ইসলামের দৃষ্টিতে শিরক
-মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত
সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজান রচিত ‘মুক্তি কোন পথে?’ থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে। -সম্পাদক]
শিরক আরবি শব্দ। এ শব্দের আভিধানিক অর্থ অংশীদার স্থাপন করা। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পরিভাষায় শিরক অর্থ ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরিক করা। মহান আল্লাহ্ বলেন- “যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ (দিদার) লাভের আশা রাখে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক না করে।” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১১০)
আল্লাহ্ তায়ালা শিরককে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য করে থাকেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- “ইন্নাশ শিরকা লাজ্বুলমুন ‘আজ্বীম।” অর্থাৎ- “নিশ্চয় শিরক তো মহাপাপ।” (সূরা লুকমান ৩১: আয়াত ১৩) মানুষের সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হতে হবে। অথচ মানুষ বুঝে হোক, না বুঝে হোক, শিরকের মতো জঘন্য অপরাধ করে থাকে। যেমন নামাজে দাঁড়িয়ে আমরা মুখে বলি- “আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং আমরা তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।” (সূরা আল ফাতিহা ১: আয়াত ৪) অথচ মনে মনে অন্যকিছুর কল্পনায় ডুবে থাকি।
নামাজে দাঁড়িয়ে বাজে কল্পনা মনে আসলে ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “কোনো ব্যক্তি যখন সালাত আদায়ে দণ্ডায়মান হয়, তখন মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ তাঁর ঐ বান্দার দিকে নিজের চেহারা মোবারক ফেরান। সে যখন অন্যমনস্কা হয়, তখন আল্লাহ্ বলেন- ‘হে আদাম সন্তান! তুমি কার দিকে তাকাচ্ছ? আমার চেয়ে উত্তম কারো দিকে কি? আমার প্রতি মনোযোগী হও।’ অতঃপর সে যদি দ্বিতীয়বার অন্যমনস্ক হয়, তবে পুনরায় আল্লাহ্ তায়ালা একথা বলেন। যদি আবারো তৃতীয়বার অন্যমনস্ক হয়, তখন আল্লাহ্ তায়ালা তার দিক থেকে স্বীয় চেহারা মোবারক ফিরিয়ে নেন।” (মুসনাদে ইমাম বাজ্জারের সূত্রে তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫)
এমনিভাবে হযরত সাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করেছে, সে অবশ্যই শিরক করেছে। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা পালন করেছে, সেও শিরক করেছে। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করেছে, সেও নিঃসন্দেহে শিরক করেছে।” (মুসনাদে আহমদের সূত্রে তাফসীরে মাজহারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১২)
এভাবে নামাজ, কিংবা অন্যান্য ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্যকিছুর কল্পনা করাই শিরক। অতএব যাবতীয় ইবাদতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য সকল চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া উচিত।
আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য চাওয়া শিরক কি না?
ইবাদতে মহান আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করা, আর জীবন ধারণের প্রয়োজনে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া, এক বিষয় নয়। জন্মগতভাবে মানুষ পরনির্ভরশীল। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানের লালন-পালনের জন্য মানব শিশুকে পিতামাতা, কিংবা অন্য কারো উপর নির্ভর করতেই হয়। লেখাপড়া শেখার জন্য তাকে শিক্ষকের উপর নির্ভর করতে হয়। এভাবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি পদক্ষেপে মানুষকে কারো না করো সাহায্য নিতে হয়। এমনকি মৃত্যুর পর অন্যের সাহায্য ছাড়া মৃতদেহ দাফন-কাফন হওয়াও সম্ভব নয়।
