Cancel Preloader

ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক ও বিদআত

মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান


[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘মুক্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে লেখাটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]


শিরক আরবি শব্দ। এ শব্দের আভিধানিক অর্থ অংশীদার স্থাপন করা। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পরিভাষায় শিরক অর্থ ইবাদতে আল্লাহ্ র সাথে অন্য কাউকে শরিক করা। মহান আল্লাহ্ বলেন- “যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ বা দিদার লাভের আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক না করে।” (সূরা আল কাহফ ১৮ : আয়াত ১১০)
আল্লাহ্ তায়ালা শিরককে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য করে থাকেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-“নিশ্চয় শিরক তো মহাপাপ।” (সূরা লুকমান ৩১: আয়াত ১৩) মানুষের সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহ্ র উদ্দেশ্যে বা আল্লাহ্ র সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হতে হবে। অথচ মানুষ বুঝে হোক, না বুঝে হোক, শিরকের মতো জঘন্য অপরাধ করে থাকে। যেমন নামাজে দাঁড়িয়ে আমরা মুখে বলি- “ইয়্যাকা না‘বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা‘ঈন।” অর্থাৎ-“আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং আমরা তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।” (সূরা আল ফাতিহা ১: আয়াত ৪) অথচ মনে মনে অন্যকিছুর কল্পনায় ডুবে থাকি। নামাজে দাঁড়িয়ে বাজে কল্পনা মনে আসলে ইবাদতে আল্লাহ্ র সাথে অন্য কিছুকে শরিক করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “কোনো ব্যক্তি যখন সালাত আদায়ে দণ্ডায়মান হয়, তখন মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ তাঁর ঐ বান্দার দিকে নিজের চেহারা মোবারক ফেরান। সে যখন অন্যমনস্ক হয়, তখন আল্লাহ্ বলেন- “হে আদম সন্তান! তুমি কার দিকে তাকাচ্ছ? আমার চেয়ে উত্তম কারো দিকে কি? আমার প্রতি মনোযোগী হও। অতঃপর সে যদি দ্বিতীয়বার অন্যমনস্ক হয়, তবে পুনরায় আল্লাহ তায়ালা একথা বলেন। যদি আবারো তৃতীয়বার অন্যমনস্ক হয়, তখন আল্লাহ্ তায়ালা তার দিক থেকে স্বীয় চেহারা মোবারক ফিরিয়ে নেন।” (মুসনাদে ইমাম বাজ্জারের সূত্রে তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫)


এমনিভাবে হযরত সাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ্ র রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করেছে, সে অবশ্যই শিরক করেছে। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা পালন করেছে, সেও শিরক করেছে। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করেছে, সেও নিঃসন্দেহে শিরক করেছে।” (মুসনাদে আহমদের সূত্রে তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১২) এভাবে নামাজ, কিংবা অন্যান্য ইবাদতে আল্লাহ্ র সাথে অন্যকিছুর কল্পনা করাই শিরক। অতএব যাবতীয় ইবাদতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সকল চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া উচিত।


আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য চাওয়া শিরক কি না?


পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা শিরক প্রসঙ্গে বলেন- “ওয়ালা ইউশরিক বি’ইবাদাতি রাব্বিহী আহাদা।” অর্থাৎ- সে (যিনি আল্লাহ্ র সাক্ষাৎ বা দিদার প্রত্যাশী) যেন তার প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক না করে। (সূরা আল কাহফ ১৮: আয়াত ১১০) ইবাদতে আল্লাহ্ র সাথে অন্যকে শরিক করা, আর জীবন ধারণের প্রয়োজনে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া, এক জিনিস নয়। জন্মগতভাবে মানুষ পরনির্ভরশীল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানের লালনপালনের জন্য মানবশিশুকে পিতামাতা, কিংবা অন্য কারো উপর নির্ভর করতেই হয়। লেখাপড়া শেখার জন্য তাকে শিক্ষকের উপর নির্ভর করতে হয়। এভাবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি পদক্ষেপে মানুষকে কারো না কারো সাহায্য নিতে হয়। এমনকি মৃত্যুর পর অন্যের সাহায্য ছাড়া মৃতদেহ দাফন-কাফন হওয়াও সম্ভব নয়।


মানুষ একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো সাহায্য নেওয়া যদি শিরক হয়, তবে পরনির্ভরশীল মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অগণিত শিরক করে আসছে- সুতরাং এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টির নিয়মে প্রত্যেক মানুষকে কিছু না কিছু দায়িত্ব পালন করতেই হয়। মানুষ একে অন্যের সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহ্ র দেওয়া দায়িত্ব পালন করে থাকে। এজন্য পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাহায্য লাভের মূলনীতিও মহান আল্লাহ্ নিজেই বলে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “তোমরা একে অন্যকে নেক কাজে এবং তাকওয়ার বিষয়ে সাহায্য করবে, কিন্তু পাপ কাজে ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করবে না।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ২) সেই সাথে সুমহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন- “আমিই বণ্টন করে রেখেছি তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে এবং তাদের একজনকে অন্য জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, যেন একে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে।” (সূরা আঝ ঝুখরুফ ৪৩: আয়াত ৩২) এমনিভাবে আমিরুল মু’মিনিন, শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের উত্তম ব্যবহারের ছয়টি হক বা অধিকার রয়েছে। যথা- ১। যখন তার সাথে সাক্ষাৎ হবে, তাকে সালাম দেবে। ২। যখন সে তাকে ডাকবে, ডাকে সাড়া দেবে। ৩। যখন সে হাঁচি দেবে, তখন ইয়ারহামুকাল্লাহ (অর্থাৎ আল্লাহ্ আপনাকে দয়া করুন) বলবে। ৪। সে অসুস্থ হলে, খোঁজ-খবর নেবে । ৫। মৃত্যু হলে তার জানাযার সাথে যাবে। ৬। নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, সে অপর মুসলমানের জন্যও তাই পছন্দ করবে।” (তিরমিযী ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৯৮)


এমনিভাবে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের মাঝে সন্তানের পক্ষ থেকে শিরক করার কিছু নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কেউ যদি নদীতে পড়ে ডুবে মরার সময়, আত্মরক্ষার জন্য অন্য কারো সাহায্য প্রার্থনা করে, তবে এটি শিরক হবে না। কারণ ঐ অবস্থায় নিজের প্রাণ বাঁচানো তার জন্য ফরজ। বরং ডুবন্ত মানুষ যদি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে, তবে সে নিজেই পানিতে ডুবে মারা যাবে। সুতরাং ইবাদতে আল্লাহ্ র সাথে অন্যকে শরিক করাই মূলত শিরক। অন্যদিকে জীবন ধারণের প্রয়োজনে আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাজে সাহায্য চাওয়া শিরক নয় ।


অলী-আল্লাহর সাহায্য চাওয়া শিরক কি না?


শিরক ছাড়াও মানুষ বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে। কখনো ইচ্ছাকৃত, কখনো অজ্ঞতাবশত। অতএব তার অপরাধের সম্ভাবনা সর্বদাই থাকে। এজন্যই মানুষকে আল্লাহ্ র নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হতে হয় এবং ভুলত্রুটি সংশোধন করে ইবাদতকে আল্লাহ্ র নিকট গ্রহণযোগ্য করার উপায় জানতে হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য উপযুক্ত সাহায্যকারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে মাহবুব (সা.)! যদি তারা নিজেদের উপর জুলুম করার পর আপনার কাছে আসত, আল্লাহ্ র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তবে নিশ্চয় তারা আল্লাহ্কে অতিশয় তওবা কবুলকারী ও পরম দয়াময় হিসেবে পেতো।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৬৪) মহিমান্বিত আল্লাহ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং তাঁর নৈকটা লাভের উসিলা অন্বেষণ করো।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩৫)


