পবিত্র শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান প্রণিত ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ ১ম খণ্ড থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।
-সম্পাদক]
বরকতময় রজনি বা শবে বরাতের রাতে মহান আল্লাহ্ প্রত্যেকটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, অতঃপর খোদায়ী প্রশাসনের মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এ রাতে মানুষ কী প্রার্থনা করে, মহান আল্লাহ্ তা সবই শুনেন।
পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- “ফীহা ইউফরাক্বু কুল্লু আমরিন হাকীমিন, আমরাম মিন ‘ইনদিনা, ইন্না কুন্না মুরসিলীনা, রাহমাতাম মির রাব্বিকা, ইন্নাহু হুওয়াস সামী’উল আলীম।” অর্থাৎ- আমার নির্দেশক্রমে এ রাতে (বরকতময় রজনিতে শবে বরাতের রাতে) প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর আমিই রাসুল প্রেরণ করে থাকি। [হে রাসুল (সা.)!] তারা আপনার প্রতিপালকের তরফ থেকে রহমত। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শুনেন, সবকিছু জানেন। (সূরা আদ দুখান ৪৪: আয়াত ৪ থেকে ৬)
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লাহর রাসুল (সা.) যে বাণী মোবারক প্রদান করেছেন, নিম্নে ইসলামের স্বর্ণযুগ হতে শুরু করে আধুনিক যুগের তাফসীর ও হাদিসের কিতাব যথা: তাফসীরে তাবারী, তাফসীরে দুররে মানছুর, তাফসীরে মাজহারী, মুসনাদে আহমাদ, বোখারী শরীফ, সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ, তিরমিযী শরীফ ও মেশকাত শরীফের হাদিস হতে উপস্থাপন করা হলো-
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে মাজহারী’র ৮ম খণ্ডের ৩০৫ পৃষ্ঠায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর বাণী- “আর আমিই রাসুল প্রেরণ করে থাকি। [হে রাসুল (সা.)!] তারা আপনার প্রতিপালকের তরফ থেকে রহমত।’ হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ্ বলেন, নবি-রাসুল প্রেরণ মানবজাতির প্রতি আমার একটি অনুগ্রহ। আর তারা তখনই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে যখন তারা আমার প্রেরিত রাসুলকে অস্বীকার করে।” এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শুনেন জানেন।’’
বর্ণিত হাদিসটি হাদিসের কিতাব বোখারী শরীফ-এর ২য় খণ্ডের ৯৪৬ পৃষ্ঠায় হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বললেন- “আল্লাহর রাসুল (সা.) এশার নামাজের শেষ রাকাতে রুকু হতে মাথা মোবারক উত্তোলন করে বলতেন- যে আল্লাহর প্রশংসা করে আল্লাহ্ তায়ালা তা শুনেন। অতঃপর তিনি ‘দোয়ায়ে কুনুত’ পাঠ করতেন এবং বলতেন- হে আল্লাহ্! তুমি আইয়াশ ইবনে আবু রাবিয়া, অলিদ ইবনে অলিদ এবং সালামা ইবনে হিশামকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ্! তুমি দুর্বল মু’মিনদেরকে রক্ষা করো।”
পর্যালোচনা :
সূরা আদ্ দুখান-এর ১ হতে ৬নং আয়াত পর্যন্ত লাইলাতুম মুবারাকাহ বা শবে বরাতের রজনি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আর এটি হলো অর্ধ শা‘বান বা শা‘বান মাসের ১৪ তারিখে দিবাগত রাত। উল্লেখ্য, (লাইলাতুম মুবারাকাহ) অর্থ বরকতময় রজনি, কল্যাণময় রজনি, মঙ্গলময় রজনি, প্রাচুর্যময় রজনি।
তাফসীরে জালালাইনের ৪১০ পৃষ্ঠায় তাফসীরে সা’বীর সূত্রে এ রাতের চারটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যথা-
১। আল লাইলাতুল মুবারাকাহ অর্থাৎ বরকতময় রজনি।
২। লাইলাতুল বারাআহ্ অর্থাৎ মুক্তির রজনি।
৩। লাইলাতুর রাহ্মাহ দয়াপ্রাপ্তির রজনি
৪। লাইলাতুস সাক অর্থাৎ বন্টনের রজনি।
এ রাতে লাওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত কুরআন সপ্তম আকাশ হতে দুনিয়ার আকাশে একত্রে নাজিল করা হয়। এ মর্মে হযরত ইকরামা (রা.) বলেন- “অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে আল্লাহ্ তায়ালা এ কুরআন সপ্তম আকাশ লাওহে মাহ্ফুজ হতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নাজিল করেন।’’ (তাফসীরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০)
শবে বরাত ও শবে ক্বদরের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই। আর তা হলো- শবে বরাতের রজনিতে সম্পূর্ণ কুরআন সামায়ে দুনিয়া বা দুনিয়ার আকাশে নাজিল হয়। আর শবে ক্বদরের রজনিতে মানব মুক্তির বিধান হিসেবে ধারাবাহিকভাবে কুরআন নাজিলের যাত্রা শুরু হয়।
এ বিষয়টি বাস্তবে সংঘটিত হয় এভাবে- শবে বরাতের রজনিতে সম্পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহ্ফুজ হতে সামায়ে দুনিয়া অর্থাৎ হযরত রাসুল (সা.)-এর ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফ্সির মোকাম হতে প্রথম স্তর সুদুরের মোকামে নাজিল করা হয়। আর এ জন্যই এ রাতকে লাইলাতুম মুবারাকাহ্ বা বরকতময় রজনি বলা হয়।
অতঃপর পবিত্র ক্বদরের রজনিতে হযরত রাসুল (সা.)-এর ক্বালবের প্রথম স্তর সুদুরের মোকাম হতে আস্তে আস্তে কুরআন নাজিলের যাত্রা শুরু হয়। গোটা কুরআন একসাথে নাজিল হওয়ার কারণে শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ রাতেই সৃষ্টি জগতের সকল মানুষের ভাগ্যলিপি এক বৎসরের জন্য নির্ধারণ করা হয়। এ বৎসরে নতুন করে কারা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে, কারা মৃত্যুবরণ করবে, কাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে, আর কারা হবে দুর্ভাগা, সকলই নির্ধারিত হয় বরাতের এ রাতে। এ রাতে মহান রাব্বুল আলামিন বান্দার প্রতি রহমত ও দয়ার দৃষ্টি প্রদান করে অসংখ্য মানুষকে ক্ষমা করে দেন।
নিম্নে হাদিসের আলোকে পবিত্র শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপস্থাপন করা হলো-
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে তাবারী’র ২৫নং খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “এক ব্যক্তি মানুষের সাথে চলাফেরা করছে। অথচ তার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অতঃপর ইবনে আব্বাস (রা.) আল্লাহর এ বাণী পাঠ করেন- ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) বরকতময় রাতে নাজিল করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’ অতঃপর বর্ণনাকারী বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়ের এক বৎসরের সিদ্ধান্ত শবে বরাতের এ রাতেই গ্রহণ করা হয়।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে তাবারী’র ২৫নং খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠার হযরত ইকরামা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহর বাণী- ‘এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’ হযরত ইকরামা (রা.) বলেন- অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রাতে পূর্ণ এক বৎসরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হায়াত-মওতের ফয়সালা হয়। হাজিদের তালিকা করা হয়। অর্থাৎ এ বৎসর যতজন হজ করবে তার সিদ্ধান্ত হয়। আর বাস্তবে দেখা যায়, সিদ্ধান্তকৃত সংখ্যা থেকে একজন বেশিও হয় না, কমও হয় না।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে তাবারী’র ২৫নং খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠায় হযরত উসমান ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আল মুগীরাহ ইবনে আখনাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এক শা‘বান হতে পরবর্তী শা‘বান পর্যন্ত মানুষের হায়াতের ফয়সালা (শবে বরাতের রাতে) করা হয়। অনন্তর এক ব্যক্তি বিয়ে করছে, তার সন্তানও হচ্ছে অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় এসে গেছে।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ২৫নং খণ্ডের ৪০৪ পৃষ্ঠায় হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে ১৪ রাকাত নামাজ আদায় করতে দেখেছি।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ২৫নং খণ্ডের ৪০২ পৃষ্ঠায় উম্মুল মু‘মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেন- “আল্লাহ্ তায়ালা চারটি রাতে সর্বপ্রকার কল্যাণের দরজা খুলে দেন। যথা- ১. ঈদুল আজহার রাত, ২. ঈদুল ফিতরের রাত, ৩. অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনি; এ রাতে হায়াত, রিজিক লিপিবদ্ধ করা হয় এবং হাজিদের তালিকা তৈরি করা হয় এবং ৪. আরাফাতের রাত ফজরের আজান পর্যন্ত।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ২৫নং খণ্ডের ৪০২ পৃষ্ঠায় হযরত আ’তা ইবনে ইয়াসার (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “যখন অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনি আসে তখন মৃত্যুর ফেরেশতার হাতে একটি ফাইল তুলে দেওয়া হয় এবং বলা হয় পরবর্তী বৎসর তুমি এদের রূহ কবজ করবে। দেখা যায়, এক ব্যক্তি খাট-পালং বানাচ্ছে, বিয়ে-শাদি করছে এবং ইমারত তৈরি করছে; অথচ তার নামটি মৃত ব্যক্তিদের ফাইলে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ২৫নং খণ্ডের ৪০১ পৃষ্ঠায় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “আল্লাহর রাসুল (সা.) শা‘বান মাসেই সর্বাধিক রোজা রাখতেন। কারণ এ মাসেই জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা হয়। অনন্তর এক ব্যক্তি বিয়ে করছে, অথচ তার নামটি মৃতের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। আর এক ব্যক্তি হজ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অথচ তার নামটিও মৃতের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে।”
বর্ণিত হাদিসটি তাফসীরের কিতাব তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ২৫নং খণ্ডের ৪০৩ পৃষ্ঠায় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “এক রাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) নামাজ আদায় করছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় সিজদারত ছিলেন, আমি ধারণা করলাম, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি গিয়ে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নাড়া দিলাম। তিনি নড়েচড়ে উঠেন। আমি সেখান থেকে ফিরে আসলাম। অতঃপর তিনি সিজদা হতে মাথা উঠিয়ে নামাজ শেষ করেন। অতঃপর তিনি বললেন, হে আয়েশা! হে হুমাইরা! তুমি কি মনে করেছ যে আল্লাহর রাসুল তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর নবি! আল্লাহর শপথ তা নয়, তবে আপনার দীর্ঘ সিজদার কারণে আমি মনে করেছিলাম আপনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বললেন, তুমি কি জানো এটি কোন রাত্রি? আমি বললাম, এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসুল ভালো জানেন। তিনি বললেন, এটি মধ্য শা‘বান বা শবে বরাতের রজনি। এ রাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করা হয়। রহমত কামনাকারীকে রহমত দান করা হয়। আর প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিকে তার আগের অবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়।”
বর্ণিত হাদিসটি হাদিসের কিতাব মেশকাত শরীফ-এর ১১৫ পৃষ্ঠায় ইবনে মাজাহ শরীফ-এর সূত্রে আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে তোমরা জাগ্রত থেকে ইবাদত করো, আর দিনে রোজা রাখ। কারণ এ রাতে আল্লাহ্ দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে এসে জগদ্বাসীকে আহ্বান করে বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কী? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছে কী? আমি তাকে রিজিক দেবো। কোনো রোগাক্রান্ত আছে কী? আমি তাকে সুস্থ করে দেবো। এভাবে অসীম দয়ালু আল্লাহ্ ভোর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।”
বর্ণিত হাদিসটি হাদিসের কিতাব মেশকাত শরীফ-এর ১১৫ পৃষ্ঠায় উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “হে আয়েশা। অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনির ফজিলত জানো কি? হযরত আয়েশা (রা.) আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসুল (সা.) এ রাতের ফজিলত কী? তিনি বলেন, এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয় কোন কোন সন্তান এ বৎসরের জন্ম নেবে। আর কে কে এ বৎসর মৃত্যুবরণ করবে। এ রাতে বান্দার আমল আল্লাহ্র নিকট পেশ করা হয় এবং এ রাতেই রিজিক বণ্টন করা হয়।”
বর্ণিত হাদিসটি হাদিসের কিতাব মেশকাত শরীফ-এর ১১৫ পৃষ্ঠায় ইবনে মাজাহ শরীফ-এর সূত্রে হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে নিজেকে প্রকাশ করেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।”
বর্ণিত হাদিসটি হাদিসের কিতাব মেশকাত শরীফ-এর ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফ-এর সূত্রে উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “এক রাতে আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে হারিয়ে ফেললাম। অতঃপর আমি তাকে খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে পেলাম। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি মনে করেছো আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসুল তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি মনে করেছি আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। তিনি বললেন, অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের এ রজনিতে আল্লাহ্ তায়ালা দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি বনি কিলাব সম্প্রদায়ের বকরীর পশম পরিমাণ বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।”
বর্ণিত হাদিসটি হাদিসের কিতাব মেশকাত শরীফ-এর ১১৫ পৃষ্ঠায় মুসনাদে আহমাদ-এর সূত্রে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “শবে বরাতের রাতে দুই শ্রেণি ব্যতীত সকল মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। যে দুই শ্রেণিকে ক্ষমা করা হয় না, তারা হলো- ১. হিংসুক ও ২. মানুষ হত্যাকারী।”
পর্যালোচনা
সুরা আদ্ দুখানের এক হতে ছয় নম্বর আয়াত পর্যন্ত অর্ধ শা‘বান বা পবিত্র শবে বরাত সম্পর্কে যেমনি বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে, তেমনি খোদায়ী প্রশাসনে কীভাবে হিকমতপূর্ণ বিষয়ের বাজেট পাশ করা হয় তাও বর্ণনা করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে- “আমার নির্দেশক্রমে (বরকতময় রজনি বা শবে বরাতের) এ রাতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।” (সূরা আদ দুখান ৪৪: আয়াত ৪ ও ৫)
হাদিস শরীফে আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- “এক শা‘বান হতে পরবর্তী শা‘বান পর্যন্ত মানুষের হায়াতের ফয়সালা করা হয়। দেখা যায় এক ব্যক্তি বিয়ে করেছে, তার সন্তানও হচ্ছে অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় এসে গেছে।” (তাফসীরে তাবারী, ২৫নং খণ্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা)
অন্য হাদিসে এসেছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান- “অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে মানুষের হায়াত ও রিজিক লিপিবদ্ধ করা হয় এবং হাজিদের নামের তালিকাও এ রাতেই করা হয়।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ২৫নং খণ্ড, ৪০২ পৃষ্ঠা)
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন- “অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে (খোদায়ী প্রশাসনের সভা শেষে) মৃত্যুর ফেরেশতাদের হাতে একটি ফাইল তুলে দেওয়া হয়। অতঃপর বলা হয়, পরবর্তী বৎসর তুমি এদের রূহ কবজ করবে।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০২)
মহান আল্লাহ্ সৃষ্টিজগত পরিচালনায় তাঁর সৈনিকদের নিয়োজিত রেখেছেন। পবিত্র লাইলাতুল বরাতে অনুষ্ঠিত ভাগ্য নির্ধারণী সভায় প্রত্যেকটি জনপদের অধিবাসীদের কর্মবিবরণী নিয়ে আল্লাহর সে সকল সৈনিক বা কুতুবগণ গুরুত্বপূর্ণ এ সভায় উপস্থিত হন। যেহেতু মহান আল্লাহর নিজস্ব বাহিনী বা প্রশাসন রয়েছে, সেহেতু মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে তার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে শত সহস্র স্থানে ‘নাহনু’ অর্থাৎ ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেভাবে দেশের সরকার প্রধান দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্তর্ভূক্ত করে আমাদের সরকার বলে সম্বোধন করে থাকেন। অলী-আল্লাহ্দের মধ্যে হতেই আল্লাহ্ তাঁর প্রশাসনের লোক নিয়োগ দেন। যাঁদেরকে পবিত্র কুরআনে হিজবুল্লাহ্ বা আল্লাহর সৈনিক বলা হয়। এরশাদ হয়েছে- “আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁরাই প্রকৃত আল্লাহর দল। জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর দল (সর্বকালে) বিজয়ী হয়।” (সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮: আয়াত ২২)
সুতরাং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা মতে, পবিত্র শবে বরাতের রজনিতে সৃষ্টি জগতের জন্য এক বছরের বাজেট নির্ধারণী সভা অনুষ্ঠিত হয়।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]