আল্লাহ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব
এ.আর. এম. মুহিউদ্দীন খান ফারুকী
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনায় ওহির বাণী আল কুরআনের ১৬নং আয়াত: মহান আল্লাহ বলেন- “অতি সত্বর আমি কাফিরদের ক্বালব বা হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব, কেননা তারা আল্লাহর এমন শরীক সাব্যস্ত করেছে, যার সপক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাজিল করেননি। আর তাদের ঠিকানা হলো দোযখ। কত নিকৃষ্ট জালিমদের আবাসস্থল।”
(সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৫১)
অত্র আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন মুশরিকদের কথা বলেছেন, যারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে। আর মুশরিকদের শিরকের পরিণাম জাহান্নাম। তারা পরকালে জাহান্নামি যেমন হবে, তেমনি এ দুনিয়ার জীবন হবে সংকীর্ণ। আর মুশরিকের শিরক, কাফিরের কুফরির পরিণাম এ দুনিয়ায় মহান আল্লাহ তাদের ক্বালব বা হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করে দেবেন।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর বাণী- “অতি সত্বর আমি কাফিরদের ক্বালব বা হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব, কেননা তারা আল্লাহর এমন শরীক সাব্যস্ত করেছে যার সপক্ষে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি।’’ [৩:১৫১) আল্লাহ আবু সুফিয়ানের ক্বালব বা হৃদয়ে ভীতি সঞ্চার করেছিলেন। এজন্য আবু সুফিয়ান যুদ্ধ থেকে ফিরে যান।
প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহই কাফির ও মুশরিকদের ক্বালব বা হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মহান ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কোনো নবিকে দেওয়া হয়নি। ১. এক মাসের দীর্ঘ পথ পর্যন্ত শত্রুর ক্বালব বা হৃদয়ে আমার নামের ভীতি সৃষ্টি করে দিয়ে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। ২. পৃথিবীর সমস্ত জমিনকে আমার জন্য মসজিদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৩. যুদ্ধলব্ধ মাল (গনিমত) আমার জন্য হালাল করা হয়েছে। ৪. আমাকে শাফায়াতের অধিকার দেওয়া হয়েছে। ৫. প্রত্যেক নবিকে বিশেষ কোনো সম্প্রদায় বা জাতির জন্য প্রেরণ করা হলেও আমাকে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির জন্য নবি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।” (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে তাফসীরে ইবনে কাছীর) উক্ত কিতাবে এ প্রসঙ্গে আরো একখানা হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবু উবামা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন- “সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের উপর এবং তাঁদের সকল উম্মতের উপর আমাকে চারটি বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যথা:- ১. সমগ্র মানবজাতির জন্য আমাকে নবি করে প্রেরণ করা হয়েছে। ২. আমার উম্মতের জন্য সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে সিজদাযোগ্য পবিত্র করা হয়েছে, ফলে যেখানেই নামাজের সময় উপস্থিত হয়ে যাবে, সেখানেই আমার উম্মত নামাজ আদায় করে নিতে পারবে। ৩. আমার শত্রু আমার থেকে এক মাসের পথের ব্যবধানে থাকলেও আল্লাহ তায়ালা আমার ঐ শত্রুর ক্বালব বা হৃদয়ে আমার ভয় প্রবেশ করিয়ে দেবেন। ৪. আমার জন্য গনিমতকে হালাল করা হয়েছে।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর)
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের এ বাণীসমূহে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, মানবদেহে ক্বালব বা হৃদয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ কর্তৃক কাফির ও মুনাফিকদের এ ক্বালব বা হৃদয়ে ভয় সৃষ্টি করে দেওয়ার কারণে, তারা প্রবল প্রতাপশালী সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত হয়েছে। এখানে আরো একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, ক্বালব বা হৃদয়ে ভয়ের সৃষ্টি হলে পুরো মানুষটিই দুর্বল হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে কারো ক্বালব বা হৃদয়ে অপরিসীম সাহসের সঞ্চার হলে, তা সমগ্র দেহে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং মানবদেহে ক্বালব বা হৃদয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সম্বলিত পবিত্র কুরআনের ১৭নং আয়াত:
মহান আল্লাহ বলেন- “তারপর তিনি তোমাদের উপর দুঃখের পর প্রশান্তি নাযিল করলেন তন্দ্রারূপে, যা তোমাদের একদলকে আচ্ছন্ন করেছিল। আর একদল ছিল যাদের বিব্রত করে রেখেছিল তাদের প্রাণের চিন্তা, তারা আল্লাহর প্রতি জাহেলি যুগের ধারণার ন্যায় অবাস্তব ধারণা করেছিল। তারা বলেছিল- এ ব্যাপারে আমাদের হাতে কি কিছু করার নেই? বলুন- নিশ্চয়ই, যাবতীয় বিষয় একমাত্র আল্লাহরই হাতে। তারা নিজেদের মনে গোপন রাখে, যা আপনার কাছে প্রকাশ করে না। তারা বলে- যদি আমাদের হাতে এ ব্যাপারে কিছু করার থাকত, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না। বলুন, যদি তোমরা নিজেদের ঘরেও থাকতে, তবুও যাদের নিহত হওয়া নির্ধারিত ছিলো, তারা বেরিয়ে পড়ত নিজেদের মৃত্যুর স্থানের দিকে। এসব এজন্য যে, আল্লাহ তোমাদের মনে যা আছে, তা পরীক্ষা করবেন এবং তোমাদের ক্বালব বা হৃদয়ে যা আছে, তা নির্মল করবেন। মনের গোপন বিষয় আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৫৪)
আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ ঐ সকল মুমিনের কথা বলেছেন, যারা উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল এবং আল্লাহর সাহায্য লাভ করেছিল। হযরত আবু তালহা (রা.) বলেন- “উহুদের দিন আমাকে তন্দ্রা এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিল যে, আমার হাত থেকে বারবার তরবারি খসে পড়ে যাচ্ছিল। খসে পড়ে, আবার ধরি, খসে যায়, আবার ধরি। তন্দ্রা আমাকে এতই আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।” এমনিভাবে আবু তালহা (রা.) আরো বলেন- উহুদের প্রান্তরে তন্দ্রা আমাদেরকে ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করেছিল। ফলে আমাদের হাত থেকে বারবার তরবারি আলগা হয়ে যেত। আমরা আবার এটি শক্ত করে মুঠোয় ধরে নিতাম। আবার আলগা হয়ে পড়ে যেত। তবে মুনাফিকদের দল ছিলো সদা ভীত সন্ত্রস্ত। তাদের জান বাঁচানো নিয়েই ছিলো তাদের ব্যস্ততা। আর পলায়নপর কপট দলটির উপর তন্দ্রা অবতীর্ণ হয়নি। অন্যদিকে ইমানদার লোকজন ছিলো সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর নির্ভরশীল।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সম্বলিত পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত এ ১৭নং আয়াতখানা সুদীর্ঘ। উপরোক্ত আলোচনাটুকু এজন্য যে, পাঠকবৃন্দ যাতে আয়াতের বিষয়বস্তু অবগত হতে পারেন। এ পর্যায়ে আলোচ্য বিষয়ের দিকে মনোনিবেশ করছি। আর তাহলো সুদীর্ঘ এ আয়াতখানায় মহান আল্লাহ ক্বালব বা হৃদয় প্রসঙ্গে কি বলেছেন- “এসব এজন্য যে, আল্লাহ তোমাদের মনে যা আছে তা পরীক্ষা করবেন এবং তোমাদের ক্বালব বা হৃদয়ে যা আছে, তা নির্মল করবেন। মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।” [৩:১৫৪]
মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, উহুদ যুদ্ধে এ বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে মুমিনদের জন্য বিরাট উপকারিতা নিহিত রয়েছে। আর তা হলো- মুমিনের ইমান যেমন তাঁর বক্ষস্থিত ক্বালবের ভেতর থাকে, তেমনি মুনাফিকের নিফাক বা কপট বিশ্বাসও তার বক্ষস্থিত ক্বালবের ভেতর থাকে। মহান আল্লাহ উহুদের যুদ্ধে মুমিনদেরকে বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি করে তাদের পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন যে, তারা যথার্থই মুমিন। প্রাণের ভয়ে তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করার মতো অবস্থায় পৌঁছে গেলেও তাদের ইমান, ক্বালব বা হৃদয়ের বিশ্বাস তাদেরকে পুনরায় ইমানের কাছে অর্থাৎ রাসুল (সা.)-এর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিনদের ইমানের অসংগতি দূর করে দেন। তাদেরকে পবিত্র করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য তৈরী করেন যে, তারা সর্বাবস্থায় নিজের জীবনের চেয়ে মহান আল্লাহ ও তাঁর শ্রেষ্ঠ মাহবুব হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসেন। অন্যদিকে মহান আল্লাহ কপট বিশ্বাসী মুনাফিকদের ক্বালব বা হৃদয়ে যে নিফাকী গোপন অবস্থায় ছিলো, উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাও প্রকাশ করে দেন। পরিশেষে মহান আল্লাহ জানিয়ে দেন- তিনি প্রত্যেকটি মানুষের ক্বালব বা হৃদয়ের প্রথম স্তর সুদুরে মোকামের অবস্থাদি সম্পর্কে মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞাতা, সবকিছু জানেন।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সম্বলিত পবিত্র কুরআনের ১৮নং আয়াত:
আল্লাহ বলেন- ‘‘হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা কুফরি করেছে এবং নিজেদের ভাইদের সম্বন্ধে বলে, যখন তারা পৃথিবীতে অভিযানে বের হয় কিংবা ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত হয়- তারা যদি আমাদের সাথে থাকত তবে মরতও না, নিহতও হতো না। যেন আল্লাহ এটাকে তাদের ক্বালব বা হৃদয়ের পরিতাপের কারণ করে দেন। আল্লাহই জীবন দেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তোমরা যা কিছুই করো, আল্লাহ সবকিছু দেখেন।”
(সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৫৬)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, “মুনাফিকরা বলে, যদি মুসলমানগণ মদীনায় আমাদের নিকট অবস্থান করত, তবে রাসুলের সাথে অভিযানে বের হয়ে মারাও যেত না এবং যুদ্ধেও নিহত হতো না। আর মুনাফিকরা এসব কথা বলত যেন আল্লাহ মুমিনদের ক্বালব বা হৃদয়ে চিন্তা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেন [ফলে মুমিনদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে এবং তারা পুনরায় রাসুল (সা.)-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধাভিযানে বের হবে না]। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- আল্লাহ তো এমনই সর্বশক্তিমান যে, তিনি ইচ্ছা করলে যুদ্ধাভিযানে জীবিত রাখেন, অন্যদিকে বাসস্থানেও মৃত্যু দিতে পারেন। অতঃপর আল্লাহ বলেন- তোমরা যা কিছুই করো এবং যা কিছুই বলো, মহান আল্লাহ সকলকেই দেখেন।” (তাফসীরে ইবনে আব্বাস, পৃষ্ঠা ৭০)
অত্র আয়াত ও হাদিসে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, মুনাফিকদের ভিত্তিহীন কথাবার্তা এজন্য যে, তারা চেয়েছিল- মুমিনদের ক্বালব বা হৃদয়ের শান্তি বিনষ্ট করতে, তাদের একাগ্রতা ও নিষ্ঠায় চিড় ধরাতে, তাদের অন্তরে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে। আর এ লক্ষ্যেই তারা বলত- মুসলমানগণ মোহাম্মদ (সা.)-এর আনুগত্য ও ভালোবাসা পরিত্যাগ করে আমাদের মতো মদীনায় পরিবার পরিজনের সাথে বসবাস করলে, তাদেরকেও মরতে হতো না। এসব কথাবার্তার ফলে জীবিত মুসলমানদের ক্বালব বা হৃদয়ে আফসোস সৃষ্টি করা এবং মোহাম্মদী ইসলামের মিনতি আনুগত্যের বলয়ের থেকে তাদেরকে বের করে নিয়ে আসাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো।
