ইসলামে ছবি তোলা হারাম নয়, বরং ছবি তোলা জায়েজ
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান
মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে শান্তি ও মুক্তির পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম প্রদান করেন। ইসলাম ধর্মে হালালের বিধান যেমন সুষ্পষ্ট, তেমনি হারামের বিধানও সুষ্পষ্ট। ইসলামের দৃষ্টিতে ছবি তোলা জায়েজ কি-না এ বিষয়ে আমাদের সমাজে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন- ইসলামে ছবি তোলা জায়েজ নেই। এটি হারাম। এক্ষেত্রে তারা বলে থাকেন- ‘যে ঘরে ছবি ও কুকুর থাকে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। অথচ ছবি তোলা হারাম- এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা নেই। উপরন্তু ইসলামে ছবির ব্যবহার সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে ছিল, আছে ও থাকবে।
প্রিয় পাঠক! তাহলে আসুন আমরা এ বিষয়ে মনোনিবেশ করি যে, ছবি তোলা প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে কি বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন-‘‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে এবং তোমাদেরকে পরিণত করেছি বিভিন্ন জাতিতে ও বিভিন্ন গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার।’’ (সূরা আল হুজুরাত ৪৯ : আয়াত ১৩)
ওহির বাণী আল কুরআনের এ আয়াতে বিষয়টি সুষ্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ্ মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও তাঁর সহধর্মিণী হযরত মা হাওয়া (আ.) থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন। অতঃপর এ দুজন থেকে তিনি পৃথিবীতে মানবের বংশ বিস্তার করেন। এক্ষেত্রে তিনি মানুষকে বিভিন্ন জাতিতে ও বিভিন্ন গোত্রে তথা বংশ পরিচয়ে বিভক্ত করেছেন, যাতে তারা একে অপরকে চিনতে পারে, অর্থাৎ প্রত্যেকেরই যেন স্বতন্ত্র পরিচয় ও পরিচিতি গড়ে উঠে। ছবি তোলার মাধ্যমে আল্লাহর এ বাণীর বাস্তবতা পূর্ণতা লাভ করে। পৃথিবী জুড়ে দেশে মহাদেশে কোটি কোটি মানুষ বসবাস করে, প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্ররূপে চেনা যায়, চিহ্নিত করা যায়, এই ছবির মাধ্যমে।
বর্ণিত আছে, সৃষ্টির আদিতে হযরত আদম (আ.) প্রার্থনা করেছিলেন, হে আল্লাহ! আমার বংশধরদের মধ্যে নবি ও রাসুল হয়ে কারা কারা পৃথিবীর বুকে তশরিফ গ্রহণ করবেন, দয়া করে তাদের পরিচয় আমাকে জানার সুযোগ করে দিন। ফলে মহিমান্বিত আল্লাহ্ সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক একটি তাবুত তথা সিন্দুকে ভরে হযরত আদম (আ.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। অতঃপর হযরত আদম (আ.) থেকে বংশ পরম্পরায় সকল নবি ও রাসুলের কাছে এ সিন্দুক হস্তান্তরিত হয়। ওহির বাণী আল কুরআনের বাণী মোবারক থেকে জানা যায়, এ তাবুত তথা সিন্দুক মহান আল্লাহ্ হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.)-কে যেমন দিয়েছিলেন, তেমনি এ সিন্দুকটি ছিল বাদশাহ তালুতের বাদশাহির নিদর্শন। বিষয়টি মহান আল্লাহ্ নিজেই ওহির বাণী আল কুরআনে বলে দিয়েছেন-‘‘আর বনী ইসরাঈলের নবি [শামুয়েল (আ.) তাদের আরো বললেন- ‘তালুতের বাদশাহির নিদর্শন হলো তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে সেই তাবুত তথা সিন্দুক আসবে, যেটিতে থাকবে তোমাদের জন্য চির প্রশান্তি। আর তাতে থাকবে মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-এর বংশধরদের পরিত্যক্ত কিছু সামগ্রী, যেটি ফেরেশতারা বয়ে আনবে। অবশ্যই এতে রয়েছে তোমাদের জন্য নিশ্চিত নিদর্শন, যদি তোমরা মুমিন হও।’’ (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ২৪৮)
