আশেকে রাসুল হওয়ার গুরুত্ব – হযরত সাব্বির আহমাদ ওসমানী
আশেক আরবি শব্দ, যার বাংলা প্রেমিক। প্রেম শব্দটিও ব্যাপক প্রচলিত, আরবি এশক থেকে আশেক। (আশেক-মাশুক) প্রেম থেকেই প্রেমিক। এ দুটি শব্দই মূলত আরবি। আশেকে রাসুল অর্থ রাসুলের প্রেমিক। যে হযরত রাসুল (সা.)-কে মন দিয়ে ভালোবাসে তাকে আশেকে রাসুল বলা হয়ে থাকে। যে হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসে সেই আশেকে রাসুল।
আমরা যদি একটু লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো সৃষ্টি জগতের সবাই হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসে, তবে এর মধ্যে একটু তারতম্য আছে। আবার শয়তান রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসে না। তাই রাসুল যেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেদিন মহান আল্লাহ্ হেসেছিলেন খুশি হয়ে, আর শয়তান সেদিন কেঁদেছিল, বেজার হয়ে। নয়তো কুল কায়েনাতের সবাই খুশি ছিল। কারণ, সৃষ্টির সবাই রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসেন। যেমন- আকাশ, জমিন, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, নভোমন্ডল-ভূমণ্ডল, আরাশ-কুরসি, লওহো-কলম, জান্নাত-জাহান্নাম, হুর-গেলমান, জিন-ফেরেশতা, নবি-রাসুল, বৃক্ষ-তরুলতা, পশু-পাখি, পানির নিচের মাছ, গর্তের পিপীলিকা সবাই নবিকে ভালোবাসে। জগতের সবচাইতে যিনি রাসুল (সা.)-কে বেশি ভালোবাসেন তিনিই হলেন মহান রাব্বুল আলামিন। তাই কুল-কায়েনাতের সবচেয়ে বড়ো আশেকে রাসুল হলেন মহান আল্লাহ্ পাক। তারচেয়ে বেশি ভালো কেউ বাসতে পারেনি। কারণ আল্লাহ্ তায়ালা রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার কারণে তামাম জগৎ সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ্ হাদিসে কুদসিতে বলেন- “লাও লাকা লামা খালাক্বতুল আফলাক।” অর্থাৎ- “হে রাসুল (সা.) আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কুল কায়েনাতের কিছুই সৃজন করতাম না।” (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০) তাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্র চাইতে বেশি কেউ রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসতে পারবে না।
মানুষের মধ্যে একটি শ্রেণি আছে, যারা হযরত রাসুল (সা.)-কে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। রাসুলের যুগের দিকে তাকালেও দেখা যায় যে, রাসুল (সা.)-কে হত্যার জন্য তির ছুড়েছে, আবার অপরদিকে যারা রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসেছিল তারা মাশুকের জীবন বাঁচাতে সেই তির নিজের বুকে ধারণ করেছে। নবির প্রেমে তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে শহিদ হয়েছেন। তবুও নবির গায়ে এতটুকু আচর লাগতে দেননি। তাঁরা ছিলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর সাহাবি। তারা ছিলেন সত্যিকারের আশেকে রাসুল, যেমন আশেকে রাসুল হযরত বেলাল (রা.), আশেকে রাসুল ওয়াছকরনি (রহ.), আশেকে রাসুল হযরত হানজালা (রা.), আশেকে রাসুল হযরত জায়েদ ইবনে হারেস (রা.) প্রমুখ।
সৃষ্টির আদি থেকে অদ্যাবধি যুগে যুগে নবি রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরাম যারা পৃথিবীতে এসেছেন এবং আসছেন সকলইে রাসুল প্রেমিক। মহান আল্লাহ্ নিজেই রাসুলের আশেকে হওয়ার জন্য তাগিদ প্রদান করেছেন। কারণ যারা রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসেন তারাইতো নবির এত্তেবা করবেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “হে মাহবুব (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়।” (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৩১) উক্ত আয়াতে একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মহান আল্লাহ্ নিজেকে ভালোবাসার পরিবর্তে রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে আনুগত্য করতে বলেছেন। অর্থাৎ রাসুলের আনুগত্য করলে মহান আল্লাহ্ নিজে তাকে ভালোবাসবেন এবং তার সমস্ত পাপ মার্জনা করে দিবেন। [“হে রাসুল (সা.) আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কুল কায়েনাতের কিছুই সৃজন করতাম না।” (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০)] যার খাতিরে আল্লাহ সৃষ্টি জগত তৈরি করেছেন। সুতরাং এতেই বুঝা যায়, তাঁর মর্যাদা কতটুকু? তাই নবিকে ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তানসন্তুতি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭ এবং মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯) অন্য হাদিসে বলা হয়েছে- ‘নাফসিহি’ অর্থাৎ-তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসবে সে ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না। এ হাদিসের বাস্তব নমুনা আমরা দেখতে পাই সাহাবায়ে আজমাইনের জীবনে। তাঁরা হযরত রাসুল (সা.)-কে এত বেশি ভালোবাসতেন যে, তাঁরা তাঁদের মূল্যবান জীবন পর্যন্ত রাসুলের জন্য বিলিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার কারণে ‘আশারায়ে মোবাশ্বেরা’ ১০ জন সাহাবি দুনিয়াতে থেকেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন। এক কথায় হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার নামই হলো ইমান। যে রাসুল (সা.)-কে যতটুকু ভালোবাসবে সে হতে ততটুকু ইমানদার।
হযরত রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার বৈশিষ্ট্যসমুহ
১। রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) জগতে এসেছেন রহমত স্বরূপ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “আমি আপনাকে জগতসমূহের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করছি।” (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) মহান আল্লাহ্ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কুরআনে এরশাদ করেন- “আলহামদুল্লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন” অর্থাৎ- “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।” (সূরা ফাতেহা ১: আয়াত ১) হযরত রাসুল (সা.) সম্পর্কে বলেন ‘রাহ্মাতুল্লিল আলামিন’ অর্থাৎ ‘জগতসমূহের রহমত’।
২। নবি করীম (সা.) ছিলেন দয়া মমতার সাগর। উম্মতের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মায়া। সীমাহীন মমতা এবং তাদের কল্যাণ সাধনে ছিলেন সদা ব্যাকুল ব্যতিব্যস্ত। উম্মতকে তিনি নিঃস্বার্থ ভালোসতেন। তিনি তাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাননি, আর কৃতজ্ঞতা কামনা করেনি। চাইতেন শুধু তাদের নাজাত ও সফলতা। একান্ত জাগতিক বিষয়েও উম্মতের বিপদ আপদে নবিজি ছিলেন নিঃস্বার্থ সহযোগিতার আধার। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন যে, হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “দুনিয়া ও আখেরাতে আমি প্রত্যেক মু’মিনেরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতর। হাদিস শরীফে এসেছে- মুমিনদের কাছে নবি তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ।” (বোখারী ৪৭৮১) উম্মতের প্রতি নবির ভালোবাসা সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক বলেন- “তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল। তার পক্ষে অতি দুঃসহ-দুর্বহ সেসব বিষয় যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে, তিনি তোমাদের অতিশয় হিতকামী, মু’মিনদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল, খুবই দয়ালু।” (সূরা তাওবা ৯: আয়াত ১২৮) তাই যে নবি উম্মতের জন্য এতটা মহানুভব ছিলেন সেই নবির প্রতি উম্মতের আচরণ কেমন হওয়া চাই?
