কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতে রক্ষা করলেন
ইমাম ড. সৈয়দ এ. এফ. এম. মঞ্জুর-এ-খোদা:
মহান আল্লাহ্ তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হযরত রাসুল (সা.)-কে সমগ্র সৃষ্টিরাজির রহমত হিসেবে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ তাঁর শ্রেষ্ঠ হাবিব সম্পর্কে বলেন, ‘‘আমি আপনাকে জগৎসমূহের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।’’
(সূরা আল আম্বিয়া-২১: আয়াত ১০৭) হযরত রাসুল (সা.) মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় মহান ব্যক্তিত্ব। মহান আল্লাহ্ মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন- “তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরতম আদর্শ।” (সূরা আহযাব-৩৩: আয়াত ২১) পবিত্র কুরআনের এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, তাঁকে অনুসরণের মাধ্যমে মানবজাতি আদর্শ চরিত্র অর্জন করতে সক্ষম হবে। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।” তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই বর্বর আরব জাতি উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছে। হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবময় জীবনে সংঘটিত প্রত্যেকটি ঘটনা মানবজাতির জন্য অনুসরণীয়।
তাঁর কিশোর বয়সে সংঘটিত বহু ঘটনা আজও অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, তিনিই আখেরি নবি এবং তিনিই শান্তি ও মুক্তির দূত হিসেবে জগতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কিশোর বয়সের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো প্রাক- ইসলামি যুগে কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ার সংবাদ পেলে পিতার মুখ দুঃখ ও ক্ষোভে বিবর্ণ হয়ে যেত। অনেক সময় কন্যার হৃদয় বিদারক চিৎকার উপেক্ষা করে পিতা তাকে জীবন্ত কবর দিতো। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বয়স যখন ১১ বছর, সেসময় তাঁর কিশোর বয়সেই তিনি এক শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতে রক্ষা করেন। ঘটনাটি ছিল এরূপ- একদা দুপুর বেলা কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.) খেজুর বাগানে একাকী বসেছিলেন। হঠাৎ পাশের কবরস্থান থেকে নারী ও পুরুষের চিৎকার শুনে তিনি দ্রুত সেখানে ছুটে যান। তিনি দেখতে পেলেন ৪/৫ মাস বয়সী এক শিশু কন্যা সন্তানকে কবর দেওয়ার জন্য কবর খুঁড়ে সেখানে রাখা হয়েছে। কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.) কবর থেকে শিশুটিকে গভীর মমতায় কোলে তুলে নিলেন।
সেসময় কিছুটা দূরে সেই শিশু কন্যার মা কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে তাঁর স্বামীকে বলছিলেন, “হে আমার স্বামী! তুমি মেহেরবানি করে আমাদের শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দিও না। তুমি ওর প্রতি দয়া করো। ওর বদলে তুমি আমাকে জীবন্ত কবর দাও, তবুও ওকে ছেড়ে দাও।” স্ত্রীর এরূপ বুকফাটা আহাজারি পাষণ্ড স্বামীর মনকে কোনোভাবেই বিগলিত করতে পারল না, বরং সে তাকে ধাক্কা মেরে মরুভূমির তপ্ত বালুতে ফেলে দিলো। এরপর ক্ষোভের সাথে বলতে লাগলো, “দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। মেয়ে সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়াই দরকার, এদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! তুমি কি চাও, সে দাসী হয়ে বেঁচে থাকুক?”
এরপর শিশু কন্যার মা মরুভূমির বালু থেকে উঠে স্বামীর পা ধরে পুনরায় একই মিনতি জানালেন। কিন্তু পাষণ্ড স্বামী তাঁর স্ত্রীর কথায় কোনো কর্ণপাত করল না। সে কন্যা শিশুটিকে জীবন্ত কবর দেওয়ার জন্য কবরের নিকট আসলো। লোকটি এসে দেখতে পেলেন তাঁর কন্যা সন্তানটিকে কোলে নিয়ে স্বর্গীয় মায়াবী চেহারার এক কিশোর দাঁড়িয়ে আছেন। লোকটি কোনো কথা না বলে কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারকের (Luminous Holy Face) দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।
এরপর হযরত মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত কোমল কণ্ঠে মিষ্ট ভাষায় লোকটিকে বললেন, “এ নিষ্পাপ শিশুটি কি তোমার মেয়ে নয়? কয়টা সন্তান দেখতে তাঁর পিতার মতো হয়? তুমি দেখেছ কি তোমার মেয়ের চোখ দুটি দেখতে অবিকল তোমার মতো! ভবিষ্যতে এই মেয়ের যখন পুত্র সন্তান হবে, সেই পুত্র সন্তানটি তোমার মতো হবে। তখন তা দেখে তুমি অনেক আনন্দিত হবে। তুমি জেনে রাখো, কন্যা সন্তান হলো রহমত স্বরূপ। আল্লাহ্ তায়ালা চাইলে তোমার এই সন্তান দীর্ঘজীবী হবে।” লোকটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিশ্চুপ হয়ে কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথা শুনছিল, আর তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল।
মুহূর্তের মধ্যে পাষণ্ড লোকটির হৃদয়ে কন্যা সন্তানের প্রতি গভীর সেড়বহ মমতা ও ভালোবাসার সৃষ্টি হলো। হযরত মুহাম্মদ (সা.) কন্যা শিশুটিকে পিতার কোলে তুলে দিলেন। এভাবে কিশোর হযরত মুহাম্মদ (সা.) শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতে রক্ষা করলেন।
হযরত রাসুল (সা.)-এর গৌরবদীপ্ত জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যে ঘটনাগুলো প্রমাণ করে তিনি মানবতার আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তাঁর মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে মানব প্রেমের অনুপম ঘটনা। মূলত তাঁকে অনুসরণের মাধ্যমে এই পৃথিবী হয়ে উঠতে পারে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির এক স্বর্গীয় ভূমি।
[লেখক: পরিচালক, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ]