আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব
এ আর এম মুহিউদ্দীন খান ফারুকী
৬ষ্ঠ পর্ব
ক্বালবের উপর ১০ম আয়াত
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘আর স্মরণ করুন যখন ইব্রাহীম (আ.) বললেন- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দেখাও কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত করো। আল্লাহ্ বললেন- তবে কি তুমি বিশ্বাস করো না? সে বলল- অবশ্যই বিশ্বাস করি, তবে দেখতে চাই এজন্য, যাতে আমার ক্বালব বা হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। আল্লাহ্ বললেন- তাহলে চারটি পাখি ধরে নাও এবং সেগুলোকে তোমার বশীভূত করো। তারপর সেগুলোর দেহের এক এক অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপর রেখে দাও। তারপর তাদের ডাক দাও, তারা তোমার কাছে উড়ে চলে আসবে। জেনে রেখ, নিশ্চয় আল্লাহ্ মহাশক্তিশালী এবং মহাবিজ্ঞানী।’’ (সূরা আল বাকারাহ্ ২ : আয়াত ২৬০)
মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে বলা হয়েছে হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ (আ.) মহান প্রতিপালক আল্লাহ্কে বলেছিলেন- হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন, তা আমাকে দেখান। আর এরূপ দেখতে চাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ যখন প্রশ্ন করেন, তখন ইব্রহীম (আ.) জবাবে বলেছিলেন- এটি দেখতে চাই এজন্য যে, ‘‘লিইয়াত্বমাইন্না ক্বালবী অর্থাৎ আমার ক্বালব বা হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য।’’
অতঃপর মহাবিজ্ঞানী ও মহাশক্তিশালী আল্লাহ্ মৃতকে জীবিত করে মহাশক্তি প্রদর্শন করে ইব্রাহীম (আ.)-এর ক্বালব বা হৃদয়কে প্রশান্ত করে দেন। অত্র আয়াতে দুটি বিষয় সুষ্পষ্ট হয়েছে, যথা:
১. প্রত্যেকটি মানুষকে ক্বালব বা হৃদয় দিয়ে সত্য উপলব্ধি করতে হয়।
২. ক্বালব বা হৃদয়ে প্রশান্তি অর্জিত হলেই সঠিক জ্ঞান লাভ করা যায়।
এজন্য মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ (আ.) মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে আরজ করেন- হে প্রতিপালক! আপনি দয়া করে দেখান আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন। আর সে ঘটনাটি ছিল এরূপ, যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) নিজের মনের প্রশান্তির জন্য মৃতকে জীবিত করার পদ্ধতি দেখতে আকাক্সক্ষা পোষণ করলেন, তখন মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে চারটি পাখি ধরে নিতে বললেন। অতঃপর নির্দেশ করলেন- হে ইব্রাহীম! প্রত্যেকটি পাখিকে যবেহ করে চারটি করে টুকরো করে নিন। আর টুকরোগুলোকে চারটি ভাগে বিভক্ত করুন। প্রত্যেক ভাগেই যেন চারটি পাখির চারটি টুকরো একত্রিত হয়। তারপর এ চারটি ভাগকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে রেখে আসুন। পরিশেষে এ চারটি পাখিকে ডাক দিন। প্রত্যেকটি পাখির চারটি টুকরো চার পাহাড় থেকে একত্রিত হয়ে জীবন লাভ করে, পূর্বের ন্যায় আপনার কাছে উড়ে চলে আসবে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান রাব্বুল আলামিনের এ নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলেন। অতঃপর তিনি এ চারটি পাখিকে ডাক দিলে মুহূর্তে যবেহকৃত মৃত পাখি, টুকরো টুকরো করে পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল- তা জীবিত হয়ে ইব্রাহীম (আ.)-এর কাছে চলে আসে।
এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহ্র প্রতি এক গভীর প্রেমাবেগ সৃষ্টি হয়। তাঁর হৃদয়ে পরম প্রশান্তি নাযিল হয়। তিনি এতদিন সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি যে বিশ্বাস লালন করতেন, আজ তার বিশ্বাস পূর্ণতা লাভ করলো। তাঁর ক্বালব প্রশান্তিতে ভরে উঠে।