আসলে প্রতিটি মানুষই নিয়ন্ত্রিত হয় তার ক্বালব বা হৃদয়ের দ্বারা। মানুষের ক্বালব বা অন্তরে যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোদুল্যমান অবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন এর প্রভাব গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে ক্বালব বা হৃদয়ে যখন ইমানের নুর প্রজ্জলিত থাকে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্যের দৃঢ়তা অটল থাকে, তখন ক্বালব বা হৃদয়ের এ উত্তম অবস্থাও গোটা দেহে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঐ আদর্শ মুমিন ব্যক্তির দ্বারা একের পর এক উত্তম ও ভালো কর্মই প্রকাশ পেতে থাকে।
এজন্য মুনাফিকদের লক্ষ্য ছিলো- মুমিনদের ক্বালব বা হৃদয়ে যুদ্ধভীতি, মৃত্যু চিন্তা, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা ও অস্থিরতা জাগ্রত করে দেওয়া। তবে মুনাফিকদের এ উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কেননা মহান আল্লাহই তাঁর মুমিন বান্দার হেদায়েতকারী। তাঁরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মুমিন ব্যক্তির ক্বালব বা হৃদয়।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সম্বলিত পবিত্র কুরআনের ১৯নং আয়াত:
আল্লাহ বলেন- “আর আপনার প্রতি আল্লাহর রহমত থাকার দরুন আপনি তাদের প্রতি কোমল ক্বালব বা হৃদয়ের অধিকারী হয়েছিলেন; কিন্তু যদি আপনি কর্কশ স্বভাব ও কঠোর ক্বালব বা হৃদয়ের অধিকারী হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং আপনি তাদের মাফ করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আর কাজ-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। আর যখন কোনো সংকল্প করেন, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ভালোবাসেন তাঁর উপর ভরসাকারীদের।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৫৯)
অত্র আয়াতের যোগসূত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উহুদ যুদ্ধে কোনো কোনো সাহাবির যে পদস্খলন এবং তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাওয়ার দরূন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর স্বীয় ক্বালব বা হৃদয়ে যে আঘাত পেয়েছিলেন, যদিও স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমা, করুণা ও চারিত্রিক কোমলতার দরূন তিনি সেজন্য সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কোনো প্রকার ভৎর্সনা করেননি এবং কোনোরকম কঠোরতাও অবলম্বন করেননি, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গী-সাথীদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং এই ভুলের দরুন তাঁদের মনে যে দুঃখ ও অনুতাপ হয়েছিল, সে সমস্ত বিষয় ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেওয়ার লক্ষ্যে এ আয়াত নাজিল হয়। অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ মাহবুব হযরত রাসুল (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন- এটি আপনার প্রতি আপনার প্রতিপালক মহান আল্লাহর অপরিসীম দয়া যে, আপনি আপনার সঙ্গী-সাথী সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছেন। কেননা আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন ক্বালব বা হৃদয় সম্পন্ন হতেন, তাহলে আপনার সাহাবায়ে কেরাম আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।
আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ কোমল ক্বালব বা হৃদয়ের প্রশংসা যেমন করেছেন, তেমনি এ হৃদয়ের অধিকারী হওয়া কেবল আল্লাহর রহমতেই যে সম্ভব তাও পরিষ্কার করেছেন। অন্যদিকে অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ কঠোর ক্বালব বা হৃদয়ের পরিণতি যেমন বলে দিয়েছেন, তেমনি আল্লাহর পথে আহ্বানকারী মোর্শেদের করণীয়ও বলে দিয়েছেন।
সুতরাং আল্লাহ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব যেমন সর্বাধিক, তেমনি এ পথের মোর্শেদ তথা নবি, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামকে স্বীয় অনুসারীদের ক্ষেত্রে কোমল হৃদয় হতে হয়। অতঃপর কোমাল ক্বালব বা হৃদয়ে অনুসারীদের হিদায়েত তথা আলোর পথে এগিয়ে নিতে হয়। এ পথে গুরু-শিষ্য প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ, যা উভয়ের কোমল হৃদয় দ্বারাই সুসম্পন্ন হয়।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনায় ওহির বাণী আল কুরআনের ২০নং আয়াত:
মহান আল্লাহ বলেন- “এবং প্রকাশ করে দেবেন মুনাফিকদের। তাদের বলা হয়েছিল: এসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো অথবা শত্রুদের প্রতিরোধ করো। তারা বলেছিল: যদি জানতাম যুদ্ধ হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম। সেদিন তারা ইমানের চেয়ে কুফরির কাছাকাছি ছিল। তারা মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের ক্বালব বা অন্তরে নেই। আল্লাহ খুব ভালোভাবে জানেন, যা তারা গোপন রাখে।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ১৬৭)
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন- “যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) এক হাজার সৈন্য নিয়ে উহুদ ও মদীনার মধ্যবর্তী সওত নামক স্থানে পৌঁছেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল এক তৃতীয়াংশ সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ করে এবং মোহাম্মদ (সা.)-কে বলে যে, আপনি অন্যদের কথা শুনে মদীনার বাইরে এসেছেন, আপনি তো আমার কথা শুনলেন না। আল্লাহর শপথ! কোন কল্যাণের লক্ষ্যে আমরা প্রাণ বিসর্জন দেবো, তা আমার বোধগম্য নয়। অতঃপর সে বলল- হে লোক সকল! কেন তোমরা ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের উপর জীবন হারাতে যাচ্ছ? অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল কপট ও সন্দেহ পোষণকারী কতক মুনাফিকসহ সে যুদ্ধাভিযানে না গিয়ে পথ থেকেই ফিরে আসে। এ দৃশ্য দেখে বনু সালমার ভাই আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম তাদের নিকট গিয়ে বুঝিয়ে বললেন যে, হে আমার প্রিয় গোএ! তোমরা স্বীয় নবিকে ও স্বীয় সম্প্রদায়কে শত্রুদের হাতে অপদস্ত করো না। তাদেরকে শত্রুর মুখে নিক্ষেপ করে পলায়ন করো না। এরূপ অনুরোধের প্রেক্ষিতে তারা তাকে দূরভিসন্ধিমূলক জবাব দিলো যে, আমরা যদি জানতাম, সত্য সত্যই তোমরা শত্রুদের মোকাবিলায় যুদ্ধ করবে, তাহলে অবশ্যই আমরা তোমাদের সহযোগিতা করতাম। কিন্তু আমরা জানি যে, যুদ্ধ হবে না। তাদেরকে শত বুঝিয়েও যখন মুসলমানগণ ব্যর্থ হলেন, তখন মুসলমানগণ বলতে বাধ্য হলেন যে, দূর হও, আল্লাহর শত্রুরা, ভাগো। আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করুন। আমাদের সঙ্গে আল্লাহর সাহায্য রয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহর রাসুল (সা.) অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ মাঠের দিকে অগ্রসর হলেন। এদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেন- সেদিন তারা ইমানের চেয়ে কুফরির কাছাকাছি ছিল।’ আল্লাহর এ বাণীর দ্বারা এটি জানা যায় যে, মানুষের বিভিন্ন অবস্থা রয়েছে এবং তার অবস্থার পরিবর্তনও ঘটে। তখনও সে ইমান থেকে দূরে সরে কুফরির কাছাকাছি এসে পৌঁছে। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেন- সেই দিন তারা ইমানের তুলনায় কুফরির বেশি নিকটবর্তী ছিলেন।’’ (তাফসীর ইবনে কাছীর)