উল্লিখিত আয়াতে যে তাবুত বা সিন্দুকের কথা বলা হয়েছে, এ তাবুত প্রসঙ্গে তাফসীরে জালালাইনে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘বনী ইসরাঈল তাদের নবি হযরত শামুয়েল (আ.)-এর কাছে রাজত্বের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট আসবে তাবুত অর্থাৎ সিন্দুক। এতে নবিগণের ছবি সংরক্ষিত ছিল। হযরত আদম (আ.)-এর নিকট আল্লাহ্ তায়ালা তা নাজিল করেছিলেন পরে তা বনী ইসরাঈলের হাতে এসে পড়ে। আমালিকা সম্প্রদায় এদের উপর বিজয়ী হলে তারা তা ছিনিয়ে নেয়। বনী ইসরাঈল এ তাবুতের অসিলায় শত্রুর উপর বিজয় প্রার্থনা করত। তারা যুদ্ধের মাঠে তা নিজেদের সম্মুখে স্থাপন করত এবং তা দিয়ে সাকিনা বা চির প্রশান্তি লাভ করত।
তাবুত বা সিন্দুক সম্বদ্ধে তাফসীরে কানজুল ইমানে বলা হয়েছে- এ তাবুত শামশাদ কাঠের তৈরী একটি স্বর্ণ-খচিত সিন্দুক ছিল, যার দৈর্ঘ্য ৩ হাত এবং প্রস্থ ২ হাত ছিল। সেটাকে আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-এর উপর নাজিল করেছিলেন। এর মধ্যে সমস্ত নবি (আ.)-এর ছবি সংরক্ষিত ছিল। তাঁদের বাসস্থান ও বাসগৃহের ছবিও ছিল এবং শেষ ভাগে হুজুর সাইয়্যেদুল মুরসালিন (নবিকুল সরদার) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হুজুরে কারিম (সা.)-এর পবিত্রতম বাসগৃহের ছবি লাল ইয়াকুতের মধ্যে ছিল, যাতে হুজুর (সা.) নামাজরত অবস্থায় দণ্ডায়মান, আর তাঁর চতুস্পার্শে¦ তাঁর সাহাবায়ে কেরাম। হযরত আদম (আ.) সেসব ছবি দেখেছেন। সিন্দুকখানা বংশ পরম্পরায় হযরত মুসা (আ.) পর্যন্ত পৌঁছালো। তিনি এর মধ্যে তাওরাতও রাখতেন এবং তাঁর বিশেষ বিশেষ সামগ্রীও রাখতেন। সুতরাং এ তাবুতের মধ্যে তাওরাতের ফলকসমূহের টুকরাও ছিল। আর হযরত মুসা (আ.)-এর লাঠি, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ এবং হযরত হারুন (আ.)-এর পাগড়ি ও তাঁর লাঠি এবং সামান্য পরিমাণ মান্না, যা বনী ইসরাঈলের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল।
হযরত মুসা (আ.) যুদ্ধের সময় এ সিন্দুককে সামনে রাখতেন। এর দ্বারা বনী ইসরাঈলের অন্তরসমূহে শান্তি বিরাজমান থাকতো। তাঁর পরবর্তী সময়ে এ তাবুত বনী ইসরাঈলের মধ্যে বংশ পরম্পরায় চলে আসছিল। যখন তাদের সামনে কোনো জটিল বিষয় উপস্থিত হতো, তখন তারা এ তাবুতকে সামনে রেখে প্রার্থনা করত, আর সাফল্যমন্ডিত হতো। শত্রুদের মোকাবিলায় এরই বরকতে বিজয় লাভ করত।
বনী ইসরাঈলের অবস্থা যখন খারাপ হয়ে গেলো এবং তাদের অপকর্ম অতিমাত্রায় বেড়ে গেলো আর আল্লাহ্ তায়ালা তাদের উপর ‘আমালিকা’ সম্প্রদায়কে বিজয়ী করলেন, তখন তারা সেই ‘তাবুত’ তাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল এবং সেটাকে নাপাক ও আবর্জনার স্থানে ফেলে রাখলো ও সেটার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করলো। এসব বেয়াদবির কারণে তারা বিভিন্ন প্রকার রোগ ও নানা ধরনের মুসিবতে আক্রান্ত হতে লাগলো। তাদের পাঁচটি বস্তি (গ্রাম) ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো। তখন তাদের নিশ্চিত ধারণা হলো যে, তাবুতের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করাই তাদের ধ্বংসের কারণ।
অতঃপর তারা তাবুতখানা একটি গরুর গাড়ির উপর রেখে গরুগুলো ছেড়ে দিলো। এদিকে ফেরেশতাগণ সেটিকে বনী ইসরাঈলের সামনে বাদশাহ তালুতের নিকট নিয়ে আসলেন। এ তাবুত আসা বনী ইসরাঈলের জন্য তালুতের বাদশাহির নিদর্শন সাব্যস্ত হয়েছিল। বনী ইসরাঈল এটি দেখে তাঁর বাদশাহি মেনে নিয়েছিল এবং বিনা দ্বিধায় জিহাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো। কেননা তাবুত পেয়ে তাদের মনে বিজয়ের ধারণা দৃঢ় হলো। বাদশাহ তালুত বনী ইসরাঈল থেকে সত্তর হাজার যুবক বেছে নিলেন, যাদের মধ্যে হযরত দাউদ (আ.) ছিলেন।’’ (জালালাঈন জুমাল খাযিন ও মাদারিক ইত্যাদি কিতাবের সূত্রে কান্যুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান, পৃষ্ঠা ৯০ ও ৯১)
তাফসীরের এ বর্ণনা থেকে বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর নিকট সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক প্রেরণ করেছিলেন এবং তা বংশ পরম্পরায় বনী ইসরাঈলের নিকট পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
প্রিয় পাঠক! তাহলে আমরা কিভাবে বলি, ছবি হারাম? মহান আল্লাহ নিজে সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক এ দুনিয়ায় পাঠিয়ে, তারা যে আল্লাহর মনোনীত, এ পরিচয়পত্র সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন, এ ছবিকে হারাম বলা আমাদের অজ্ঞতা নয় কি? অথচ ছবি তোলা হারাম নয়, বরং এ ছবি ব্যক্তির পরিচয় সত্যায়ন করে, যে ধারা মহান আল্লাহ্ নিজেই চালু করেছেন।
বিশ^নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-সহ অন্যান্য নবিগণের ছবি মোবারক সম্পর্কে হাদিস শরীফে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। হযরত মাওলানা আহম্মদ ছাইদ (রহ.) প্রণীত মোহাম্মদ খালেক অনূদিত- বিশ^নবী (সা.)-এর তিনশত মো’জেযা নামক কিতাবের ২৩৭ ও ২৩৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে-‘‘নু’আঈম ইবনে আবদুল্লাহ, হিসাম ইবনে আস এবং আরো এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর শাসনামলে রোম সম্রাটের নিকট প্রেরিত হইয়াছিলেন। তাহারা বলেন-আমরা জাবালা ইবনে আয়হামের নিকট গমন করিলাম। তিনি আমাদিগকে সম্রাটের কাছে লইয়া গেলেন। সেখানে আমরা একটি স্বর্ণখচিত ও সুগন্ধিযুক্ত সিন্দুক দেখতে পাইলাম। সিন্দুকের ভিতরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ ছিল। সম্রাট একটি প্রকোষ্ঠ হইতে একটি কৃষ্ণকায় রেশমী রুমাল বাহির করলেন। উহাতে হযরত আদম (আ.)-এর চিত্র বা ছবি ছিল।
অতঃপর দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ খুলিয়া উহার মধ্য হইতেও রেশমী রুমাল বাহির করিল। উহাতে নূহ (আ.)-এর ছবি দেখাইবার পরই নবী করীম (সা.)-এর ছবি বাহির করিয়া বলিল- ইহাই সর্বশেষ প্রকোষ্ঠ, তাহার সম্পর্কে তোমাদিগকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই এই প্রকোষ্ঠটি আগে খুলিলাম। অতঃপর অন্যান্য প্রকোষ্ঠ খুলিয়া অপরাপর পয়গম্বরগণের ছবি দেখাইলাম। হযরত ঈসা (আ.), হযরত হারুন (আ.), হযরত দাউদ (আ.), হযরত মুসা (আ.), হযরত লুত (আ.) এবং হযরত ইসহাক (আ.)-এর ছবিও দেখাইল। সে বলিল এইগুলি দানিয়াল (আ.) তৈরী করিয়াছিলেন।’’
বিশিষ্ট গবেষক মরহুম মাওলানা আব্দুল জলীল মাহাহেরী তাহার সুবিখ্যাত ‘তলোয়ার নয় উদারতায়’ গ্রন্থে লিখেন- ‘‘দাহিয়া কলবীর হাতে পত্র পাওয়ার পরে এক রাত্রে কয়সর পত্রবাহকগণকে নিভৃত কক্ষে ডাকিয়া আনাইলেন। তাহাদের সম্মুখে একটি বড় সিন্দুক আনা হইল। উহার ভিতরে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ ছিল। কয়সর সিন্দুক খুলিয়া উহার এক কুঠরি হইতে একটি কালোবর্ণের রেশমী রুমাল বাহির করিলেন। উহাতে একটি মানুষের ছবি ছিল। বাদশাহ কয়সর জিজ্ঞাস করিলেন, ইহা কাহার ছবি বলিতে পার কি? পত্র বাহকগণ কহিলেন, আমরা চিনিতে পারিলাম না। তখন কয়সর বলিতে লাগিলেন, ইহা আদি পিতা আদম (আ.)-এর ছবি। অতঃপর আর একটি কুঠরি হইতে অন্য একটি রেশমী রুমাল বাহির করিয়া তাহাতে একটি ছবি দেখাইয়া বললেন, ইহা হযরত নূহ পয়গম্বরের ছবি। অতঃপর অপর একটি প্রকোষ্ঠ হইতে একটি ছবি বাহির করা হইল। বর্ণনাকারী বলেন- আমরা দেখিয়া অত্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হইলাম যে, ইহা অবিকল হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছবি ছিল। কয়সর জিজ্ঞাসা করিলেন, এই ছবি চিনিতে পারিয়াছ কি? আমরা বলিলাম নিশ্চয়ই চিনিতে পারিয়াছি, ইনিই আমাদের শেষ নবি মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। বাদশাহ কয়সর পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, ইনিই কি তোমাদের পয়গম্বর? আমরা বলিলাম- আপনি বিশ^াস করুন- এই ছবি দেখা আর হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে দেখা একই কথা। বাদশাহ কয়সর সম্মানার্থে দন্ডায়মান হইয়া পুনরায় উপবেশন করিলেন এবং কিছুক্ষণ ছবিটিকে ভালোরূপে দেখিয়া বলিতে লাগিলেন, নিশ্চয়ই ইনি শেষ নবি। আমার নিকট আরো অনেকগুলি ছবি আছে; এখন সবগুলি খুলিয়া দেখাইতেছি।
অতঃপর ঘটনা প্রসঙ্গে মাওলানা আব্দুল জলীল মাজাহেরী লিখেন-‘‘অতপর একটির পর একটি খুলিয়া হযরত মুসা, হযরত ঈসা, হযরত সোলায়মান এবং অন্যান্য অনেক পয়গম্বরের ছবি দেখাইলেন। পত্রবাহকগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, এই সমস্ত ছবি কিরূপে আপনার হস্তগত হইল? বাদশাহ বলিলেন- হযরত আদম (আ.) আল্লাহর নিকট দরখাস্ত করিয়াছিলেন যে, তাঁহার বংশধর পয়গম্বরগণের ছবি যেন তাঁহাকে দান করা হয়। তখন আল্লাহ্ পাক তাঁহার নিকট এই ছবিগুলো পাঠাইয়াছিলেন। হযরত আদম (আ.) ছবিগুলো স্বীয় বাসস্থানে রাখিয়া যান। যুলকারনাইন বাদশাহ স্বীয় ভ্রমণকালে এই সিন্দুক উদ্ধার করত দানিয়ালকে দান করেন। আমার পূর্বপুরুষগণ সেখান হইতে তাহা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। (বিশ^নবি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তিনশত মোজেযা, পৃষ্ঠা ২৩৮ ও ২৩৯) সুতরাং সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক ছিল, যা মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-এর নিকট পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, ছবি হারাম নয় বরং এটি নিদিষ্ট ব্যক্তিকে সত্যায়ন করে।
এমনিভাবে ছবি প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন- ‘‘হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে ফেরেশতা জিব্রাঈল একটি রেশমি কাপড়ে আমার ছবি নিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করেন এবং বলেন- এ আপনার স্ত্রী। কোন কোন রেওয়ায়েতে আছে- জিব্রাঈল তাঁর হাতের তালুতে এ ছবি নিয়ে এসেছিলেন।” [সংক্ষিপ্ত তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৯৩২; তিরমিজী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৬; তিরমিজী শরীফ ৬ষ্ঠ খণ্ড, (ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত), পৃষ্ঠা ৩৭৮ ও ৩৭৯, হাদীস নং ৩৮৮০ এবং তিমমিজী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৫৭৩ ও ৫৭৪)]
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এ হাদিসে দেখা যায়- মহান আল্লাহ্ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মাহবুব হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সহধর্মিণীরূপে হযরত আয়েশা (রা.)-এর ছবি জিব্রাঈল ফেরেশতার মাধ্যমে নবিজির কাছে প্রেরণ করেন। ছবি তোলা যদি হারাম হতো, তবে মহান আল্লাহ্ ছবি পাঠাতেন না, আর জিব্রাঈল ফেরেশতা হাতের তালুতে বহন করে ছবি নিয়ে রাসুল (সা.)-এর নিকট আসতেন না। একইভাবে ছবি তোলা যদি হারাম হতো, তবে হযরত রাসুল (সা.) উক্ত হারাম জিনিসের দিকে ফিরেও থাকাতেন না। অতএব পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বর্ণনায় ছবিকে ব্যক্তির পরিচয়ের সত্যতা প্রমাণের বাহন হিসেবে উল্লেখ করে সুষ্পষ্টভাবে এটির বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
এমনিভাবে মহান রাব্বুল আলামিনের সুন্দর সুন্দর ৯৯টি গুণবাচক নাম রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুণবাচক নাম হচ্ছে- আল-মুসাব্বির অর্থাৎ- প্রকৃত রূপকার বা চিত্রকর, আকৃতি প্রদানকারী, রূপদাতা, চিত্রশিল্পী, অঙ্কনকারী, ছবি নির্মাতা ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ তাঁর আল-মুসাব্বির নামের গুণের বর্ণনা দিয়ে এরশাদ করেন-‘‘তিনিই সেই মহান সত্তা আল্লাহ্, যিনি মায়ের গর্ভে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন, যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেন।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৬) অন্য আয়াতে আল্লাহ্ বলেন- ‘‘আল্লাহ্ই সেই সত্তা, যিনি জমিনকে তোমাদের জন্য করেছেন বাসস্থান এবং আসমানকে করেছেন ছাদ। আর তিনিই তোমাদের আকৃতি দান করেছেন এবং তোমাদের আকৃতিকে করেছেন অতীব সুন্দর।’’ (সূরা আল মুমিন ৪০ : আয়াত ৬৪)
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ্ আরো বলেন- “তিনিই (আল্লাহ্) সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন যথাযথভাবে এবং তোমাদের আকৃতি দান করেছেন। আর তিনিই তোমাদের আকৃতিকে সর্বদিক থেকে সুন্দর করেছেন। আর তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তন।’’ (সূরা আত তাগাবুন ৬৪ : আয়াত ৩)
এমনিভাবে ওহির বাণী আল কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে- ‘‘তিনিই আল্লাহ্, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সুঠাম করেছেন, তারপর তোমাকে সুসামঞ্জস্য করেছেন। আর যে আকৃতিতে তিনি চেয়েছেন, (সেই রূপেই) তোমাকে গঠন করেছেন।’’ (সূরা আল ইনফিতার ৮২: আয়াত ৭ ও ৮)
মহান রাব্বুল আলামিনের এ সকল বাণীতে বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ হলেন প্রকৃত রূপকার বা চিত্রকর। জগতজুড়ে হাজারো বর্ণের, হাজারো রূপ বা আকৃতির প্রাণীকুল যেমন তাঁরই সৃষ্টি, তেমনি কোটি কোটি মানুষকে তিনিই ভিন্ন ভিন্ন রূপ বা আকার দান করেছেন। মূলে আল্লাহ্ হলেন সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা, রূপদানকারী।
আর ছবি তোলার মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিনের অপরূপ সুন্দর সৃষ্টি মানুষেরই স্থিরচিত্র ধারণ করা হয়। বর্তমান বিশ্ব বিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগ, এ যুগকে ইন্টারনেটের যুগ বলা হয়। এ যুগে ছবি, অডিও, ভিডিও সমগ্র পৃথিবীকে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে সংযুক্ত করে প্রতিটি মানুষকে বিশ^ সভ্যতার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। উপরন্তু বর্তমান যুগে ছবির মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তার পরিচয় সুষ্পষ্টভাবে তুলে ধরে থাকে।
সুতরাং ছবিকে হারাম বলা শুধুমাত্র কুরআন ও হাদিস বিরোধীই নয় বরং এটি বর্তমান বিশ^ব্যবস্থার অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেওয়ার একটি হীন প্রয়াস হিসেবেই গণ্য হবে।
মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পরম করুণাময় রাব্বুল ইজ্জতের পক্ষ থেকে আমার উপর জামানার মোজাদ্দেদ বা মহান সংস্কারকের দায়িত্ব অর্পিত হয়। সে থেকে অদ্যাবধি আমাকে ইসলাম ধর্মে অনুপ্রবেশকৃত পবিত্র কুরআন ও হাদিস পরিপন্থী বিষয়াবলী চিহ্নিত করে তা সংশোধন করার কাজ করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমার করা অসংখ্য সংস্কার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। তার মধ্যে ছবি তোলার ব্যপারে ইসলামের প্রকৃত বক্তব্য আমিই সর্বপ্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রেরণ করি এবং তা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত ও কার্যকর হয়।
আর সে ঘটনাটি ছিল এ রকম- পরম করুণাময় আল্লাহ্ স্বয়ং সকল নবি ও রাসুলের ছবি মোবারক পৃথিবীতে প্রেরণ করলেও, আমাদের সমাজে ছবি তোলা হারাম, নাজায়েজ এ রকম কুরআন ও হাদিস বিরোধী মতবাদ প্রচলিত ছিল। দেখা যায়, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে ছবি সংবলিত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার যখন বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন নির্বাচন কমিশন থেকে এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসের দলিল চাওয়া হয়। দেশ ও জাতির এ বিশেষ প্রয়োজনীয় মুহূর্তে আমি আমার বক্তব্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রেরণ করে ছবি সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য জানিয়ে দেই। এ সময় আমি ছবি প্রসঙ্গে সমাজের ভুল ধারণা সংশোধন করে বলি-‘‘আল্লাহ্ তায়ালা যেহেতু নবি ও রাসুলগণের ছবি হযরত আদম (আ.)-এর কাছে প্রেরণ করেছেন, সুতরাং ছবি তোলা হারাম হতে পারে না। অতঃপর আমি বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণ করি যে, ইসলামে ছবি তোলা জায়েজ। কেননা এ বিষয়ে মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। এ সময় আমি আমার বক্তব্য এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের মর্মবাণী সংবলিত আমার লিখিত কিতাব- ‘সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী অবদান : আল্লাহ্ কোন পথে?’- এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রেরণ করেছিলাম।
মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় আমার এ কর্মপ্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ছবি তোলার সত্যতা স্বীকৃতি লাভ করে এবং এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জনাব এস. এম. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত ঐ প্রজ্ঞাপনের তৃতীয় ধারায় বলা হয়- ‘‘ভোটার তালিকার জন্য ছবি তুলতে ধর্মীয়ভাবে কোনো বাধা নিষেধ নেই।”
প্রিয় পাঠক! ২০০৭ সালের বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছবি তোলা প্রসঙ্গে সমাজের কুসংস্কার দূর করে সত্য প্রতিষ্ঠা করা অনেক কঠিন একটি বিষয় ছিল। তবে মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় তিনি এ কাজকে সহজ করে দেন। আজ ২০২০ সালের ৮ জুন সোমবার যখন মাসিক আত্মার বাণী জুন-২০২০ সংখ্যার জন্য এ লেখা প্রস্তুত করছি, তখন দেশের সর্বত্র ছবি তোলার ব্যাপারে বিতর্কের অবসান হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সকলেই স্বীকার করছেন, ইসলামে ছবি তোলা জায়েজ।
পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিনের দরাবারে লক্ষ-কোটি শোকরিয়া আদায় করি, তিনি দয়া করে আমাকে ইসলাম ধর্মের খেদমত করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী; দেওয়ানবাগ শরীফ এবং প্রণেতা, তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী।]