যুগে যুগে মহান রাব্বুল আলামিন ধর্ম সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ও ত্রুটিপূর্ণ আমল সংশোধন করে, আল্লাহ্ প্রাপ্তির সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য নবুয়তের যুগে নবি ও রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও অলী-আল্লাহ্ প্রেরণ করে আসছেন। তাঁরা সমকালীন মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং আল্লাহ্ র প্রতিনিধি। অর্থাৎ তাদের কাছে গিয়ে মানুষ যেমন হিদায়েত লাভ করে, তেমনি তাদের উসিলায় মানুষের যাবতীয় পার্থিব বালা-মুসিবত দূর হয়। তাই অলী-আল্লাহ্ র সাহায্য চাওয়া মোটেই শিরক নয়। বরং আল্লাহ্ র কাছে সেটি পছন্দনীয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ্ র , আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাঁদের, যাঁরা তোমাদের মধ্যে (আল্লাহ্ র সাথে যোগাযোগ করে) ফয়সালা দিতে পারেন।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৫৯) এজন্য ওহির বাণী আল কুরআনের পথনির্দেশনা থেকে জানা যায়, হিজরত সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পরে মক্কায় থেকে যাওয়া বিপদগ্রস্ত মুসলমানগণ বিপদমুক্তির জন্য আল্লাহ্ র কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন- “রাব্বানা আখরিজনা মিন হাযিহিল কারইয়াতিজ্ব জ্বালিমি আহলুহা, ওয়াজ আল লানা মিল্লাদুনকা ওয়ালিইয়্যাও, ওয়াজ আল লানা মিল্লাদুনকা নাসীরা।” অর্থাৎ-হে আমাদের প্রতিপালক! এ জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিন, এখানকার অধিবাসীরা ভয়ানক অত্যাচারী। আর আপনার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করে দিন এবং আপনার কাছ থেকে কাউকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী করে দিন। (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৭৫)


মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যদি অলী-আল্লাহ্ র সাহায্য চাওয়া শিরক হতো, তবে মুসলমানগণ এভাবে প্রার্থনাও করতেন না, আর মহান আল্লাহ্ও এ প্রার্থনা পছন্দ করে কবুল করতেন না । অতঃপর তা কুরআনে উল্লেখও করতেন না। পরম করুণাময় আল্লাহ্ চান, মানুষ তাঁর প্রেরিত মহামানবের সান্নিধ্যে এসে তাঁর রহমত লাভ করুক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- কোনো ব্যক্তি যখন লঞ্চ ডুবে নদীতে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়, তখন সে যদি বাঁচার জন্য বিধর্মী জেলের কাছে সাহায্য চায়, এতে তার শিরক হবে কেন? বরং অলী-আল্লাহ্গণের নিকট সাহায্য চাওয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁদেরকে উসিলা হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাঁদের উসিলায় আল্লাহ্ র রহমত লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা। প্রকৃতপক্ষে আওলিয়ায়ে কেরামের উসিলায় আল্লাহ্ র রহমত লাভের সম্ভাবনা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত একজন মহাপাপীও আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভে ধন্য হয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসের আলোকে একটি ঘটনা নিন্মে উল্লেখ করছি-


