কারবালা ও ইমাম হোসাইন (রা.)
ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা: মোহাম্মদী ইসলামের ইতিহাসে ৬১ হিজরির ১০ই মহররমের কারবালার নির্মম ঘটনা সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। কেননা এই দিনটিতে দোজাহানের বাদশাহ্ রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র এবং শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও নবিনন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.)-এর কলিজার টুকরা ও হৃদয়ের ধন সাইয়্যেদিনা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে সপরিবারের নির্মমভাবে শহিদ করা হয়। মোহাম্মদী ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ রক্ষায় ইমাম হোসাইন (রা.), তাঁর পরিবারের সদস্য এবং কতিপয় আশেকে রাসুলের সেদিনের আত্মত্যাগ সত্যিকার রাসুল প্রেমিকদের হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি, বরং সত্য ও ন্যায়ের পতাকা উড্ডীন করার জন্য কারবালার প্রান্তরে আত্মত্যাগের যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা আশেকে রাসুলদের জন্য প্রেরণার উৎস এবং মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ।
কারবালার প্রান্তরের নির্মম ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হলো-
৯ই মহররম
৬১ হিজরির ৯ই মহররম, বৃহস্পতিবার দুপুর বেলা ইমাম হোসাইন (রা.) নিজ তাঁবুর সম্মুখে বসাছিলেন। এমতাবস্থায় শোরগোল দেখা দিলে তিনি তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই হযরত আব্বাস আলমদার ইবনে আলী (রহ.)-কে খোঁজ নেওয়ার জন্য বললেন। তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)-কে জানালেন যে, ইয়াজিদের সেনাপতি ওমর ইবনে সাদের সৈন্যরা যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসছেন। ইমাম হোসাইন (রা.) হযরত আব্বাস (রহ.)-কে বললেন, “তুমি ওমর ইবনে সাদের নিকট গিয়ে বলো এই মুহূর্তে যেন যুদ্ধ শুরু করা না হয়, আমাদের যেন একটি রাতের অবকাশ দেওয়া হয়, যেন এই রাতে আমরা ইবাদত বন্দেগি করতে পারি।” হযরত আব্বাস (রা.) ত্রিশজন অশ্বারোহীসহ ওমর ইবনে সাদের নিকট গমনপূর্বক ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বার্তা পৌঁছে দিলেন। ওমর ইবনে সাদ ইমামের প্রস্তাবে সম্মত হলো। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর একটি রাতের সময় চাওয়ার বিষয়ে কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে ১০ই জিলহজ কোরবানি করতে নিয়েছিলেন। তাই ইমাম হোসাইন (রা.) সেটার দিকে লক্ষ্য রেখে নিজের জীবনকে উৎসর্গের জন্য ১০ই মহররম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া ছয় মাসের কম বয়স হলে কোরবানি করা যায় না। হযরত আলী আসগর ইবনে হোসাইন (রহ.)-এর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হতে একদিন বাকী ছিল, সেই কারণেও একদিন সময়ের প্রয়োজন ছিল। আবার অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর অনুসারীদেরকে একটি সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন যেন তাঁরা ইমামের জন্য বাধ্য হয়ে জীবন দিতে না হয় এবং অন্ধকারে তাঁরা যেন তাঁদের জীবন বাঁচিয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারেন। এই লক্ষ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবারের সদস্য ও সকল সাথির উদ্দেশে বলেন, “এজিদের সৈন্যরা শুধু আমাকে চায়, আপনাদের নয়। সুতরাং আপনারা কেন তাঁদের হাতে শহিদ হতে যাবেন।… আমি আমার সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিলাম। …
আপনারা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। এ ব্যাপারে সিদ্বান্ত নিতে এবং এখান থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে নিতে আপনাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেজন্য আমি আমার প্রদীপ নিভিয়ে দিলাম।” এ বলে তিনি তাঁর প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ পর যখন ইমাম হোসাইন (রা.) প্রদীপ জ্বালালেন, তখন দেখতে পেলেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও সাথিগণ প্রত্যেকে একে অপরের হাত ধরে আছেন। কেউই সেখান থেকে প্রস্থান করেননি, সবার চোখ দিয়ে প্রেমের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অতঃপর তাঁর পুত্র, ভাতিজা, ভাগ্নে ও বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরা কি শুধু এই উদ্দেশ্যেই চলে যাবো যে, আপনার পর আমাদের বেঁচে থাকতে হবে? ঐ দিন যেন আল্লাহ্ আমাদের না দেখান।” ইমাম হোসাইন (রা.) হযরত মুসলিম বিন আকিল (রা.)-এর সন্তানদের উদ্দেশে বললেন, “মুসলিমের শাহাদত তোমাদের জন্য যথেষ্ট, কাজেই আমি তোমাদের অনুমতি দিচ্ছি তোমরা চলে যাও।” ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রেম ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তাঁর নিকটাত্মীয় একজন বললেন, “আমরা মানুষদের কী জবাব দেবো? নিজের সর্বোত্তম ভাইকে, ইমামকে আমরা শক্রদের কবলে রেখে চলে এসেছি? এটাও কি হয় যে, আমরা তাঁর সহযোগী হয়ে একটি তির চালাইনি, না একটা বর্শা নিক্ষেপ, না তরবারি একটি আঘাত এবং জানতেও পারবো না শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত ভাইটির কী পরিণাম হলো? খোদার কসম! আমরা কখনো এমনটি করব না, বরং আমরা নিজেদের জান-মাল, পরিবার-পরিজন সবকিছু আপনার কদম পাকে উৎসর্গ করব। আপনার সাথে মিলে আপনার দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। যে পরিণাম আপনার হবে, সেটা আমাদেরও হবে। আল্লাহ্ যেন আমাদের সেই জীবন না দেন, যেন আপনার পরে বেঁচে থাকতে হয়।”
এরপর হযরত মুসলিম বিন আওসাজা আল আসাদী (রা.), হযরত সা’দ বিন আবদুল্লাহ্ হানাফি (রা.) ও হযরত জুহাইর বিন কায়েন (রা.) দাঁড়িয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ সংবলিত মোহাম্মদী ইসলাম রক্ষায় নবিদৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবারের সদস্য ও সাথিদের আনুগত্য ও আত্মত্যাগের দৃঢ় মনোবল দেখে সন্তুষ্ট হন এবং তাঁদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন। এদিকে ১০ই মহররম ভোরে ইয়াজিদের অন্যতম সেনাপতি হোর ইবনে ইয়াজিদ আর রাইয়াহী তাঁর ভুল বুঝতে পেরে তিনি তাঁর ভাই, পুত্র ও কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সত্যের পক্ষে থেকে যুদ্ধ করার জন্য ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কদম পাকে নিজেদের উৎসর্গ করেন। উল্লেখ্য যে, ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য ইয়াজিদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম হুর বিন ইয়াজিদ রাইয়াহীকে ১ হাজার সশস্ত্র অশ্বারোহী বাহিনীসহ প্রেরণ করা হয়।
১০ই মহররম
১০ই মহররম ফজরের নামাজের পর ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর ৭২ জন সঙ্গীকে নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। মোহাম্মদী ইসলামের দলে ৩২ জন অশ্বারোহী ও ৪০ জন পদাতিক সৈন্য ছিল। এই ৭২ জন সৈন্যের মধ্যে ১৪/১৮ বছরের হযরত কাসিম বিন হাসান (রহ.) যেমন ছিলেন, তেমনি ৭০ বছরের বৃদ্ধ হযরত মুসলিম বিন আওসাজা (রা.) ছিলেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ রক্ষায় ৭২ জন নবি প্রেমিক খোদায়ী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ২২ হাজার এজিদ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার দৃঢ় সংকল্পে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিবেন, তবুও অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে মাথা নত করবেন না। ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর সৈন্যবাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ডান দিকের নেতৃত্ব অর্পণ করেন হযরত জুহাইর বিন কাইন (রা.)-এর উপর, আর বাম দিকের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন হযরত হাবিব বিন মুহাজির (রা.)-কে এবং তাঁর ভাই হযরত আব্বাস আলামদার ইবনে আলী (রহ.)-কে সমস্ত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করেন। এদিকে তাঁবুর পিছনের দিক সুরক্ষার জন্য কাঠের স্তুপ করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যেন এজিদ বাহিনী পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে।
ফজরের নামাজের পর যুদ্ধ শুরু হয়। এজিদ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ ইয়াজিদের পক্ষ থেকে পুরস্কার পাওয়ার লোভে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দিকে একটি তির নিক্ষেপ করে তার সৈন্যদের উদ্দেশে বলল, “সাক্ষী থেকো, সর্বপ্রথম তির আমিই মেরেছি।” এদিকে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গীরা যতক্ষণ জীবিত ছিলেন তাঁরা ইমাম পরিবারের কাউকে যুদ্ধ করতে দেননি। একে একে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গীরা প্রাণপণ লড়াই করে শহিদ হচ্ছিলেন। আরবের যুদ্ধ রীতি অনুযায়ী উভয় পক্ষ থেকে একজন করে এসে দ্ব›দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হতো। এজিদ বাহিনী দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যখন একের পর এক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছিল, তখন তারা একযোগে আক্রমণ করে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গীদেরকে নির্মমভাবে শহিদ করছিল, যা ছিল প্রচলিত যুদ্ধ রীতির নিয়ম বহির্ভূত। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গীদের মধ্যে শহিদ হয়েছেন এমন উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন হযরত মুসলিম ইবনে আওসাজা (রা.), তাঁর ৯/১০ বছরের সন্তান হযরত হাবিব (রহ.), হযরত হুর (রহ.), হযরত জুহাইর ইবনে কাইন বাজলী (রা.), হযরত হাবিব ইবনে মুজাহের (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমের আল কালবি (রা.), হযরত সাদ বিন আবদুল্লাহ হানাফি (রা.), হযরত ওয়াহাব কালবি প্রমুখ।
অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ইমাম ভক্তরা যখন সবাই শহিদ হয়ে গেলেন, তখন ইমাম পরিবারের সদস্যরা একজন একজন করে যুদ্ধের ময়দান যাচ্ছিলেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বৈমাত্রেয় ৬ ভাই যথাক্রমে হযরত আব্বাস ইবনে আলী (রহ.), হযরত জাফর ইবনে আলী (রা.) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আলী (রা.), হযরত উসমান ইবনে আলী (রহ.), হযরত আবু বকর ইবনে আলী (রহ.) ও হযরত মুহাম্মদ ইবনে আলী (রহ.) প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহিদ হন। নবিদৌহিত্র হযরত হাসান (রা.)-এর ৩ পুত্র যথাক্রমে হযরত কাসেম (রহ.), হযরত আবদুল্লাহ্ (রহ.) ও হযরত আবু বকর (রহ.) অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন এবং নির্মমভাবে শহিদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ২ পুত্র হযরত আলী আকবর (রহ.) ও ৬ মাসের শিশুপুত্র হযরত আলী আসগর (রহ.)-ও মর্মান্তিকভাবে শহিদ হন। শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও নবিনন্দিনী হযরত ফাতেমা (রা.)-এর কন্যা হযরত জয়নব (রা.)-এর দুই পুত্র হযরত আওন ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফর (রহ.) ও হযরত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফর (রহ.) নির্মমভাবে শহিদ হন। এছাড়া ইমাম হোসাইন (রা.) চাচাতো ভাইসহ নিকটাত্মীয় অনেকে কারবালার প্রান্তরে নিজেদের উৎসর্গ করেন। তাঁদের এই আত্মত্যাগ ও আনুগত্য ছিল নবিদৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এই অত্যুজ্জ্বল ভালোবাসার মূল কারণ হচ্ছে ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর সুমহান আদর্শে আদর্শবান। তাই ইমামের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশ মূলত আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যেরই প্রকাশ।
হযরত আলী আসগর ইবনে হোসাইন (রহ.)-এর শাহাদত
কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-সহ ৭২ জন সঙ্গীর প্রত্যেকে যেভাবে শহিদ হয়েছিলেন, তা ছিল মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। বিশেষ করে ইমামের ৬ মাসের শিশুপুত্র হযরত আসগর ইবনে হোসাইন (রহ.)-এর শহিদ হওয়ার ঘটনাটি কথা স্মরণ হলে যে কোনো নবি প্রেমিকের চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। হযরত আলী আসগর (রহ.) পানির তৃষ্ণায় ছটফট করছিলেন। এজিদের সৈন্যরা ফোরাত নদী অবরুদ্ধ করে রাখায় সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না। এদিকে ইমাম শিবিরে একফোটা পানিও নেই। ইমাম হোসাইন (রা.) বাধ্য হয়ে হযরত আলী আসগর (রহ.)-কে কোলে নিয়ে রণাঙ্গনে গিয়ে এজিদ সৈন্যদের উদ্দেশে বললেন, “এ শিশু ৩ দিন যাবৎ ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত। পানির তৃষ্ণায় সে ছটফট করছে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি ওর জন্য একটু পানির ব্যবস্থা করবে?” কিন্তু পাষণ্ড এজিদ সৈন্যদের হৃদয়ে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ল না। এজিদ সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ, হুরমুলা ইবনে কাহেল আসাদি নামক এক পাপীষ্ঠকে নির্দেশ করল তির নিক্ষেপ করার জন্য। হুরমলা এমন জোরে এক তির ছুঁড়ে মারলো, যা হযরত আলী আসগর (রহ.)-এর কণ্ঠনালী ভেদ করে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বাহু মোবারকে গিয়ে বিঁধল। তিরের দ্রুতগতির কারণে শিশু আলী আসগর (রহ.)-এর দেহ মোবারক ইমাম হোসাইন (রা.)-এর হাত মোবারক থেকে উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। তিনি দ্রুত আলী আসগর (রহ.)-কে চেপে ধরলেন এবং বাহু থেকে তির বের করলেন। সেসময় ইমামের বাহু থেকে এবং আলী আসগর (রহ.)-এর গলা থেকে পবিত্র রক্ত অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসলো। ইমাম হোসাইন (রা.) শিশুপুত্রের পবিত্র রক্ত হাতে মুঠ করে নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “হে আল্লাহ্! এই লোকগুলোর কর্মকাণ্ড আমি তোমাকে সাক্ষী রাখছি। হে পরওয়ারদিগার! এই একটি সময়ে আমি যে পথে দ্রুত যাত্রা করছি, তার কঠিনতর মনজিলগুলো তোমার করুণাতেই হতে চলছে সহজতর।” এই কথা বলার পরই শিশু হযরত আলী আসগর (রহ.)-এর দেহ একবার কম্পন করে নিথর হয়ে গেল। পিতার কোলেই ৬ মাসের শিশু আলী আসগর (রহ.) শহিদ হলেন। ইমাম হোসাইন (রা.) শেষবারের মতো পুত্রের দুগালে স্নেহের চুমো খেলেন। অতঃপর হাত মোবারকে লেগে থাকা রক্ত দাঁড়ি মোবারকে রঙিন করে শহিদ পুত্রকে বললেন, “যাও আমার চাঁদ বদন! আমিও এ অবস্থায় তোমার রক্তে, মাখামাখি হয়ে প্রিয় নানাজির কাছে এসে পড়ছি। আর তাঁকে দেখাতে আসছি যে, এ দুরাচার উম্মতেরা তোমার এবং আমার কী অবস্থা করেছে।” অতঃপর ইমাম হোসাইন (রা.) শহিদ রক্তাক্ত আলী আসগর (রহ.)-কে কোলে নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। ৬ মাসের শিশুপুত্রের রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে মা হযরত রাবাব (রহ.) স্তব্ধ হয়ে গেলেন এবং দু’চোখের পানি ফেলে শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “হায় মানুষতো ৬ মাসের পশুকেও জবাই করে না। এ কেমন মুসলমান তৃষ্ণার্ত ৬ মাসের শিশুকে জবাই করে দিলো।” কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
দাউ দাউ জ্বলে শিরে কারবালা ভাস্কর,
কাঁদে বানু, পানি দাও মরে জাদু আসগর।
পেলো না তো পানি শিশু, দিয়ে গেল কাঁচা খুন,
ডাকে মাতা, পানি দেবো, ফিরে আয় বাছা শুন।
হযরত আব্বাস আলামদার ইবনে আলী (রহ.)-এর শাহাদত
কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পরিবারের সদস্য ও আহলে বাইত প্রেমিকেরা প্রাণপণ যুদ্ধ করে একে একে শহিদ হলেন। সেসময় পুরুষের মধ্যে শুধু বাকী ছিলেন ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর প্রিয় বৈমাত্রেয় ভাই হযরত আব্বাস আলামদার (রহ.) এবং ইমামের অসুস্থ ১১ বছরের পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদিন ইবনে হোসাইন (রহ.)। এমতাবস্থায় হযরত আব্বাস (রহ.) যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। ঠিক সেসময় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ১০ বছরের ছোটো মেয়ে হযরত সকিনা (রহ.) তাঁর চাচা আব্বাস (রহ.)-কে জড়িয়ে ধরে বললেন, “চাচাজান! তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। আপনি কি আমাকে সামান্য পানি এনে দিতে পারবেন না?” হযরত সকিনা (রহ.)-এর এই কথা শুনে আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর হযরত আব্বাস (রহ.)-এর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তিনি প্রাণপ্রিয় ভাতিজি সকিনা (রহ.)-এর জন্য পানি আনতে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নিকট ফোরাত নদীর দিকে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, “যাও ভাই, আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত রাসুল (সা.) তোমার সহায়। এক হাতে বর্শা, আর অন্য হাতে মশক নিয়ে ফোরাতের দিকে অভিযান করো।”
হযরত আব্বাস (রহ.) ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কদমবুসি করে বীর বিক্রমে ফোরাতের দিকে ছুটে চললেন। এজিদ সৈন্যরা আব্বাস (রহ.)-এর নিকট আসতে সাহস পাচ্ছিল না। তিনি নির্বিঘ্নে ফোরাতের তীরে পৌঁছে গেলেন এবং মশকে পানি ভর্তি করলেন। এসময় এজিদ সৈন্যরা একটা বৈষ্টনী তৈরি করে আব্বাস (রহ.)-কে ঘিরে ফেলল, যেন কোনো অবস্থাতেই পানি নিয়ে তিনি তাঁবুতে পৌঁছতে না পারেন। কিন্তু হযরত আব্বাস (রহ.) অদম্য গতিতে তাঁবুর দিকে ছুটে চললেন। এজিদ সৈন্য যারাই আব্বাস (রহ.)-কে পথরুদ্ধ করার জন্য আক্রমণ করছিল, প্রত্যেকেই আব্বাস (রহ.)