মানুষ একে অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো সাহায্য নেওয়া যদি শিরক হয়, তবে পরনির্ভরশীল মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অগণিত শিরক করে আসছে- সুতরাং এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টির নিয়মে প্রত্যেক মানুষকে কিছু না কিছু দায়িত্ব পালন করতেই হয়। মানুষ একে অন্যের সাহায্যের মাধ্যমে আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব পালন করে থাকে। এজন্য পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাহায্য লাভের মূলনীতিও মহান আল্লাহ্ বলে দিয়েছেন, এরশাদ হচ্ছে- “তোমরা একে অন্যকে নেক কাজে এবং তাকওয়ার বিষয়ে সাহায্য করবে, কিন্তু পাপ কাজে ও সীমালঙ্ঘনের বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করবে না।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ২)
সেই সাথে সুমহান আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন-“আমিই বন্টন করে রেখেছি তাদের জীবিকা পার্থিব জীবনে তাদের মধ্যে এবং তাদের একজনকে অন্য জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, যেন একে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে।” (সূরা আঝ ঝুখরুফ ৪৩: আয়াত ৩২)
এমনিভাবে আমিরুল মু’মিনিন শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের উত্তম ব্যবহারের ৬টি হক বা অধিকার রয়েছে। যথা ১। যখন তার সাথে সাক্ষাৎ হবে, তাকে সালাম দেবে। ২। যখন সে তাকে ডাকবে, ডাকে সাড়া দেবে। ৩। যখন সে হাঁচি দেবে, তখন ইয়ারহামুকাল্লাহ্ (অর্থাৎ আল্লাহ্ আপনাকে দয়া করুন) বলবে। ৪। সে অসুস্থ হলে, খোঁজ-খবর নেবে। ৫। মৃত্যু হলে তার জানাজার সাথে যাবে এবং ৬। নিজের জন্য যা পছন্দ করবে, সে অপর মুসলমানের জন্যও তাই পছন্দ করবে।” (তিরমিযী ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৯৮)
এমনিভাবে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের মাঝে সন্তানের পক্ষ থেকে শিরক করার কিছু নেই।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কেউ যদি নদীতে পড়ে ডুবে মরার সময়, আত্মরক্ষার জন্য অন্য কারো সাহায্য প্রার্থনা করে, তবে এটি শিরক হবে না। কারণ ঐ অবস্থায় নিজের প্রাণ বাঁচানো তার জন্য ফরজ। বরং ডুবন্ত মানুষ যদি সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে, তবে সে নিজেই পানিতে ডুবে মারা যাবে।
সুতরাং ইবাদতে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করাই মূলত শিরক। অন্যদিকে জীবন ধারণের প্রয়োজনে আল্লাহ্ ছাড়া কারো কাছে সাহায্য চাওয়া শিরক নয়।
অলী-আল্লাহর সাহায্য চাওয়া শিরক কি না?
পূর্বেই বলা হয়েছে- ইবাদতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করাকে শিরক বলা হয়। শিরক ছাড়াও মানুষ বিভিন্ন অপরাধ করে থাকে। কখনো ইচ্ছাকৃত, কখনো অজ্ঞতাবশত। অতএব তার অপরাধের সম্ভাবনা সর্বদাই থাকে। এজন্যই মানুষকে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হতে হয় এবং ভুলত্রুটি সংশোধন করে ইবাদতকে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য করার উপায় জানতে হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য উপযুক্ত সাহায্যকারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে মাহবুব (সা.)! যদি তারা নিজেদের উপর জুলুম করার পর আপনার কাছে আসত, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রাসুলও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তবে নিশ্চয় তারা আল্লাহ্কে অতিশয় তওবা কবুলকারী ও পরম দয়াময় হিসেবে পেতো।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৬৪)
মহিমান্বিত আল্লাহ্ ওহির বাণী আল কুরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং তাঁর নৈকট্য লাভের অসিলা অন্বেষণ করো।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩৫)
যুগে যুগে মহান রাব্বুল আলামিন ধর্ম সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা ও ত্রুটিপূর্ণ আমল সংশোধন করে, আল্লাহ্ প্রাপ্তির সঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য নবুয়তের যুগে নবি ও রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও অলী-আল্লাহ প্রেরণ করে আসছেন। তাঁরা সমকালীন মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং আল্লাহর প্রতিনিধি। অর্থাৎ তাঁদের কাছে গিয়ে মানুষ যেমন হিদায়েত লাভ করে, তেমনি তাঁদের অসিলায় মানুষের যাবতীয় পার্থিব বালা-মুসিবত দূর হয়। তাই অলী-আল্লাহর সাহায্য চাওয়া মোটেই শিরক নয়। বরং আল্লাহর কাছে সেটি পছন্দনীয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “হে মু’মিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাঁদের যারা তোমাদের মধ্যে (আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে) ফয়সালা দিতে পারেন।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৫৯)
এজন্য ওহির বাণী আল কুরআনের পথনির্দেশনা থেকে জানা যায়, হিজরত সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পরে মক্কায় থেকে যাওয়া বিপদগ্রস্ত মুসলমানগণ বিপদমুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন- “হে আমাদের প্রতিপালক! এ জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিন, এখানকার অধিবাসীরা ভয়ানক অত্যাচারী। আর আপনার কাছ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করে দিন এবং আপনার কাছ থেকে কাউকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী করে দিন।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৭৫)
মহান রাব্বুল আলামিনের এ বাণী মোবারকের বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যদি অলী-আল্লাহর সাহায্য চাওয়া শিরক হতো, তবে মুসলমানগণ এভাবে প্রার্থনাও করতেন না, আর মহান আল্লাহ্ও এ প্রার্থনা পছন্দ করে কবুল করতেন না। অতঃপর তা কুরআনে উল্লেখও করতেন না।
প্রকৃতপক্ষে পরম করুণাময় আল্লাহ্ চান, মানুষ তাঁর প্রেরিত মহামানবের সান্নিধ্যে এসে তাঁর রহমত লাভ করুক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- কোনো ব্যক্তি যখন লঞ্চ ডুবে নদীতে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়, তখন সে যদি বাঁচার জন্য বিধর্মী জেলের কাছে সাহায্য চায়, এতে তার শিরক হবে না। তাহলে কোনো অলী-আল্লাহর সাহায্য চাইলে তা শিরক হবে কেন? বরং অলী-আল্লাহ্গণের নিকট সাহায্য চাওয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁদেরকে অসিলা হিসেবে গ্রহণ করা এবং তাঁদের অসিলায় আল্লাহর রহমত লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা।
প্রকৃতপক্ষে আওলিয়ায়ে কেরামের অসিলায় আল্লাহর রহমত লাভের সম্ভাবনা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত একজন মহাপাপীও আল্লাহর ক্ষমা লাভে ধন্য হয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসের আলোকে একটি ঘটনা নিম্নে উল্লেখ করছি-
বনি ইসরাইলের এক মহাপাপী ব্যক্তি অলী-আল্লাহ্গণের মজলিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করায় মহান আল্লাহর ক্ষমা লাভ
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- “বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি জঘন্য পাপ করত। মদ্যপান, ব্যভিচার ও মানুষ হত্যা ছিল তার নিত্য কর্ম। একে একে সে নিরানব্বইজন নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে খুন করে। একদা এ মহাপাপীর মাঝে অনুশোচনা সৃষ্টি হয়। অনুতাপের আগুনে তার হৃদয় দগ্ধ হতে থাকে। সে আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশায় অস্থির হয়ে ওঠে। সে অনেক খোঁজাখুঁজি করে একজন বড়ো ধর্মযাজকের দ্বারস্থ হয়ে আরজ করে- হযরত! আমি নিরানব্বইজন মানুষ খুন করেছি, আমার জন্য কি আল্লাহর ক্ষমা আছে? ধর্মযাজক এ মহাপাপীর পাপের বিবরণ শুনে বললেন- আল্লাহ্ যদি তোমাকেই ক্ষমা করে দেন, তবে তিনি জাহান্নাম বানিয়েছেন কার জন্য? এ কথা শুনে বনি ইসরাইলের ঐ ব্যক্তি ধর্মযাজককে হত্যা করে একশ’ খুন পূর্ণ করে।
এ পর্যায়ে সে আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশায় পুনরায় পথ চলতে লাগলো। পথিমধ্যে লোকটি একজন আল্লাহ্ ওয়ালা সুফির সাক্ষাৎ পায়। ঘটনা সবিস্তারে অবগত হয়ে সুফি বললেন-হাঁ, তোমার জন্য আল্লাহর ক্ষমা আছে। আমি আল্লাহর এক ক্ষুদ্র বান্দা, তুমি অমুক স্থানে যাও। সেখানে কিছু সংখ্যক আল্লাহ্ওয়ালা ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন আছেন। লোকটি আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশায় আল্লাহর অলী-বন্ধুদের মজলিসের দিকে পাগলের ন্যায় ছুটে চলল। কিন্তু! কিছুপথ অগ্রসর হওয়ার পর মালাকুল মউত