Cancel Preloader

ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার পর আরো বেশি জীবন্ত

মুহাম্মদ জহিরুল আলম
যুগে যুগে আল্লাহ্ প্রেরিত মহামানবগণের আদর্শ অনুসরণই ছিল সমকালীন মানুষের ধর্ম। দয়াল রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর নুরে মোহাম্মদীকে হৃদয়ে ধারণ করে মহামানবগণ মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের প্রকৃত পরিচয় জগদ্বাসীর নিকট প্রকাশ করেছেন, তাঁদের অনুগত্যের মাঝেই ছিল মানবের মুক্তির পথ। দয়াল রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আহলে বাইতের মাধ্যমেই মহামানবগণের আগমনের এ ধারা জগতের বুকে বহমান। বিদায় হজের দিন আরাফাত ময়দানের ভাষণে হযরত রাসুল (সা.) আহলে বাইতের অনুসরণের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “হে লোকসকল! আমি তোমাদের নিকট ঐ বস্তু রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা পথভ্রষ্ট (ধ্বংস) হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বাইত।” (তিরমিজী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৯)। আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন- “জেনে রেখো, আমার আহলে বাইত তোমাদের জন্য হযরত নূহ (আ.)-এর কিস্তি বা নৌকাতুল্য। যে তাতে আরোহণ করেছে, সেই রক্ষা পেয়েছে। আর যে তাতে আরোহণ করতে পারেনি, সেই ধ্বংস হয়েছে।” (মেশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ৫৭৩)


আল্লাহর রাসুল (সা.) হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু, হযরত ফাতেমা (রা.), হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে ডেকে নিজের কাছে এনে বললেন “হে আল্লাহ্! এঁরা আমার আহলে বাইত।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৬৮) দশম হিজরির ১৮ জিলহজ হজের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে হযরত রাসুল (সা.) মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি গাদিরে খুম নামক এক স্থানে আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার পর সবাইকে সমবেত হতে বললেন। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে কয়েকটি উটের জিনকে একত্রিত করে মঞ্চ তৈরি করলে, তিনি তাতে আরোহণ করেন। এরপর রাসুল (সা.) হযরত আলী (কা.)-এর দুই হাত উত্তোলন করে বললেন, “আমি যার মাওলা (অভিভাবক), আলী-ও তার মাওলা।” (তিরমিজি শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১২) অথচ হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর নবি পরিবারের সদস্যদের সাথে কি আচরণ করা হয়েছে! পরিতাপের বিষয়, হযরত রাসুল (সা.)-এর জাহেরিভাবে এ ধরা ত্যাগ করার পর থেকেই আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ সহ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মিথ্যা রটনা শুরু হয়। ক্ষমতার মসনদ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে মুক্তিকামী মানুষকে আহলে বাইতের সদস্যদের হতে দূরে রাখাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ফলে সমাজে ধর্মের নামে মনগড়া শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। আহলে বাইতের সদস্য এবং তাঁদের অনুসারীদের প্রতি নির্মম ও নিষ্ঠুর আঘাতের মধ্যদিয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগেই উমাইয়াদের মাধ্যমে চক্রান্তের সূচনা। ক্ষমতা ও অর্থের মোহান্ধ এসব মানুষরূপী দানবের কাছে মনুষত্ব্য, বিবেক, ধর্ম কোনোকিছুই বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পায়নি। শুরু হয় আহলে বাইতের সদস্যদের একের পর এক নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যা।


আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য দয়াল রাসুল (সা.)-এর নয়নমণি ইমাম হোসাইন (রা.), যিনি এক আদর্শের নাম। হিজরি চতুর্থ সনের শাবান মাসের তৃতীয় দিনে তিনি পিতা আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও মাতা নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর কোলে আগমন করেন। নানা আল্লাহর হাবিব সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব দয়াল রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.), নানি ছিলেন জগৎ জননী হযরত খাদিজা আত তাহেরা (রা.)। তাঁর দাদা হযরত আবু তালিব (রা.), দাদি হযরত ফাতেমা বিনতে আসাদ ইবনে হাসিম (রা.)। তাঁর দাদা-দাদি উভয়েই প্রথমদিকে দ্বিনে হানিফের অনুসারী ছিলেন, পরবর্তীতে হযরত রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম গ্রহণ করেন।