বনি ইসরাঈলের এক মহাপাপী অলী-আল্লাহ্গণের মজলিসের উদ্দেশে যাত্রা করায় আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভ
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “বনি ইসরাঈলের এক ব্যক্তি জঘন্য পাপ করত। মদ্যপান, ব্যভিচার ও মানুষ হত্যা ছিল তার নিত্য কর্ম। একে একে সে ৯৯ জন নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে খুন করে। একদা এ মহাপাপীর মাঝে অনুশোচনা সৃষ্টি হয়। অনুতাপের আগুনে তার হৃদয় দগ্ধ হতে থাকে। সে আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভের আশায় অস্থির হয়ে ওঠে। সে অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজন বড়ো ধর্মযাজককের দ্বারস্থ হয়ে আরজ করে- হযরত! আমি ৯৯ জন মানুষ খুন করেছি, আমার জন্য কী আল্লাহ্ র ক্ষমা আছে? ধর্মযাজক এ মহাপাপীর পাপের বিবরণ শুনে বললেন- আল্লাহ্ যদি তোমাকেই ক্ষমা করে দেন, তবে তিনি জাহান্নাম বানিয়েছেন কার জন্য? এ কথা শুনে বনি ইসরাঈলের ঐ ব্যক্তি ধর্মযাজককে হত্যা করে একশ খুন পূর্ণ করে। এ পর্যায়ে সে আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভের আশায় পুনরায় পথ চলতে লাগলো। পথিমধ্যে লোকটি একজন আল্লাহ্ওয়ালা সুফির সাক্ষাৎ পায়। ঘটনা সবিস্তারে অবগত হয়ে সুফি বললেন- হাঁ, তোমার জন্য আল্লাহ্ র ক্ষমা আছে। আমি আল্লাহ্ র এক ক্ষুদ্র বান্দা, তুমি অমুক স্থানে যাও। সেখানে কিছুসংখ্যক আল্লাহ্ওয়ালা ব্যক্তি আল্লাহ্ র স্মরণে নিমগ্ন আছেন। লোকটি আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভের আশায় আল্লাহ্ র অলীদের মজলিসের দিকে পাগলের ন্যায় ছুটে চলল। কিন্তু কিছুপথ অগ্রসর হওয়ার পর মালাকুল মউত তার সামনে এসে হাজির হলো। তার হায়াত ফুরিয়ে গেছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার কিছুমাত্র সময় নেই। রুহ কবজ হয়ে গেলো। এদিকে পাপিষ্ঠ এ ব্যক্তির রুহ নেওয়ার জন্য সিজ্জিনের একদল ফেরেশতা যেমন আগমন করে, তেমনি ইল্লিনের একদল ফেরেশতাও হাজির হয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। সিজ্জিনের ফেরেশতাদের দাবি, মৃত ব্যক্তি মহাপাপী; সুতরাং তার রুহ জাহান্নামের অশান্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। অন্যদিকে ইল্লিনের ফেরেশতাদের দাবি, সে আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভের আশায় আল্লাহর বন্ধুদের দরবার শরীফের দিকে যাচ্ছিল; সুতরাং তাকে শান্তিময় স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ্ দুদল ফেরেশতার মাঝে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এ ফয়সালা দিয়ে, তোমরা উভয়দল স্থান মেপে দেখো। সে কি যাত্রাপথ থেকে অলী- আল্লাহ্গণের মজলিসের দিকে বেশি অগ্রসর হয়েছে, নাকি অর্ধেকেরও কম পথে আছে? উভয় স্থানের মধ্যে যে স্থানের দিকে সে অধিক নিকটবর্তী হবে, তাকে সে স্থানের বলে গণ্য করা হবে। এদিকে সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ ফেরেশতা প্রেরণ করে লক্ষ্য করলেন- তাঁর আল-গাফুর তথা পরম ক্ষমাশীল নামের মহিমা প্রত্যাশী লোকটি দূরত্বের অর্ধেকের চেয়ে বেশি আসতে পারেনি, বরং অর্ধেকের চেয়েও এক বিঘত পরিমাণ জায়গা পেছনে রয়েছে। এ সময় সুমহান আল্লাহ্ তাঁর আল-গাফূর তথা পরম ক্ষমাশীল নামের মহিমা প্রকাশ করলেন, জমিনকে নির্দেশ করলেন- মৃত ব্যক্তির লাশকে এক হাত সামনে ঠেলে দাও। এদিকে প্রেরিত ফেরেশতার ফয়সালা অনুযায়ী দূরত্ব মেপে ইল্লিনের ফেরেশতারা লাশটিকে অলী-আল্লাহ্গণের মজলিসের অধিক নিকটবর্তী পেলো। অতঃপর তারাই আল্লাহ্ র ক্ষমা লাভে ধন্য ঐ ব্যক্তির রুহটি শান্তিময় স্থানে নিয়ে যায়।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী- ৪র্থ, পৃষ্ঠা ৯১ ও ৯২: বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৩ ও ৪৯৪; ই. ফা. বা. কর্তৃক অনুদিত বোখারী শরীফ ৬ষ্ঠ খণ্ড, হাদীস নং ৩২২৪, পৃষ্ঠা ১৫০ ও ১৫১; মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৯: মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ২০৩ এবং রিয়াদুস সালেহীন, পৃষ্ঠা ৩৫ ও ৩৬ হাদিস নং ২০)


এমনিভাবে আল্লাহ্ র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ একশ রহমত সৃষ্টি করেন। এর মধ্য থেকে একটি রহমত তিনি পৃথিবীবাসীর মাঝে বণ্টন করে দেন। আর তিনি তাদের মাঝে এটি ছড়িয়ে দেন নির্ধারিত এক সময়ের জন্য। অবশিষ্ট ৯৯টি রহমত মহান আল্লাহ্ আওলিয়ায়ে কেরামের মাঝে সঞ্চিত রেখেছেন। অতঃপর মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ পৃথিবীবাসীর মাঝে যে একটি রহমত বণ্টন করেছেন, কিয়ামত দিবসে তা গুটিয়ে নেবেন এবং ৯৯টি রহমতের সাথে তা সংযুক্ত করে, সর্বমোট একশ রহমতই আওলিয়ায়ে কেরামের জন্য নির্ধারণ করে দেবেন।” (মুসনাদে আহমদ ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩৩) কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই, এক শ্রেণির আলেম নামধারী ব্যক্তি অলী-আল্লাহ্গণের নিকট সাহায্য চাওয়াকে শিরক বলে প্রচার করে, অথচ নিজেরা পার্থিব বিপদে পড়ে বিধর্মীদের সাহায্য নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এ ধরনের প্রচার অবশ্যই বিদ্বেষমূলক। প্রকৃতপক্ষে নবুয়ত শেষ হওয়ার পর বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্ র সাহায্য নিয়ে ক্বালবে আল্লাহ্ র জিকির জারি করা ব্যতীত মানুষ ইমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। আল্লাহ্ বলেন- “ওয়া মাইয়্যুদ্বলিল ফালান তাজিদা লাহ্ ওয়ালিইয়্যাম মুরশিদা।” অর্থাৎ- “আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন কোনো (মোর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭) সুতরাং যে কেউ তাঁর সাহায্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে, সে নিজেকে গোমরাহি থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে এবং পরিণামে বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করে জাহান্নামি হবে ।


ইসলামের দৃষ্টিতে বিদআত


বিদআত আরবি শব্দ, যার অর্থ নতুন কিছু প্রবর্তন করা বা আবিষ্কার করা। অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে- নতুনত্ব, নতুন ধর্মমত। ইসলামি পরিভাষায় হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর ধর্মের বিষয়ে নতুন যে সকল বিষয় ইসলামে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, সেগুলোই বিদআত বলে গণ্য হয়। আমাদের প্রচলিত ধারণা মতে, বিদআত একটি অতীব গর্হিত কাজ। কেননা এগুলো হযরত রাসুল (সা.)-এর সময়ে ছিল না। কিন্তু মানুষের আমলের সুবিধার্থে খোলাফায়ে রাশেদিনের অন্যতম হযরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলে পবিত্র কুরআনকে ত্রিশ পারায় বিভক্ত করা হয়েছে। এটি একটি উত্তম কাজ। সুতরাং বিদআত মাত্রই বর্জনীয় বা খারাপ বলা যায় না। হযরত রাসুল (সা.)-এর আমলে উট ছিল প্রধান যানবাহন, অথচ বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে বহুবিধ উন্নততর যানবাহন আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে বর্তমানে মানুষ অতি অল্প সময়ে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে পারে। যানবাহনের এই নব আবিষ্কারকে নিশ্চয়ই গর্হিত কাজ বলা যাবে না। তবে হযরত রাসুল (সা.)-এর পরে ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ে কোনো পরিবর্তন বা সংযোজন অবশ্যই গর্হিত কাজ বলে বিবেচ্য।


ধর্মবিশারদগণের মতে বিদআত ২ (দুই) প্রকার। যথা- ১। বিদআতে হাসানাহ অর্থাৎ- ভালো উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত নতুন বিষয় ২। বিদআতে সাইয়্যেয়াহ অর্থাৎ- খারাপ উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত নতুন বিষয় ।


হযরত জারির (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্ র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো ভালো নিয়মের প্রচলন করে, সে এর বিনিময় পাবে। অতঃপর পরবর্তীতে যারা সেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবে, তাদের বিনিময়ও সে পাবে। অথচ এতে তাদের বিনিময় বিন্দুমাত্র কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো মন্দ নিয়ম চালু করে, তার উপর এর (গুনাহের) বোঝা চেপে বসবে। অতঃপর পরবর্তীতে যারা সেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ করবে, তাদের বোঝাও তার উপর গিয়ে পড়বে। কিন্তু তাদের বোঝা কিছুমাত্র কম করা হবে না।” (মুসলিম শরীফের সূত্রে তাফসীরে মাজহারী ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৭ ও ১১৮ এবং মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৩)