তার সামনে এসে হাজির হলো। তার হায়াত ফুরিয়ে গেছে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার কিছুমাত্র সময় নেই। রূহ কবজ হয়ে গেলো। এদিকে পাপিষ্ঠ এ ব্যক্তির রূহ নেওয়ার জন্য সিজ্জিনের একদল ফেরেশতা যেমন আগমন করে, তেমনি ইল্লিনের একদল ফেরেশতাও হাজির হয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। সিজ্জিনের ফেরেশতাদের দাবি, মৃত ব্যক্তি মহাপাপী; সুতরাং তার রূহ জাহান্নামের অশান্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। ইল্লিনের ফেরেশতাদের দাবি, সে আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশায় আল্লাহর বন্ধুদের দরবার শরীফের দিকে যাচ্ছিল; সুতরাং তাকে শান্তিময় স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ্ দুদল ফেরেশতাদের মাঝে একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এ ফয়সালা দিয়ে, তোমরা উভয়দল স্থান মেপে দেখো। সে কি যাত্রাপথ থেকে অলী-আল্লাহ্গণের মজলিসের দিকে অগ্রসর হয়েছে, নাকি অর্ধেকেরও কম পথে আছে? উভয় স্থানের মধ্যে যে স্থানের দিকে সে অধিক নিকটবর্তী হবে, তাকে সে স্থানের বলে গণ্য করা হবে। এদিকে সর্বজ্ঞ আল্লাহ্ ফেরেশতা প্রেরণ করে লক্ষ্য করলেন- তাঁর আল-গাফূর তথা পরম ক্ষমাশীল নামের মহিমা প্রত্যাশী লোকটি দূরত্বের অর্ধেকের চেয়ে বেশি আসতে পারেনি, বরং অর্ধেকের চেয়েও এক বিঘত পরিমাণ জায়গা পেছনে রয়েছে। এ সময় সুমহান আল্লাহ্ তাঁর আল-গাফূর তথা পরম ক্ষমাশীল নামের মহিমা প্রকাশ করলেন, জমিনকে নির্দেশ করলেন- মৃত ব্যক্তির লাশকে এক হাত সামনে ঠেলে দাও। এদিকে প্রেরিত ফেরেশতাদের ফয়সালা অনুযায়ী দুরত্ব মেপে ইল্লিনের ফেরেশতারা লাশটিকে অলী-আল্লাহ্গণের মজলিসের অধিক নিকটবর্তী পেলো। অতঃপর তারাই আল্লাহর ক্ষমা লাভে ধন্য ঐ ব্যক্তির রূহটি শান্তিময় স্থানে নিয়ে যায়।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯১ ও ৯২; বোখারি শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৩ ও ৪৯৪; ই.ফা.বা.কর্তৃক অনূদিত বোখারি শরীফ ৬ষ্ঠ খণ্ড, হাদিস নং ৩২২৪, পৃষ্ঠা ১৫০ ও ১৫১; মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৯; মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ২০৩ এবং রিয়াদুস সালেহীন, পৃষ্ঠা ৩৫ ও ৩৬, হাদিস নং ২০)
এমনিভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ একশ’ রহমত সৃষ্টি করেন। এর মধ্য থেকে একটি রহমত তিনি পৃথিবীবাসীর মাঝে বন্টন করে দেন। আর তিনি তাদের মাঝে এটি ছড়িয়ে দেন নির্ধারিত সময়ের জন্য। অবশিষ্ট নিরানব্বইটি রহমত মহান আল্লাহ্ আওলিয়ায়ে কেরামের মাঝে সঞ্চিত রেখেছেন। অতঃপর মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ্ পৃথিবীবাসীর মাঝে যে একটি রহমত বন্টন করেছেন, কিয়ামত দিবসে তা গুটিয়ে নেবেন এবং নিরানব্বইটি রহমতের সাথে তা সংযুক্ত করে সর্বমোট একশ’ রহমতই আওলিয়ায়ে কেরামের জন্য নির্ধারণ করে দেবেন।” (মুসনাদে আহমদ ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩৩)
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এক শ্রেণির আলেম নামধারী ব্যক্তি অলী-আল্লাহ্গণের নিকট সাহায্য চাওয়াকে শিরক বলে প্রচার করে, অথচ নিজেরা পার্থিব বিপদে পড়ে বিধর্মীদের সাহায্য নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। এ ধরনের প্রচার অবশ্যই বিদ্বেষমূলক। প্রকৃতপক্ষে নবুয়ত শেষ হওয়ার পর বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহর সাহায্য নিয়ে ক্বালবে আল্লাহর জ্বিকির জারি করা ব্যতীত মানুষ ইমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারবে না। মহান আল্লাহ্ বলেন- “আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোনো (মোর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)
সুতরাং যে কেউ তাঁর সাহায্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে, সে নিজেকে গোমরাহি থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে এবং পরিণামে বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করে জাহান্নমি হবে।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]