পবিত্র আশুরা: একটি পর্যালোচনা
অধ্যক্ষ মো. নিয়ামুল কবির
‘আশুরা’ আরবি শব্দ, এর অর্থ দশম। আশুরাকে কেন্দ্র করে অনেক ইতিহাস রয়েছে। মহররম হিজরি সনের প্রথম মাস। বিশ্ব জগতে সংঘটিত অসংখ্য উত্থান-পতন ও সৃষ্টি-ধ্বংসে বিজড়িত এই মাস। এই মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরার দিবসেই মহান রাব্বুল আলামিন আসমান ও জামিনের সৃষ্টি কার্য সম্পন্ন করে বিশ্ব জগতের প্রতিপালক হিসেবে আরশে আজিমে সমাসীন হয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা বিষয়টি উপস্থাপন করা হলো:
মহান আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ্, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে, তারপর তিনি সমাসীন হন আরশে, তিনি পরিচালনা করেন প্রতিটি কাজ। সুপারিশ করার কেউ নেই তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে। তিনিই হলেন আল্লাহ্, তোমাদের পালনকর্তা, কাজেই তোমরা তাঁরই ইবাদত করো। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৩)
সেদিন আরশে সমাসীন হওয়ার মধ্য দিয়ে যে অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানে সকল আদম সন্তানের রূহসমূহ মহান আল্লাহ্কে রব (প্রভু) হিসেবে স্বীকার করে নেয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ ফরমান, “স্মরণ করো, আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তোমার রব বের করলেন তাদের বংশধরদের এবং তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নিলেন তাদেরই সম্বন্ধে এবং বললেন: আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল: হাঁ, আমরা সাক্ষী রইলাম। তা এজন্য যে, তোমরা যেন কিয়ামতের দিন বলতে না পার যে, আমরা তো এ ব্যাপারে বেখবর ছিলাম।” (সূরা আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৭২)
সুতরাং মহান রাব্বুল আলামিনের আরশে সমাসীন হওয়ার এই দিবসটি ছিল মহরমের ১০ তারিখ। আর সেদিনটি ছিল শুক্রবার । সঙ্গত কারণে এই দিবসটির গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত অপরিসীম। এমনকি মহান আল্লাহ্ নিজেই এই দশ তারিখের কসম করে পবিত্র কুরআনে আয়াত নাজিল করেছেন। এরশাদ হচ্ছে- “কসম ফজরের সময়ের, কসম দশ রাতের (মহরমের ১০ তারিখের)।” (সূরা ফাজর ৮৯: আয়াত ১-২)
মহররমের দশ তারিখ সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বিভিন্ন হাদিস
উপর্যুক্ত আয়াতে দশ রাত্রি বলতে দশ তারিখকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, আমরা সবিশেষ অবহিত আছি যে , চান্দ্র মাসের তারিখ গণনা করা হয় রাত্রির শুরু বা সন্ধ্যার পর থেকে। সূরা আল ফাজরের ১ ও ২নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশ্ববিখ্যাত তাফ্সীরে তাবারীর ৩০নং খণ্ডের ১৬৮ পৃষ্ঠায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “আর কসম দশ রাত্রির। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এর দ্বারা বৎসরের প্রথম মাস মহরমের দশ দিন অর্থাৎ পবিত্র আশুরাকে বুঝানো হয়েছে। ”
আলোচ্য হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ৩০নং খণ্ডের ৪৯৯ পৃষ্ঠায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “তোমরা আশুরার রোজা রাখো। ইহুদিদের বিপরীত কাজ করো। তোমরা আশুরার রোজার সাথে আগের দিন অথবা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখো।”
হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-কে শুক্রবার আসরের পর সৃষ্টি করেন। (অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। বস্তুত দিনটি ছিল মহররম মাসের দশম তারিখ পবিত্র আশুরার দিন)।” (মেশকাত শরীফ ৫১০পৃষ্ঠা)
মহামানবগণের বাণী:
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, যুগের ইমাম, আম্বিয়ায়ে কেরামের ধর্মের দায়িত্ব ও বেলায়েতলাভকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, “আশুরার দিবসে আল্লাহ্ বসলেন আরশে। আশুরার অসিলায় পাপিতাপি মুক্তি পায়।”
কাদেরিয়া তরিকার ইমাম বড়ো পির মহিউদ্দিন হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেছেন-“মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আশুরার দিবসে আরশে সমাসীন হয়েছেন। আর এ বিশ্বজাহান ধ্বংসও হবে এ দিনে। সর্বপ্রথম বৃষ্টি ও আল্লাহর রহমত দুনিয়াতে বর্ষিত হয় এই আশুরার দিবসেই।”
পবিত্র আশুরা অর্থাৎ মহররম মাসের দশ তারিখ শুক্রবার মহান রাব্বুল আলামিনের অভিষেকের দিন হওয়ার কারণেই এ দিবসের বুজুর্গি, সম্মান ও মাহাত্ম্যকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন-কোনো রাজ্যের রাজার অভিষেকের দিনটি সেই দেশের রাজা ও প্রজাদের নিকট বিশেষ স্মরণীয় ও সম্মানিত দিন। সেই দিনটি প্রজাদের জন্য চাওয়া ও পাওয়ার দিন। তেমনিভাবে আশুরা হলো মহান আল্লাহর বান্দাদের জন্য চাওয়া ও পাওয়ার দিন। এজন্য মহান রাববুল আলামিন তাঁর অভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সৃষ্টিজগতে অসংখ্য ঘটনার অবতারণা করেন। সেসকল ঘটনাসমূহকে পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করা হলো। মহররমের দশ তারিখ শুক্রবার অর্থাৎ পবিত্র আশুরার এ দিবসে-
১. মহান রাব্বুল আলামিন হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে জমিনে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যেমন প্রেরণ করেন, তেমনি করে তাঁকে বেহেস্তেও প্রবেশ করান। অতঃপর এ দিবসেই তাঁকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়। আর আশুরার পবিত্র দিবসেই হযরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়।
২. হযরত নুহ (আ.)-এর কিস্তি বা নৌকা ঝড়-তুফানের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল।
৩. হযরত ইব্রাহিম (আ.) যেমন ভূমিষ্ঠ হন, তেমনি এ দিনেই তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পান। তাঁর কলিজার টুকরা সন্তান হযরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর নামে কোরবানি করে এ দিবসেই ‘খলিলুল্লাহ’ বা আল্লাহর বন্ধু খেতাবে ভূষিত হন।
৪. হযরত আইয়ূব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ-শোকে ভোগার পর অবশেষে মুক্তি লাভ করেন।
৫. হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে এ দিবসেই জান্নাতে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
৬. হযরত দাউদ (আ.) আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রাপ্ত হন ।
৭. হযরত সোলেমান (আ.) হারানো রাজত্ব ফিরে পান।
৮.হযরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর দয়ার বরকতে মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসেন।
৯. পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) ও পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর একে অপরের সাক্ষাৎ পান।
১০. প্রাচীন মিশরের রাজা দ্বিতীয় র্যামেসিস (ফেরাউন)-এর বিবি হযরত আছিয়া (আ.) শিশু মুসা (আ.)-কে গ্রহণ করেন; আবার হযরত মুসা (আ.) স্বীয় অনুসারী বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। পক্ষান্তরে, ফেরাউন ও তার দলের লোহিত সাগরে সলিল সমাধি ঘটে ।
১১. হযরত ঈসা (আ.) এ দিবসে মহান আল্লাহর আহ্বানে জীবিতাবস্থায় আসমানে উত্থিত হন।
১২. এই দিনে আখেরি নবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর রূহ মোবারক সৃষ্টি করা হয়েছিল ।
১৩. দুই হাজার শান্তির দূত নবি ও রাসুলের শুভ জন্মদিন এ দিবসে। (আর নবি, রাসুল ও অলী- আল্লাহর জন্মদিন যে রহমতের এ কথা আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনেই বলে দিয়েছেন)।
১৪. সাইয়্যেদুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমিরুল মু’মিনিন শেরে খোদা হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (রা.)-এর হৃদয়ের ধন, মোহাম্মদী ইসলামের অকুতোভয় বীর সেনানি ইমাম হোসাইন (রা.) মাত্র ৭২ জন সহযোগী নিয়ে দুরাচার এজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদত বরণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করার এক সুমহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন।
১৫. কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার পর মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী মুসলমানগণ এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজেদের ঐতিহ্য ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। বিধর্মীদের চক্রান্তের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহান আদর্শ এলমে তাসাউফ বা এলমে মারেফাত (ঝঢ়রৎরঃঁধষ ঝপরবহপব) কালের অতলে হারিয়ে যায়। উল্লেখ্য, রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া মোহাম্মদী ইসলাম বা দয়াল রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া ইসলামের পুনঃ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান ১৯৮৫ সালের এ আশুরার দিবসেই কোটি কোটি আশেকে রাসুলের প্রাণের স্পন্দন দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। এ দিবসটিতে অতি তাজিমের সাথে দরুদ ও সালাম পেশ করা, ঘরে ঘরে মিলাদ পড়া, দয়াল রাসুলে পাক (সা.)-এর স্মরণে অনুষ্ঠান পালন ও এতিম-অসহায়দেরকে দান-খয়রাত করার উপর তাগিদ দিয়েছেন ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সম্মানিত প্রফেসর মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্বপ্রদানকারী মহামানব, দেওয়ানবাগ শরীফের পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর।
আজ এই পবিত্র আশুরার দিনের সত্যিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে আমাদের প্রত্যেক আশেকে রাসুল ভাই ও বোনদের। ইয়াওমে আশুরাকে রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) যেভাবে এবং যে দৃষ্টিতে উম্মতে মোহাম্মদীকে পালন করতে বলেছেন, ঠিক সেভাবে সংশ্লিষ্ট সকলকেই তা অনুসরণ করা উচিত।
তথ্যসূত্র:
১. সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী, তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ১ম খণ্ড, আল কোরআন গবেষণা কেন্দ্র, দেওয়ানবাগ শরীফ, বাবে রহমত, ১৪৭ আরামবাগ, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০, পৃষ্ঠা ৫৯৪-৬০০
২. গাউসুল আজম বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.), অনুবাদ এ. এন. এম. ইমদাদুল্লাহ্, গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন (১ম ও ২য় খণ্ড); ফেন্সী লাইব্রেরী এন্ড স্টেশনারী ৬, প্যারীদাস রোড, ঢাকা-১১০০, পৃষ্ঠা ১৯৯-২০০, ২য় সংস্করণ ১৯৯৬
৩. হযরত মাওলানা মুহাম্মদ শাফী (রহ.), অনুবাদ ও সম্পাদনায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, খাদেমুল-হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদীনা, সৌদী আরব, পৃ. ৪৯৬-৫৯৯
৪. ছহীহ্ আ’মালে নাজাত, সংকলন ও সম্পাদনায় মাওলানা আহমদ ছৈয়দ (কাওছার), পরিবেশনায় ইসলামিয়া কুরআন মহল, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা, পৃ. ২৩৩-২৩৫, ২য় সংস্করণ, জুলাই, ২০০০
[লেখক: অধ্যক্ষ, নবযুগ কলেজ, কুশুরা, ধামরাই, ঢাকা।]