৩। মু’মিনের জীবনে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। মহব্বতে রাসুল তো ইমানের রুহ, মু’মিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই এশক ও মহব্বত ছাড়া ইমানের পূর্ণতা আসে না। আর নিছক ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং পার্থিব সমস্ত কিছুর উপর এই ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হবে। এমনকি হযরত রাসুল (সা.)-কে নিজের জানের চেয়েও অধিক ভালোবাসতে হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম (রা.) বলেন- “একদিন আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে ছিলাম। হযরত রাসুল (সা.) ওমর (রা.)-এর হাত ধরা ছিলেন। ওমর (রা.) বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আপনি আমার কাছে সবকিছুর থেকে প্রিয়, তবে আমার জানের চেয়ে বেশি নয়। তখন আল্লাহ্র রাসুল (সা.) বলেন, না ওমর, এতে হবে না। যে সত্তার হাতে আমার জান রয়েছে, তার কসম! ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণাঙ্গ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জানের চেয়েও প্রিয় না হই। পরক্ষণেই হযরত ওমর (রা.) বলেন হাঁ, এখন তা হয়েছে।” আল্লাহ্র কসম! (এখন থেকে) আপনি আমার কাছে আমার জানের চেয়েও প্রিয়। তখন নবিজি (সা.) বললেন, হাঁ ওমর! এখন হয়েছে। (বুখারী হাদিস ৬৬৩২) আল্লাহ্ ও আল্লাহ্র রাসুলের ভালোবাসা যদি সবকিছুর উপরে না হয় তাহলে মু’মিন পথ চলবে কীভাবে?
৪। পৃথিবীতে মু’মিনের সবচেয়ে বড়ো দৌলত হচ্ছে তার ইমান। এই মহাদৌলতের স্বাদ যার নসিব হয়, সমস্ত দুঃখ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। আর এই স্বাদ সেই পায়, যার নিকট আল্লাহ্ ও রাসুলের ভালোবাসা সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে থাকে। হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- তিনটি গুণের অধিকারী ব্যক্তি ইমানের স্বাদ আস্বাদন করবে। তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে, “তিনি যার কাছে আল্লাহ্ ও রাসুল সবচেয়ে প্রিয় হবে।” (মুসলিম হাদিস ৪৯)
নবিজির প্রতি ভালোবাসা যেমনিভাবে ইমান ও আমলে উৎকর্ষ লাভের উপায়, তেমনি তা আখিরাতে মহা সাফল্য অর্জনের সম্বল। আর প্রত্যেক মু’মিনের কাক্সিক্ষত সেই সাফল্য হলো আখিরাতে হযরত রাসুল (সা.)-এর সঙ্গ লাভ। হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “তুমি তারই সঙ্গী হবে যাকে তুমি ভালোবাস।” (মুসলিম শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৩১) এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, “ইয়া রাসুলাল্লাহ্! কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে? তিনি বললেন, তুমি কিয়ামতের জন্য কী পাথেয় সঞ্চয় করেছ? সে বলল, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তুমি তাঁর সঙ্গে উঠবে (কিয়ামতের দিন) যাকে তুমি ভালোবাস।” হযরত আনাস (রা.) বলেন, ইসলাম গ্রহণের পরে কোনো কিছুতে আমরা এত বেশি খুশি হইনি যতটা নবি (সা.)-এর বাণী- ‘তুমি তার সঙ্গেই (থাকবে) যাকে তুমি ভালোবাস’ দ্বারা আনন্দ লাভ করেছি। (মুসলিম শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৩২)
৫। স্বীকৃত বাস্তবতা হলো- যে যাকে ভালোবাসে সে তার কথা বেশি বলে। বারবার তার আলোচনা করতে থাকে। সুতরাং নবি প্রেমিকের কাজই হবে তাঁর আনুগত্য। সে যত বেশি তাঁর স্মরণ করবে, ততই তার অন্তরে তাঁর প্রতি মহব্বতে দেওয়ানা হতে থাকবে। দরুদ পাঠ হলো এশকে রাসুলের স্থায়িত্ব ও প্রবৃদ্ধির কারণ। তাছাড়া দরুদ পাঠ তো এমনিতেই অনেক ফজিলত ও রহমতের বিষয়। আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মু’মিনদেরকে দরুদ পাঠের আদেশ করে বলেছেন- “নিশ্চয় আল্লাহ্ স্বয়ং ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবির উপর দরুদ পাঠ করেন। হে মু’মিনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ পড় এবং শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬) হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যে রাসুল (সা.)-এর উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত দান করবেন।” (তাফসীরে মাজহারী ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭৮)
৬। হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত ছিলেন সাহাবায়ে আজমাইন। তাঁরা সত্যিকার নবি প্রেমের বেনজির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণের আগেই এই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, আমি কাউকে এতটা ভালোবাসতে দেখিনি, মোহাম্মদ (সা.)-কে তার সঙ্গীরা যতটা ভালোবাসে। হযরত রাসুল (সা.)-কে সাহাবায়ে কেরাম যে পরিমাাণ ভালোবেসেছে তা ইতিহাসে বিরল। হযরত হানজালা (রা.) নবির প্রেমে জীবন দিয়েছেন। ফরজ গোসলের কথা পর্যন্ত ভুলে গেছেন। তাই আল্লাহ্ তাকে জান্নাতী পানি দিয়ে গোসল করিয়েছেন। এমন বহু নজির বিদ্যমান।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মৃত্যুশয্যায় আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হযরত রাসুল (সা.) কোন দিন ওফাত লাভ করেছেন? তখন হযরত আয়েশা (রা.) জানালেন, সোমবার। তিনি বললেন, আজ কি বার? জবাব দিলেন- সোমবার। তিনি [আবু বকর (রা.)] বললেন, আমি আশা করি এখন থেকে আগত রাতের মধ্যে (আমার মৃত্যু হবে)।” (বুখারী, হাদীস ১৩৮৭)
ভালোবাসার দৃষ্টান্ত দেখুন। আমার মৃত্যুও যেন হয় সেদিনে যে দিনে প্রেমাষ্পদের ওফাত হয়েছিল। হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “যখন যুদ্ধের সময় উপস্থিত হলো, তখন রাতের বেলা আমার পিতা আমাকে ডেকে বললেন, আমার মনে হয় যে, নবি করিম (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে যাঁরা প্রথম শহিদ হবেন, আমি তাঁদের মধ্যে একজন হবো। আর আমি আমার (মৃত্যুর) পরে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) ব্যতীত তোমার চাইতে অধিকতর প্রিয় কাউকে রেখে যাচ্ছি না।” (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ১৩৫১)
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি ওহুদ যুদ্ধের এক পর্যায়ে সাহাবায়ে কেরাম নবি করিম (সা.) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তখন হযরত আবু তালহা (রা.) ঢাল হাতে নিয়ে নবি করিম (সা.)-এর সম্মুখে প্রাচীরের ন্যায় অটল হয়ে দাঁড়ালেন। …. এক সময় নবি করিম (সা.) মাথা উঁচু করে শত্রুদের অবস্থা অবলোকন করতে চাইলে হযরত আবু তালহা (রা.) বললেন, হে আল্লাহ্র নবি! আমার মাতা পিতা আপনার জন্য কোরবান হউক, আপনি মাথা উঁচু করেবন না। হয়ত শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তির এসে আপনার গায়ে লাগতে পারে। (বুখারী শরীফ, হাদিস নং ৩৮১১)
আরেক মহিলা সাহাবির ঘটনা- সেটা আরো বিস্ময়কর। উহুদ যুদ্ধেরই ঘটনা। হযরত রাসুল (সা.) বনু দীনারের এক নারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যার স্বামী ও ভাই উহুদ যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। লোকেরা যখন তাকে মর্মবেদনা জানাতে গেলো তখন তিনি জানতে চাইলেন, নবিজি কেমন আছেন? তারা বললো ভালো আছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তাতেও তার মন শান্ত হলো না। বললেন, তবুও আমি নিজে দেখতে চাই, আমাকে দেখাও। অতঃপর যখন তাকে দেখানো হলো, তিনি বললেন, আল্লাহ্র রাসুল আপানি নিরাপদ আছেন। আপনার (নিরাপত্তার) পরে সমস্ত বিপদ তুচ্ছ।
এরকম আরো বহু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সাহাবায়ে কেরাম। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পরবর্তীরাও নবি প্রেমের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাতে পারে, আল্লাহ্ তায়ালা যেন আমাদের সকলের হৃদয়ে নবির প্রতি ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দেন।
ইতিপূর্বে আমরা আশেকে রাসুল, তথা নবি প্রেমিকের আলোচনা করেছি। এবার আমরা দেখবো যারা হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসেনা বা তাঁর সাথে দুশমনি পোষণ করে তাদের পরিণাম কী। হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে দুশমনি বা বেয়াদবি ও বিদ্বেষ পোষণকারীর ইবাদত আল্লাহ্র দরবারে কবুল হবে না বা কোনো কাজে আসবে না এবং তাদের উপর আল্লাহ্র লানত। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “আর যে ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দিলো, সে আল্লাহ্ তায়ালাকেই কষ্ট দিলো। যে আল্লাহ্কে কষ্ট দিলো, শীঘ্রই তিনি তাকে পাকড়াও করবেন। (তিরমিজি শরীফ পৃষ্ঠা ২২৫)
পবিত্র কুরআনের বাণী- “যারা আল্লাহ্কে ও তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ্ অবশ্যই তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লানত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৭) মহান আল্লাহ রাসুলের শানে বলেন- “ওহে যারা ইমান এনেছো! তোমরা উঁচু করো না, তোমাদের কণ্ঠস্বর নবির কণ্ঠস্বরের উপর এবং তোমরা এমন উচ্চস্বরে তাঁর সাথে কথা বলো না। যেমন তোমরা একে অপরের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলে থাকো। এতে তোমাদের কর্মফল বিনষ্ট হয়ে যাবে, অথচ তোমরা টেরও পাবে না।” (সূরা হুজুরাত ৪৯: আয়াত ২)
আবু জাহেল রাসুলের সাথে দুশমনি করার কারণে তার ইহ ও পরকাল লানত পেয়েছে। তার নাম ছিল আবুল হাকাম অর্থ জ্ঞানীর পিতা, হযরত রাসুল (সা.) তার প্রতি নাখোশ হয়ে নাম দিয়েছিলেন আবু জাহেল- অর্থ মূর্খের পিতা। জগদ্বাসী আজ তাকে আবু জাহেল হিসেবেই চিনে। আবু লাহাব নবির সাথে দুশমনি করার কারণে মহান আল্লাহ্ তাকে অভিসম্পাত দিয়েছেন। এ সম্পর্কে কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।” (সূরা লাহাব ১১১: আয়াত ১)
আল্লাহ্ তায়ালা অন্যত্র বলেন- “তারা কি এ কথা জানেনি যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেথায় সে অনন্তকাল থাকবে। এটা বিষম লাঞ্চনা।” (সূরা তাওবা ৯: আয়াত ৬৩)
মূলকথা, হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে যারা দুশমনি করবে তারা দুনিয়া ও পরকালে পরিত্যায্য। ভালো মানুষ কখনো রাসুলের সাথে দুশমনি করতে পারে না। হযরত রাসুল (সা.)-কে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ইমানদার হতে হবে। তাই মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেছেন- “যে রাসুল (সা.)-কে যতটুকু ভালোবাসবে সে হবে ততটুকু ইমানদার।”
দয়াল রাসুলের আশেক বানানোর জন্যই যুগে যুগে অলী-আল্লাহ্গণ জগতে আগমন করে থাকেন। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) সারা জীবন মানুষকে রাসুলের আশেক হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান একজন উচ্চস্তরের অলী-আল্লাহ্, যুগের মোজাদ্দেদ ছিলেন। তাঁর লক্ষ লক্ষ অলৌকিক কারামত রয়েছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের বহু সংস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি মানুষকে ৪টি শিক্ষা দিয়েছেন, ১। আত্মশুদ্ধি ২। দিলজিন্দা ৩। নামাজে হুজুরি ও ৪। আশেকে রাসুল হওয়া। আশেকে রাসুল হওয়ার কথাটি তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই শিক্ষা গ্রহণ করে আশেকে রাসুল হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর দিদার পেয়ে ধন্য হয়েছেন।
দয়াল মোর্শেদ বাবা দেওয়ানবাগীর ওফাতের পরে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারীর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সূফী সম্রাটের প্রচারিত মোহাম্মদী ইসলামের কাণ্ডারী হয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী এ শিক্ষা প্রচার করে যাচ্ছেন।
[লেখক: ইসলামি আলোচক, সদস্য, দেওয়ানবাগীর দল ওলামা মিশন বাংলাদেশ; সাবেক খতিব, দারুল ফালাহ্ জামে মসজিদ, রিয়াদ, সৌদি আরব]