হযরত ইমাম সাতবীর (রহ.)-এর মতে, ধর্মের মূল লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করলে তা গর্হিত, আর মূল লক্ষ্যবস্তুকে লাভ করার জন্য এক বা একাধিক উপায় উদ্ভাবন উত্তম শ্রেণির বিদআত । হযরত উসমান গনি (রা.) কর্তৃক পবিত্র কুরআন শুদ্ধভাবে সংকলন, পারা এবং রুকুতে বিভক্তকরণ, সিহাহ সিত্তাহ (৬ খানা নির্ভুল) হাদিস সংকলন, হযরত উমর (রা.) কর্তৃক নারী ও পুরুষের একত্রে জামাতে নামাজ আদায় নিষিদ্ধকরণ, চারটি মাজহাব সৃষ্টি, বিভিন্ন তরিকা প্রতিষ্ঠা, ইত্যাদি উত্তম তথা হাসানাহ শ্রেণির বিদআত। পক্ষান্তরে ইসলামের মৌলিক বিষয় পরিবর্তন-পরিবর্ধন গর্হিত তথা সাইয়্যেয়াহ্ শ্রেণির বিদআত। যেমন ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি। যথা- কালেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্জ। কেউ যদি ইসলামের এই মূলনীতি পরিবর্তন করে পাঁচটির স্থলে ছয়টি অথবা সাতটি বানিয়ে নেয়, তবে এটি হবে বিদআতে সাইয়্যেয়াহ।


একশ্রেণির বিদআত মঙ্গলজনক। যে সকল বিষয় ইসলাম ধর্মে নতুন সংযোজনের ফলে মানুষ সহজে মূল লক্ষ্যে পৌছাতে পারে, সেরূপ সংযোজন ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়। আর এটি এজন্য যে, যুগে যুগে হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শচ্যুত মুসলিম শাসকবর্গ ও অমুসলিমদের চক্রান্তে মনগড়া ব্যাখ্যা ও মাসআলা ধর্মে অনুপ্রবেশ করে সরলপ্রাণ বিশ্বাসীদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করে থাকে। এ সমস্ত ক্ষতিকর সংযোজন থেকে ধর্মকে মুক্ত করে যুগোপযোগী সংস্কার সাধনের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেক শতাব্দীতে সংস্কারক বা মোজাদ্দেদ প্রেরণ করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ্ র রাসুল (সা.) থেকে এ কথা অবগত হয়েছি, তিনি এরশাদ করেন- “নিশ্চয় মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ এই উম্মতের জন্য প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এমন এক ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি তাঁদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (আবু দাউদ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬)


এ সকল মহামানব মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে ধর্মে প্রবিষ্ট কুসংস্কারসমূহ চিহ্নিত করে, ধর্মের সংস্কার সাধন করেন। ফলে ধর্ম নবজীবন লাভ করে, অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.)-এর জামানায় ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে যে চারিত্রিক পরিবর্তন সাধন হতো, আত্মিক উৎকর্ষতা লাভ হতো, মানুষ আল্লাহ্ র আশেকে পরিনত হতো, তদ্রƒপ উক্ত মহামানব কর্তৃক ধর্মের সংস্কার সাধনের পর মানুষ তাঁকে পূর্ণভাবে অনুসরণের মাধ্যমে হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগের অনুরূপ ফায়দা লাভ করে থাকে। এরূপ মহামানব সংস্কারের প্রয়োজনে ধর্মের যা কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে থাকেন, তা আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর হুকুমেই করে থাকেন। ফলে এরূপ সংস্কার মানুষের জন্য অবশ্যই উপকারী ও মঙ্গলজনক । মহান আল্লাহ্ বলেন- “আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাঁদের মধ্যে এমন একদল আছে, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৮১)
পক্ষান্তরে অন্য যে কোনো নতুন ব্যবস্থা, যা পরিণামে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ও খারাপ পথে চালিত করে, মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, সেই রকম বিদআত ইসলামের দৃষ্টিতে অবশ্যই অপরাধ।


[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]

সম্পর্কিত পোস্ট