ইমাম হোসাইন (রা.) জীবনের ৬ বছর প্রিয় নানাজির সাথে এবং ৩০ বছর পর্যন্ত পিতার সাথে জীবন যাপন করেছেন। মোহাম্মদী ইসলামের প্রতিটি বিপর্যয় তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত, সাকিফার হট্ট্রগোল, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-কে কীভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে, মা ফাতেমা (রা.)-এর বিরুদ্ধে আগ্রাসন, খুমস্ প্রত্যাহার, ফাদাক জব্দ করা, মা ফাতেমা (রা.)-এর ওফাত, পিতা হযরত আলী (কা.)-এর শাহাদতবরণ, মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, বড়ো ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর শাহাদত, নবি পরিবার ও আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রতি নির্মম-নিষ্ঠুর-নৃশংস আচরণ সকল কিছু তিনি দেখেছেন।

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর পর এজিদ সর্বপ্রথম যে সিদ্ধান্ত নেয় তা হলো, মদীনার গভর্নর ওয়ালিদ ইবনে ওতবার নিকট ফরমান পাঠায় সে যেন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নিকট হতে এজিদের আনুগত্যের জন্য বাইয়াত গ্রহণ করে। ইমাম হোসাইন (রা.) সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং শাসক গোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে পরিবার পরিজনকে নিয়ে মক্কায় চলে আসেন। কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মক্কায় আগমন এবং এজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতির কথা জানতে পারেন, আহলে বাইতের অনুসারী কুফার নেতারা সুলায়মান ইবনে সদ্র আল-খুজাইর ঘরে সভার আয়োজন করে এজিদের দুঃশাসনের প্রতি সোচ্চার হয় এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি বাইয়াত হওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। গোত্র প্রধানরা লিখিত আকারে নিজেদের প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কুফায় আসার দাওয়াত দিয়ে চিঠি প্রেরণ করে। প্রতিটি চিঠিতে একাধিক জনের স্বাক্ষর ছিল। এমনও হয়েছে একদিনে ৩০০টি চিঠি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর হাতে পৌঁছেছে। একপর্যায়ে চিঠির সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইমাম হোসাইন (রা.) চিঠির জবাব লিখে দাওয়াত কবুলের কথা তাঁর চাচাতো ভাই হযরত মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.)-এর মাধ্যমে কুফাবাসীকে অবগত করেন। হযরত মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) ইমামের বার্তা নিয়ে কুফায় পৌঁছলে সেখানকার প্রখ্যাত ব্যক্তি মুখতার আল-সাকাফির গৃহে অবস্থান নেন। ইমামের বার্তা শুনার জন্য মসজিদে সবাই একত্রিত হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার জনতা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে নেতা হিসেবে মেনে সমর্থন করার অঙ্গীকার করে। (মুহাম্মদ বাকির আল-মাজলিশি, বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৪৪, পৃষ্ঠা ৩৩৭)। এজিদ গুপ্তচরের মাধ্যমে সব তথ্য জেনে মারওয়ানের পরামর্শে উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ-কে কুফার গভর্নর নিয়োগ করে। তারপরের ইতিহাস কূটকৌশল, ছলনা, প্রবঞ্চনা, লোভ ও নিষ্ঠুরতার ইতিহাস, সভ্যতার এক কলংকজনক অধ্যায়। এজিদের চক্রান্তে ও উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের কূটকৌশলে চল্লিশ হাজার লোক থেকে হযরত মুসলিম ইবনে আকিল একপর্যায়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে যান। উবায়দুল্লাহ নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে হযরত মুসলিম ইবনে আকিল (রহ.) এবং উরওয়া ইবনে হানিকে হত্যা করে মৃতদেহ দীর্ঘদিন প্রধান সড়কে ঝুলিয়ে রাখে।
৬০ হিজরির ৮ জিলহজ মক্কাবাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা ত্যাগ করেন। যাত্রা পথের পুরোটা জুড়ে ইমাম নবি ইয়াহইয়া (আ.)-এর শাহাদতের কাহিনি বর্ণনা করেন। ‘আল-সিফাহ’ নামক স্থানে বিখ্যাত কবি ফারাজদাকের সাথে সাক্ষাৎ হয়, তাঁর কাছ থেকেও তিনি ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন। আরেক স্থানে আবু হিররাহ’র সাথে দেখা হলে ইমাম অনাগত ভবিষ্যতের কথা তাকে পূর্ণ ব্যক্ত করেন। কুফা হতে দুই মনজিল বাকি থাকতে হুর বিন ইয়াজিদ ১০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ইমামের পথ রোধ করে। এজিদের নির্দেশে হুরের প্রতিবন্ধকতায় ইমামের কাফেলা মহররমের ২ তারিখ যে স্থানে এসে পৌঁছে সেই স্থানটিই হলো কারবালার প্রান্তর। অশ্রুসজল নয়নে ইমাম প্রার্থনা করেন, “হে খোদা! আমি যন্ত্রণা ও অগ্নিপরীক্ষায় তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” এরপর অনুসারীদের দিকে ফিরে বললেন, “এটা যন্ত্রণা ও অগ্নিপরীক্ষার স্থান। এটা সেই স্থান যেখানে আমরা ও আমাদের পশুগুলো অবস্থান করবে আর আমাদের রক্ত প্রবাহিত হবে।”


পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ঘটনার মধ্যদিয়ে মোহাম্মদী ইসলামের সূর্য অস্তমিত হয়। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে দুুরাচার এজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর অসম যুদ্ধে নবি পরিবার এবং সঙ্গী সহ ৭২ জন নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘ইবর’-এ মন্তব্য করেন-“ইসলামের অভ্যুদয় ঘটেছে মক্কায়, পরিপূর্ণতা লাভ করেছে মদিনায়, রোগাগ্রস্ত হয়েছে কুফায়, মৃত্যুবরণ করেছে দামেস্কে এবং কবরস্থ হয়েছে বাগদাদে।” কারবালার ঘটনার মধ্য দিয়ে এজিদের নেতৃত্বে উমাইয়ারা মুসলিম জাহানের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। উমাইয়ারা ‘মোহাম্মদী ইসলাম’-এর পরিবর্তে দ্বিন ইসলাম প্রবর্তন করে। ৮৯ বছর ক্ষমতায় থেকে এজিদ বাহিনী যে ইসলাম প্রচার করে তা ছিল ভোগের, প্রতারণার, নিষ্ঠুরতার, জুলুম, অত্যাচারের, লেবাস সর্বস্ব ও মৌখিক স্বীকৃতির। তাদের মনগড়া দ্বিন ইসলামের কবলে পড়ে মানুষ দয়াল রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম হতে অনেক দূরে সড়ে যায়। উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসিয়রা ৫০৮ বছর ক্ষমতায় থেকে একই পথ অনুসরণ করে।


আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “হোসাইন আমা হতে, আর আমি হোসাইন হতে।” (তিরমিজী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৭১) উমাইয়া ও আব্বাসিয়রা যতই ক্ষমতার মসনদ আঁকড়িয়ে রাখুক না কেন, সফল হতে পারেনি। নুরে মোহাম্মদীর আলোকবর্তিকা বিরাজমান ছিল, আছে এবং থাকবে। ছাপ্পান্ন বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যটি এত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন যে, তা অনাদিকাল ধরে মোহাম্মদী ইসলামকে সজীব ও সতেজ করে তুলবে। ইমাম হোসাইন (রা.) যে রাত্রিতে মদীনা ত্যাগ করেন, যত দিন তিনি মক্কা নগরীতে অবস্থান করেছিলেন এবং মক্কা থেকে কারবালায় যাত্রার পথে যেখানেই যাত্রা বিরতি করেছেন প্রতিটি স্থানেই, এমনকি শাহাদত পর্যন্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আমার যাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করা এবং এজিদের অনৈসলামি শাসনের প্রতিবাদ করা, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা। আর আল্লাহর কিতাব এবং মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রবর্তিত দ্বিনকে পুনর্জীবিত করা ব্যতীত আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।” উমাইয়ারা ভেবেছিল ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করলেই তাদের ক্ষমতার মসনদ নিষ্কন্টক হয়ে যাবে, আসলে তা নয়। এজিদ কখনোই খলিফার মর্যাদা পায়নি, সর্বত্রই সে ঘৃণিত হয়েছে। ইমাম হোসাইন (রা.) একটি আদর্শের নাম, মোহাম্মদী ইসলাম রক্ষায় তিনি কারবালার পর আরো বেশি জীবন্ত। এ ব্রহ্মাণ্ড যতদিন থাকবে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আদর্শ, আলোকবর্তিকা হয়ে মানব সভ্যতাকে সত্যের পথ দেখিয়ে যাবে।
[লেখক: পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

সম্পর্কিত পোস্ট