আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব
এ. আর. এম. মুহিউদ্দীন খান ফারুকী (পর্ব-৪)
ক্বালব প্রসঙ্গে ৫ম আয়াত
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘স্মরণ করো, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূর (পর্বত)-কে তোমাদের উপর তুলে ধরেছিলাম এবং বলেছিলাম দৃঢ়ভাবে ধরো, যা আমি তোমাদের দিয়েছি এবং শোন। তারা বলেছিল: আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম। কুফরির কারণে তাদের ক্বালব বা হৃদয়ে বাছুর-প্রীতি সিঞ্চিত হয়েছিল। আপনি বলে দিন : যদি তোমরা বিশ্বাসী হও, তাহলে তোমাদের বিশ্বাস যার আদেশ দেয়, তা কতই না মন্দ।’’ (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ৯৩)
আলোচ্য আয়াতখানা মানুষের ক্বালব বা হৃদয় প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একখানা আয়াত। মহান আল্লাহ্ বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়কে শান্তি ও মুক্তির পথে তুলে আনতে সেই যুগের ত্রাণকর্তারূপে হযরত মুসা (আ.)-কে প্রেরণ করেন। অতঃপর নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে হযরত মুসা (আ.) বনী ইসরাঈলকে খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেন। এদিকে দীর্ঘ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বনী ইসরাঈল হযরত মুসা (আ.)-এর উপর খুুশি হয় এবং তারা তাদের নবির কাছে আবদার করে যে, আপনি আমাদেরকে ধর্ম বিধান সম্বলিত একখানা কিতাব আল্লাহ্র কাছ থেকে এনে দিন। মুসা (আ.) তাঁর উম্মতের আবদারের বিষয়টি সামনে রেখে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করেন এবং দয়াময় আল্লাহ্ উক্ত প্রার্থনা কবুল করেন। এদিকে হযরত মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব আনয়নের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের নির্দেশনা অনুযায়ী তূর পাহাড়ে গমন করেন এবং প্রতিশ্রুত ৩০ দিনের পরিবর্তে ৪০ দিন অবস্থান করেন। এ বিলম্বের কারণে বনী ইসরাঈল হযরত হারুন (আ.)-এর নির্দেশ অমান্য করে সামেরী কর্তৃক উদ্ভাবিত গো-বাছুরের পূজা শুরু করে দেয়।
এদিকে মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব নিয়ে বনী ইসরাঈলের মাঝে ফিরে আসেন এবং তাঁর কওম আল্লাহ্কে ছেড়ে দিয়ে একটি গো-বাছুরের পূজা করছে- এ দৃশ্য দেখে খুবই মর্মাহত হন। অতঃপর তিনি গো-বাছুরটি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্মীভুত করে এর ছাইসমূহ নদীতে নিক্ষেপ করেন এবং বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ্ প্রদত্ত ওহির কিতাব তাওরাতকে আকড়িয়ে ধরতে বলেন। অর্থৎ আল্লাহ্র বাণী তাওরাত অনুসরণ করে চলার আহবান জানান। কিন্তু বনী ইসরাঈল তাওরাত কিতাব মানতে অস্বীকার করল। অতঃপর মহান আল্লাহ্ তূর পাহাড় তাদের মাথার উপর উত্তোলন করে ধরেন এবং বলেন-তাওরাত মেনে নাও। যদি তাওরাত মেনে না নাও, তবে তূর পাহাড় এখনই তোমাদের মাথার উপর ছেড়ে দেবো। বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় শাস্তির ভয়ে সাথে সাথে বলে- আমরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে নিলাম, এ সময় তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচার জন্য সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ্ কেবল ভয় প্রদর্শন করেই তাদেরকে ছেড়ে দেন। এর অতিরিক্ত কোনো শাস্তিই তাদের দেওয়া হয়নি। তবে বিপদ কেটে গেলে তারা অবাধ্যতা পোষণ করে এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন- ‘‘আর স্মরণ করুন, যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূরকে তোমাদের উপর তুলে ধরে বলেছিলাম-আমি তোমাদের যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধরো এবং তাতে যা আছে, তা স্মরণ রেখ, যাতে তোমরা সাবধান হয়ে চলতে পার। এরপরও তোমরা তা থেকে ফিরে গেছ। অতএব, তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী না থাকলে অবশ্যই তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে।’’ (সূরা আল বাকারাহ্ ২ : আয়াত ৬৩ ও ৬৪)
সুতরাং বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, বনী ইসরাঈল আল্লাহর আযাবের ভয়ে সত্য গ্রহণের স্বীকৃতি দিলেও তাদের ক্বালব বা হৃদয়ে কুফরি লুকায়িত থাকায়, তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি।
আসলে ধর্মটি ক্বালব বা হৃদয়ের ব্যাপার। কারো ক্বালব যদি সত্য গ্রহণে প্রস্তুত না হয়, তবে ভয়ভীতি কিংবা অন্য কোনো পথ খোলা নেই। উপমাস্বরূপ বলা যায়, দর্শনেন্দ্রিয় বা চক্ষু বিহনে যেমন দেখা যায় না, তেমনি ক্বালব বিহনে ধর্ম উপলব্ধি করা যায় না। এমনিভাবে ক্বালব বা হৃদয়ে যদি সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়, একইভাবে ক্বালবের মাঝে যদি কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা কিংবা ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়, তবে এর সমাধান ক্বালবের ভেতর থেকে হওয়াই জরুরি। এজন্য মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী আশেকে রাসুলের জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, যখন আপন মুর্শেদ সম্বন্ধে অন্তর জগতে কোনো প্রকার খটকা লাগে, সাথে সাথে মুর্শেদের শরণাপন্ন হয়ে মনের অবস্থা খুলে বলা এবং উক্ত সন্দেহ সংশয় নিরসন করে নেওয়া। এ প্রসঙ্গে হযরত হুজায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘‘ক্বালব বা অন্তরসমূহ যখন ফেতনায় পতিত হয়, তখন ক্বালবে একটি কালো দাগ পড়ে যায় এবং দাগ পুরো ক্বালবকে আচ্ছাদিত করে ফেলে (যেভাবে মেঘ সূর্যকে ঢেকে ফেলে)।’’ (তাফসীরে কুরতুবী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪ ও ২৫৫)
সূরা আল বাকারাহর ৯৩নং আয়াতের বিষয়বস্তুতে ক্বালব প্রসঙ্গে এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, মানুষ তার কর্মের জন্য দায়ী। বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় একমাত্র উপাস্য আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিয়ে গো-বাছুরকে উপাস্য মেনে পূজা করে কুফরি করেছে। অর্থাৎ তারা সূর্র্যকে মেঘ দিয়ে ঢাকার মতো ক্বালবে প্রজ্বলিত তাওহিদের আলোকে শিরক ও কুফরির অন্ধকার দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। অতঃপর তাদের ক্বালব বা অন্তর মিথ্যাকে এমনভাবে গ্রহণ করে যে, তারা আল্লাহ্ ও তার রাসুলের নির্দেশ অমান্য করে বসে। এজন্য ক্বালব বা হৃদয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কেউ যদি ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি যথার্থরূপে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, তবে মহান আল্লাহ্ ঐ ক্বালবকে সঠিকভাবে পরিচালিত করেন।
এজন্য আমাদের মহান মুর্শেদ মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। তিনি মুক্তিকামী মানুষের ক্বালবে তাঁর পবিত্র শাহাদত অঙ্গুলি মোবারক স্পর্শ করেন এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত অপরিসীম ঐশী শক্তির দ্বারা তিনি মানুষের ক্বালবে ‘আল্লাহ্’ শব্দের নুর বপন করে ক্বালব জিন্দা করে দেন। অতঃপর রেতের ঘর্ষণে যেমন লোহার জং পরিস্কার হয়ে যায়, তেমনি ক্বালবে ‘আল্লাহ্’ শব্দের নুর বপন করার ফলে, ক্বালবে অহর্নিশি আল্লাহর জিকির চলতে থাকে। এর ফলে ক্বালব সকল প্রকার গুনাহর ময়লা থেকে পবিত্র হয়ে পরিশুদ্ধ হয়। আর পরিশুদ্ধ ক্বালবের পর্দায় অন্তর্চক্ষু দিয়ে আল্লাহ্কে ঐভাবে দেখা যায়, যেভাবে টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদ উপস্থাপনকারী ব্যক্তির আলোকদেহ দেখা যায়। সুতরাং সূফী সম্রাটের শিক্ষা বর্তমান সময়ে মানবজাতির জন্য অপরিসীম কল্যাণ বয়ে এনেছে।
ক্বালব প্রসঙ্গে ৬ষ্ঠ আয়াত:
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘হে রাসুল (সা.)! আপনি বলে দিন- যে কেউ জিব্রাঈলের শত্রু- এ কারণে যে, সে আল্লাহর নির্দেশে আপনার ক্বালব বা হৃদয়ে কুরআন নাজিল করেছে, যা পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়নকারী এবং যা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভসংবাদ।’’ (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ৯৭)
