ইমানের নুর: তাসাউফভিত্তিক পর্যালোচনা
আশেকে রাসুল এস এ সুলতান
জন্ম হতে মৃত্যু অবধি মানুষ যে সময়টা অতিবাহিত করে, তা তাৎপর্যপূর্ণ হওয়া খুবই জরুরি। কেননা যে কোনোভাবে জীবন অতিবাহিত করার মাধ্যমে জীবনের কোনো সার্থকতা থাকে না। মানুষের জীবন সার্থক করতে হলে জীবনের উদ্দেশ্য অন্বেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় জীবন হয় অন্ধকারে নিপতিত। অন্ধকার হতে মুক্তির জন্য আলোর অন্বেষণ করে আলোকময় জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আলোকময় জীবন কী? প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ মনে করে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করার লক্ষ্যে, পার্থিব জ্ঞান আহরণ করার মাধ্যমে আলোকময় জীবন লাভ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে এটি আলোকময় জীবনের সঠিক পন্থা নয়।
আলোকময় জীবনে বাস্তবে আলোর সন্ধান পেতে হয়, যার মাধ্যমে মানুষ জীবনে ও মরণে শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজে পেতে পারে। রাতের আঁধারে আলো ব্যতীত পথ চলা যায় না, পদে পদে বিপদ এমনকি মৃত্যুরও সম্ভাবনা থাকে। জীবন চলার জন্য প্রয়োজন আলোর। আর এই আলো হচ্ছে ইমানের আলো, যা কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়, যে রকম সমাজের মানুষ মনে করে, ইমানের আলোর বাস্তব রূপ বিরাজমান, যা মানুষ সরাসরি করে থাকে। ফলে সে জীবনে ও মরণে অফুরন্ত শান্তি লাভ করার মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হয়। আসলে আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন, নুরে ইমান বলতে কী বুঝায়?
মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান তাঁর প্রণীত তাফসীর শরীফ ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ গ্রন্থে নুরে ইমানের বাস্তবিক রূপ এবং এর তাৎপর্যের সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি পবিত্র কুরআনের আয়াত ও মারফু হাদিস উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “মরুবাসীরা বলে- আমরা ইমান এনেছি। হে মাহবুব (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা মুমিন নও। বরং তোমরা বলো, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। আর (এটি এই জন্য যে), ইমানের নুর এখনও তোমাদের ক্বালবে প্রবেশ করেনি।
কাজেই যদি তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো, তবে তিনি তোমাদের কর্মফল একটুও নষ্ট করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়।” (সূরা আল হুজুরাত-৪৯:আয়াত ১৪)
এ প্রসঙ্গে তাফসীরে দুররে মানসুরের ২৬নং খণ্ডের ৫৮৩ পৃষ্ঠায় ইমাম আহমদের সূত্রে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন- “ইসলাম হচ্ছে প্রকাশ্য কর্ম, আর ইমান হচ্ছে, ক্বালব বা অন্তরের বিষয়- এ কথা বলে তিনি স্বীয় বুকের দিকে তিনবার ইশারা করেন। আর বলেন- খোদাভীতির স্থান এখানে, খোদাভীতির স্থান
এখানে অর্থাৎ ক্বালব বা অন্তরে।” হাদিসের কিতাব ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফের ১ম খণ্ডের ৬৫ পৃষ্ঠায় ৬৫নং হাদিসে আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য, আমিরুল মুমিনিন শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন- “ইমান হচ্ছে ক্বালবের মারেফাত জানা (ক্বালবের ভেতরে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে), মুখে তাঁর স্বীকৃতি দেওয়া এবং কর্মের মাধ্যমে তাঁর ভিত্তি বাস্তবায়ন করা।”
উল্লিখিত পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহ ও হযরত রাসুলে পাক (সা.)-এর হাদিসের ব্যাখ্যা দ্বারা বোঝা যায়- যারা স্বীয় ক্বালবে ইমানের নুর ধারণ করে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করেছে, মহান আল্লাহ্ তাদের কর্মফল নষ্ট করবেন না।
বরং তিনি তাদের প্রতি পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়। অর্থাৎ তিনি তাদেরকে ক্ষমা করেন ও দয়া করেন। প্রকৃতপক্ষে ক্বালবে ইমানের নুর প্রবেশ না করা পর্যন্ত কেউ মু’মিন হতে পারে না। এ জন্য কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, “ইমান হচ্ছে নুর, জ্যোতি বা আলো। আর কুফর হচ্ছে অন্ধকার।” হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আল্লাহর কসম। কোনো ব্যক্তির ক্বালবে সেই পর্যন্ত ইমান প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমার আপনজন তথা আমার আহলে বাইতকে শুধুই আল্লাহর জন্য ভালো না বাসবে।”(সুনানে ইবনে মাজাহ ১ম খণ্ড, ই. ফা. বা. কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নং ১৪০, পৃষ্ঠা ৯০ ও ৯১)
তিনি আরও ফরমান- “যার ক্বালবে সরিষার দানা পরিমাণ ইমান রয়েছে, সে জাহন্নামে প্রবেশ করবে না।” (ইবনে মাজাহ ১মখণ্ড, ই. ফা. বা. কর্তৃক অনূদিত, হাদিস নং ৫৯, পৃষ্ঠা ৬১) সুতরাং মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর বাণী মোবারক হতে এ কথা সুস্পষ্ট যে, ইমানের অবস্থান মুমিনের ক্বালবে। এটি আল্লাহর নুর বিশেষ। এটি বই পুস্তক থেকে আহরিত কোনো বিশেষ জ্ঞান নয়। এজন্য আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “আল্লাহ্ যাকে চান, তাকে নুরের দিকে তুলে নেন।” (সূরা আল নুর-২৪: আয়াত ৩৫)
ইমানের নুর লাভ করার জন্য হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবত লাভ করা শর্ত। কেননা হযরত রাসুল (সা.) হলেন- আল্লাহর সিরাজুম মুনিরা তথা প্রজ্বলিত প্রদীপ। মহান আল্লাহ্ তাঁর নিজের উপমা দিয়েছেন- “আমি হলাম জ্বালানো বাতির মতো এবং আমার রাসুল হলেন জ্বালানো বাতি।” আর নিভানো বাতিকে জ্বালাতে হলে জ্বালানো বাতির আগুনের সাথে মিশিয়ে জ্বালাতে হয়। এজন্য আরবের বর্বর মানুষগুলো হযরত রাসুল (সা.)- এর সহবতে এসে তাঁর মাঝে বিরাজমান সিরাজুম মুনির তথা প্রজ্বলিত প্রদীপ থেকে নিজেদের অন্ধকার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে মুমিন হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- “তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে এক বিশেষ নুর বা জ্যোতি ও একটি প্রকাশ্য কিতাব। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, এ বিশেষ নুর দিয়ে তিনি তাদের শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং তাদের তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন স্বীয় অনুমতিμমে। আর তাদের তিনি পরিচালিত করেন সরল সঠিক পথে।” (সূরা আল মায়িদাহ-৫: আয়াত ১৫ ও ১৬)
এজন্য নবুয়তের যুগে মুক্তিকামী মানুষকে মহান আল্লাহর প্রেরিত মহামানব তথা নবি ও রাসুলগণের সানিড়বধ্যে গিয়ে ইমানের নুর হৃদয়ে লাভ করে মু’মিন হতে হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে মুক্তিকামী মানুষকে হযরত রাসুল (সা.)-এর সিরাজুম মুনিরের ধারক ও বাহক আওলিয়ায়ে কেরামের সানিড়বধ্যে গিয়ে হৃদয়ে ইমানের নুর লাভ করে মু’মিন হতে হয়। এজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- “আমি আদম সন্তানদের প্রত্যেক যুগের উত্তম শ্রেণিতে যুগের পর যুগ প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর ঐ যুগে প্রেরিত হয়েছি, যে যুগে আমি বর্তমানে আছি।” (বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৩,
মেশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ৫১১) আর নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে হযরত রাসুল (সা.)-এর সিরাজুম মুনির যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও আউলিয়ায়ে কেরামের মাঝে বিরাজ করে বলেই আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ
করেছে যুগের ইমাম বিহনে অর্থাৎ আনুগত্য না করে, সে জাহেলি অবস্থায় তথা ধর্মহীন বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।”(মুসনাদে আহমদ, ১৩নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৮)