-এর বর্শার আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এভাবে হযরত আব্বাস (রহ.) যখন এজিদ সৈন্যদের হত্যা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শত শত এজিদ সৈন্য একযোগে তাঁকে আক্রমণ করে। এমন সময় হাকিম ইবনে তোফায়েল নামের এক এজিদ সৈন্য হযরত আব্বাস (রহ.)-এর ডান হাতটি কেটে ফেলল। এমতাবস্থায় হযরত আব্বাস (রহ.) মুখ দিয়ে মশক কামড়ে ধরে এক হাতে বর্শা চালিয়ে তাঁবুর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। ঠিক সেসময় এক এজিদ সৈন্য অতর্কিত হামলা করে হযরত আব্বাস (রহ.)-এর বাম হাতটিও কেটে ফেলল। কিন্তু এরপরেও তিনি মুখে মশক কামড়ে ধরে ভাতিজি হযরত সকিনা (রহ.)-এর জন্য পানি নিয়ে ছুটে চলছেন তাঁবুর দিকে। এই প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন-
দুই হাত কাটা তবু শের নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে হাঁকে দুশমনও ‘সাব্বাস’।
দ্রিম দ্রিম বাজে ঘন দুন্দভি দামামা,
হাঁকে বীর ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’।
দুর্বার হযরত আব্বাস (রহ.)-কে লক্ষ্য করে এক এজিদ সৈন্য তির নিক্ষেপ করল, যা মশকে লাগলো এবং সম্পূর্ণ পানি কারবালার উত্তপ্ত বালুতে পড়ে গেলো। এমন সময় তামিম গোত্রের এক এজিদ সৈন্য লোহার গুর্জ ঘুরিয়ে হযরত আব্বাস (রহ.)-এর মাথায় আঘাত করল, সাথে সাথে তিনি ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন, অতঃপর চিৎকার করে তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর উদ্দেশে বললেন, “আকা! আমার শেষ সালাম গ্রহণ করুন।” উল্লেখ্য যে, ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি হযরত আব্বাস (রহ.)-এর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তি ও আনুগত্য। তাই তিনি ইমামকে ‘ভাইজান’ বলে সম্বোধন না করে ‘আকা’ (নেতা) বলে ডাকতেন।
হযরত আব্বাস (রহ.)-এর সালামের আওয়াজ শুনে ইমাম হোসাইন (রা.) তৎক্ষণাৎ সেই দিকে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন হযরত আব্বাস (রহ.) মাটিতে পড়ে আছেন। ইমাম হোসাইন (রা.) হযরত আব্বাস (রহ.)-এর মাথাকে নিজের কোলে তুলে নেন। হযরত আব্বাস (রহ.) বললেন, “আকা! আমি আমার প্রাণপ্রিয় ভাতিজি সকিনার জন্য পানি আনতে পারলাম না। ওকে বলবেন, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি ওর জন্য পানি আনতে।” অতঃপর হযরত আব্বাস (রহ.) বললেন, “ছোটো বেলায় আম্মাজানের নিকট থেকে শুনেছিলাম, দুনিয়ায় এসে সর্বপ্রথম আপনার চেহারা মোবারক আমি দেখেছিলাম, আজ পৃথিবী থেকে বিদায়বেলা আপনার চেহারা মোবারক দেখেই মরতে চাই। কিন্তু এক চোখে তিরবিদ্ধ হয়ে আছে, অন্য চোখে রক্ত জমে আছে। হাত নেই যা দিয়ে রক্ত সরিয়ে আপনার পবিত্র চেহারা দেখতে পারি।” ইমাম হোসাইন (রা.) হাত দিয়ে প্রিয় ভাইয়ের চোখের রক্ত মুছে দিলেন। হযরত আব্বাস (রা.) প্রাণভরে তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় ভাই ইমামের জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক দেখলেন। ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, “ভাই আব্বাস! তুমি সবসময় আমাকে ‘আকা’ বলে ডাকতে, কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে ‘ভাই’ ডাকটি শোনার জন্য ব্যাকুল থাকতাম, অথচ তুমি আমাকে আকা বলেই ডাকতে। আজকে তুমি আমাকে একটিবার ভাই বলে ডাকো।” হযরত আব্বাস (রহ.) বললেন, “আকা! এতো বড়ো বেয়াদবি আমি কী করে করি?” ইমাম হোসাইন (রা.) বললেন, “তোমার নিকট এটাই আমার অনুরোধ।” ইমামের এই কথাটি শোনার পর ‘ভাইজান’ শব্দটি উচ্চারণ করে আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর হযরত আব্বাস ইবনে আলী (রহ.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত:
কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) একে একে ৭২ জন সঙ্গীকে নির্মমভাবে শহিদ হতে দেখলেন। সঙ্গীরা প্রত্যেকেই নিজের জীবন থাকতে ইমামকে যুদ্ধে যেতে দেননি। এখন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর পালা। তিনি তাঁবুতে প্রবেশ করলেন। তাঁর যুদ্ধসামগ্রী বের করলেন। মিসরী কাবা (কোট বিশেষ) পরিধান করলেন। প্রিয় নানাজি হযরত রাসুল (সা.)-এর ব্যবহৃত পাগড়ি মোবারক মাথায় পরিধান করলেন। শহিদকুল সর্দার হযরত আমির হামজা (রা.)-এর বর্ম পরলেন। প্রাণের বড়ো ভাই ইমাম হাসান (রা.)-এর কোমরবদ্ধ নিজ কোমরে বাঁধলেন। পিতা শেরে খোদা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর তরবারি জুলফিকার হাতে নিয়ে নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করলেন। অতঃপর অসুস্থ পুত্র ইমাম জয়নাল আবেদিন (রহ.)-এর নিকট গিয়ে বললেন, “প্রিয় পুত্র! আল্লাহ্ তায়ালা তোমার থেকেই আমার বংশ জারি করবে। তুমি আমার স্থলাভিষিক্ত হবে।” এই কথা বলে ইমাম হোসাইন (রা.) নিজ পাগড়ি মোবারক ইমাম জয়নুল আবেদিন (রহ.)-কে পরিয়ে দিলেন। এর মাধ্যমে ইমামতের সুমহান দায়িত্ব হযরত জয়নুল আবেদিন (রহ.)-এর উপর অর্পণ করলেন। এরপর ইমাম হোসাইন (রা.) নবি পরিবারের সকল মহিলা সদস্যের সাথে সাক্ষাৎ করে শেষ বিদায় নিয়ে বীরদর্পে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রণাঙ্গনের দিকে ছুটলেন। জুলফিকার হাতে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে রণাঙ্গনে দেখে এজিদ সৈন্যদের অন্তরাত্মা কেঁেপ উঠল। সেসময় ইমাম হোসাইন (রা.) নিজ ব্যক্তিত্ব ও বংশ মর্যাদার উপর একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন-
সত্য প্রিয় ইবনে আলী বংশ আমার হাশেমি,
এ পরিচয় গর্ব আমার বংশে নবির এই আমি।
নানা আমার প্রিয় নবি, যাঁর তুলনা নেই ধরায়,
মানবরূপে প্রদীপ যেন খোদার পথে রইনু ঠায়।
জননী মোর মা ফাতেমা, নুর নবিজির শাহ্জাদি,
বেহেশত জুড়ে উড়ছে পাখায় জাফর আমার চাচাজি।
মোদের আছে সত্য নিয়ে নাজিল হওয়া এই কিতাব,
ঐশী বাণীর আলোক দিয়ে গড়া মোদের নেক স্বভাব। [ভাবানুবাদ]
এরপর ইমাম হোসাইন (রা.) এজিদ সৈন্যদের উদ্দেশে শেষবারের মতো সত্য পথের আসার আহব্বান জানিয়ে তেজোদীপ্ত বক্তব্য প্রদান করলেন। কিন্তু এজিদ সৈন্যরা কোনো কর্ণপাত করল না। এজিদ বাহিনীর নামকরা সৈন্যরা দ্ব›দ্বযুদ্ধের জন্য একের পর এক আসতে লাগলো এবং প্রত্যেকেই ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নিকট ধরাশায়ী হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। এজিদ বাহিনীর শক্তিশালী যোদ্ধা তামিম বিন কাহ্তাবা, জাবের ইবনে কাহের-সহ অনেকে ইমামের তরবারির এক আঘাতে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করল। এই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ক্রোধে বদর বিন সুহাইল ইয়ামনি সেনাপতি উমর ইবনে সাদকে বলল, “কী সব বীরত্বের কলঙ্ক, কাপুরুষদের আপনি হোসাইনের মোকাবেলায় পাঠাচ্ছেন, যারা ভালো করে দু’দণ্ড লড়তে পারে না, আমার চার পুত্রের মধ্যে যাকে চান এখন ময়দানে পাঠিয়ে দিন। আর দেখুন, আমার কাছ থেকে শিখে আমার সন্তানেরা আজ কেমন যুদ্ধ বিদ্যার পারদর্শী দেখায়।” ইবনে সাদ বদরের বড়ো পুত্রকে ইশারা করল। সে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মোবাবেলায় আসলো। ইমাম বললেন, “ময়দানে তোমার পিতা আসলেই ভালো হতো। তাতে তোমার করুণ পরিণতি দেখতে হতো না।” এই কথা বলে ইমাম তরবারি দিয়ে এমন আঘাত করল সাথে সাথে সে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল। পুত্রের করুণ মৃত্যু দেখে বদর বিন সুহাইল ক্রোধান্বিত হয়ে ইমামের উপর হামলা চালালো। ইমাম নিজ ঢাল দিয়ে হামলাকে প্রতিহত করলেন এবং পাল্টা আঘাত করে বদরকে দুখণ্ড করে ফেললেন। এভাবে একেকজন তলোয়ারবাজ, বর্শাধারী এবং সিরিয়া ও ইরাকের শক্তিশালী যোদ্ধারা ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সাথে দ্ব›দ্ব যুদ্ধে আসতে থাকলো এবং অসহায়ের মতো মৃত্যু মুখে পতিত হলো।
এমতাবস্থায় এজিদ শিবিরে শোরগোল পড়ে গেলো যে, যুদ্ধের অবস্থা যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ইমাম হোসাইন (রা.) কাউকে জীবিত ছাড়বেন না। এজিদ বাহিনী সিদ্ধান্ত নিলো একজন একজন যুদ্ধ করার বদলে চারদিক থেকে ঘিরে একসাথেই ইমাম হোসাইন (রা.)-কে আক্রমণ করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এজিদ সৈন্যরা চারিদিক থেকে বৃষ্টির মতো তির নিক্ষেপ করা শুরু করল। তারা ইমামের দেহ মোবারক তিরে তিরে ঝাঁঝরা আর রক্তাক্ত করে ফেলে। আবুল হুনুক নামে এক এজিদ সৈন্যের নিক্ষিপ্ত তির ইমামের কপাল মোবারকে বিদ্ধ হলো। রক্তের ফিনকি ধারায় ইমামের জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। সুযোগ বুঝে ইবনে ইয়াজিদ আমবাহি ইমামের পবিত্র বুকে একটি তির এমনভাবে ছুঁড়ে মারলো, যা হৃদপিণ্ডে গিয়ে বিধল। এমতাবস্থায় ঘোড়ার পিঠে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ল, ইমাম হোসাইন (রা.) ঘোড়া থেকে কারবালার জমিনে পড়ে গেলেন। তখন সিমার বিন জুল জওশন ইমামের চেহারা মোবারকে তরবারির আঘাত করল, আর সিনান ইবনে আনাস নখয়ী বর্শা দিয়ে দেহ মোবারকে আক্রমণ চালালো। খোলি ইবনে ইয়াজিদ ইমামের মাথা মোবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এগিয়ে আসলো। কিন্তু ভয়ে সে পিছনে হটে গেলো। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন, “খোলির ভাই হাশাল বিন ইয়াজিদ ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মাথা মোবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে খোলির হাতে দেয়।” আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে “সিমার জুল জওশন ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মাথা মোবারক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে।” এই মতটিই প্রসিদ্ধ। এভাবে আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য নবি দৌহিত্রকে কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ করা হয়। এরপর ইমামের পবিত্র দেহকে দশটি ঘোড়া দিয়ে দৌড়িয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর শেষ চিহ্নটিকেও এজিদের সৈন্যরা মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ইমাম হোসাইন (রা.) ৫৫ বছর ৫ মাস ৫ দিন বয়সে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দেহ মোবারককে ৭২টি আঘাতে জর্জরিত করা হয়। সেদিন কারবালার প্রান্তরে সূর্যও যেন গভীর বেদনা নিয়ে পশ্চিম আকাশে ডুবে যায়। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দেহ মোবারকের রওজা ইরাকের কারবালায় এবং তাঁর মাথা মোবারকের রওজা মিশরের কায়রোতে অবস্থিত। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ আহলে বাইত প্রেমিক ইমাম হোসাইন (রা.)-এর উভয় রওজা মোবারক জিয়ারত করে থাকেন।
[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]