সুতরাং ওহির বাণী আল কুরআনের দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত সত্য যে, আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব অপরিসীম। ক্বালব বা হৃদয়ে প্রশান্তি নাযিল হলে সাধক উপলব্ধি করতে পারে যে, তিনি সঠিক পথে রয়েছেন, নির্ভুল কর্মটি করছেন।
ক্বালব প্রসঙ্গে ১১তম আয়াত:
ক্বালব প্রসঙ্গে সূরা আল বাকারাহ’র সর্বশেষ আয়াতে আল্লাহ্ বলেন- ‘‘আর যদি তোমরা সফরে থাক এবং কোনো লেখক না পাও, তবে বন্ধকী বস্তু হস্তগত রাখা বিধেয়। যদি তোমাদের একে অপরকে বিশ্¦াস করে, তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়, সে যেন আমানত ফিরিয়ে দেয় এবং তার পালনকর্তা আল্লাহ্কে ভয় করে। আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করবে না। যে কেউ তা গোপন করবে, অবশ্যই তার ক্বালব বা হৃদয় হবে পাপপূর্ণ। তোমরা যা করো, সে বিষয়ে আল্লাহ্ সম্যক অবহিত।’’ (সূরা আল বাকারাহ্ ২ : আয়াত ২৮৩)
অত্র আয়াতে মহান রাব্বুল আলমিন মুমিনদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- তোমরা সাক্ষ্য গোপন করবে না। অর্থাৎ যার কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার মতো বিষয়বস্তু আছে, সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ তা গোপন করতে নিষেধ করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিনের এরূপ সুষ্পষ্ট ঘোষণা শ্রবণ করার পরেও যে বা যারা তা গোপন করে, হাকিমের সামনে সত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকে, সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ তাদের এহেন নিকৃষ্ট কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন। এরাই তারা, যাদের ক্বালব বা হৃদয় পাপে পরিপূর্ণ। আর এ সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়বস্তু নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের লেনদেনের ক্ষেত্রে হোক অথবা নগদ কারবারের ক্ষেত্রে হোক অথবা যে কোনো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার ক্ষেত্রে হোক, যদি সে বিষয়টি এড়িয়ে যায়, সত্যকে গোপন করে তবে অবশ্যই তার ক্বালব বা হৃদয় পাপে পূর্ণ হয়ে যাবে।
অত্র আয়াতে বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, মানুষের পাপকর্মের কারণে তার ক্বালব বা হৃদয় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সাক্ষ্য দেওয়ার মতো বিষয়বস্তু নিজের কাছে থাকার পরেও তা গোপন করা একটি অন্যায় কাজ। এরূপ কাজ যে ব্যক্তি করে, তার ক্বালব বা হৃদয়ে পাপে পূর্ণ হয়ে যায়। এজন্য হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘নিশ্চয় মুমিন ব্যক্তি যখন কোনো গুনাহ করে, তার ক্বালবে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যদি সে তওবা করে ও ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে ক্বালবের কালো দাগ সাফ হয়ে যায়। আর যদি গুনাহ বেশি হয়, তবে কালো দাগের পরিমাণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে (গুনাহর) কালো দাগসমূহ ক্বালব বা হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে।’’ (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজহা’র সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ২০৪)
সুতরাং পবিত্র কুরআন ও হদিসের বাণী মোবারকে বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় সুষ্পষ্ট যে, সাক্ষ্য গোপন করার কারণে কিংবা অন্য যে কোনো পাপের কারণে মানুষের ক্বালব বা হৃদয় বিমারগ্রস্থ, পাপাচ্ছন্ন অন্ধকার হয়ে যায়। এজন্য আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় মুর্শেদে কামেল আপন মুরিদকে সর্বাগ্রে আত্মশুদ্ধি তথা ক্বালব বা হৃদয়কে পাপের কালিমা থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
ক্বালব প্রসঙ্গে ১২তম আয়াত
ক্বালব প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ সূরা আলে ইমরানের ৭ম আয়াতে এরশাদ করেন- ‘‘হে রাসুল (সা.)! তিনিই আপনার প্রতি এ কুরআন নাযিল করেছেন। এতে আছে কতক আয়াতে মুহকামাত অর্থাৎ দ্ব্যর্থহীন সুষ্পষ্ট আয়াত, এ আয়াতগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো হলো আয়াতে মুতাশাবিহাত অর্থাৎ রূপক আয়াত। যাদের ক্বালব বা হৃদয়ে সত্য লঙ্ঘনের প্রবণতা রয়েছে, তারাই ফেতনা সৃষ্টি এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে আয়াতে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। আর এর ব্যাখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর তারা বলে- ‘‘আমরা এতে ইমান এনেছি, এসবই আমাদের প্রভুর তরফ থেকে এসেছে। জ্ঞানবানরা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৭)
মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে বিষয়টি সষ্পষ্ট যে, পবিত্র কুরআনে দুপ্রকার আয়াত রয়েছে। যথা:
১. আয়াতে মুহকামাত ও ২. আয়াতে মুতাশাবিহাত
‘আয়াতে মুহকামাত’ বলতে বুঝায়, যে সকল আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্ট। বিষয়বস্তু সুষ্পষ্ট ও সহজ হওয়ার কারণে এ বিধানাবলি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। অন্যদিকে ‘আয়াতে মুতাশাবিহাত’ বলতে ঐ সকল আয়াতকে বুঝায়, যার অর্থ ও উদ্দেশ্য সুষ্পষ্ট নয়। বিষয়টি রূপকভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় এটি অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য বা দ্বিঅর্থবোধক। যাদের ক্বালব বা হৃদয়ে কুটিলতা রয়েছে, যাদের ক্বালব সত্য বিমুখ, যাদের ক্বালবে সত্য লঙ্ঘনের তৎপরতা রয়েছে, তারা কেবল আয়াতে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। এর দ্বারা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার প্রয়াস পায়। শাব্দিক মতবিরোধ দ্বারাই তারা ঘৃণ্য তৎপরতা চালানোর সুযোগ লাভ করে। কেননা মুহকাম আয়াতসমূহ দ্বারা তাদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না। যেহেতু মুহকাম আয়াতসমূহের শব্দগুলো সুষ্পষ্ট ও খুবই উজ্জ্বল, ফলে এতে তারা কমবেশি করতে পারে না এবং এর দ্বারা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় না।
আয়াতে মুতাশাবিহা যেহেতু একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে, সেহেতু ক্বালবের রোগে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা এ আয়াতগুলো ব্যবহার করে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে তৎপরতা চালায়। সুতরাং ক্বালব বা হৃদয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া খুবই জরুরি বিষয়। অন্তরে যদি সত্য লঙ্ঘনের প্রত্যাশা থাকে, তবে ঐ ব্যক্তির দ্বারা ফেতনা-ফ্যাসাদ প্রকাশ পাবেই। এজন্য আমাদের সমাজ বাস্তবতায় দেখা যায়, ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও স্বার্থের কারণে অনেকেই কুপথে পরিচালিত হয়। এমনিভাবে ক্বালব বা হৃদয় পরিশুদ্ধ না হওয়ার কারণে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অগাধ পাণ্ডিত্য থাকার পরেও তারা শিরক-বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
সুতরাং আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব অপরিসীম। যে যতবেশি ক্বালব বা হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে পেরেছে, সে ততবেশি আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় অগ্রসর হতে পেরেছে। পক্ষান্তরে যার ক্বালব বা হৃদয় যতবেশি পাপাসক্ত, আত্মিক রোগে রোগাক্রান্ত, সে ততবেশি আল্লাহ্ থেকে দূরে অবস্থান করছে। এজন্য নবুয়তের যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং বেলায়েতের যুগে আওলিয়ায়ে কেরাম সর্বাগ্রে মানুষকে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা দিয়ে তাদেরকে আদর্শ চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলেছেন এবং আল্লাহ্ প্রপ্তির সাধনায় মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে দিয়েছেন।
