কারবালার আত্মত্যাগের মহিমা মু’মিনের ইমানি পরীক্ষার প্রেরণা
ড. পিয়ার মোহাম্মদ
ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহর থেকে ১০০ কি.মি. দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে একটি বালুকাময় প্রান্তর। কুফা নগরীর প্রায় ৪০ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে ফোরাতের শাখা নদীর পশ্চিম তীরের সেই বালুকাময় প্রান্তরটিই ‘কারবালা’ নামে পরিচিত। এ কারবালার নাম শুনলে পাষণ্ড হৃদয়ও শিউরে উঠে। এখানেই এজিদ বাহিনী নির্মমভাবে শহিদ করেছিল মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ ৭২ জনকে। এ বর্বরোচিত ঘটনা মু’মিনদের জন্য এক অবিস্মরণীয় বেদনার অধ্যায় হয়ে আছে।
আমির মুয়াবিয়ার মুত্যুর পর তার মনোনয়ন অনুসারে পুত্র এজিদ বিন মুয়াবিয়া ৬১ হিজরির শাবান মাসে মসনদ দখল করে নেয়। এটি ছিল হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে খলিফা নির্বাচনের চরম ব্যত্যয়। এজিদ ছিল হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ বিবর্জিত লোক। সে সিংহাসনে আরোহণ করে হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশাবলি পদদলিত করতে থাকে এবং মোহাম্মদী ইসলামকে তার মতো করে বিকৃত করতে বদ্ধ পরিকর হয়। সেজন্য মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) স্বৈরাচারী এজিদের খেলাফত মেনে নিতে পারেননি। কুফাবাসীও এজিদের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-কে হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ রক্ষার পক্ষে আহ্বান জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার পরিজন ও সঙ্গী নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। ইতোমধ্যে কুফাবাসী এজিদের চক্রান্তে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পক্ষে এগিয়ে আসতে পারেনি। এজিদের বিশাল বাহিনী এই সুযোগে ১০ মহররম তথা আশুরার দিন কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরাপরাধ এবং যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তাঁর পরিবার পরিজন ও সঙ্গীদের উপর।
পরম করুণাময়ের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে অকুতোভয় চিত্তে ইমাম হোসাইন (রা.) আক্রমণের প্রতিরোধ করেন। অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথানত না করে সত্য ও ন্যায়ের পতাকাকে উড্ডীন করার জন্য যুদ্ধ করে অবশেষে শহিদ হন। তাঁর এ আত্মত্যাগ প্রতিটি মুসলমানের জন্য প্রেরণার উৎস, মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে আছে। এজিদের মতো মদ্যপ, নারী লিপ্সু এবং ধর্ম বিশ্বাসহীন লোক কোনো ক্রমেই হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরি হতে পারে না। সেদিন যদি ইমাম হোসাইন (রা.) এজিদের বিরোধিতা না করতেন তাহলে বিশ্ববাসী এজিদকে হযরত রাসুল (সা.)-এর খলিফা হিসেবে মনে করতেন এবং এজিদ ও তার অধীনস্থদের অনাচার, অবৈধ যৌনাচার ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধী অপকর্মকে ইসলামের বিধান মনে করে ইসলাম ধর্মকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর জীবন উৎসর্গ করে ইসলামকে সে অপবাদ থেকে রক্ষা করেছেন। ইমাম হোসাইন (রা.) এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মসনদের লোভে নয়, বরং হযরত রাসুল (স.) এর আদর্শকে রক্ষার জন্য। এ বিষয়টি অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে একজন মু’মিনের ইমানের গভীরতা।
আশুরার দিনটি ইসলামের ইতিহাসে আরো অনেক ঘটনার কারণে মর্যাদাবান হলেও কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শহিদ হওয়ার বিষয়টি মু’মিনের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। মহররম শব্দের অর্থ পবিত্র। এ মাসে ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ করা নিষিদ্ধ। হযরত রাসুল (সা.) এ মাসে কোনো জিহাদেও অংশ নেননি। মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ এ চারটি মাসকে আল্লাহ্ তায়ালা পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হয়েছে “এর চারটি মাস সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ মাসগুলোর ব্যাপারে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না।” (সূরা তওবা ৯: আয়াত ৩৬) অথচ সেই মাসেই এজিদের বাহিনী হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্রকে নির্মমভাবে শহিদ করে নিজকে ইসলামের কাণ্ডারি হিসেবে ঘোষণা দেয়। এজিদ এ জঘন্য কাজ করতে গিয়ে মহান আল্লাহর আদেশ যেমন অমান্য করেছে, তেমনই হযরত রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শান ও মান বিবেচনা করেনি। আর করবেই বা কেন সেতো ইসলামের ছত্রছায়ায় বর্ণচোরা চরিত্রের লোক। ক্ষমতার লোভে হযরত রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্রকে হত্যা করতে তার বিবেক বাধা দিবে কীভাবে। এটা যে কত জঘন্য কাজ তা উপলদ্ধি করার মতো মন মানসিকতা সে পাবে কোথায়। আফসোস হয় তাদের জন্য যারা মু’মিন হিসেবে দাবী করে, অথচ দুরাচারি এজিদের এহেন অপকর্মকে ধিক্কার না দিয়ে তার পক্ষে সাফাই গায় অথবা এ ঘটনাকে মোটেই আমলে নেয় না। বিষয়টিকে রাজনৈতিক হিসেবে চালানোর চেষ্টার পক্ষ সমর্থন করে।
রাহ্মাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর কাছে তাঁর দুই দৌহিত্র ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। তাঁদের দেখার নিমিত্তে তিনি প্রায়ই তাঁদের ঘরে যেতেন। খেলতে দেখে প্রীত হতেন এবং বুকের সাথে বুক লাগিয়ে আদর করতেন। মাঝে মধ্যে নামাজ আদায়ের সময় তাঁর দৌহিত্রদ্বয় এসে পিঠে উঠে বসে থাকতেন। হযরত রাসুল (সা.) ধীরস্থিরে নামাজ সম্পন্ন করে তাঁদেরকে নিজের কোলে নিয়ে বসতেন। তিনি একদা মসজিদে শুক্রবারের খুৎবা প্রদানকালে শিশু ইমাম হোসাইন (রা.) প্রবেশ করলে তাঁকে দেখে মিম্বর হতে নেমে আসেন এবং তাঁকে কোলে তুলে বুকের সাথে লাগিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন, “হে আল্লাহ্! আমি তাঁদের উভয়কেই ভালোবাসি। আপনিও তাঁদের একইরকম ভালোবাসুন।” (বোখারি শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩০) দয়াল রাসুল (সা.) যাঁকে এতটা ভালোবাসেন তাঁকে যে নির্মমভাবে শহিদ করে তাকে কীভাবে সমর্থন করা যায়? ইমাম হোসাইন (রা.) মু’মিনের অতি আপনজন, তাঁকে যে ভালোবাসবেন মহান আল্লাহ্ ও দয়াল রাসুল (সা.) তাকে ভালোবাসবেন। আমরা যদি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি অনাচারকে ঘৃণার চোখে দেখতে না পারি তাহলে হযরত রাসুল (সা.)-এর সুপারিশ পাব কীভাবে? আর তাঁর সুপারিশ ছাড়া মুক্তিই বা মিলবে কীভাবে? এজিদের জঘন্য কাজকে আমলে না নিলে আমরা কি এজিদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবো না? সেজন্য কারবালার ঘটনা মু’মিনের জন্য ইমানি পরীক্ষা। এ পরীক্ষাই নির্ধারিত হবে আমরা কি দয়াল রাসুল (সা.)-এর নাকি এজিদের। হযরত রাসুল (সা.)-এর দলভুক্ত হতে হলে তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। অন্যথায় কী হবে মহান আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন- “[হে রাসুল (সা.)!] আপনি বলুন আমি আমার দাওয়াতের বিনিময়ে তোমাদের কাছে আত্মীয়তার সম্প্রীতি ব্যতিরেকে অন্য কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করি না।” (সূরা আশ শুরা ৪২: আয়াত ২৩) এ আয়াত দিয়ে আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত ফরজ করে দিয়েছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উক্ত আয়াত নাজিলের পর সাহাবায়ে কেরাম হুজুর পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনার কোন নিকটাত্মীয়, যাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাজিল হলো? জবাবে নবি করিম (সা.) বলেন, আলী, ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন। তাছাড়াও সূরা আলে ইমরানের ৬১নং আয়াত নাজিলের পর হযরত রাসুল (সা.) আলী, মা ফাতেমা, ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)-কে গায়ের কালো কম্বলের ভিতর ডেকে বললেন, হে আল্লাহ্ সাক্ষী থাকুন তারাই আমার নিকটাত্মীয়।
মহান আল্লাহ্ ফরমান, “তোমরা সকলে আল্লাহর রশ্মিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যেও না।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১০৩) এ সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেন “আমি তোমাদের কাছে এমন কিছু বস্তু রেখে যাচ্ছি তোমরা যদি সেসব ধারণ করে রাখ, তবে আমার পরে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না তোমরা। এর একটি আরেকটির চেয়ে মহান- তা হলো আল্লাহর কিতাব আকাশ থেকে জমিন পর্যন্ত বিস্তৃত এক সুদূঢ় রজ্জু। আর আমার পরিবার আমার আহলে বাইত। হাওজে কাওছারে আমার কাছে আগমন করা পর্যন্ত এরা বিচ্ছিন্ন হবেনা কখনও।” (তিরমিজী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৯) যারা তাদের সঙ্গে দৃঢ় মহব্বত রাখবেন তারাই আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরেছেন বলে বিবেচিত হবে। যাঁকে ভালোবাসার জন্য স্বয়ং আল্লাহ্ পাক নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর শত্রুর পক্ষের জঘন্য কার্যক্রম একজন মুসলমান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। তাতে সে আল্লাহর রজ্জু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এটাতো মহান আল্লাহ্ পাকের ঘোষণা। বিষয়টি নিয়ে মু’মিন ভাইদের গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন। ইতিহাস এজিদকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু আমরা অনেকেই এখনো তাকে আমির মুয়াবিয়ার পুত্র হিসেবে মর্যাদার আসনে রেখেছি। এটা হতে পারে না। নিজস্ব জ্ঞান বুদ্ধি প্রয়োগ করে দয়াল রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পক্ষ সমর্থন করার মাধ্যমে ইমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারলে বিপদ।
গাদিরে খুমের ভাষণে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, আমি দুটি ভারি জিনিষ তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি। তোমরা তা মজবুত করে আঁকড়ে ধরে রাখলে বা আমলে নিয়ে এলে আমার পরে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না বা অন্ধকারে পড়ে মরবে না। এ দুটি ভারি জিনিষের মধ্যে একটি হচ্ছে কিতাবুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর বাণী পাক কুরআন ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে আমার আহলে বাইত। এ দুটি ভারি জিনিষ কখনো একটি অপরটি হতে পৃথক হবে না হাউজে কাউছার পর্যন্ত। হযরত ইয়া’লা ইবনে যুররাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন- “হোসাইন আমা হতে আর আমি হোসাইন হতে। যে হোসাইনকে ভালোবাসিবে আল্লাহ্ তাকে ভালোবাসিবেন। হোসাইন বংশসমূহের মধ্যে একটি বংশ।” (তিরমিজী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৮) তাহলে এজিদ শুধু ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সাথে শত্রুতা করেননি প্রকারান্তরে হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে শত্রুতা করেছে। কোনো মু’মিন নিশ্চয় রাসুল (সা.)-এর শত্রুকে মেনে নিবেন না। সেজন্য স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে এ নিগূঢ় বিষয়টি উপলদ্ধি করে ইমানি পরীক্ষায় পাশ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
আহলে বাইতের সদস্যগণ শুধু গুনাহ থেকেই মুক্ত নন বরং সকল প্রকার চারিত্রিক ও আচরণগত অপকৃষ্টতা থেকেও মুক্ত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন- “হে নবি পরিবার! আল্লাহ্ তো তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে চান এবং তোমাদেরকে সর্বতোভাবে পবিত্র রাখতে চান। (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ৩৩)।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেছেন, যখন রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে আপনি আপনার আহলে বাইতের মধ্য থেকে কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন? তিনি বলেন হাসান ও হোসাইনকে। প্রিয় রাসুল (সা.) প্রায়ই ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনকে তাঁর বুকে চেপে ধরে তাঁদের পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিতেন এবং তাদের চুম্বন করতেন। খুতবায় আমরা ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)-কে বেহেশতে যুবকদের নেতা বলে উল্লেখ করি। অথচ সেই নামাজী মুসলমানদের অনেকেই কারবালার ঘটনায় এজিদের জঘন্য কাজের ন্যাক্কারজনক অধ্যায়কে উপলদ্ধি করতে পারে না। মুসলমানদের অজ্ঞতা এবং শত্রুদের চক্রান্তের কারণেই এ প্রথা চলে আসছে মুসলিম সমাজে। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি এজিদ কারবালার প্রান্তরে যে অন্যায় করেছিল দিন দিন মানুষ তা ভুলতে বসেছে। আমরা এভাবে জীবন পরিচালিত করে যদি এজিদের কার্যক্রমকে ঘৃণা করতে না পারি এবং ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগকে মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হই তাহলে আমরা রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসা পাবো না, বরং তিনি হয়ত সেদিন মুখ ফিরিয়ে বলতে পারেন যাও দেখ এজিদের ভালোবাসা কোনা কাজে আসে কিনা, যা আমাদের জন্য হবে ভয়ঙ্কর।
ইমাম হোসাইন (রা.) যে ঘটনায় নির্মমভাবে এজিদের বাহিনী দ্বারা পরিবার পরিজনসহ শহিদ হলেন সেই ঘটনাকে একজন মুসলমান ভুলে কীভাবে! এ ঘটনায় যদি কেউ আদর্শগতভাবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পক্ষ সমর্থন না করেন তাহলে রাসুল (সা.)-এর বর্ণনানুযায়ী সে হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসে না। আর রাসুল (সা.)-কে যে সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালো না বাসতে পারবে সে মু’মিন হতে পারে না। এ ভালোবাসা হবে নিঃশর্ত ভালোবাসা। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি ভালোবাসাও হবে তেমনই। অথচ মুসলমান হয়েও অনেককে বলতে শুনি কারবালার ঘটনা শিয়াদের বিষয়। কত বড়ো ভুল আমাদের। এ কথা বললে আমরা কি রাসুল (সা.)-এর উম্মত দাবী করতে পারি। হযরত রাসুল (সা.) যাঁকে মহব্বত করেছেন আমরা যদি তাঁকে মর্যাদা দিতে না পারি তাহলে আমরা কীভাবে ইমানদার দাবী করতে পারি। তাছাড়া আল কুরআনের সুরা শুরার ২৩নং আয়াতের বিধানমতে হযরত রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইতকে ভালোবাসা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। মু’মিন হতে হলে এ বিষয়টি উপলদ্ধি করা দরকার। হযরত রাসুল (সা.) বলতেন যারা আমার আহলে বাইতকে ভালোবাসে, তাঁরা আমাকে ভালোবাসে। যারা তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তারা আমার সম্পর্কেও বিদ্বেষ পোষণ করে। আমি হোসাইনের এবং হোসাইন আমার। যে হোসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তায়ালাও তাকে ভালোবাসেন। সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান তাই বলেছেন কারবালার ঘটনা শুধুমাত্র শিয়াদের হতে পারে না। এটি মুসলিম উম্মার সকলের। এর তাৎপর্য উপলদ্ধি করেই ইমানদার হতে হয়। অন্যথায় রাসুল (সা.)-এর সাথে বিদ্বেষের তুল্য হিসেবে গণ্য হয়। কারবালার ঘটনা মু’মিনের জন্য এমনই ইমানি পরীক্ষার বিষয়।
কারবালার যুদ্ধের পর ৮৯ বছর এজিদ গোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। এ গোষ্ঠিই রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে মানুষের মন থেকে কারবালার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ঘটনা প্রবাহকে ভিন্ন খাতে রূপ দিতে প্রয়াস পেয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, কেননা সব অপরাধীই সুযোগ পেলে তার অপরাধকে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে। আমরা কি সেই ষড়যন্ত্রে পা দেবো নাকি সত্যকে গ্রহণ করব। সিদ্ধান্ত সকল মুসলমানকেই নিতে হবে। বিষয়টি আমাদের জন্য একটি ইমানি পরীক্ষার জীবন্ত অধ্যায় হিসেবে বিদ্যমান। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শরীরে দয়াল রাসুল (সা.)-এর পবিত্র রক্ত বহমান এবং তিনি সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক। সেই ইমাম হোসাইন (রা.), তাঁর পরিবার ও সাথীদের আত্মত্যাগ যদি আমাদের হৃদয়ে নাড়া না দেয় তাহলে হযরত রাসুল (সা.) আমাদের মুক্তির জন্য ভাববেন তা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র। সেজন্য কারবালার ঘটনা যদি কারো হৃদয়ে রেখাপাত করে তবেই বুঝতে হবে সে আশেকে রাসুল এবং সেই ইমানদার। আর এ ঘটনাকে অবজ্ঞা করে যারা কুরআন ও হাদিসের বিরুদ্ধাচরণ করে, রাসুলের আহলে বাইতের মান শানের প্রতি অবজ্ঞা করে তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
কবি বলেছেন, “ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালাকে বাদ।” অর্থাৎ “কারবালা যুদ্ধের পর ইসলাম সত্যিকার অর্থে পুনর্জীবিত হলো।” ইমাম হোসাইন (রা.) বলতেন, “জিল্লতি বরদাশত করার চেয়ে মৃত্যুই উত্তম।” আজ মুসলিম উম্মাহ সেই গৌরবজনক অধ্যায় ভুলে গেছে। ত্যাগ, নিষ্ঠা ও কোরবানির শিক্ষা হারিয়ে ঘটনাকে ভুলতে বসেছে। মুসলিম জাতি ঘুমিয়ে আছে। অথচ ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জাগ্রত করার জন্য ৬১ হিজরিতে ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের পবিত্র রক্ত কারবালার জমিনে ঢেলে দিয়ে গেছেন। কারবালার প্রান্তরে পাপিষ্ঠরা যে নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছে, তাতে পাথরের বুকেও রক্ত ঝরে অথচ আমাদের অনেকের হৃদয়ে ঝরে না। শাহাদতের পর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পবিত্র দেহে ৩৩টি বর্শা ও ৩৪টি তরবারির আঘাত দেখা গিয়েছিল। শরীরে ছিল অসংখ্য তিরের জখমের চিহ্ন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মাথা মোবারক এবং দেহ মোবারকের রওজা হলো দুই দেশে। এমন পৈশাচিকতাকে কোনো বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। মহান আল্লাহ্ পাক যাঁকে নিষ্পাপ ঘোষণা করেছেন। তাঁর প্রতি এমন অত্যাচারকে কে কীভাবে দেখছেন তা দিয়েই নির্ধারিত হবে ইমানের মাত্রা। যাঁকে হারিয়ে আকাশ বাতাস কাঁদে তার কারণে আমরা যদি ব্যথিত না হই, তাহলে আমরা মু’মিনতো দুরের কথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দাবী করি কীভাবে?
কারবালার ঘটনার মধ্যে মুসলমানদের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠাকল্পে আত্মত্যাগের এক অনুপম আদর্শ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতালিপ্সা ও মসনদের লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে উঠে ইমাম হোসাইন (রা.) বুকের তাজা রক্ত প্রবাহিত করে ইসলামের শাশ্বত নীতি ও আদর্শকে সমুন্নত করে গেছেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের আদর্শ প্রজ্বলিত হয়েছে। সত্যের জন্য শাহাদতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত আছে কারবালার ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এ দিবসের শিক্ষণীয় ও করণীয় হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করা। কারবালার শোকাবহ ঘটনার শাশ্বত বাণী তাই অন্যায় প্রতিরোধ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়। কারবালা শিক্ষা দিয়েছে যে সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.), কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। কারবালায় তপ্ত খুন দ্বারা ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এক অমর ইতিহাস রচনা করেছেন এবং প্রজ্বলিত করেছেন ইসলামি চেতনার অনির্বাণ মশাল। সেই মশালের আলোতে আমাদের পথ চলা দরকার। তা না হলে আমাদের ইমান অন্ধকারে পতিত হতে পারে।
এজিদের চক্রান্তে মুসলিম উম্মাহ ইসলামের সঠিক ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই উপলদ্ধি করতে পারেনি। তাই এজিদের উত্তরসূরিরা বহাল থেকে আমাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। যারা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে শহিদ করেছে তারা চেয়েছে কেউ যেন এ ঘটনা স§রণ না করে। ঘটনার সাথে রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে ঘোলাটে করার চেষ্টা করেছে। ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন তাঁর যুগে মুসলিম জাহানের ইমাম। পার্থিব ক্ষমতার জন্য তাঁর কোনো লোভ থাকতে পারে না। তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর আদর্শকে লালন করা। এখানে হয়েছেও তাই। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেছেন, এ চক্রান্তের বেড়াজাল পেরিয়েই আশেকে রাসুল হতে হয়। আমরা উপলদ্ধি করব এ দিনটি রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সত্যকে রক্ষা করতে গিয়ে নির্মমভাবে শহিদ হওয়ার দিন। আমাদের অন্তরে ক্ষত সৃষ্টির দিন। এ উপলদ্ধি দিয়েই ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
শুধু মাত্র নিজেকে ইমানদার বলে দাবী করলেই ইমানদার হওয়া যায় না। প্রকৃত ইমানদার হতে তাকে ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল করিমে আল্লাহ্ পাক বলেন, “তোমরা কি মনে করো যে, তোমরা বেহেশতে চলে যাবে, যদিও এখনও তোমরা তাদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে?” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ২১৪) তিনি আরো বলেন, “অবশ্য ধন সম্পদে এবং জন সম্পদে তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং অবশ্য তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের এবং মুশরেকদের কাছে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং পরহেজগারী অবলম্বন করো, তবে তা হবে একান্ত সৎ সাহসের ব্যাপার।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৮৬) মহান আল্লাহ্ অন্য আয়াতে বলেন, “যদি আল্লাহ্ চাইতেন, তবে অবশ্যই তিনি তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি- যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব দৌঁড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন করো।” (সূরা মায়িদা ৫: আয়াত ৪৮) তিনি আরো বলেন, “আমি তোমাদেরকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি মন্দ ও ভালো দিয়ে; এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ৩৫) কুরআনের অনেক আয়াতেই এ ধরনের পরীক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারবালার ঘটনাটিও মু’মিনের জন্য তেমনি একটি ইমানি পরীক্ষা।
প্রত্যেক মু’মিনের ইমানি দায়িত্ব আহলে বাইতের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া। কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সকল মুমিনের ইমানদীপ্ত পরকালমুখী জীবন গড়ে তোলা দরকার। আমরা সবাই যেন কারবালার ঘটনা বুঝে এবং হৃদয়ে ধারণ করে আহলে বাইতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারি। যারা এখনো কারবালার ঘটনা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেননি তারা একটু চিন্তা করলেই আহলে বাইতের নির্মম শাহাদতের বেদনা হৃদয়ে অনুভব করতে পারবেন। আল্লাহর দরবারে ইমানি পরীক্ষায় পাশ করাও সহজ হবে। আমরা যেন হযরত রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শান মান উপলদ্ধি করে এবং তাঁকে ভালোবেসে ইমানি পরীক্ষায় পাশ করতে পারি। মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক: অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]