অতঃপর আয়াতের অবশিষ্টাংশে আল্লাহ বলেন- ‘‘তারা (মুনাফিকরা) মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের ক্বালব বা অন্তরে নেই। আল্লাহ খুব ভালোভাবে জানেন, যা তারা গোপন রাখে।’’ আল্লাহর এ বাণী মোবারকের মর্ম হচ্ছে- মুনাফিকদের মুখের কথার সঙ্গে ক্বালব বা হৃদয়ের কথার কোনো মিল নেই। যেমন তারা বলেছিল- আমরা যদি যুদ্ধ হবে বলে জানতাম, তাহলে অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে থাকতাম। অথচ তারা নিশ্চিতরূপে এ কথা জানত যে, ওহুদ প্রান্তরে মুশরিকরা মুসলমাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কারণ এর পূর্বে মুসলমানরা মুশরিকদের বড়ো বড়ো নেতাকে বদরের প্রান্তরে সম্মুখযুদ্ধে হত্যা করেছিল। কাজেই তারা সর্বশক্তি নিয়ে দুর্বল মুসলমানদের উপর ভীষণ আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত হয়েছিল। মোট কথা, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল ও তার সঙ্গীসাথীরা নিশ্চিত জানত যে, এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হতে চলেছে। এজন্য আল্লাহ বলেন- আল্লাহ ভালো করে জানেন তারা যা কিছু গোপন করে থাকে।
অতএব ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সম্বলিত এ ২০ নম্বর আয়াতের সারসংক্ষেপ এই যে, মহান আল্লাহ মানুষের ক্বালব বা হৃদয়ের খবর রাখেন। কে ক্বালবে কুফরি ও নিফাকি গোপন করে মুখে মুখে ইমানের দাবী করে আবার কে স্বীয় ক্বালব বা হৃদয়ে প্রকৃত ঘটনা গোপন করে, মুখে ছলছাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে, সর্বজ্ঞ আল্লাহ এ সবই জানেন। প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ মানুষের ক্বালব বা হৃদয়ের অবস্থা মূল্যায়ন করেন। যার ক্বালব বা হৃদয়ে ইমানের নুর রয়েছে, একইভাবে যে ব্যক্তি স্বীয় ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত মহামানবের প্রতি অবিচল বিশ্বাস লালন করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে মুমিনরূপেই চিহি“ত হবে। অন্যদিকে যে ব্যক্তি স্বীয় ক্বালব বা হৃদয়ে কুফরি, নিফাকি, অবিশ্বাস লালন করে, সে মুখে মুখে ইমানের দাবী করলেও লাভ নেই। আল্লাহর কাছে ক্বালব বা হৃদয়ের অবস্থাই বিবেচ্য। এজন্য আল্লাহ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব অপরিসীম।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনায় ওহির বাণী আল কুরআনের ২১নং আয়াত:
আল্লাহ বলেন- ‘‘তারা এমন লোক, যাদের ক্বালব বা অন্তরের বিষয়ে আল্লাহ জানেন। সুতরাং আপনি তাদের উপেক্ষা করুন এবং তাদের সদুপদেশ দিন। আর এমন কথা তাদের বলুন, যা তাদের মর্মস্পর্শ করে।’’ (সূরা আন নিসা ৪ : আয়াত ৬৩)
এ আয়াতের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। হযরত রাবী ইবনে আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- ‘‘আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর দুজন সাহাবির মধ্যে বিরোধ চলছিল। তাদের একজন মুমিন আর অপরজন ছিল মুনাফিক। মুমিন ব্যক্তিটি তার সাথীকে বিরোধ মীমাংসার জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নিকট যেতে আহবান জানাল। কিন্তু মুনাফিক সাথীটি মুমিন সাথীকে কা’ব ইবনে আশরাফের নিকট যেতে বলল। এ ঘটনা প্রসঙ্গে আল্লাহ নাজিল করেন- ‘‘যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তায়ালা যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসুল (সা.)-এর দিকে এসো, তখন আপনি মুনাফিকদেরকে দেখবেন, তারা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। (তাফসীরে দুররে মানছুর ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৮২) এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাল বলেন- ‘‘তারা এমন লোক যাদের ক্বালব বা হৃদয়ের বিষয়ে আল্লাহ জানেন। আর এ বাণীর মর্ম হচ্ছে- মুনাফিকরা মৌখিকভাবে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করলেও তাদের ক্বালব বা হৃদয়ে তা নেই। তারা কপট বিশ্বাসী, তাদের মুখে এক রকম এবং ক্বালব বা হৃদয়ে রয়েছে ভিন্ন রকম।
পরিশেষে ক্বালবের রোগে আক্রান্ত এ সকল মুনাফিকদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন- হে রাসুল (সা.)! আপনি তাদের উপেক্ষা করুন এবং তাদের সদুপদেশ দিন আর এমন কথা তাদের বলুন, যা তাদের মর্ম স্পর্শ করে।
ক্বালব বা হৃদয়ের বর্ণনা সম্বলিত ওহির বাণী আল কুরআনের ২২নং আয়াত:
আল্লাহ্ বলেন- ‘‘আর তারা তো অভিশপ্ত হয়েছিল তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য, আল্লাহর আয়াতসমূহের সাথে তাদের কুফরি করার জন্য, অন্যায়ভাবে নবিদের হত্যা করার জন্য এবং ‘আমাদের ক্বালব বা অন্তর সংরক্ষিত’ তাদের এ উক্তির জন্য বরং আল্লাহ তাদের ক্বালব বা অন্তরসমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন তাদের কুফরির কারণে। ফলে তারা খুব অল্প সংখ্যকই ইমান আনে।’’ (সূরা আন নিসা ৪ : আয়াত ১৫৫)
আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ ইহুদি জাতির কয়েকটি জঘন্যতম পাপের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এ সকল পাপের ফলে তাদের উপর আল্লাহর গজব ও অভিসম্পাত নাযিল হয়েছিল। একইভাবে এ সকল পাপের ফলে ইহুদিদের হিদায়েত ও সত্য পথ থেকে বিভ্রান্ত ও সুদূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। তাদের জঘন্যতম কয়েকটি পাপ হচ্ছে- তাদের নিকট থেকে আল্লাহ কর্তৃক দৃঢ়ভাবে গৃহীত অঙ্গীকার ভঙ্গ করা এবং নবিগণের মাধ্যমে আল্লাহ কর্তৃক প্রদর্শিত মুজিযাসমূহ ও নিদর্শনাবলীকে অগ্রাহ্য করা। এমনিভাবে ইহুদিরা বিপুল সংখ্যক নবিকে অন্যয়ভাবে হত্যা করেছিল। এর ফলে তারা আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্ত হয়েছিল। আর তারা অভিশপ্ত হয়েছিল এ কথার কারণে যে, ‘আমাদের ক্বালব বা হৃদয়সমূহ সংরক্ষিত।’
বর্ণিত আছে, ইহুদিরা গর্ব করে বলত- আমাদের ক্বালব বা অন্তরসমূহ সংরক্ষিত তথা আবৃত। উপদেশ দাতা নবিগণের কথা মিথ্যা। উহা আমাদের ক্বালবে প্রবেশ করবে না। প্রকৃতপক্ষে ইহুদিদের ক্বালব বা হৃদয় ছিল জঘন্যতম সত্যদ্বেষী। এতে কুফর অত্যন্ত গভীরভাবে অংকিত হয়ে গিয়েছিল। তারা নবিদের প্রতি বিদ্বেষভাব ত্যাগ করে সত্য গ্রহণে কোনোরূপ প্রস্তুত ছিল না। মহান আল্লাহ ইহুদিদের এই কুফরির কারণে তাদের ক্বালব বা অন্তরসমূহ মোহরাঙ্কিত করে দেন। ফলে তাদের ক্বালবে ইমানের নুর প্রবেশ করেনি এবং সত্যও তাদের ক্বালবে প্রবেশ করতে পারত না।
মূলে ক্বালব বা হৃদয়ই হিদায়েতের কেন্দ্রবিন্দু। আল্লাহ যার ক্বালবকে ইমানের জন্য খুলে দেন, কেবল সেই হিদায়েতের পথের সন্ধান লাভ করে। অন্যদিকে আল্লাহ যার ক্বালবকে তালাবদ্ধ করে দেন অথবা মোহরাঙ্কিত করে দেন। তাদের ভাগ্যে আর হিদায়েত জুঁটে না।
সুতরাং আল্লাহ প্রাপ্তির সাধনায় ক্বালবের গুরুত্ব অপরিসীম। দরজা বিহনে যেমন ঘরে প্রবেশ করা যায় না, তেমনি ক্বালব বিহনে আল্লাহময় জগতে প্রবেশ করা যায় না।
[লেখক: তাফসীরকারক, বাংলাদেশ টেলিভিশন]