ক্বালব প্রসঙ্গে ১৩তম আয়াত
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! সরল-সঠিক পথ প্রদর্শনের পর আমাদের ক্বালব বা হৃদয়কে বিপদগামী করবেন না। আর আমাদের দান করুন আপনার অপরিসীম রহমত। নিশ্চয় আপনি তো মহাদাতা।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৮)
অত্র আয়াতে ওহির জ্ঞানে জ্ঞানী আহলে কাশফ ব্যক্তিবর্গের প্রার্থনা স্থান পেয়েছে। তারা সরল-সঠিক পথে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য প্রার্থনা করে বলেন- আমাদেরকে হিদায়েত দিয়েছেন। সুতরাং হিদায়েত দেওয়ার পর আমাদের ক্বালব বা হৃদয়কে বিপথগামী করবেন না। আল্লাহর ভেদ-রহস্য সম্পর্র্কে অবগত জ্ঞানীগণ জানেন যে, আল্লাহ্র দয়া বিহনে সিরাতুল মুস্তাকিমে কায়েম থাকা যায় না। আর মানুষ কর্মদোষে যে কোনো সময় সরল-সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। এজন্য জ্ঞানীগণ সদা সর্বদা আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণ করে তাঁরই আশ্রয়ে কালাতিপাত করতে চান। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘প্রতিটি মানুষের ক্বালব বা হৃদয় পরম দয়ালু আল্লাহর দুঅঙ্গুলির মধ্যে রয়েছে। তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে এটিকে ইমানের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। আর যদি তিনি ইচ্ছা করেন, তবে এটিকে সন্দেহপ্রবণ-বিদথগামী করে দেন। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- হে আয়েশা! তুমি কি আল্লাহর এ বাণী শ্রবণ করোনি? হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে হিদায়েত দান করার পর আমাদের ক্বালব বা হৃদয়কে বিপথগামী করবেন না। আমাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা। (তাফসীরে দুররে মনছুর ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৫)
এমনিভাবে হযরত উম্মে সালমা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এভাবে প্রার্থনা করতেন- হে ক্বালব বা হৃদয়ের অবস্থা পরিবর্তনকারী! আমার ক্বালবকে আপনার ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন। অতঃপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন- ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে হিদায়েত দান করার পর আমাদের ক্বালব বা হৃদয়কে বিপথগামী করবেন না। আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।’’ (তাফসীরে তাবারী ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৭)
প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ্ মুমিনদের ক্বালব বা হৃদয়ে ইমানের নুর প্রদান করে উক্ত নুর দ্বারা ক্বালব বা হৃদয়কে আলোকিত করে দেন। এটি আল্লাহর বিশেষ দান। এজন্য এ নেয়ামত আজীজীর সাথে ধরে রাখতে হয়।
সুতরাং ওহির বাণী আল কুরআনের এ আয়াতেও বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, আল্লাহ্ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব অপরিসীম। যার ক্বালব হিদায়েতের উপর রয়েছে, ঐ ব্যক্তির গোটা দেহ হিদায়েতের পথে পরিচালিত। একইভাবে তার ত্রিয়াকর্মও সত্য, সুন্দর ও আলোকিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে যার ক্বালব গোমরাহীর উপর রয়েছে, ঐ ব্যক্তির গোটা দেহ গোমরাহীর পথে পরিচালিত। আর এরূপ ব্যক্তির থেকে অন্ধকারের কর্মই প্রকাশ পেয়ে থাকে।
এজন্য আল্লাহর মনোনীত মহামানবগণ স্ব স্ব অনুসারীদের ক্বালব বা হৃদয়কে আলোকিত করে দিয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমে পথ চলার তালিম দিয়ে থাকেন। আর এটিই ধর্মের মূল শিক্ষা।
ক্বালব প্রসঙ্গে ১৪তম আয়াত:
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘আর তোমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়ভাবে আল্লাহর রজ্জু ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না। আর স্মরণ করো আল্লাহর সে অনুগ্রহ, যা তোমাদের উপর রয়েছে- তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু, আল্লাহ্ তোমাদের ক্বালব বা হৃদয়ে মহব্বত সৃষ্টি করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের কিনারে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেন। এরূপে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, যেন তোমরা সঠিক পথে চলতে পারো।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১০৩)
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ্ মদীনার দুটি বিবাদমান গোত্র আউস ও খাযরাজ গোত্রের কথা বলেছেন, যারা জাহেলী যুগে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও চরম শত্রুতায় লিপ্ত ছিল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রায়ই যুদ্ধে লেগে থাকত। অতঃপর উভয় গোত্র যখন মোহাম্মদী ইসলামের দীক্ষা নিল, তখন মহান আল্লাহ্ উভয় গোত্রের লোকদের ক্বালব বা হৃদয়ে প্রেম, মহব্বত ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। এর ফলে একে অপরের প্রতি যে শত্রুতা ছিল, তা বন্ধুত্বে রূপ নিল। তারা পরস্পর হয়ে গেলো একে অপরের ভাই।
তাফসীরে ইবনে কাছীরে উল্লেখ করা হয়েছে, মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার বলেন- এই আয়াতটি আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। চিরবিবাদমান এই গোত্র দুটির বর্তমান সৌহাদ্যপূর্ণ অবস্থা দেখে ইহুদিরা শত্রুমিত হয়ে পড়ে। দূরভিসন্ধি করে তারা একজন লোককে আউস ও খাযরাজের নিকট পাঠিয়ে তাদের পূর্বেকার যুদ্ধবিগ্রহ ও শত্রুতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এইভাবে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টির মানসে উভয়ের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। ফলে তাদের পুরাতন নির্বাপিত আগুন দাউ দাউ করে জ¦লে উঠে। এমনকি একে অপরের উপর তরবারি চালাতে প্রস্তুত হয়ে যায়। আবার সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের শোরগোল ও চিৎকার শুরু হয় যায় এবং তারা হিংসা, জিঘাংসায় মেতে উঠে। অতঃপর উভয় গোত্র স্থির করে যে, তারা হুররা প্রান্তরে খোলাখুলি যুদ্ধ করবে এবং পিপাসার্ত শুষ্ক মরুভূমিকে রক্তপানে সিক্ত ও পরিতৃপ্ত করবে।
আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এই সংবাদ জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং উভয় দলকে শান্ত করেন। অতঃপর রাসুল (সা.) তাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি বর্তমান থাকতেই তোমরা পরস্পরের মধ্যে তরবারি চালাতে আরম্ভ করলে? তারপর রাসুল (সা.) তাদেরকে আলোচ্য আয়াতটি পাঠ করে শোনান। এতে উভয় গোত্রের সকলেই লজ্জিত হলো এবং কিছুক্ষণ পূর্বের কর্মের জন্য দুঃখ করতে লাগল। অবশেষে অস্ত্র ফেলে পুনরায় তারা পরস্পর পরস্পরকে করমর্দন ও আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল।
পরিশেষে এ আয়াত প্রসঙ্গে এ কথা সুষ্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ্ যার ক্বালবে মহব্বত, ভালোবাসা, সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দেন, ঐ ব্যক্তির দ্বারা মহব্বত, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির কর্মই প্রকাশ পাবে। সুতরাং আদর্শ মানুষ, আদর্শ পরিবার ও সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত প্রেরিত মহামানবের সহবত লাভ করে ক্বালব বা হৃদয়ে মহব্বত, ভালোবাসা ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করে নেওয়া। এজন্য হযরত রাসুল (সা.) সমাজ শুদ্ধির পূর্বে ব্যক্তিশুদ্ধি অর্থাৎ আত্মশুদ্ধির উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
ক্বালব প্রসঙ্গে ১৫তম আয়াত:
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘এটা তো আল্লাহ্ শুধু এজন্য করেছেন যেন তোমাদের জন্য সুসংবাদ হয়, যাতে তোমাদের ক্বালব বা হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। আর সাহায্য তো শুধুমাত্র মহাশক্তিশালী ও মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর তরফ থেকে হয়ে থাকে।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১২৬)
এ আয়াতখানা বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। ইমাম শাবী (রহ.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- ‘‘বদর যুদ্ধের দিন মুসলমানদের নিকট এ খবর পৌঁছে যায় যে, মুশরিক কুরজ ইবনে জাবের আল মুহারেবী মুশরিক বাহিনীকে সাহায্য করছে। খবরটি তাদের নিকট কষ্টদায়ক হয়ে উঠলো। অনন্তর মহান আল্লাহ্ মুসলমানদের হৃদয়ে সাহসের সঞ্চায় করতে সুসংবাদস্বরূপ এ আয়াত নাযিল করেন- ‘‘তোমাদের জন্য কি এটি যথেষ্ট নয় যে, আসমান থেকে তিন হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে সাহায্য করবেন? হ্যাঁ, অবশ্যই যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে কাফের বাহিনী অতর্কিতে তোমাদের উপর আক্রমণ করলে, আল্লাহ্ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন। এটা তো আল্লাহ্ এজন্য করেছেন যেন তোমাদের জন্য সুসংবাদ হয়, যাতে তোমাদের ক্বালব বা হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। আর সাহায্য তো আল্লাহ্র পক্ষ হতে হয়ে থাকে, যিনি মহাশক্তিশালী এবং মহাবিজ্ঞানী। অতঃপর কুরজ ইবনে জাবের পরাজিত হয়, মুশরিক বাহিনীকে সাহায্য করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।’’ (তাফসীরে দুররে মানছুর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৮)
অত্র আয়াতে ক্বালব বা হৃদয় প্রসঙ্গে এ কথা সুস্পষ্ট যে, প্রতিটি মানুষের শক্তির মূল উৎস মানুষের ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকামে বিরাজিত মহান আল্লাহ্। এজন্য মানুষ যদি মনের দিক থেকে শক্তিশালী হয়, ঐশ^র্যবান হৃদয়ের অধিকারী হয়, ক্বালব বা হৃদয়ে বিরাজিত আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসী হয়, তবে জীবনের যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও মানুষ সফলতা ও বিজয়ের দ্বার প্রান্তে উপনীত হতে পারে। বদরের যুদ্ধে পর্যায়ক্রমে এক হাজার, তিন হাজার, পাচঁ হাজার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহান আল্লাহ্ মুমিনদের ক্বালব বা হৃদয়ে সাহসের সঞ্চার করেছেন। অথচ প্রকৃত সাহায্য আল্লাহ্ই করে থাকেন। এজন্য যে মানুষ মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে, সে শত্রুর মোকাবিলায় পরাজিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে মনের দিক থেকে যারা সাহসী, অকুতভয় বীর সেনানী, বিজয় কেবল তাদেরই পদ চুম্বন করে।
এজন্য মহান আল্লাহ্ বলেন- তিনি বদরের যুদ্ধে ফেরেশতা দিয়ে সাহয্য করার প্রতিশ্রুতি এজন্য করেছেন যে, যেন এটি মুসলিম সৈন্যদের জন্য সুসংবাদ হয় এবং তাদের ক্বালব বা হৃদয় প্রশাস্তি লাভ করে। অর্থাৎ তারা নিশ্চিত বিজয় লাভের আশায় যেন আশান্বিত হয় এবং সে লক্ষ্যেই যেন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর বাস্তবে হয়েছিলও তাই। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন।
মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ভেদ ও বাতেনের দরিয়া ক্বালব বা হৃদয়ে অনন্ত রহস্য উপলদ্ধি করার তৌফিক দান করুন। আমীন!
[লেখক: তাফসীরকারক, বাংলাদেশ টেলিভিশন]