আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব
এ. আর. এম. মুহিউদ্দীন খান ফারুকী
পর্ব-৫
ক্বালব প্রসঙ্গে ৭ম আয়াত:
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “যারা কিছু জানে না তারা বলে- কেন আল্লাহ্ আমাদের সাথে কথা বলেন না; কিংবা কেন আমাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে না? এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদেরই মতো কথা বলত। তাদের ক্বালব বা হৃদয় এক রকম। অবশ্যই আমি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি নিদর্শনাবলী দৃঢ় প্রত্যয়শীলদের জন্য।” (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ১১৮)
আলোচ্য আয়াতখানা ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সংবলিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একখানা আয়াত। এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ প্রেরিত মহামানবের সত্যতা অস্বীকারকারী কাফিররা যে সর্বযুগেই এক ও অভিন্ন, তা জানিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ স্থান ও কালের ব্যবধান হলেও নবুয়ত, রিসালাত ও বেলায়েত অস্বীকারকারী মানুষগুলোর ক্বালব বা হৃদয়ের অবস্থা সর্বযুগেই এক রকম। এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে মহান আল্লাহ্ বলেন- যারা কিছু জানে না অর্থাৎ যারা আল্লাহর পরিচয় জানে না, তাঁরা ভেদ-বাতেন ও অনন্ত গুণাবলি সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা আল্লাহরর প্রেরিত নবি, রাসুল ও অলী-আল্লাহর পরিচয়ও জানে না। এ সকল অজ্ঞ লোককে যখন নবি-রাসুলগণ সত্যের দাওয়াত প্রদান করেন, তখন তারা বলে- কেন আল্লাহ্ আমাদের সাথে কথা বলেন না অর্থাৎ আল্লাহ্ যদি কোনো সংবাদ মানুষকে দিতে চান, তবে কোনো ব্যক্তিকে নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহর রুপে কেন পাঠাতে হবে, তিনি নিজেই তো সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলতে পারেন। এমনিভাবে তারা অহংকার প্রকাশ করে আল্লাহ্কে অস্বীকার করে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তো ফেরেশতাদের সাথে কথা বলেন, তিনি তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে কথা বলেছেন। সুতরাং হে মোহাম্মদ (সা.)! এখন আল্লাহ্ যদি আমাদেরকে কিছু বলতে চান, আদেশ-নিষেধ করতে চান, তবে কি তিনি সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলতে পারেন না? এখন কেন তোমার নিকট ওহি প্রেরণ করে তোমার মাধ্যমে তার আদেশ-নিষেধ আমাদের কাছে পৌঁছাতে হবে? এমনও তো হতে পারে, আল্লাহ্ মোহাম্মদের নিকট কিছুই নাজিল করেননি, বরং সে তার মনগড়া কথা আল্লাহ্র নামে চালিয়ে দিচ্ছে (নাউযুবিল্লাহ্) অথবা হে মোহাম্মদ! তুমি যদি আল্লাহর রাসুলই হবে, তবে আল্লাহ্ তো তোমাকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতেন যে, এ আমার রাসুল। এমনিভাবে তারা আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর নবুয়ত ও রিসালাতের সংজ্ঞা প্রমানার্থে অলৌকিক মুজিজা দাবী করে বলে- কেন আমাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে না? প্রকৃতপক্ষে তারা দলিল প্রমাণ ও অলৌকিক মুজিজা দেখতে চেয়ে তাদের হঠকারিতা ও শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগের কাফিরদের এ হীন আচরণ উল্লেখ করে মহান আল্লাহ্ বলেন- এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরাও তাদেরই মতো কথা বলত। অর্থাৎ পূর্ববর্তী ইহুদিদের মধ্যে যারা স্বীয় ক্বালব বা হৃদয়ের মধ্যে কুফরি লালন করত, তারা মুসা (আ.)-কে বলত, হে মুসা! তুমি প্রকাশ্যে আমাদেরকে আল্লাহ্কে দেখিয়ে দাও। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- “আহলে কিতাব আপনার কাছে আবেদন করে তাদের উপর আসমান থেকে লিপিকা অবতীর্ণ করিয়ে দিতে, কিন্তু তারা তো মুসা (আ.)-এর কাছে এর চেয়েও বড়ো দাবি করেছিল। তারা বলেছিল- প্রকাশ্যে আল্লাহ্কে আমাদের দেখিয়ে দাও। ফলে তাদের পাকড়াও করল বজ্রাঘাত তাদের ধৃষ্টতার দরূন।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ১৫৩) একইভাবে পূর্ববর্তী খ্রিষ্টানদের মধ্যে যারা স্বীয় ক্বালবে বা হৃদয়ের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় লালন করত, তারা হযরত ঈসা (আ.)-কে বলেছিল- হে ঈসা! তুমি আমাদেরকে যে আল্লাহর কথা বলছ, তিনি তোমার প্রতিপালক এবং আমাদেরও প্রতিপালক। তবে তোমাদের প্রতিপালক কি আসমান থেকে আমাদের জন্য খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করার ক্ষমতা রাখেন? এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন- “স্মরণ করো, হাওয়ারীরা বলেছিল- হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! আপনার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা প্রেরণ করতে পারেন? তিনি বলেছিলেন- আল্লাহ্কে ভয় করো, যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫ : আয়াত ১১২)
অতঃপর মহান আল্লাহ্ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মাহবুব কুল-কায়েনাতের রহমত বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন- তাওহিদ, নবুয়ত রিসালাত অস্বীকারকারীদের ক্বালব বা হৃদয় সর্বযুগেই এক রকম। সুতরাং এ ঘটনা মোহাম্মদ (সা.)-এর যুগে নতুন কোনো ঘটনা নয়, পূর্ববর্তী আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের থেকে তাদের নবিরাও একই রকম আচরণ পেয়েছিল।
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ্ মানব জাতির উদ্দেশে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশ দিয়েছেন যে, ক্বালব বা হৃদয় হলো হিদায়েত ও ইমান গ্রহণের যেমন দরজা, একইভাবে এ ক্বালব বা হৃদয়ের মধ্যেই কুফরি, মুনাফিকি, সন্দেহ-সংশয় ইত্যাদি ইমান বিধংসী উপায়-উপকরণ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে লুকায়িত থাকে। এজন্য ক্বালব বা হৃদয়ে ইমান যথাযথভাবে প্রতিস্থাপন হয়ে গেলে ঐ মানুষটির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা ইমানের কর্ম যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি তার দেহ-মন ইমানের আলো দ্বারা আলোকিত হয়ে যায়। অন্যদিকে ক্বালব বা হৃদয়ে যদি কুফরি, মুনাফিকি ও সন্দেহ-সংশয় থাকে, তবে ঐ ব্যক্তির ক্রিয়া-কর্মে মিথ্যা, ছলছাতুরি প্রতারণা ইত্যাদি অসৎ কর্মই প্রকাশ পায়। মূলে মানবজীবনে ক্বালব বা হৃদয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
এজন্য মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর একবলাজান মানুষকে যে চারটা মূল শিক্ষা প্রদান করেন, তন্মধ্যে প্রথমটা হলো- আত্মশুদ্ধি। অর্থাৎ তিনি মানুষকে স্ব স্ব ক্বালব বা হৃদয়কে ষড়রিপুর বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে প্রত্যেকের হৃদয়কে নুরে ইমানের আলো দ্বারা আলোকিত করার সুমহান শিক্ষা দেন।
ক্বালব প্রসঙ্গে ৮ম আয়াত
ক্বালব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যার পার্থিব জীবন সম্বন্ধের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে এবং সে আল্লাহ্কে সাক্ষী রাখে তার ক্বালব বা হৃদয়ে যা আছে সে ব্যাপারে। প্রকৃতপক্ষে সে ঘোর ঝগড়াটে লোক।” (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ২০৪)
ওহির বাণী আল কুরআনের এ আয়াতখানায় ক্বালব বা হৃদয়ে মুনাফিকরা কিভাবে সত্য গোপন করে, সে বিষয়টি আলোকপাত করা হয়েছে। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “রাজীতে আসিম ও মারছাদ বাহিনীর লোকেরা শাহাদত বরণ করলে দুই মুনাফিক বললো- হায় দুর্ভাগ্য, এ নিহত লোকগুলোর জন্য, যারা ধ্বংস হয়ে গেল। কপাল পোড়ারা তাদের পরিবার পরিজনদের মাঝেও থাকলো না, আবার তাদের সঙ্গীর (নবির) পয়গামও পৌঁছাতে পারলো না। তখন আল্লাহ্ তায়ালা উপরোক্ত আয়াত নাজিল করেন- ‘আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যার পার্থিব জীবন সম্বন্ধের কথাবার্তা তোমকে চমৎকৃত করবে এবং সে আল্লাহ্কে সাক্ষী রাখে তার ক্বালব বা হৃদয়ে যা আছে, সে ব্যাপারে। প্রকৃতপক্ষে সে ঘোর ঝগড়াটে লোক।’
এমনিভাবে এ আয়াতের শানে নুযুল প্রসঙ্গে ইমাম বগভী (রহ.) বলেন- ক্বালবি, মুকাতিল ও আতা (রহ.) বলেছেন- “আখনাস ইনবে শুরায়ক ছাকাফী বনু যুহরার মিত্র ছিল। সে ‘আখনাস’ নামে খ্যাত হয়েছেন এ কারণে যে, বদরের যুদ্ধের দিন সে বনু যুহরার তিনশত যোদ্ধা নিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা হতে পিছু হটে দিয়েছিল। লোকটি ছিল মিষ্টভাষী ও সুদর্শন। সে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে আসা যাওয়া করত এবং তাঁর মজলিসে বসে নিজের মুসলমান হওয়া প্রকাশ করে বলতো- আমি আপনাকে মুহাব্বত করি।’’ আর এ বিষয়ে সে আল্লাহ্কে সাক্ষী রেখে কসম করতেও দ্বিধা করত না। কিন্তু আসলে সে ছিল মুনাফিক। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাকে কাছে টেনে বসাতেন। এ আখনাস প্রসঙ্গেই উপরোক্ত আয়াত নাজিল হয়।” (তাফসীরে মাজহারী)
অত্র আয়াতে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, মানুষ মুখে যাই বলুক অথবা প্রকাশ করুক, সে ক্বালব বা হৃদয়ের গভীরে যে বিষয়টি লালন করে, অন্তর্যামী আল্লাহ্ এভাবেই তাকে মূল্যায়ন করবেন। অর্থাৎ যার ক্বালব বা হৃদয় গহীনে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের প্রতি নির্মল বিশ্বাস ও আন্তরিক মুহাব্বত রয়েছে, সে যেমন মুমিনরূপে গণ্য হবে, তদ্রূপ যার অন্তরে কপটতা বা মুনাফিকি রয়েছে, সে মুখে ইমানের দাবী করলেও অন্তরের মুনাফিকির কারণে সে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ও মুমিনদের নিকট মুনাফিকরূপেই চিহ্নিত হবে। এ প্রসঙ্গে সাহাবি হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ তোমাদের আকৃতি এবং সম্পদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না বরং তিনি দৃষ্টিপাত করেন তোমাদের ক্বালব বা হৃদয়ের দিকে এবং তোমাদের কর্মের দিকে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা ৩০৬)
প্রিয় পাঠক! তাহলে চিন্তা করে দেখুন, ইসলাম ধর্মে ক্বালব বা হৃদয়ের গুরুত্ব কত অপরিসীম! এজন্য সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান ক্বালব বা হৃদয়ের পরিশুদ্ধিতার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করে থাকেন।
ক্বালব প্রসঙ্গে ৯ম আয়াত
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “আল্লাহ্ অর্থহীন কসমের জন্য তোমাদেরকে দায়ী করবে না। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন তোমাদের ক্বালব বা হৃদয়ের সংকল্পের জন্য। আর আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও পরম ধৈর্যশীল।” (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ২২৫)
আলোচ্য আয়াতখানা ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সংবলিত খুব গুরুত্বপূর্ণ একখানা আয়াত। অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাঁর মুমিন বান্দার প্রতি যে অপরিসীম ক্ষমাশীল, সেই মহিমা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি মুমিনগণ মুখে মুখে যে সব অর্থহীন কসম করে, তা তিনি ধরেন না বরং ক্বালব বা হৃদয়ের সংকল্প, কসম ইত্যাদিই তিনি ধরেন, এ বিষয়টিও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীকে এ মর্মে সংবাদ দিয়েছেন যে, মুমিনদের কেউ মুখে মুখে যদি শপথের বাক্য উচ্চারণ করে, অথচ এটি ঐ ব্যক্তি তার ক্বালব বা হৃদয় থেকে কসমের নিয়তে করেনি, তবে এ কসম বা শপথ পূর্ণ না করলে মহান আল্লাহ্ তাকে শাস্তি দেবেন না। আর এ ক্ষেত্রে কসমের কাফফারাও দিতে হবে না। এ প্রসঙ্গে হযরত ইকরাম (রা.) বলেন- “আল্লাহ্ তোমাদের অর্থহীন শপথের জন্য শাস্তি দেবেন না। এ কথার মর্ম হচ্ছে- যেমন মানুষ বলে আল্লাহর কসম। এটি এরূপ নয়; আবার বলে আল্লাহর কসম! হ্যাঁ, এটি এরূপ ইত্যাদি।” (তাফসীরে তাবারী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৫)
প্রকৃতপক্ষে বান্দার সাথে আল্লাহর যোগসূত্র স্থাপিত হয় ক্বালব বা হৃদয়ের মাধ্যমে। এজন্য ক্বালব বা হৃদয় থেকে যে কসম হয়ে যায়, সে কসম পূর্ণ করা আবশ্যক। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “বনি ইসরাইলের মধ্যে দুজন বন্ধু ছিল। একজন খুবই ইবাদত করত, অপরজন অন্যায়, অপরাধ ও পাপ কর্মে লিপ্ত থাকত। তবে সে নিজেকে মহাপাপী বলে জানত। একদিন আবেদ ব্যক্তি গুনাহগারকে বলল- গুনাহ থেকে ফিরে এসো। সে বলল- হে বন্ধু! আমাকে আমার এবং আমার প্রভুর মাঝে ছেড়ে দাও। অপর একদিনের ঘটনা, আবেদ ব্যক্তি গুনাহগারকে মস্ত বড়ো এক গুনাহে লিপ্ত দেখে বলল- গুনাহ ছাড়। গুনাহগার বলল- আমাকে আমার এবং আমার প্রভুর মাঝে ছেড়ে দাও, তোমাকে কি আমার কর্মের জন্য রক্ষক বানানো হয়েছে? তখন আবেদ ব্যক্তি রাগের বশবর্তী হয়ে দৃঢ় শপথ করে বলল, আল্লাহর কসম! আল্লাহ্ কখনও তোমাকে ক্ষমা করবেন না এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। এদিকে আবেদের এ কথায় মহান আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হলেন। ঘটনাক্রমে আল্লাহ্ তায়ালা মালাকুল মউতকে পাঠিয়ে দুজনেরই রূহ কবজ করালেন। অতঃপর দুজনের রূহ বিচারের জন্য আল্লাহ্ পাকের সামনে দণ্ডায়মান হলো। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন গুনাহগারকে বললেন, যাও আমি তোমাকে আমার পরম ক্ষমাশীল নামের বরকতে ক্ষমা করে দিলাম। তুমি আমার রহমতে ইল্লিন নামক শান্তিময় স্থানে চলে যাও। তারপর তিনি আবেদকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তুমি কি আমার বান্দাকে আমার ক্ষমা ও রহমত থেকে বঞ্চিত করতে পারলে? আবেদ বলল, না, হে প্রভু! আপনি মহান। পরিশেষে মহান আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হয়ে ঐ আবেদকে সিজ্জিন নামক অশান্তিময় স্থানে নিক্ষেপ করেন।”
প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ্ প্রতিটি মানুষের ক্বালব বা হৃদয়ের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতে বিরাজ করেন। যে ব্যক্তি আপন ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করে, তাঁর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকে, সে মহান আল্লাহ্কে তার হৃদয়ের সুধারণার অনুরূপই পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র রহমত ও ক্ষমার ব্যাপারে সুধারণা পোষণ না করে, বরং নিজের আমলকেই মুক্তির অসিলা মনে করে, এরূপ ব্যক্তিও আল্লাহ্কে তার হৃদয়ের ধারণার অনুরূপই পেয়ে থাকে।
এজন্য একজন আশেকে রাসুল মুমিন ব্যক্তির উপরে অপরিহার্য কর্তব্য হলো- সর্বদা আপন ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি সর্বোত্তম সুধারণা পোষণ করা। কেননা, মহান আল্লাহ্ সদাসর্বদা আমাদের মঙ্গল চান। গর্ভধারিণী মা তার সন্তানকে যতটুকু ভালোবাসেন, মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ আমাদেরকে তার চেয়ে ৭০ গুণ বেশি ভালোবাসেন। এজন্য কেউ যখন অশ্রুসিক্ত নয়নে ক্বালব বা হৃদয় থেকে আল্লাহ্র বন্ধুর অসিলা ধরে তাঁর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তবে মহান আল্লাহ্ তাঁর ঐ বান্দার প্রার্থনা দয়া করে কবুল করেন।
আয়াতের আলোচ্য বিষয়ে আল্লাহ্ বলেন, “তিনি তোমাদের শাস্তি দেবেন তোমাদের ক্বালব বা হৃদয়ের সংকল্পের জন্য।” অর্থাৎ ক্বালব বা হৃদয় দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ করলে যেমন শাস্তি পেতে হয়, একইভাবে ক্বালব বা হৃদয় দ্বারা সত্য, সঠিক ও উত্তম কাজ করলে আল্লাহ্ তার পুরস্কারও প্রদান করেন।
এজন্য মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান আত্মশুদ্ধি ও দিল জিন্দার উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকেন। আর আল্লাহ্ প্রাপ্তির পথে ক্বালবের গুরুত্ব এতবেশি যে, বাল্ব বিহনে যেমন বিদ্যুতের আলো পাওয়া যায় না, তদ্রূপ ক্বালব বা হৃদয় বিহনে আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায় না।
মহান আল্লাহ্ আমাদের সকলকে এ মহাসত্য উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক : তাফসীরকারক, বাংলাদেশ টেলিভিশন।]