অত্র আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র ক্বালব বা হৃদয় মোবারকের কথা বলেছেন। যে ক্বালব বা হৃদয় মোবারক হলো এলমে ওহির খনি, এটিই প্রত্যদেশ বাণীর ঝর্ণাধারা, যেখান থেকে সত্যের বাণী উৎসারিত হয় তথা নাজিল হয়। আর এ নাজিলের কাজটি মূলত মহান আল্লাহ্ নিজেই করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- ‘‘পরম দয়ালু আল্লাহ্, তিনিই [হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে] কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন।’’ (সূরা আর রাহমান ৫৫ : আয়াত ১ ও ২) ওহির বাণী আল কুরআনের অন্যত্র মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- ‘‘নিশ্চয় এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্ই নাজিল করেন। যা রূহুল আমীন বা বিশ্বস্ত রূহ আপনার ক্বালবে অবতীর্ণ করে, যাতে আপনি সতর্ককারী হতে পারেন।’’ (সূরা আশ শু‘আরা ২৬ : আয়াত ১৯২ থেকে ১৯৪)
প্রত্যেকটি জিনিসেরই জাহের ও বাতেন রয়েছে। মানুষের দেহ বা শরীর যেমন তার জাহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তেমনি মানুষের ভেতরের রূহ হলো তার বাতেন। আমরা যখন ঘুমের মধ্যে নিজেকে অন্য কোথাও আবিষ্কার করি, তখন অবিকল নিজেকে দেখি অথচ আমি তো ঐ স্থানেই রয়েছি, যেখানে নিদ্রা বা ঘুমের কোলে বিভোর হয়ে আছি। আসলে স্বপ্নে আমরা আমাদের বাতেনি রূপ দেখে থাকি। তদ্রুপ ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ.)-এরও জাহের ও বাতেন রয়েছে। বাস্তবে নুরের তৈরী জিব্রাঈল (আ.) যেমন রয়েছেন, তেমনি জিব্রাঈল (আ.) বদর যুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুর মোকাবিলাও করেছেন।
অন্যদিকে প্রতিটি মানুষের মাঝে নফস তথা জীবাত্মার পাশাপাশি রূহ বা পরমাত্মা রয়েছে। এ পরমাত্মা দুটিভাগে বিভক্ত। ১. মানব আত্মা ও ২. ফেরেশতার আত্মা।
এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘প্রতিটি মানুষের ক্বালব দুটি করে কক্ষ রয়েছে। তার একটিতে শয়তানের অবস্থান, আর ক্বালবের অন্য কক্ষটিতে ফেরেশতা অবস্থান করে।’’ (তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড : পৃষ্ঠা ১৬৮)
এজন্য গভীর সাধনার মাধ্যমে যখন কোনো ব্যক্তির নফ্স তথা জীবাত্মা শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে পুতঃপবিত্র হয়ে উঠে, তখন তার ভেতরের রূহ বা পরমাত্মার মধ্যে ফেরেশতার স্বভাব উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। ফলে ঐ আত্মা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে থাকে।
কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত রাসুল (সা.)-এর মাঝে রূহুল আমীন বা রুহুল কুদুস অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্র রূহ মোবারক ফুঁকে দেওয়া হযেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘জেনে রাখ, নিশ্চয়ই বিশ্বস্ত রূহ অর্থাৎ রূহুল আমীন আমার মাঝে ফুঁকে দেওয়া হয়েছে।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ১৯নং খণ্ড : পৃষ্ঠা ৩২১)
সূরা আল বাকারাহর ৯৭নং আয়াতের বিষয়বস্তুতে ক্বালব প্রসঙ্গে এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, আল্লাহর নির্দেশে পবিত্র রূহ বা বিশ্বস্ত রূহ হযরত রাসুল (সা.)-এর ক্বালবে পবিত্র কুরআন নাজিল করেছে। যা পূর্ববর্তী ওহির কিতাব তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিলের যেমন সত্যায়নকারী, তেমনি এটি মুমিনদের জন্য পথনির্দেশনা সম্বলিত ওহির কিতাব।
এজন্য নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আওলিয়ায়ে কেরাম এ ক্বালবের মাধ্যমেই আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ পেয়ে থাকেন। নবুয়তের যুগে এ সংবাদকে ওহি বলা হলেও নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে একে এলহাম বলে।
এজন্য আমাদের মহান মুর্শেদ- মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন- ‘‘সাধনার মাধ্যমে নিজের মধ্যে প্রভুর অস্তিত্ব অনুভব করে নিজেকে প্রভুর হুকুমে পরিচালনাকারীকে বলা হয় আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি।’’ এ প্রসঙ্গে হযরত হাসান (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘এলেম হলো দুই প্রকার। যথা -১. ক্বালবি এলেম, আর এ এলেমই হচ্ছে পরম উপকারী এলেম ২. মুখের এলেম তথা কিতাবি এলেম; আর এ এলেমই মাখলুকাতের উপর আল্লাহর দলিল। (তাফসীরে দুররে মানছুর ২২নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১)
মূলে এলমুল ক্বালবের এ মহাজ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন বলেই হযরত রাসুল (সা.) হলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী। এমনিভাবে এলমুল ক্বালবের সাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে যথার্থভাবে আল্লাহর প্রতিনিধিরূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় বলেই হযরত রাসুল (সা.) এ জ্ঞানকে মানুষের জন্য পরম উপকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, প্রত্যেকটি বস্তুর জাহের ও বাতেন রয়েছে। অতএব মানুষেরও জাহের ও বাতেন রয়েছে। মানুষের জাহের হলো- দেহ, আর বাতেন হলো রূহ বা পরমাত্মা। মানবদেহের যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয় তথা চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা ও ত্বক রয়েছে, তেমনি রূহ বা পরমাত্মারও পঞ্চ ইন্দ্রিয় তথা আত্মিক চক্ষু, আত্মিক কর্ণ, আত্মিক জিহ্বা, আত্মিক নাসিকা ও আত্মিক ত্বকও রয়েছে। এ কারণে প্রতিটি মানুষই ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখে, স্বপ্নে কি কথা হয়, তা শুনে এবং মনেও রাখতে পারে। আবার স্বপ্নে সে কারো সাথে কথা বলে। অর্থাৎ দৈহিক পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ন্যায় প্রতিটি মানুষের মাঝেই আত্মিক পঞ্চ ইন্দ্রিয় সর্বদা কাজ করে থাকে। মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থাৎ বই-পুস্তক অধ্যয়নের মাধ্যমে সীমিত জ্ঞান অর্জন করতে পারে। অন্যদিকে এলমুল ক্বালবের সাধনার মাধ্যমে অন্তরের পঞ্চ ইন্দ্রিয় জাগ্রত করতে সক্ষম হলে সে অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে। মূলে সিন্দুর কাছে বিন্দু যেমন, এলমুল ক্বালবের কছে বই-পুস্তকের জ্ঞান তেমনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।
এলমুল ক্বালব শুধুমাত্র জ্ঞানের মহাসমুদ্রই নয়, বরং এটি আল্লাহর নুরময় এমনই এক বিজ্ঞান, যার সাহায্যে মানুষ আত্মিক পঞ্চইন্দ্রিয় জাগ্রত করে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করে তার সাথে কথোপকথন করতে পারে। এজন্য দেখা যেতো, হযরত রাসুল (সা.) মজলিসে বসে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে আলোচনায় মশগুল আছেন, তখন তাঁর ক্বালবের ভেতরে ওহি নাযিল হতো। অর্থাৎ নুরময় সত্তা আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর ক্বালবের সপ্তম স্তরে নাফসির মোকামে বিরজমান থেকে উক্ত ক্বালবের ১ম স্তর সুদুরের মোকামে ওহি করতেন। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) স্বীয় আত্মিক কর্ণ দ্বারা ওহির বাণী শ্রবণ করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে জানিয়ে দিতেন। এজন্য প্রত্যেক যুগেই মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরিত মহামানব তথা নবি, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামের সহবতে গিয়ে আল্লাহর বাণী সম্পর্কে অবগত হতে হয়েছে। নবুয়তের যুগে যেমন ওহি নাজিল হয়েছে, নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে আওলিয়ায়ে কেরামের ক্বালবে আল্লাহর পক্ষ থেকে এলহাম হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন- ‘‘কোনো মানুষের অবস্থা এমন নয় যে, আল্লাহ্ তার সাথে কথা বলবেন; কিন্তু ওহির মাধ্যমে, অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে, কিংবা তিনি কোনো রাসুল প্রেরণ করবেন, সে আল্লাহ্ যা চান তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেবে। নিশ্চয় তিনি অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা আশ শূরা ৪২ : আয়াত ৫১)
সুতরাং আওলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা অনুযায়ী এলমুল ক্বালবের সাধনার মাধ্যমে বর্তমানেও মানুষ আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে মহান প্রভুর ইচ্ছায় নিজেকে পরিচালিত করতে পারে। মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বন্ধুর অসিলায় আমাদের সহায় হউন। আমিন।
[ লেখক: সদস্য, আল কুরআন গবেষণা কেন্দ্র, দেওয়ানবাগ শরীফ, ঢাকা]