পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.): রহমত ও বরকতের দিন
ড. জাহাঙ্গীর আলম
মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা। সৃষ্টির পূর্বে তিনি ছিলেন এক ও অদ্বিতীয়। তিনি নিজেকে প্রকাশ করার জন্য সৃষ্টিজগত সৃজন করলেন। এই প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন-“আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম তাই সৃষ্টিজগত সৃজন করলাম। (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ১০) মহান রাব্বুল আলামিন নুরময় সত্তা হতে নিজের সকল গুণ, রূপ, লাবণ্য, মাধুর্য দিয়ে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নুরকে তথা নুরে মোহাম্মদীকে সৃজন করলেন। এই নুর হতে তামাম মাখলুকাত সৃষ্টি। এই প্রসঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন, “আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরী- আনা মিন নূরিল্লাহি ওয়া কুল্লা শাইয়্যিম মিন নূরী।” অর্থ- আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নুরকে সৃজন করেছেন, আমি আল্লাহ্-র নুর হতে আর সমস্ত সৃষ্টিরাজি আমার নুর হতে। (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ৩)
সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে পাওয়ার জন্য কুল মাখলুকাত অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছিল। তাঁর আগমনের পূর্বে চারদিক ছিল নানাপ্রকার পাপ-পঙ্কিলতায় ঘোর অন্ধকার। মানুষের মাঝে কোনো মনুষ্যত্ব ছিল না। আরবের মানুষ ছিল সামাজিক অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অধঃপতনে নিমজ্জিত চারদিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-রাহাজানি, নানারকম আন্তঃকলহে লিপ্ত, অশান্তির অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার। ঠিক তেমনি এক ক্রান্তিলগ্নে পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পশ্চিম দিগন্তে দেখা গেল পূর্ণিমার চাঁদ হতে অতি উজ্জ্বল শান্তির সওগাত, মুক্তির বাণী নিয়ে আরবের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে হযরত মা আমিনা (আ.)-এর কোলে হযরত আব্দুল্লাহ (আ.)-এর শাহি প্রাসাদে জ্যোতির্ময় এক মহামানবের আগমন ঘটলো। এমনই এক সময় রাতও নয় দিনও নয়, সুবেহ সাদেকের সময়, সোমবার ১২ই রবিউল আউয়াল হিজরিপূর্ব ৫৩ সাল।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভাগমনের দিন ছিল কুল মাখলুকাতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের, খুশির, রহমত ও বরকতের। এই দিনটি মুসলিম উম্মাহ্র নিকট ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) হিসেবে পরিচিত। ‘ঈদ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো খুশি হওয়া, আনন্দ উদ্যাপন করা। ‘মিলাদ’ শব্দের অর্থ জন্ম, ‘ঈদে মিলাদুনবি’ অর্থ নবির জন্মের আনন্দ। অর্থাৎ নবিজির শুভাগমনে আনন্দ বা খুশি উদ্যাপন করাকে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) বলে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) স্বয়ং নিজের জন্মদিন পালন করেছেন। এই প্রসঙ্গে হযরত আবু কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত একদা হযরত রাসুল (সা.)-কে আরজ করা হলো রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে সোমবারের সওম সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হলে তিনি বলেন, “ঐদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং ঐদিন আমার উপর কোরআন নাজিল হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৮, বায়হাকি আহসানুল কুবরা ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৬, মুসনাদে আহম্মদ ইবনে হাম্বল ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৭)
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) সম্বন্ধে ইমাম আল্লামা শেহাবুদ্দিন আহম্মদ বিন হাযার আল হায়তামি আল শাফী (রহ.) প্রণীত ‘আন নেয়ামাতুল কুবরা আলাল আলম ফি মওলুদে সাইয়্যেদিল আনাম’ নামক কিতাব থেকে জানা যায় যে, ইসলামের প্রধান চার খলিফা ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করেছেন এবং এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরে মূল্যবান বাণী মোবারক প্রদান করেছেন। এই থেকে প্রতীয়মান হয় ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অধিক পুণ্যের কাজ। ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) যথাযথ সম্মানের সাথে পালন করে আমরা আল্লাহ্র দয়া লাভ করতে পারব। হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন ইমামুল মুরসালিন, তথা নবি-রাসুলদের সর্দার। সৃষ্টির আদি হতে প্রেরিত সকল নবি-রাসুল তাঁর আগমনের সুসংবাদ তাদের নির্দিষ্ট কওমের নিকট প্রচার করেছেন এবং তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল তাঁর স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর প্রমাণ আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ ৪টি আসমানি কিতাবে দেখতে পাই। প্রথম আসমানি কিতাব তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে-“তোমাদের প্রভু, ঈশ্বর তোমাদের ভ্রাতৃত্বের মধ্য হতে আমার (মুসা) মতই একজন পয়গম্বর উত্থিত করবেন। তাঁর কথা তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করবে।” ইনজিল কিতাবে প্রণীত হয়েছে-“যদি তোমরা আমাকে ভালোবাস, তবে আমার উপদেশ মতো কার্য করো, আমি স্বর্গীয় পিতার কাছে প্রার্থনা করব যাতে তিনি তোমাদেরকে আর একজন শান্তিদাতা প্রেরণ করেন, যিনি চিরদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন।”
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে-“নিশ্চয়ই আল্লাহ্ নিজে ও তার ফেরেশতারা নবির উপর দরুদ পাঠ করেন, হে বিশ্বাসীরা তোমরাও তার উপর দরুদ পাঠ করো ও শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো। (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬)
মহান রাব্বুল আলামিন নিজে সম্পর্কে বলেন-“আলহামদুলিলাহি রাব্বুল আলামিন”- সকল প্রশংসা আল্লাহ্র। তিনি জগতসমূহের প্রভু। হযরত রাসুল (সা.) সম্পর্কে বলেন – “ওয়ামা আরসালনাকা ইলা রাহমাতাল্লীল আলামিন।” অর্থ: (হে রাসুল) আমি তো আপনাকে জগতসমূহের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ১০৭) সারা বিশ্বের রহমত ও বরকত হলো হযরত মোহাম্মদ (সা.)। হযরত রাসুল (সা.)-এর রহমত লাভ করতে আমাদেরকে তাঁর নির্দেশিত পথ ও মত অনুযায়ী চলতে হবে। তবেই হযরত রাসুল (সা.) আমাদের উপর রাজি খুশি হবেন। দয়াল রাসুল (সা.)-এর শাফায়াত লাভের জন্য আমাদেরকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে তাঁর শুভ জন্মদিন তথা ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) ঘরে ঘরে পালন করতে হবে। যদি আমরা ঘরে ঘরে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করতে পারি, তাহলে দয়াল রাসুল (সা.)-এর রহমত লাভ করতে সক্ষম হবো। আর রহমত যেখানে থাকে সেখানে গজব থাকতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল বিপদাপদ বালা মুসিবত অভাব অনটন দূর হবে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারবো। ইনশাল্লাহ্!
হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার নাম ইমান। যে রাসুল (সা.)-কে যতটুকু ভালোবাসতে পারবে তার ইমান ততটুকু। এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বলেন-“যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তানসন্ততি ও অন্যসকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মেন হতে পারবে না।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭ এবং মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯) হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের একটি মাধ্যম হলো- তাঁর শুভ জন্মদিন মর্যাদার সাথে পালন করা। আমরা যদি হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করতে পারি, তাহলে হযরত রাসুল (সা.) আমাদের উপর খুশি হবেন। আমরা যদি কোনো একটি কর্ম দ্বারা হযরত রাসুল (সা.)-কে খুশি করতে পারি, তাহলে আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বয়ে আসবে অনাবিল সুখ ও শান্তি।
আমরা যদি নিজেদের ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজনের কারো জন্মদিন পালন করি তাহলে সে মহাখুশি হয়। একজন ছাত্র যদি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে মা ও বাবা আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রতিবেশীর মাঝে মিষ্টি বিতরণ করে। যে রাসুল (সা.)-এর কারণে সকল কিছু পেলাম, ঐ রাসুলের শুভ জন্মদিন শতগুণ বেশি আনন্দের নয় কি? দয়াল নবির শুভ জন্মদিন তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর দিনে আমরা যদি নিজেদের ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজনদের মাঝে নতুন জামা কাপড় ক্রয় করে দেই, ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উপলক্ষ্যে পাড়ায়, মহলায়, এলাকায় যদি মিষ্টি, কেক, উন্নত মানের খাবার বিতরণ করি, তাহলে দয়াল রাসুল (সা.) কি আমাদের উপর খুশি হবেন না? দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আমাদের মাঝে ঈদুল ফিতর আসে, সুন্নতে ইব্রাহিম হিসেবে কোরবানির ঈদ পালন করি। আর যে রাসুলের উসিলায় এই দুই ঈদ পেলাম সেই রাহমাতুলিল আলামিনের শুভ জন্মদিন এর চেয়ে লক্ষগুণ বেশি খুশির নয় কি? ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) হলো- উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য শ্রেষ্ঠ ঈদ।
আমাদের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় খ্রিষ্টানরা তাদের নবি হযরত ঈসা (আ.)-এর শুভ জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর (বড়ো দিন) সারা বিশ্বে ছুটিসহ মহাধুমধামের সাথে পালন করে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের শুভ জন্মদিন (বুদ্ধ পূর্ণিমা) অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করে। হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মদিন (শুভ জন্মাষ্টমী) হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করে। কিন্তু যে রাসুল (সা.)-এর কারণে হযরত ঈসা (আ.), হযরত মুসা (আ.)-সহ সকল নবি-রাসুলের সৃষ্টি, কুল-কায়েনাত সৃষ্টি সে রাসুলের শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করতে গেলে একটা সময় নানা রকমের ফতোয়ার কবলে পড়তে হতো। মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর মহৎ উদ্যেগে এ প্রস্তাবে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) স্বীকৃতি লাভ করে। সরকার এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করে। সেই থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ সরকার যথাযথ মর্যাদার সাথে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) পালন করে আসছে। সরকার এই উপলক্ষ্যে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। হাসপাতাল, কারাগার-সহ বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানে এবং দুঃস্থ অসহায়দের মাঝে উন্নত মানের খাবার বিতরণ করেন। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পবিত্র কালেমা খচিত পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। অফিস আদালত বাসা বাড়ি আলোকসজ্জা করা হয়।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি সিরাজুম মুনিরার ধারক ও বাহক মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উপলক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এই উপলক্ষ্যে তিনি আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন আহ্বান করেন। এই দিনটি তিনি সবচেয়ে বড়ো উৎসবের দিন হিসেবে গুরুত্বের সাথে পালন করেন। এই মহামানবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) উদ্যাপনের মাধ্যমে অগণিত মানুষ আশেকে রাসুলে পরিণত হচ্ছেন। দয়াল রাসুল (সা.)-এর প্রকৃত প্রেম হৃদয়ে ধারণ করে অনেক মানুষ স্বপ্ন ও মোরাকাবায় তাঁর দিদার লাভ করেছেন। আশেকে রাসুলগণ আল্লাহর অবারিত রহমত ও বরকত লাভ করে সুখ ও শান্তিময় জীবনযাপন করছেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুর শুভ জন্মদিন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) আমাদের সকলকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে পালন করে দয়াল রাসুল (সা.)-কে রাজি খুশি করার তৌফিক দান করুক। আমিন।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]