Cancel Preloader

ত্যাগের আনন্দ প্রাণে প্রাণে – ড. পিয়ার মোহাম্মদ

ঈদুল আজহা অর্থ কোরবানি বা ত্যাগের আনন্দ। কী সেই ত্যাগ, আর কী সেই আনন্দ? মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ আদেশ করলেন, “হে ইব্রাহিম আপনার প্রিয় বস্তুকে আমার নামে কোরবানি করুন।” আল্লাহ্র নবি অনেক কিছু কোরবানি করলেন। তবুও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একই আদেশ অব্যাহত থাকল। নবি আল্লাহ্র আদেশ পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে অবগত করিয়ে তাঁর সম্মতিতে কোরবানি করার জন্য চোখ বেঁধে পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন, কিন্তু কোরবানি হলো দুম্বা। গায়েবি আওয়াজ ভেসে আসল “হে ইব্রাহিম আপনার কোরবানি কবুল হয়েছে।” হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.)-এর প্রাণ আনন্দে উদ্ভাসিত হলো। এই সেই ত্যাগের আনন্দ। তারই অনুররণে আজ সবার প্রাণে বইছে আনন্দ জোয়ার …।

বছর ঘুরে এলো ফিরে
ঈদুল আজহার দিন,
ত্যাগের মহিমাতে রাঙ্গা
প্রাণে প্রাণে অমলিন।
ইব্রাহিমের ত্যাগ আনন্দে
কোরবানি দেয় সব মু’মিন।

নিজের পুত্র নিজের হাতে
করতে কোরবানি,
চালাই ছুরি আজ ইব্রাহিম
খোদারে মানি।
দুম্বা জবাই পুত্র হাসে
আনন্দে হয় সব বিলিন।

আল্লাহ্ খুশি নবি খুশি
খুশি ধরণী,
ত্যাগের আনন্দে যায় ভেসে
হৃদয় তরণি।
পিতা পুত্রের ইমান বুঝে
কবুল রাব্বুল আলামিন।

কোরবানি মুসলিম জাতির এক গাম্ভীর্যময় ধর্মীয় উৎসব। এ দিনে ত্যাগ স্বীকারের মানসে সামর্থ্য অনুসারে মুসলিম জাতি উৎসর্গ করেন কোরবানির পশু। সামর্থ্যহীনের ঘরেও পৌঁছে যায় কোরবানির মাংস। ইসলামের এমন ত্যাগের নমুনা মানবতার পথে এক মাইলফলক। এমন দিনে আনন্দের পরশ ছুঁয়ে যায় পৃথিবী জুড়ে সবার ঘরে ঘরে, সবার অন্তরে অন্তরে। প্রকৃতির মাঝে বয়ে যায় আনন্দের হিল্লোল। এ দিনটা যেন অন্য রকম দিন। ধরণী যেন একটি বছর ধরে এ দিনেরই অপেক্ষায় থাকে। তাইতো অপেক্ষার পালা বদলে ঈদুল আজহার দিনে সবাই মেতে উঠে নতুন সাজে, নতুন ভুষণে। পৃথিবী জুড়ে সবার হৃদয়ে ফুটে একরাশ কুসুম কলি …।

আজকে মু’মিন এক কাতারে
হাজির ঈদগাহে,
নামাজ শেষে দেয় কোরবানি
খোদারই রাহে।
পশু জবাই করে সবাই
খোদার পানা চাহে।

পশুর মাংস বিলিয়ে দিবে
গরিব দুঃখীরে,
পাড়া পড়শি আপনজনা
সবার মাঝারে।
সবার ঘরে তাই আনন্দ
মহাসমারোহে।

আত্মত্যাগের এমন দিনে
দুঃখ হয় বাসি,
প্রাণে প্রাণে এক আনন্দ
মুখে এক হাসি।
সাম্য সুখের আনন্দে মন
ভাসে প্রেম প্রবাহে।

আজ এ পবিত্র ত্যাগের দিনে মানুষ পশু কোরবানির মাধ্যমে মনের পশুকে কোরবানি করে অর্জন করেন আত্মশুদ্ধি। মনের পশুকে দমন করে সুগম করে পুলসিরাতের পথ। পশুর গলায় ছুরি চালাই আর মুখে থাকে আল্লাহ্র নাম। এ ত্যাগের মাধ্যমেই মানুষ মানবীয় গুনাবলিতে বলীয়ান হয়ে উঠেন। এইতো প্রকৃত আনন্দ। এরই নাম ঈদ, এরই নাম খুশি। সেই খুশির ঝরণাতলে সবাই করে একসাথে অবগাহন …।

মনের ঘরে পশু রেখে
করলে পশু কোরবানি,
লাভ হবে না ও ভাই মু’মিন
জেনে রাখ তাঁর বাণী।
রক্ত মাংস চাই না আল্লাহ্
চাই শুধু অন্তরখানি।

আল্লাহ্র রাহে কোরবানি দেয়
নবি ইব্রাহিম,
সাদা অন্তর দেখে খুশি
রহমান রাহিম।
তাই পশু ভাই হয় কোরবানি
খোদার কী মেহেরবানি।

আল্লাহ্র আদেশ মানেন নবি
মানেন ইসমাইল,
ভালোবাসা প্রাণের মায়া
তার রাহে দাখিল।
তাই কোরবানি হলো কবুল
প্রাণের বদলা প্রাণহানি ।

হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই ত্যাগ শুধু তাঁর নিজের নয়। তিনি যখন শিশু ইসমাইলকে মহান আল্লাহ্র আদেশের কথা জানান তখন হযরত ইসমাইল (আ.) বললেন “আপনি আল্লাহ্র আদেশ পালন করুন। আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” পথিমধ্যে শয়তান হযরত ইসমাইল (আ.)-কে কুমন্ত্রণা দিয়ে বিরত রাখতে পারেনি। পিতা পুত্র দুজনই ত্যাগের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। একেই বলে ইমান, একেই বলে ত্যাগ আর সেই ত্যাগেরই আনন্দ আজকের ঈদ …।

ভোগে নাই ভাই কোনো সুখ
ত্যাগেই সুখ যত,
ত্যাগ করেছে যে জন বুঝে
প্রাণে সুখ কত।
প্রেম মহিমায় হাসে ধরা
ফুল ফুটে শত ।

কোরবানির ঈদ দেখায় গেলো
ত্যাগের মহিমা,
সবার উপর আল্লাহ্র আদেশ
ভুলো গরিমা।
আনন্দে প্রাণ উঠবে ভরে
দুঃখ হবে গত ।

মানবতা হাসে যখন
কেটে যায় আঁধার,
পৃথিবী হয় সুখের বাগান
সবাই হয় সবার।
ত্যাগের কাছে দুঃখ জ্বালার
মাথা হয় নত ।

ঈদুল আজহা সারা পৃথিবীর মু’মিন হৃদয়ে বাজিয়ে যায় ত্যাগের আনন্দের একই সুর। প্রতিটি জীবনের পরতে পরতে, তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে জাগ্রত হয় ত্যাগের অনাবিল অনুভূতি। শানিত হয় সবার হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা। যেখানে নাই কোনো ভেদাভেদ। সবাই অনুভব করে মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য-এটাইতো কোরবানি। আসুন আজ এমন পবিত্র দিনে অন্তরটাকে আল্লাহ্র রাহে ত্যাগের মহিমায় সাজিয়ে নিই …।

আজ আনন্দ প্রাণে প্রাণে
ত্যাগের মহিমায়,
মন ভরে যায় তাই খুশিতে
যেদিকে তাকায়।
প্রতিটা দিন হোকনা এমন
মনে প্রাণে চাই

হোক পৃথিবী স্বর্গরাজ্য
মানব প্রেমময়,
ত্যাগই হবে সব মানুষের
মানবতার জয়।
ভাগাভাগি করব সবাই
দুঃখ যদি পাই \

নাই ভেদাভেদ আশরাফ আতরাফ
মানুষ যদি হয়,
সবার প্রভু সৃষ্টিকর্তা
অন্য কেহ নয়।
এসো সবাই মিলে মিশে
আনন্দে গান গায়

ঈদুল আজহার এ বিশেষ খুশির দিনে সকলকে জানাই ঈদ মোবারক। প্রতিটি দিন প্রতিটি মানুষের জীবনে আসুক ঈদের দিন হয়ে। সবাই সারাক্ষণ সম্পৃক্ত হোক সম্প্রীতির বন্ধনে, ত্যাগের পরশে। জীবন আবর্তিত হোক সহমর্মিতার পথ বেয়ে আর সময় কাটুক খুশির অবগাহনে। ধরণীর বুকে দোল খেয়ে যাক চিরন্তন আনন্দ ধারা। সবার হৃদয়ে প্রবাহিত হোক মানবতা আর মহানুভবতার নির্ঝর প্রস্রবণ। অমলিন হোক ঈদুল আজহার খুশি। ঈদ মোবারক …।


[লেখক: ইসলামি গবেষক; সাবেক অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]

সম্পর্কিত পোস্ট