্ম প্রেম আশেকের হৃদয়কে জ্যোতির্ময় করে তুলে। মাশুক যে কর্ম পছন্দ করেন, আশেক সেই কর্মের মাঝেই নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। মাশুককে অনুসরণের মাধ্যমে এবং তাঁর দেওয়া নির্ধারিত পথে পরিচালিত হয়ে একজন আশেক নিজেকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন।
দোজাহানের বাদশাহ হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেমাস্পদ হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা। মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ আশেকে ছিলেন হযরত রাসুল (সা.)। স্রষ্টা ও তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির পারস্পরিক আধ্যাত্ম প্রেমের কথা মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদিসে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “হে মাহ্বুব (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও দয়াময়।” (সূরা আলে ইমরান-৩: আয়াত ৩১)
এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, যিনি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চান, তাকে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বন্ধু হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করতে হবে এবং আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসতে হবে। তাহলে একজন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে দুটি পুরস্কার লাভ করবেন। যথা: একটি হলো- আল্লাহ্ নিজেই ঐ ব্যক্তিকে ভালোবাসবেন এবং দ্বিতীয়টি হলো- আল্লাহ্ তার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবিবকে যে ভালোবাসার কথা বলেছেন, সেটিই হলো আধ্যাত্ম প্রেম বা ভালোবাসা। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি সেই আধ্যাত্ম প্রেম বা ভালোবাসা হৃদয়ে ধারণ করেই বর্বর আরবজাতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন।
হাদিসে কুদসিতে এরশাদ হয়েছে, “হে রাসুল (সা.)! যদি আমি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম, তবে সৃষ্টিকুলের কোনো কিছুই সৃজন করতাম না।” (তাফসীরে মাজহারী, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০)
হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নুরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নুর থেকে সকল বস্তু সৃষ্ট।’’তাই মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান মোহাম্মদী ইসলামের মিলাদ শরীফে সংযুক্ত করেছেন-
আপনার এশ্কে সকল সৃজন ঐ আকাশ আর এই জমিন,
সকল সৃষ্টির মূলে আপনি রাহমাতাল্লিল আলামিন!
আশেক ও মাশুকের নিবিড় প্রেমাকার্ষণের মাহাত্ম্যকে প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এভাবে ব্যখ্যা করেছেন-
নবি মোর পরশমণি, নবি মোর সোনার খনি
নবি নাম জপে যে জন, সেতো দোজাহানের ধনী।
সেই নামে মধু মাখা, সেই নামে জাদু রাখা
সেই নামে মজনু হইলো মাওলা আমার কাদের গণি।
নবি মোর নুরে খোদা, তাঁর তরে সকল পয়দা
আদমের কলবেতে তাঁরই নুরের রৌশনি।
হযরত রাসুল (সা.) তাঁকে ভালোবাসার গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭; মুসলিম শরীফ, পৃষ্ঠা ৪৯)
এই হাদিস থেকে সুস্পষ্ট যে, মুমিন হওয়ার পূর্ব শর্ত হলো হযরত রাসুল (সা.)-কে সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা। আর মাশুকের প্রতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসাই হলো আধ্যাত্ম প্রেম। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতি যে ব্যক্তি আধ্যাত্ম্য প্রেমের মহিমায় নিজেকে মহিমান্বিত করতে পেরেছেন, তিনিই হয়েছেন সত্যিকার আশেকে রাসুল।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের প্রতি সাড়া দাও। যখন রাসুল তোমাদেরকে এমন কিছুর প্রতি আহ্বান করেন, যা তোমাদেরকে জীবনদান করবে।” (সূরা আনফাল-৬: আয়াত ২৪)
হযরত রাসুল (সা.) যখন মক্কাবাসীকে এক আল্লাহর প্রতি ইবাদতের আহ্বান করলেন, তখন আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে একদল আশেকে রাসুল নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন। শত বাধা বিপত্তি ও নির্মম অত্যাচার উপেক্ষা করে তাঁরা হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি অনুপম প্রেমাকর্ষণে নিজেদেরকে সপে দিলেন, এই প্রেমাকর্ষণই হলো আধ্যাত্ম প্রেম। ঐ সকল আশেকে রাসুল সাহাবিদের আধ্যাত্মিক প্রেমের গভীরতা এতো বেশি ছিল যে, নিজের মাশুকের [হযরত রাসুল (সা.)] জন্য মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছেন, তবুও মক্কার কাফেরদের নিকট মাথা নত করেননি।
হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে আত্মত্যাগের মাধ্যমে অনেক সাহাবি জগতের বুকে অমর হয়ে আছেন এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তাঁদের কয়েক জনের আত্মত্যাগের অত্যুজ্জ্বল কথা নিমেড়ব উপস্থাপন করা হলো হযরত বিলাল (রা.)-এর নাম একজন নিবেদিত ‘আশেকে রাসুল’ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন হাবসি বংশোদ্ভুত কৃষ্ণকায় কৃতদাস। তাঁর মনিব ছিলেন কাফের উমাইয়া ইবনে খালফ। হযরত রাসুল (সা.) ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসার আহ্বান জানালে, হযরত বিলাল (রা.) আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে চলে তাঁর অন্তরাত্মা সত্যের উজ্জ্বল দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তাঁর মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ যখন জানতে পারলো যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তখন সে তাঁর উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সে তাঁর উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। ঠিক দুপুরে যখন সূর্য পূর্ণ উষ্ণতা ও তীব্রতা নিয়ে মধ্যগগণে অবস্থান করে, ঠিক সেসময় সে হযরত বিলাল (রা.)-কে মরুভূমির গরম বালুর উপর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। এরপর উমাইয়া বলতো যে, তুই এই অবস্থা থেকেই মরে যাবি, যদি বাঁচতে চাস, তাহলে মোহাম্মদকে (সা.) অস্বীকার কর এবং লাত ও উজজার পুজা অর্চনায় রত হয়ে যা। কিন্তু এতো নির্যাতনের পরেও হযরত বিলাল (রা.) বলতেন, ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ অর্থাৎ- আল্লাহ্ এক, আল্লাহ্ এক। শুধু তাই নয়, চাবুক আর বেতের আঘাতে তাঁর শরীর ক্ষত বিক্ষত করা হতো। গলায় দড়ি বেঁধে মক্কার অলি-গলিতে তাঁকে ঘুরানো হতো।
শত নির্যাতন করেও কাফেরেরা হযরত বিলাল (রা.)-কে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা থেকে এক বিন্দুও টলাতে পারেনি। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতি এই গভীর প্রেমকেই বলা হয় আধ্যাত্ম প্রেম। এই আধ্যাত্ম প্রেম তাঁর হৃদয়ে ছিল
বলেই আজও মুসলিম জাতি তাঁকে ‘আশেকে রাসুল’ হিসেবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। উল্লেখ্য যে, হযরত আবু বকর (রা.) প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কাফের উমাইয়া ইবনে খালফের নিকট থেকে তাঁকে মুক্ত করেন। পরবর্তীতে হযরত বিলাল (রা.)-ই মুসলিম জগতের প্রথম মুয়াজ্জিন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
আধ্যাত্ম প্রেমের জগতে হযরত ইয়াসির (রা.), তাঁর স্ত্রী হযরত সুমাইয়া (রা.) ও তাঁদের সন্তান হযরত আম্মার (রা.) মানবাজতিরনিকট অনুসরণীয় হয়ে আছেন। হযরত ইয়াসির (রা.) ছিলেন কৃতদাস। তিনি, তাঁর স্ত্রী ও সন্তান ইসলাম গ্রহণ করলে মক্কার কাফেররা তাঁদের উপর বর্বর নির্যাতন চালায়। নানা রকম শারীরিক নির্যাতন করেও কাফেরেরা তাঁদেরকে ইসলামচ্যুত করতে পারেনি। পরবর্তীতে কাফের আবু জাহেল হযরত সুমাইয়া (রা.)-এর লজ্জাস্থানে বর্শা নিক্ষেপ করে তাঁকে শহিদ করে। ইসলামের ইতিহাসে তিনি মহিলা সাহাবিদের মধ্যে প্রথম শহিদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। হযরত ইয়াসির (রা.)-এর স্ত্রী নির্মমভাবে শহিদ হওয়ার পরও তিনি ও তাঁর ছেলে হযরত আম্মার (রা.) ইসলামের প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে গেছেন, কাফেরদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন, কিন্তু মাথা নত করেননি।
আশেকে রাসুল হিসেবে মহিলা সাহাবি হযরত আফিফা (রা.)-এর নামও স্মরণীয় হয়ে আছে। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার একটি ঘটনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
৩য় হিজরিতে কাফেরদের সাথে উহুদ প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে কাফেরদের নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতে হযরত রাসুল (সা.)-এর দান্দান মোবারক শহিদ হয়। এমনি সময় কাফেরেরা ঘোষণা করল, মোহাম্মদ (সা.) নিহত হয়েছেন। সংবাদ পেয়ে রাসুল (সা.)-এর আশেকগণ ঘরে থাকতে পারলেন না। মদীনার মহিলারা পর্যন্ত আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মহব্বতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। হযরত আফিফা (রা.) হযরত রাসুল (সা.)-এর শাহাদতের সংবাদ শুনে তা সহ্য করতে না পেরে বেহাল বেকারার হয়ে উহুদ প্রান্তরের দিকে ছুটলেন। পথে এক সাহাবির সাথে দেখা হলে, তিনি বললেন, “আফিফা কোথায় যাচ্ছ? এই যুদ্ধে তোমার স্বামী শাহাদত বরণ করেছেন।” আফিফা (রা.) বললেন, ‘‘ইন্নালিল্লাহ্। বলো, আমার দয়াল রাসুল (সা.) কেমন আছেন?” কিছু দূর গেলে অন্য এক সাহাবি বললেন, “হে আফিফা! পাগলের মতো কোথায় যাচ্ছ? তোমার পিতা এই যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন।” আফিফা (রা.) বললেন, ‘‘ইন্নালিল্লাহ্। বলো দয়াল রাসুল (সা.) কেমন আছেন?” আরও কিছুদূর অগ্রসর হলে এক সাহাবি বললেন, “হে আফিফা! অস্থির হয়ে কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি জানো এই যুদ্ধে তোমার সন্তান ও ভাই শাহাদত বরণ করেছেন।” আফিফা (রা.) বললেন, “ইন্নালিল্লাহ্। বলো দয়াল রাসুল (সা.) কোথায় আছেন? কেমন আছেন?” ঐ সাহাবি দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, “বোন! তোমার মতো আশেকের জন্যই আল্লাহ্ তাঁর রাসুলকে বাঁচিয়ে রেখেছেন!”
সাহাবির নিকট থেকে এই সংবাদ পেয়ে হযরত আফিফা (রা.) দয়াল রাসুল (সা.)-এর এশকে দেওয়ানা হয়ে দ্রুত পাহাড়ের চুড়ায় উঠে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ্ (সা.)! এই যুদ্ধে আমার স্বামী, আমার পিতা, আমার সন্তান, আমার ভাই শহিদ হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই, আপনাকে দেখে আমার মনের সকল জ্বালা-যন্ত্রণা দূর হয়ে গেছে।”
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে তাঁর আশেকদের সম্পর্ক আধ্যাত্ম প্রেম-ভালোবাসার, যা অতুলনীয়।
আধ্যাত্ম প্রেমের ভুবনে উম্মতে মোহাম্মদীর হৃদয়ে যে নাম মোবারকটি অত্যুজ্জ্বল হয়ে আছে, তিনি হলেন আমিরুল মুমিনিন শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু। শৈশব থেকে তিনি হযরত রাসুল (সা.)-এর স্নেহের পরশে বেড়ে উঠেন।
মাত্র ১০ বছর বয়সে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রেমাবেগে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ গ্রহণ করেন। প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (রা.)-এর পর হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ২য় ব্যক্তি হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে।
উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত রাসুল (সা.) তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের ইসলামের পথে আহ্বানের জন্য নিজ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। নিমন্ত্রণে এসে আত্মীয়-স্বজন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সত্য আহ্বানকে প্রত্যাখান করেন। কিন্তু ১০ বছরের বালক হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আজীবন হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবতে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে আত্মীয়-স্বজনের উদ্দেশে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.)-এর শানে তেজোদীপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। মাত্র ১০ বছরের বালকের এমন সাহসী ও সাবলিল বক্তব্যে কাফের আবু লাহাব-সহ উপস্থিত অন্যান্যদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। সেদিনের বক্তব্য শুনে হযরত রাসুল (সা.) বালক হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর জন্য প্রাণভরে দোয়া করেন।
হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু হিজরতের রাতে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর বিছানায় শুয়েছিলেন। আর তা কেবল সম্ভব হয়েছে দয়াল রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার কারণে। তাইতো মোহাম্মদী ইসলামের মিলাদ শরীফে বলা হয়ে থাকে-
প্রাণের রাসুল হিজরত করে যেদিন গেলেন মদীনায়
মরণ জেনেও হযরত আলী শুইলেন তাঁহার বিছানায়!
আরব ভূমিতে মোহাম্মদী ইসলাম প্রতিষ্ঠায় হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর ভূমিকা ছিল অনবদ্য। কাফেরদের আক্রমণ প্রতিরোধে বিভিন্ন যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতা ও বীরত্ব ইসলামের ইতিহাসে অমর ও অক্ষয় হয়ে আছে। খন্দকের যুদ্ধে আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কাফের আমর বিন আবদে ওদ্দ যখন হুঙ্কার ছেড়ে মুসলমান যোদ্ধাদের মল্ল যুদ্ধের আহ্বান জানায়, তখন মুসলমান যোদ্ধারা আতংকিত হয়ে পড়েন। কিন্তু হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-ই আমরের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মুসলমানদের সম্মান রক্ষা করেন এবং আমরকে মল্ল যুদ্ধে পরাজিত করেন। ফলে কাফেরেরা ভীত হয়ে পড়ে।
হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা এত গভীর ছিল যে, দয়াল রাসুল (সা.)-এর জন্য তিনি নিজের জীবনের মায়াকে সর্বদা তুচ্ছ মনে করেছেন।
হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আধ্যাত্ম প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে আদর্শ রমণী নারী জাতির জন্য অনুসরণীয় হয়ে আছেন, তিনি হলেন নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)। শৈশব থেকেই হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও অনুরাগ। উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (রা.)-এর ওফাতের পর শিশু কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) সর্বদা হযরত রাসুল (সা.)-কে দেখাশোনা করতেন। হযরত রাসুল (সা.) মক্কার বিভিন্ন জায়গায় ইসলামের দাওয়াত দিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন, তখন শিশু কন্যা ফাতেমা (রা.) পরম স্নেহে পিতার চেহারা মোবারকের ঘাম মুছে দিতেন। একদা ক্বাবাঘরের সামনে হযরত রাসুল (সা.) নামাজে সিজদারত ছিলেন, সেসময় তাঁর মাথা মোবারকের উপর মক্কার এক কাফের উটের নাড়িভুঁড়ি ফেলে দেয়। এই সংবাদ শুনে শিশু কন্যা ফাতেমা (রা.) দ্রুত সেখানে গিয়ে নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করেন এবং ঐ কাফেরের হীন কর্মের কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করেন। পিতার প্রতি ছোটো শিশু কন্যার এরূপ গভীর মমত্ববোধ আধ্যাত্ম প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। উহুদের যুদ্ধে হযরত রাসুল (সা.)-এর দান্দান মোবারকের শহিদ হওয়ার খবর জানতে পেরে, হযরত ফাতেমা (রা.) তৎক্ষণাৎ উহুদের প্রান্তরে ছুটে যান এবং দুই চোখের পানি ফেলে দয়াল রাসুল (সা.)-এর সেবা শুশ্রুষা করেন।
অসুস্থ থাকাকালীন একদিন হযরত রাসুল (সা.) নবিনন্দিনীকে কানে কানে কিছু কথা বললেন, আর তা শুনে নবিনন্দিনী কেঁদে উঠেন। এরপর আল্লাহর রাসুল (সা.) দ্বিতীয়বার আরও কিছু কথা কানে কানে বললেন, এবার নবিনন্দিনী হেসে উঠেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়শা (রা.) নবিনন্দিনীর নিকট কান্না ও হাসির কারণ জানতে চান।
তখন হযরত ফাতেমা (রা.) বলেন “প্রথমবার দয়াল রাসুল (সা.) আমাকে জানান যে, এই অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁর ওফাত হবে। নবিজির এই কথা শুনে আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। এরপর তিনি আবার আমার কানে কানে বললেন, আমার পরিবারের মধ্যে তুমি-ই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। তাঁর একথা শুনে আমি হেসেছিলাম।”
নবিনন্দিনীর এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মূলত হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু, হযরত ফাতেমা (রা.) এবং তাঁদের দুই পুত্র সন্তান ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.) হলেন পাক পাঞ্জাতনের সদস্য, তাঁরা আহলে বাইত। তাঁদের গৌরবময় জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবর্তিত হয়েছে হযরত রাসুল (সা.)-কে কেন্দ্র করে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ধর্ম মোহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার জন্য ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.), তাঁর পরিবার পরিজন এবং অন্যান্য আহলে বাইত প্রেমিক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। এই সুমহান আত্মত্যাগ পৃথিবীর বুকে সংঘটিত সকল আত্মত্যাগের ঊর্ধ্বে এবং নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগ। এই আত্মত্যাগের মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি গভীর আধ্যাত্ম প্রেমের জন্য। হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগে আধ্যাত্ম প্রেমের অনেক নিদর্শন যেমন রয়েছে, তেমনি বেলায়েতের যুগেও আধ্যাত্ম প্রেমের অনেক ঘটনা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে।
আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের মাঝে তাঁর স্বীয় মোর্শেদ পিরানে পির দস্তগির, সুলতানুল মাশায়েখ, সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর প্রতি যে আধ্যাত্ম প্রেম বিদ্যমান, তা মোর্শেদ প্রেমিকদের জন্য শিক্ষণীয়। স্বীয় মোর্শেদের প্রতি গভীর ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “আমি আমার মোর্শেদের দরবারে প্রথম গিয়ে তাঁকে কদমবুসি করে নজর দিলাম, তিনি আমাকে একটি টিকিট দিলেন। টিকিটটি নিয়ে মাত্র ১০ গজ দূরে যাওয়ার পরই আমার মাঝে অলী-আল্লাহর তাওয়াজ্জোহর অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। মোর্শেদকে আবার দেখার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে গেলাম। আমার মনে হচ্ছিল তিনি আমার প্রাণ, আর আমি দেহ মাত্র। সেসময় আমার হৃদয়ের মাঝে মাশুকের প্রতি ঐশি প্রেম জাগ্রত হয়। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো কী দেখলাম, আরেকবার যদি দেখতাম!”
মূলত মোর্শেদের প্রতি এরূপ ভালোবাসাই হচ্ছে আধ্যাত্ম প্রেম। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর মোর্শেদ ইমাম হুজুরকে এতোটাই ভালোবেসেছেন যে, সাধনা জীবনে সর্বদা ফানা ফিশ্ শায়েখ অবস্থায় থাকতেন। এরূপ অবস্থার কথা বলতে গিয়ে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “আমি সবসময় মোর্শেদের চিন্তা, মোর্শেদের খেয়ালে চলতাম। সর্বাবস্থায় চেষ্টা করতাম মোর্শেদের সান্নিধ্যে থাকতে। আমি ঢাকা থাকলেও মোর্শেদ ফরিদপুরে কী করছেন, আমি তা বলতে পারতাম। মোর্শেদের কোনো অসুখ হওয়ার আগেই আমার সেই অসুখটা দেখা দিতো। তখন আমি বুঝতে পারতাম আমার মোর্শেদের ঐ অসুখ হয়েছে। মোর্শেদের সাথে আমার রূহানি যোগাযোগ ছিল সর্বক্ষণের। মোর্শেদ আমাকে না দেখলেও থাকতে পারতেন না, আমিও মোর্শেদকে না দেখলে অস্থির হয়ে যেতাম। আমি একটু বাহিরে গেলেই, মোর্শেদ অস্থির হয়ে যেতেন এবং বলতেন মাহবুব মিয়া কোথায় গেল? মাহবুব মিয়া কোথায়? এই যে স্বর্গীয় প্রেম।” (১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ খ্রি. শুক্রবারে বাবে রহমতে অনুষ্ঠিত আশেকে রাসুল (সা.) মাহ্ফিলে প্রদত্ত মোবারকময় বক্তব্য থেকে সংকলিত)
ইমাম হুজুরের ওফাতের ১ বছর পর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান মোহাম্মদী ইসলাম প্রচারের স্বার্থে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সর্বমোট ১১টি দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। আজও সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর মোর্শেদ ইমাম হুজুরের শুভ জন্মদিন স্মরণে দেওয়ানবাগ শরীফের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান ‘বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন’ প্রতিবছর আয়োজন করে থাকেন। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মোর্শেদ প্রেমিক অংশগ্রহণ করে থাকেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, একজন আশেক যদি আধ্যাত্ম প্রেমের প্রজ্বলিত শিখা তার হৃদয়ের মাঝে জ্বালাতে পারেন, তাহলে ঐ আশেকের হৃদয় আল্লাহর নুর দ্বারা আলোকিত হয়ে উঠে। তখন তিনি তার মাশুকের ইচ্ছায় নিজেকে পরিচালিত করতে সক্ষম হন। ফলে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় লাভ করে আশেক সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন।
[লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]
তথ্য সূত্র:
১। আল কুরআন
২। আল হাদিস
৩। বিশ্বনবীর স্বরূপ উদ্ঘাটনে সূফী সম্রাট: রাসূল (সঃ) সত্যিই কি গরীব ছিলেন? সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা
দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান
৪। সীরাতে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মাওলানা ইদ্রীস কান্ধলবী রহ., অনুবাদ-মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের
৫। আস-সীরাতুন নববীয়া (স), ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল
৬। হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (স): সমকালীন পরিবেশ ও জীবন, শায়খুল হাদীস মওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোছাইন ও ড. এ এইচ এম মুজতবা হোছাইন