সুতরাং উল্লিখিত হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) যুগের ইমামের আনুগত্যের কথা বলেছেন। অর্থাৎ যে যুগের ইমামের আনুগত্য করে, সে হযরত রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করে, আর যে ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করে। এজন্য দেখা যায়, বেলায়েতের যুগে যুগের ইমামের দরবার শরীফ থেকে হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া শান্তির ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার করা হয়। ফলে যে কোনো মুক্তিকামী মানুষ মু’মিন হওয়ার আশা নিয়ে যখন যুগের ইমামের সহবতে হাজির হয়, তখন তিনি হযরত রাসুল (সা.)-এর অনুকরণে আগন্তুককে তওবাহ ইস্তেগফারসহ কালেমা তাইয়্যেবা তথা তাওহিদ ও সালতের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করে স্বীয় শাহাদত অঙ্গুলি মোবারক আগন্তুকের ক্বালবে স্পর্শ করে দেন। ফলে যুগের ইমামের সিরাজুম মুনির বা প্রজ্বলিত প্রদীপ থেকে আল্লাহ্ শব্দের জীবন্ত নুর ঐ মুরিদের ক্বালবে প্রবেশ করে মৃত ক্বালবকে জীবিত করে দেয়। আর আল্লাহ্ শব্দের এ নুরটি যখন মুরিদের ক্বালবে বসে যায়, তখনি সে মু’মিন হয় এবং তার হৃদয় আলোকিত হয়। এমনিভাবে যুগের ইমাম বা মোর্শেদের ক্বালব থেকেই মুরিদের ক্বালবে ইমান প্রবেশ করে। আর মুরিদ যখন মোর্শেদের কাছ থেকে নুরে মোহাম্মদীর নুর স্বীয় হৃদয়ে লাভ করে, তখনি তার হৃদয়ে আল্লাহ্ নামের জিকির চালু হয়ে যায়। এ জিকির আল্লাহর রহমতে সব সময়ই চলতে থাকে। অতঃপর মুরিদকে সাধনার মাধ্যমে মোর্শেদের কাছ থেকে ফায়েজ হাসিল করে পরম যতেড়বর সাথে ইমানের এ নুরকে লালন করতে হয়। সময়ের ব্যবধানে মুরিদের অন্তরে এ নুরে মোহাম্মদীর নুর থেকেই ইমানের শিশুর জন্ম হয়, যাকে তাসউফের পরিভাষায় হায়াতে ওয়াহদানিয়্যাত বা তিফলুল মা’আনি বা নুরের শিশু বলা হয়। মুরিদ যখন এ অবস্থায় উপনীত হয়, তার মাঝে সৃষ্ট এ নুরের শিশু, নুরে মোহাম্মদীর ধারক মোর্শেদকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করে থাকে। কেননা ঐ সত্তার পিতা মোর্শেদ।
সুতরাং মুসলমান হওয়া তথা ইসলাম গ্রহণ করা আর মু’মিন হওয়া এক জিনিস নয়। মুসলমান হলো- আত্মসমর্পণ করে ইসলামে প্রবেশ করা। আর মু’মিন হওয়া অনেক উচ্চ স্তরের বিষয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘‘তোমরা একনিষ্ঠভাবে নিজেদেরকে আল্লহ্র দ্বিনে প্রতিষ্ঠিত করো, আল্লহ্র প্রকৃতি অনুসরণ করো, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।” (সূরা রূম-৩০: আয়াত ৩০)
মানুষ সৃষ্টি হয় পিতার শুμকিট বা মানব সৃষ্টির বীজ মায়ের ডিম্বকোষে প্রবেশ করে যতড়ব করে মানব শিশু সৃষ্টির মাধ্যমে, আর
ইমানের জন্ম হয় মোর্শেদের সিনা মোবারক হতে ইমানের বীজ তথা ইমানের নুর মুরিদের ক্বালবে প্রবেশ করে যতেড়বর মাধ্যমে
লালনের দ্বারা ইমানের নুরের শিশু জন্মের মাধ্যমে। এজন্যই মহান রাব্বুল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর দ্বারা মুমিনের
দাবিদার মরুবাসীদের বলেছেন- “তোমরা মু’মিন নও। বরং তোমরা মাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছ। ইমানের নুর এখনো
তোমাদের ক্বালবে প্রবেশ করেনি।” (সূরা হুজুরাত-৪৯: আয়াত ১৪)
যারা নুরে মোহাম্মদীর নুর বা আলো দ্বারা নিজেদের আলোকিত করতে পেরেছে তারাই নুরে মোহাম্মদীর ধারক ও বাহক
মোর্শেদের আনুগত্য করে মুমিন হয়ে মহান আল্লাহ্কে পরম দয়াময় ও ক্ষমাশীল রূপে পেয়েছে। এ যুগে ক্বালবে নুরে ইমান
লাভ করে মু’মিন হওয়ার জন্য যুগের ইমাম সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর
কেব্লাজানের সানিড়বধ্য লাভ করা প্রয়োজন। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের তাঁর এই মহান বন্ধুর পরিচয় লাভ করে তাঁর
সান্নিধ্যে এসে আমাদের হৃদয়ে ইমানের নুর প্রবেশ করত তা যতেড়বর সাথে লালন করার মাধ্যমে মু’মিন হওয়ার তৌফিক দান
করুন। আমিন।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
তথ্য সূত্র:
১। তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৪র্থ খণ্ড; সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা
দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান
২। সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ১ম খণ্ড; সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা
দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান