ধর্ম পালনে মোর্শেদের প্রয়োজনীয়তা – ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
‘মোর্শেদ’ আরবি শব্দ, যার অর্থ পথপ্রদর্শক। যিনি এলমে শরিয়ত, এলমে তরিকত, এলমে হাকিকত ও এলমে মারেফত এই ৪টি বিদ্যায় বিদ্বান। রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘‘শরিয়ত আমার কথা, তরিকত আমার কাজ, হাকিকত আমার অবস্থা এবং মারেফত আমার নিগূঢ় রহস্য।’’ (নূরুল আসরার বা নূর তত্ত্ব ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪)
এক কথায়- যিনি সাধনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় ও দিদার লাভ করেছেন, যিনি আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং অপরকে আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সক্ষম তাঁকেই মোর্শেদ বলে।
‘মোর্শেদ’ শব্দের ফারসি প্রতিশব্দ হচ্ছে পির বা আধ্যাত্মিক শিক্ষক। আমাদের সমাজে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গুরুকে ‘পির’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। পারস্য দেশের সুফি-সাধকগণ মোর্শেদ অর্থে পির শব্দটি ব্যবহার করতেন, যা কালক্রমে আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়েছে। পির বা মোর্শেদ হওয়ার জন্য অলী-আল্লাহ্ হওয়া শর্ত। মানুষকে হিদায়েত করার মতো আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন অলী-আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ নিজেকে মোর্শেদ বলে দাবী করলে সেটা অন্যায় দাবী বলে গণ্য হবে।
মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, যিনি মুরিদকে মহান আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সক্ষম। যিনি মুরিদকে হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথেও যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারেন। যিনি মুরিদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দিতে পারেন। যিনি মুরিদের হৃদয়ে ইমানের বীজ বপন করে থাকেন। মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, যিনি মুরিদের চরিত্রকে সংশোধন করে দেন। যিনি মুরিদের অন্তরের খবর রাখেন। যিনি মুরিদকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, মুরিদ যদি লক্ষ মাইল দূরে থেকে বিপদে পড়ে তাঁকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ডাকে, তখন তিনি তাকে উদ্ধার করেন।
আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বা তাওয়াজ্জোহর স্তর ভেদে অলী-আল্লাহ্গণ চার শ্রেণির।
যথা-
১। অলী-আল্লাহ্, ২। অলীয়ে কামেল, ৩। অলীয়ে মোকাম্মেল এবং ৪। মোজাদ্দেদে জামান বা যুগের ইমাম।
উল্লেখ্য যে, মোর্শেদের মধ্যে যিনি যত বেশি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী তাঁর ভক্ত মুরিদের তত সহজে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান প্রণীত ‘শান্তি কোন পথে?’, নামক কিতাবে বলা হয়েছে- ‘‘নবুয়তের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অলী-আল্লাহ্গণই মোর্শেদ রূপে মানুষকে পথ দেখিয়ে থাকেন। মোর্শেদে কামেলের মাধ্যমে খোদা প্রাপ্তির সন্ধান লাভ হয়ে থাকে। এ মহামানব তাঁর তাওয়াজ্জোহ্ এত্তেহাদির দ্বারা মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে দমন করে আত্মার ঐশীভাব প্রস্ফুটিত করে দিয়ে মানুষকে সুপথগামী করে তোলেন।’’ মোর্শেদের হৃদয়ে ঐশী নুর প্রজ¦লিত রয়েছে, তা হযরত রাসুল (সা.)-এর পবিত্র ক্বালবের ধারা হয়ে এসেছে। অর্থাৎ উহা সিরাজাম মুনিরা বা প্রজ¦লিত প্রদীপ। মূলত সিরাজাম মুনিরা বলতে নুরে মোহাম্মদী-কে বুঝায়। সৃষ্টির শুরু হতে অদ্যাবধি যত মহামানব জগতের বুকে আগমন করেছেন, প্রত্যেকে ঐ নুরে মোহাম্মদী ধারণ করেই মোর্শেদরূপে হেদায়েতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহ্গণের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে মোজাদ্দেদে জামান বা যুগের ইমাম।
হাদিস শরীফে আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- ‘‘যে ব্যক্তি তার (যুগের) ইমামকে চিনতে পারল না, (আর এ অবস্থায়) যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে তার মৃত্যু অন্ধকারে নিপতিত ও নিমজ্জিত হবে।’’ (মুসনাদে ইমাম জাফর সাদেক ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৯ ও ৫৩৩)
মোকাম্মেল মোর্শেদ প্রজ¦লিত নুর মুরিদের ক্বালবে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে আত্মার কু-রিপুসমূহ দমন করে থাকেন। ফলে উক্ত নুরের জ্যোতিতে মুরিদের অন্ধকার হৃদয় আলোকিত হয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি মোর্শেদ ব্যতীত একাকী সাধনা করে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের পরিচয় লাভ করতে পারে না। এ জন্য মোর্শেদ গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য। শিক্ষক ছাড়া যেমন বিদ্যা অর্জন করা যায় না, তদ্রুপ মোর্শেদ ব্যতীত একাকী সাধনা করে মারেফত হাসিল হয় না এবং মহান আল্লাহর সন্ধান লাভ করা যায় না। আসলে মোর্শেদের সাহচর্য ব্যতীত প্রকৃত মু‘মিন হওয়া সম্ভব নয়।
দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা মহান সংস্কারক যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান ‘এজিদের চক্রান্তে মোহাম্মদী ইসলাম’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘‘কামেল অলী-আল্লাহ্ বা মোর্শেদ সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। এমন মহামানবদের সান্নিধ্য গ্রহণে মানুষ আত্মিক উন্নতি লাভের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের প্রেম হাসিল করতে সক্ষম হয়। খাঁটি অলী-আল্লাহ্ তথা মোকাম্মেল মোর্শেদ গ্রহণ করা একান্ত অপরিহার্য। কেননা, ধর্ম পালনে মোর্শেদের ভূমিকা অপরিসীম। আর এ কারণেই আল্লাহ্ তায়ালা ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম মহব্বত হাসিলের উদ্দেশ্যে মানুষ খাঁটি পির-মোর্শেদের সন্ধান করে থাকে।’’
হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর জগতে আর কোনো নবি-রাসুল আসবেন না। এরপরে শুরু হয়েছে বেলায়েত বা বন্ধুত্বের যুগ। নবুয়তের ধারা শেষ হওয়ার পর থেকে অলী-আল্লাহ্গণ মানুষের জন্য মোর্শেদ বা পথপ্রদর্শক রূপে সৃষ্টির প্রতি রহমত বিতরণ করে থাকেন। মূলত তাঁরা নবিগণের উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অর্থাৎ- হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতিনিধিরূপে তাঁরা মানুষের পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন, মূলত তারাই প্রকৃত নায়েবে রাসুল।
উল্লেখ্য যে, কিতাব পড়ে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা যায় বটে, কিন্তু নায়েবে রাসুল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়। হযরত রাসুল (সা.)-এর পর তাঁর সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ অলী-আল্লাহর সহবতে গিয়ে নিজ হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। কেননা, সকল অলী-আল্লাহ্ নিজের মাঝে নুরে মোহাম্মদীকে ধারণ করেছেন, তাঁরাই কামেল মোর্শেদ। তাঁদের সান্নিধ্যে এসে, তাঁদের শিক্ষা গ্রহণ করে এবং সেই অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই কেবল প্রকৃত মু‘মিন হওয়া সম্ভব। আর সেই কারণেই মোর্শেদ গ্রহণ করা প্রতিটি মানুষের জন্য একান্ত কর্তব্য।
কামেল মোর্শেদের ক্বালবের ৭ম স্তর নাফসির মোকামে মহান আল্লাহ্ বিরাজমান এবং কামেল মোর্শেদ তাঁর ক্বালবের দ্বার উন্মেচন করতে সক্ষম হয়েছেন বিধায় আল্লাহর সাথে তাঁর যোগাযোগ থাকে। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কামেল মোর্শেদ হলেন আল্লাহ্কে পাওয়ার ঠিকানা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- আপনি যদি আপনার কোনো বন্ধুর খোঁজে ঢাকা শহরে তার ঠিকানা ছাড়া আসেন, তাহলে ঠিকানা বিহীন আপনার বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তদ্রুপ, আপনি ঠিকানা বিহীন তালাশ করলে আল্লাহ্কে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে, আল্লাহ্ কোথায় আছেন?
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘মু’মিন ব্যক্তির ক্বালব বা দিল হলো আল্লাহর আরশ।’’ (তাফীরে ইবনুল আরাবী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৯) মহান আল্লাহ্ পবিত্র কালামে এরশাদ করেন- ‘‘আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে একদল আছেন, যাঁরা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায় বিচার করে।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৮১) এ সম্প্রদায় হলেন অলী-আল্লাহ্। তাঁদের সান্নিধ্যে গেলে মানুষের হৃদয়ের পাপ-কালিমা দূরীভূত হয়ে যায়। ফলে ঐ মানুষ হতে পারে আদর্শ মানুষ। হাদিস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে- ‘‘তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও।’’ আল্লাহর চরিত্র আমরা কোথায় পাবো? আল্লাহর চরিত্র হযরত রাসুল (সা.)-এর মধ্যে বিদ্যমান।
হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তম চরিত্রাদর্শ ও অনুসরণের গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘‘তোমাদের জন্য রাসুল (সা.)-এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’’ (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ২১) অন্যত্র তাঁর অনুসরণ ও ভালোবাসা সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন- ‘‘হে মাহবুব (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়াময়।’’ (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩১)
বেলায়েত বা বন্ধুত্বের যুগে অলী-আল্লাহগণ হচ্ছেন আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান। কেননা, অলী-আল্লাহ্গণ হলেন আল্লাহর বন্ধু। সুতরাং অলী-আল্লাহ্গণের আদর্শ ও শিক্ষা গ্রহণ করলে মানুষের পক্ষে চরিত্রবান হওয়া সম্ভব।
বিখ্যাত আলেম হযরত ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর একটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় মোর্শেদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিম্নে ঘটনাটি উপস্থাপন করা হলো-
জগদ্বিখ্যাত আলেম ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী যখন বুঝতে পারলেন যে, মোকাম্মেল মোর্শেদ বিহনে ইমান নিয়ে কবরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তৎকালীন যুগের বিখ্যাত অলী-আল্লাহ্ হযরত ইমাম সানজালি (রহ.)-এর কাছে বায়েত গ্রহণ করতে গেলেন। কিন্তু ইমাম সানজালি (রহ.), ইমাম ফখরুদ্দীন রাজীর জাহেরি এলেমের কথা শুনে তাকে মুরিদ করলেন না। তিনি বললেন, বাবা! আপনি বড়ো আলেম. আপনাকে মুরিদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আপনার মধ্যে এলেমের অহংকার আছে। তিনি আরো বললেন, আপনাকে আমি এক শর্তে মুরিদ করতে পারি, আপনি এক বছর কোনো এলেম চর্চা না করে নির্জন গভীর জঙ্গলে মোরাকাবা-মোশাহেদা করে কাটাবেন। এ কথা শুনে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী মনে মনে ভাবলেন, আমাকে এলেম চর্চা করতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু লিখতে তো নিষেধ করেননি। তাই তিনি সঙ্গে কাগজ-কলম নিয়ে নির্জন জঙ্গলে চলে গেলেন এবং সেখানে বসে পবিত্র কুরআনের তাফসীর লিখলেন। এ তাফসীরই ‘তাফসীরে কাবির’ নামে খ্যাত। এক বছর পরে তাফসীরের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি হযরত ইমাম সানজালি (রহ.)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁকে পাণ্ডুলিপি খানা দিলে তিনি বললেন, বাবা! আপনাকে আমি এলেম কমাতে বলেছিলাম, কিন্তু আপনি তা আরো বাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। সুতরাং আপনাকে মুরিদ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথা শুনে ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) মনক্ষুণ্ন হয়ে চলে গেলেন।
মৃত্যুর সময় প্রতিটি মানুষকে ইমানি পরীক্ষা দিতে হয়। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) এলেমের অহংকারে বশবর্তী হয়ে ভাবলেন, ইমাম সানজালি (রহ.) আমাকে যেহেতু তাঁর মুরিদ করলেন না, আমার মোর্শেদের প্রয়োজন নেই। তিনি শরিয়ত তথা কিতাবি বিদ্যা দিয়েই ইমানি পরীক্ষায় পার হতে পারবেন, এ বিশ্বাসে আল্লাহর একত্ববাদের উপর ৩৬০ খানা দলিল মুখস্থ করলেন।
মৃত্যুর সময় তাঁর ইমানি পরীক্ষা শুরু হলে ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) এক এক করে আল্লাহর একত্ববাদের উপর দলিল দিতে শুরু করলেন। সেই সময় শয়তান তাঁর প্রতিটি দলিল খণ্ডন করলে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। অতঃপর তাঁর মুখস্থ করা ৩৬০ খানা দলিল একে একে শেষ হয়ে গেল। অবশেষে শয়তান আরো একখনা দলিল দিয়ে পুনরায় প্রমাণ করল যে, আল্লাহ্ একাধিক। এমতাবস্থায় জগদ্বিখ্যাত আলেম ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর আমিত্ব, অহংকারের সকল বাঁধ ভেঙ্গে গেল, তাঁর মধ্যে অনুশোচনার সৃষ্টি হলো। তিনি দুচোখের পানি ফেলে বলতে লাগলেন- হায় আফসোস! আজ যদি আমার মোর্শেদ থাকতো, তাহলে আমাকে ইমান হারা হয়ে কবরে যেতে হতো না। তখন তিনি অসহায় নিরুপায় হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে ইমাম সানজালি (রহ.)-এর দয়া কামনা করলেন।
মোর্শেদ অন্তর্যামী, শত সহস্র মাইল দূরে থেকেও মুরিদের খবর তিনি রাখেন। ইমাম সানজালি (রহ.)-এর অন্তরে দয়ার উদ্রেক হলো। তখন তাঁর মনে পড়ল সেদিনের কথা, যেদিন ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) তাঁর নিকট এসেছিলেন মুরিদ হওয়ার জন্য, কিন্তু তিনিই তো তাকে মুরিদ করেননি। আজ জগদ্বিখ্যাত আলেম মোর্শেদ বিহনে ইমান হারা হয়ে কবরে যাচ্ছে, এই ভেবে ইমাম সানজালি (রহ.) আর স্থির থাকতে পারলেন না।
ঠিক ঐ সময় ইমাম সানজালি (রহ.) ওজু করছিলেন এবং কয়েকশত মাইল দূরে থেকে অন্তরের চোখ দিয়ে ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) ও শয়তানের বাদানুবাদ দেখছিলেন। শয়তানের কাছ থেকে মুরিদকে রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর ওজুর ঘটি শয়তানের দিকে নিক্ষেপ করে বললেন- ‘‘হে ফখরুদ্দীন! বলো, বিনা দলিলে আমার আল্লাহ এক।’’ মোর্শেদের নিকট থেকে এ নির্দেশ পাওয়া মাত্র ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) শয়তানকে বললেন- ‘‘আমার মোর্শেদের দোহাই দিয়ে বলছি! বিনা দলিলে আমার আল্লাহ্ এক।’’ এ কথা বলা মাত্র শয়তান বলল- হে ফখরুদ্দীন ! আজ যদি তোমার মোর্শেদ ইমাম সানজালি (রহ.) তোমার পাশে না থাকতেন, তাহলে আমি শয়তান দেখতাম, তুমি কীভাবে ইমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করো।
জীবনের এ চরম অন্তিম মুহূর্তে আল্লাহর বন্ধু ইমাম সানজালি (রহ.)-এর দয়া পেয়ে ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর দুচোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মহান রাব্বুল আলামিনের অপার দয়ায় জীবনের শেষ লগ্নে শরিয়তের আলেম ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) উপলদ্ধি করতে পারলেন যে, একমাত্র মোর্শেদই পারেন মুরিদের মৃত্যুর সময় বেইমান হয়ে মরে যাওয়া থেকে মুরিদকে রক্ষা করতে।
প্রিয় পাঠক! ভেবে দেখুন, বিখ্যাত আলেম ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.)-এর মতো ব্যক্তির যদি ইমান নিয়ে কবরে যাওয়ার জন্য মোর্শেদের সাহায্য ও দয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হতে পারে? আসলে মোকাম্মেল অলী-আল্লাহ্ বা মোর্শেদের সহবতে না গেলে কারো পক্ষেই ইমান নিয়ে কবরে যাওয়া সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য যে, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী (রহ.) মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাঁর মোর্শেদ ইমাম সানজালি (রহ.)-এর দয়ার বদৌলতে ইমানের পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছেন, ঘটনাটি তিনি জাতিকে জানানোর জন্য দয়াময় আল্লাহর নিকট আরজ করলেন- ‘‘হে দয়াময় খোদা! আপনি দয়া করে কিছুটা সময় আমাকে দান করুন, যেন আমি জাতিকে মহান মোর্শেদের সান্নিধ্যে যাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য যে অপরিহার্য, তা জানাতে পারি।’’ দয়াময় খোদা তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন এবং মৃত্যুর পূর্বে আপন মোর্শেদের নেকদৃষ্টি ও দয়ার কথা তিনি জাতিকে বিস্তারিত বলে গেলেন। (তথ্য সূত্র : জামিউত তাফসীর ও নুরুল আসরার, ১ম খণ্ড)
মহান আল্লাহর অপার দয়ায় যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানকে আমরা মোর্শেদ রূপে পেয়েছি, তাঁর শিক্ষা গ্রহণ ও নিয়মিত আমল করে আমরা মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর নৈকট্য লাভ করত ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারি।
মহান আল্লাহ্ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের নুরানি চেহারা মোবারকের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি পূর্ণিমার চাঁদে দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন- এ মহামানব তাঁর প্রিয় বন্ধু। সুতরাং যে মহান মোর্শেদকে আল্লাহ্ দয়া করে এত বড়ো বিরল সম্মানের অধিকারী করেছেন, মুরিদের কর্তব্য হচ্ছে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া, তিনি একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মহামানব, বর্তমান যুুগে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করে ওয়াজিফা আমল করলে একজন ব্যক্তি আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হয়ে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে নিজের জীবন অতিবাহিত করতে সক্ষম।
আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে- আলোকিত মানুষ চাই। আলোকিত মানুষ হতে চাইলে যিনি আলোর চরিত্রের অধিকারী তাঁর সান্নিধ্যে যাওয়া অপরিহার্য। পবিত্র কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করে আপনার ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান লাভ হবে। কিন্তু কখনই আলোকিত মানুষ হতে পারবেন না। আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য যিনি কুরআনের চরিত্রে চরিত্রবান, এরূপ মহামানবের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ আপন হৃদয়ের মাঝে ধারণ করতে হবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- আইনের গ্রন্থাবলি অধ্যয়ন করে একজন ব্যক্তি বিচারক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। যে কোনো বিচারের রায় বিচারককেই প্রদান করতে হয়। বিচারকের আসনে আইনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান গ্রন্থটিকে রেখে দিলে সেই গ্রন্থ রায় প্রদান করতে পারবে না। তাই যিনি আইনের গ্রন্থ অধ্যয়ন করে আইন বিষয়ক যাবতীয় তথ্যাবলি নিজ হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছেন, তিনিই সঠিকভাবে বিচার কার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন।
অনুরূপভাবে, মহান মোর্শেদ হলেন কুরআনের চরিত্র তথা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান এবং আল্লাহর রঙে রঙিন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- ‘‘ছিবগাতাল্লাহ্।’’ অর্থাৎ- আল্লাহর রঙে রঙিন হও।
আসলে আলোকিত মানুষ হলেন অলী-আল্লাহ্গণ। মূলত তাঁরাই মহামানব। তাঁদের নির্দেশিত পথে চললেই সুন্দর চরিত্রের মানুষে পরিণত হওয়া সম্ভব। তাই মোর্শেদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মোর্শেদ সম্পর্কে বলেন- ‘‘আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোনো (মোর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকরী অভিভাবক পাবেন না।’’ (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)
আমাদের এ উপমহাদেশে ইসলাম এসেছে অলী-আল্লাহ্গণের মাধ্যমে, আর অলী-আল্লাহ্গণের মধ্যে বহু সংখ্যক এসেছেন সুদূর আরব দেশ থেকে। তাঁদের ভাষা ছিল আরবি। আবার অনেকে এসেছেন সুদূর পারস্য থেকে। তাঁদের ভাষা ছিল ফারসি। সুতরাং তাঁদের মাধ্যমে মানুষ আরবি এবং ফারসি এ দুটি ভাষার সাথেই পরিচয় লাভ করেছে। এছাড়া মোগল শাসনামলে এ উপমহাদেশে ফারসি ভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত ছিল। তাই আমরা নামাজ, রোজা, পির, দরবেশ, ফেরেশতা ইত্যাদি ফারসি শব্দ ব্যবহার করে থাকি। ফলে বহু সংখ্যক মানুষ মোর্শেদ শব্দের সাথে পরিচিত নয়। মোর্শেদ এমন একজন মহামানব, যিনি একদিকে যেমন আল্লাহর অলী, অপরদিকে তিনি রাসুল (সা.)-এর সিরাজাম মুনিরার অধিকারী।
কামেল মোর্শেদের গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন- ‘‘হাসপাতালে রোগী আছে, প্রচুর ঔষধ আছে, কিন্তু ডাক্তার নেই, তাতে রোগীর রোগ ভালো হবে না। এজন্য প্রয়োজন ডাক্তারের। অলী-আল্লাহ্গণ আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তুল্য এবং কলুষিত আত্মার জন্য ডাক্তার তুল্য। তাঁদের সান্নিধ্যে যাওয়া ছাড়া যেমনি এলমে মারেফাত হাসিল করা সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় আত্মাকে রোগমুক্ত করা।
কোনো ডাক্তার থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে সে অনুযায়ী ঔষধ সেবন না করে রোগী যদি ব্যবস্থাপত্র মুখস্থ করে তাহলে যেমন রোগ মুক্তির আশা করা যায় না, তদ্রুপ অলী-আল্লাহ্গণের সহবতে না গিয়েই শুধু কিতাব পড়লে তা দ্বারা আল্লাহ্কে পাওয়া যায় না। কারণ আল্লাহ্ নুরের। কালির অক্ষর পড়ে নুরের আল্লাহ্কে পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’’ (সূত্র: এজিদের চক্রান্তে মোহাম্মদী ইসলাম, পৃষ্ঠা ১৬৬)
মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা গ্রহণ করে তদানুযায়ী আমল করলেই কেবল মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-কে পাওয়া সম্ভব। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ এরশাদ করেন- ‘‘যার ক্বালবকে আমার (আল্লাহ্) জি¦কির থেকে গাফেল করেছি, তুমি তার আনুগত্য করবে না।’’ (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ২৮)
অলী-আল্লাহ্গণ হলেন শান্তির দূত। তাঁরা আল্লাহর গুণে গুণী। প্রতিটি মানুষকে ইহকালীন কর্ম অনুযায়ী শান্তি অথবা শাস্তি ভোগ করতে হয়। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- মানুষকে তিনটি প্রশ্ন করা হয়। আর তা হলো- ‘‘মার রাব্বুকা, ওয়ামা দ্বিনুকা, ওমান নাবিয়্যুকা; আও মান হাজার রাজুল।’’ অর্থাৎ- তোমার প্রভু কে? তোমার ধর্ম কি? তোমার নবি কে? অথবা হযরত রাসুল (সা.)-কে দেখিয়ে বলা হবে এই ব্যক্তি কে?
যিনি রাসুল (সা.)-কে চিনতে পারবেন, কেবল তিনিই এ প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হবেন। অন্যথায় বলবে- হা হা লা আদরী। অর্থাৎ- আফসোস! আফসোস! আমি জানি না। পরকালের এ তিনটি প্রশ্নের জবাব ইহকালে থেকেই প্রস্তুত করতে হবে এবং জবাব প্রস্তুতের জন্য যেতে হবে মোর্শেদের সান্নিধ্যে। কারণ কামেল মোর্শেদই পারেন আপনাকে মহান আল্লাহ্ এবং হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। ফলে আপনি আপনার প্রভুর পরিচয় যেমন পাবেন, তেমনি দয়াল রাসুল (সা.)-এর পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হবেন।
সুতরাং আপনার আর কোনো ভয় থাকবে না। তাই কোনো অলী-আল্লাহর সহবতে গিয়ে নিজের কু-রিপুকে দমন করতে পারলে সমাজে শান্তি নেমে আসবে।
[লেখক: পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]