জিলহজ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত – হযরত সাব্বির আহমাদ ওসমানী
বছরে চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে জিলহজ মাস অন্যতম। অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এ মাস। জিলহজ মাসের ১০ তারিখে কোরবানির ঈদ পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহ্র বন্ধু হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় আনুগত্য ও মহান ত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত স্মরণ করে থাকেন। আল্লাহ্ পাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম জাতি প্রতি বছর হজ পালন ও পশু কোরবানি করে থাকে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুরো পরিবারের নজিরবিহীন কোরবানির ইতিহাস মানুষকে যে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মু’মিন তার সবকিছুই আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) ও হযরত মা হাজেরা (আ.) আল্লাহ্র প্রতি গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশগুলোকে আল্লাহ্ তায়ালা হজের অংশ হিসাবে গণ্য করেছেন এবং এই হজ ও কোরবানি সম্পন্ন করি পবিত্র জিলহজ মাসে। যার ফলে ইসলামে জিলহজ মাসের গুরুত্ব অতি ব্যাপক।
হযরত ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন- জিলহজের প্রথম ১০ দিনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ হলো- এই দিনগুলোতে ইসলামের ৫টি রুকনের সমাহার রয়েছে। যেমন- ইমান ও সালাত অন্য দিনগুলোর মতো এ দিনগুলোতেও বিদ্যমান। যাকাত বছরের অন্য যে কোনো সময়ের মতো এ সময়ও প্রদান করা যায়। আরাফার দিনে রোজার নির্দেশনার ফলে ইসলামের আরেকটি রুকন-রোজার দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। আর পঞ্চম রুকন বা হজ ও অন্যদিকে কোরবানি এই দশ দিনেই পালনযোগ্য। তাছাড়া এই দিনগুলোতে রয়েছে আরাফাহ ও কোরবানির দিন। আরাফার দিনের দোয়াকে শ্রেষ্ঠ দোয়া বলা হয়েছে। কোরবানির দিনকে বছরের সেরা দিন বলে আবু দাউদ ও নাসাঈর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং মাস হিসাবে রমজান আর দিন হিসাবে এ দশ দিন শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “যাতে তারা উপস্থিত হতে পারে তাদের কল্যাণময় স্থানে এবং তারা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে পারে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে সেসব চতুস্পদ জন্তু জবেহ করার সময় যা তাদেরকে তিনি রিজিক হিসেবে দান করেছেন। অতঃপর তোমরা তা থেকে খাও এবং বিপন্ন, অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও।” (সূরা হাজ ২২: আয়াত ২৮)
জিলহজ মাসের আমল
তাওবা: তাওবা অর্থ ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহ্ তায়ালার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহ্র হুকুমের পাবন্দি করার উপর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃতকর্মের উপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে আর কখনও আল্লাহ্র নাফরমানি না করা ও তাঁর হুকুমের অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা।
ফরজ ও নফল নামাজগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা
ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ সময়মতো সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় রাসুল (সা.)। সকল ইবাদতসমূহ তাঁর সুন্নত ও মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা, বেশি বেশি করে নফল নামাজ আদায় করা।
হজ ও ওমরা পালন: হযরত রাসুল (সা.) হজ ও ওমরা-এই দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি ইবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ্র কাছে প্রিয় হতে পারে। তাই হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি, সে সেদিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে গেল, যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে।” (বোখারী ১৪৪৯ মুসলিম ১৩৫০)
আল্লাহ্র জিকির করা: দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে জিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, তাই এ দিনগুলিতে জিকির আজগার তাসবিহ তাহলিল বেশি বেশি পাঠ করতে হবে।
কোরবানির দিন তথা ১০ তারিখের আমল: এ দিনের একটি নাম হলো ইয়াওমুল হজ্জিল আকবার বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজিগণ তাদের পশু জবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। কোরবানির দিন বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। হাদিসে এসেছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে কুরত (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “আল্লাহ্র নিকট দিবাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হলো কোরবানির দিন। তারপর পরবর্তী তিন দিন। (আবু দাউদ ১৭৬৫)
কোরবানি করা: কোরবানি হচ্ছে ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে জবেহ করা। ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কোরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কোরআন মাজিদে যেমন এসেছে- “তোমরা প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করো ও (পশু) নাহার (কোরবানি) করো।” (সূরা কাওসার ১০৮: আয়াত ২) আল্লাহ্ আরো বলেন- “(হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন- আমার নামাজ, আমার যাবতীয় ইবাদত (কোরবানি), আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমুহের প্রতিপালক আল্লাহ্রই উদ্দেশ্যে।” (সূরা আনআম ৬: আয়াত ১৬২)
হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পর কোরবানির পশু জবেহ করল তার কোরবানি পরিপূর্ণ হলো ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।” (বোখারি ৫৫৪৫ ও মুসলিম ১৯১৬)
এই দশ দিনে সকল মৌলিক ইবাদত একত্রিত হয়
এই দশ দিন আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত প্রায় সকল ইবাদত একত্রিত হয়। যা অন্য কোনো সময়ে একত্রিত হওয়া সম্ভব নয়। যেমন হজ, কোরবানি, সালাত, সিয়াম, দান-সদকা এবং আরাফায় জোহর, আছর, এক সাথে কসর পড়া, মুজদালিফায় মাগরিব ও এশা একসাথে আদায় করা বছরে শুধু এক দিনই হয়। তাই এই সকল ইবাদত এই দশ দিন একত্রিত করা যায়।
জিলহজ মাসে ৯ তারিখ আরাফার দিনের ফজিলত
জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো আরাফার দিন। এদিনেরও বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হযরত রাসুল (সা.) নবুয়তের শেষ দিকে বিদায় হজের সময় আরাফার দিন শুক্রবার আল্লাহ্ ইসলামকে পরিপূর্ণ দ্বিন হিসাবে ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকেই তোমাদের জন্য (পরিপূর্ণ) ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫ : আয়াত ৩) হযরত রাসুল (সা.) বলেন- সকল দোয়ার শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো আরাফার দিনের দোয়া, আর শ্রেষ্ঠ কালিমা (জিকর) যা আমি পাঠ করেছি ও আমার পূর্ববর্তী নবিগণ পাঠ করেছেন। তা হলো- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।” অর্থ- “আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নাই। তিনি অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই। তাঁরই রাজত্ব। তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা। তিনি সব কিছুর উপরে ক্ষমতাবান।” (তিরমিজি ৩৫৮৫, মিশকাত ২৫৯৮) জিলহজ মাস বলতে জিলহজের প্রথম দশকের বর্ণনা। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন- শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির। (সূরা ফজর: আয়াত ১-২) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) মুজাহিদ ও ইকরামা (রহ.)-এর মতে ১০ রাত বলতে জিলহজের ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে এ মাসের ১০ দিনের মর্যাদা প্রমাণিত। জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আরো ইঙ্গিতবাহী আয়াত আছে। এরশাদ হয়েছে- “তারা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করতে পারে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে।” (সুরা হাজ্জ ২২: আয়াত ২৮)
জিলহজ মাস সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে আরোও বহু আলোচনা এসেছে তাই আসুন আমরা সবাই এই জিলহজ মাসকে ইবাদতের মাস হিসাবে গ্রহণ করি এবং দুনিয়া ও পরকালের জীবন শন্তিময় করি। আমিন।
[লেখক: ইসলামি আলোচক; সদস্য, দেওয়ানবাগীর দল ওলামা মিশন বাংলাদেশ; সাবেক খতিব, দারুল ফালাহ্ জামে মসজিদ, রিয়াদ, সৌদি আরব]