ত্যাগের মহিমায় আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উপায় – ড. জাহাঙ্গীর আলম
কোরবানি শব্দটি আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ নৈকট্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা, উৎসর্গ করা। যে ইবাদতের মাধ্যমে একজন মানুষ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভ করে তাকে কোরবানি বলা হয়।
কোরবানি সুন্নাতে ইব্রাহিম। হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন- “হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আমার নামে উৎসর্গ করো।” এরপর তিনি আল্লাহ্র নামে ১০০টি দুম্বা কোরবানি করলেন। পরবর্তীতে আবারও একই রকম নির্দেশ আসলো, এরপর আবার ১০০টি গরু, অতঃপর ১০০টি উট কোরবানি করলেন। এরপরও আবার আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একই নির্দেশ এলো। হযরত ইব্রাহিম (আ.) গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে চিন্তা করলেন পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো আমার শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুপুত্র দান করুন। অতঃপর আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। তারপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন- হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বলো, তোমার মত কি? সে বলল- হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা পূর্ণ করুন। ‘ইনশাআল্লাহ’, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! আপনি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালেন। আমি এরূপেই খাঁটি বান্দাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (সূরা আস-সাফফাত ৩৭: আয়াত ১০০-১০৫)
আমরা যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, প্রতি বছর কোরবানিতে আমরা কি আমাদের প্রিয়বস্তু আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করতে পেরেছি? যদি না পারি তাহলে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা সম্ভব নয়। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যেমন করে মহান আল্লাহ্র নির্দেশে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়বস্তু স্বয়ং পুত্রের স্নেহ-মায়ামমতা, প্রেম ভালোবাসা পরিত্যাগ করে হযরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করে আল্লাহ্র কুরবিয়াত বা নৈকট্য লাভ করে ইব্রাহিম ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধি লাভ করেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে আমরা যদি কোরবানি করতে পারি, তবে অবশ্যই আমরা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হবো। কোরবানি এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্র সান্নিধ্য অতি সহজে লাভ করতে পারবো। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের নিকট কোরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস কোনো কিছুই চান না, চান শুধু আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য, তাকওয়া (খোদাভীতি)। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আল্লাহ্র কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোস্ত এবং না এগুলোর রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৭)
পশু কোরবানি করার মাধ্যমে যদি কোরবানি কবুল হতো তাহলে হযরত ইব্রাহিম (আ.) যে দুম্বা, গরু ও উট কোরবানি করেছিলেন আল্লাহ্ তা কবুল করে নিতেন। মহান রাব্বুল আলামিন চান বনের পশু গরু, ছাগল, মহিষ, উট, দুম্বা ইত্যাদি কোরবানির মাধ্যমে মানুষের নিজের মাঝে যে পশু প্রবৃত্তি আছে সেটাকে কোরবানি দেওয়া। যদি আমরা এই কাজটি করতে পারি, তাহলে সমাজে সুখ, শান্তি, স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা বিরাজমান থাকবে।
আমরা বাহ্যিকভাবে সবাই মানুষ। আত্মার ছুরতে সবাই মানুষ নয়। এই পশুর ছুরতের বহিঃপ্রকাশ সমাজে বিদ্যমান। যার কারণে মানুষ পশুর ন্যায় আচার আচরণ করে। এর ফলে সমাজে নানারকম খুন রাহাজানি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কোরবানির শিক্ষার মাধ্যমে আমরা যদি ভিতরের পশু প্রবৃত্তিকে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করতে পারতাম, তাহলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এতো দ্ব›দ্ব, কলহ, নানারকম অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, অনিয়ম থাকতো না। আমরা যদি নিজেদের পশু প্রবৃত্তিকে আল্লাহ্র নামে উৎসর্গ করে, নিজের ভিতরের পশুর প্রভাবসমূহ দূর করে মহান রাব্বুল আলামিনের উপর সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারি তবেই হবে আমাদের হাকিকতে কোরবানি। যেটির পথপ্রদর্শক ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে শুরু করে সমস্ত নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহগণ। হাকিকতে কোরবানি করতে হলে নবি-রাসুলগণ, অলী-আল্লাহগণ যেভাবে আল্লাহ্র নামে পশু কোরবানি করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে আমাদের কোরবানি করতে হবে।
উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে আমরা যদি হযরত মোহাম্মদ (সা.) যেভাবে কোরবানি করেছিলেন, তা অনুসরণ করতে পারি তাহলে সহজেই আমরা কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হবো। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আর আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি বিধিবদ্ধ করে দিয়েছি যাতে তারা আল্লাহ্ তাদেরকে যে চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন তা জবেহ করার সময় তার উপর আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের উপাস্য তো একমাত্র আল্লাহ্। সুতরাং তোমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো।” (সূরা আল হাজ্জ ২২: আয়াত ৩৪)
হযরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র, হযরত ইব্রাহিম (আ.) এবং আমাদের নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহ্র নামে পশু কোরবানি করেছিলেন। সুতরাং আমরা যখন পশু কোরবানি করব একজন কিংবা কয়েকজন মিলে তখন কোরবানির সময় সকলেই মনে মনে আকুতি জানাবো- হে মহান রাব্বুল আলামিন আপনার নামে এই পশু উৎসর্গ করলাম। আপনি আমাদের এই কোরবানি কবুল করুন। এই প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সা.) আমাদের উম্মতে মোহাম্মদীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বলেছেন- “হে আল্লাহ (এই পশু) তোমার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এবং তোমারই উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত তুমি এটি কবুল করো মোহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে আল্লাহ্ তোমার নামে কোরবানি করছি এবং আল্লাহ্ই মহান, অতঃপর রাসুল (সা.) জবেহ করতেন।” (আহমদ আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দায়েমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ১২৮)
এছাড়াও কোরবানি করার সময় আমরা পবিত্র কুরআনের যে আয়াতটি পাঠ করি তাহলো- “নিশ্চয় আমার নামাজ আমার যাবতীয় ইবাদত আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্রই জন্য।” (সূরা আল আনআম ৬: আয়াত ১৬২)
কোরবানি কোনো ব্যক্তির নামে দেওয়া যা পবিত্র কুরআন ও হাদিস পরিপন্থী। আমাদের সমাজের কেউ কেই ভুলবশত ব্যক্তির নামে কোরবানি করে থাকে, এটি ইসলাম বিরোধী। মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান আমাদেরকে এই রকম একটি ভুল কাজ থেকে উদ্ধার করেছেন। তিনি আমাদেরকে কুরআন ও হাদিসের অকাট্য দলিল দিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন বান্দার নামে নয়, আল্লাহ্র নামে কোরবানি দেওয়ার জন্য। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের নির্দেশে আমরা সেই ভুল থেকে বের হয়ে মূলে এসে আল্লাহ্র নামে কোরবানি করে অনেকেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করছে।
ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ.) যে কোরবানি করেছিলেন এবং হযরত ইসমাইল (আ.)-এর কাছ থেকে আমরা আত্মসমর্পণের যে শিক্ষা পেয়েছি, সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে আমাদেরকে যেতে হবে নবি-রাসুলদের সুযোগ্য উত্তরসূরি মহামানব তথা অলী-আল্লাহ্দের নিকট। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে অলী-আল্লাহ্গণের সান্নিধ্য লাভ করে, তাঁদের শিক্ষা গ্রহণ করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন ও নৈকট্য লাভ করার মতো কোরবানি করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[ইসলাম ধর্ম বিষয়ক লেখক]