Cancel Preloader

প্রখ্যাত সুফিসাধক হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)

ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান
২য় পর্ব
কাকি উপাধির ঘটনা
‘কাক’ ফারসি শব্দ, এর বাংলা অর্থ রুটি। ‘কাকি’ মানে রুটি সংক্রান্ত কারামত। হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর উপাধি প্রাপ্তির দুটি ভিন্ন মত রয়েছে। একটি হলো-দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি সব সময় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আর কারো থেকে নজরও গ্রহণ করতেন না। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অতি অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করতেন। তাঁর মহীয়সী স্ত্রী প্রতিবেশী এক মুদি দোকানদারের স্ত্রী থেকে কর্জ নিয়ে পরিবার চালাতেন। একদিন ওই নারী তিরস্কারের ভাষায় বলল, ‘‘আমরা যদি তোমাদের প্রতিবেশি না থাকতাম, তবে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্যভাবে লিপিবদ্ধ ছিল।’’ একথা তিনি হযরত কাকি (রহ.)-কে জানালেন। তিনি মনে খুব কষ্ট পান। তিনি বললেন, ‘‘ভবিষ্যতে কারো নিকট থেকে কর্জ নিও না। যখনই প্রয়োজন হবে তখন ঘরের এক কোণা থেকে যেন কাক (রুটি) নেন। এরপর, যখনই প্রয়োজন হতো আশ্চর্যজনকভাবে তারঁ স্ত্রী ঘরের কোণা থেকে রুটি পেয়ে যেত। ফলে রুটিওয়ালার স্ত্রী হযরত বখতিয়ার কাকি (রহ.)-এর স্ত্রীর কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলেন। তিনি তাকে ‘কাক’ এর আশ্চর্যজনক ঘটনাটি বর্ণনা করেন। এই গোপন রহস্যটি উন্মোচিত হওয়ার পর যদিও কাক তথা রুটি আসা বন্ধ হয়ে যায়, ঐ দিন থেকে মানুষ কুতুবউদ্দিকে কাকি নামে সম্বোধিত করতে থাকে।
আরেকটি মত হলো ছোটোবেলায় খাজা বখতিয়ার কাকি (রহ.) যখন মাদ্রাসা থেকে বাসায় ফিরতেন, তখন তাঁর মা তাঁকে বলতেন যে, চোখ বন্ধ করে আল্লাহ্র কাছে খাবার চাও, খাবার এসে যাবে। খাজা চোখ বন্ধ করলেই তাঁর মা তাঁর সামনে রুটি রেখে দিতেন। একদিন তাঁর মা কোনো কাজে বাইরে যাওয়ায়, ছেলে বাসায় এসে দেখে যে মা নেই এবং সে আবার চোখ বন্ধ করে আল্লাহ্র কাছে রুটি চান। এদিকে তাঁর মা চিন্তায় পড়ে যায় যে তাঁর ছেলে আজকে রুটি না পেয়ে হয়তো মন ভেঙে যাবে। কিন্তু মা যখন বাসায় আসেন, দেখতে পান ছেলে রুটি খাচ্ছে এবং জিজ্ঞেস করায় জানতে পারেন চোখ বন্ধ করে আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাইতেই রুটি এসে পড়ে! এই অলৌকিকতার পরে খাজা কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার (রহ.)-এর নামের শেষে রুটি তথা কাকি শব্দ যোগ হয়।
হারামাইন শরীফাইনে সফর
১১৮৭ সালে হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) আপন মোর্শেদের সাথে প্রথমে মক্কা মুয়াজ্জামায় যান। সেখান থেকে মদীনা মুনাওয়ারায় হাজির হন। আপন মোর্শেদের বিশেষ কৃপা দৃষ্টিতে উভয় পবিত্র স্থানে তিনি অগণিত দয়া ও দান পেয়ে ধন্য হন। মদীনা মুনাওয়ারায় কিছু দিন অবস্থান করার পর ১১৮৯ সালে বাগদাদ শরীফ চলে আসেন। এখানেও তিনি কিছু দিন অবস্থান করেন।
খিলাফত প্রাপ্তি
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ও হযরত রাসুলে আকরাম (সা.)-এর নির্দেশে গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) সমরকন্দ মসজিদে তাঁর প্রিয় ও যোগ্য মুরিদ হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)-কে খিলাফত দান করে ধন্য করেন এবং সনদ হিসেবে খিরকাহ (বিশেষ চাদর) প্রদান করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। খিলাফতকালে সেখানে হযরত শায়খ শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দী (রহ.), হযরত শায়খ দাউদ কিরমানি (রহ.) ও হযরত শায়খ বোরহান উদ্দিন চিশতি (রহ.) প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় অলীগণও উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর তিনি সমরকন্দ, গজনি, বাগদাদ ও আজমির হয়ে দিল্লি পৌঁছেন। তৎকালে সুলতান ইলতুতমিশ হিন্দুস্তানের সম্রাট ছিলেন। সুলতান হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)-এর একান্ত ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর নিকট মুরিদও হন।
আজমীর শরীফে তাশরিফ
খিলাফতের অমূল্য রতœ লাভ করার পর ১১৯০ সালে আপন মোর্শেদের সাথে বাগদাদ থেকে হিন্দুস্তানের উদ্দেশে রওনা হন। চিশত, হিরাত ও সব্যেওয়ার হয়ে লাহোর এসে পৌঁছান। সেখান থেকে সুমানা ও দিল্লি হয়ে ১১৯২ সালে আজমীর শরীফে এসে পৌঁছান। কিছু দিন আজমীর শরীফে অবস্থান করার পর গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) আপন মুুরিদ ও ভক্তবৃন্দের সাথে গজনিতে তাশরিফ রাখেন। তিনি হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)-কে অনুমতি দেন, যেন তিনি স্বীয় মাতার সাথে সাক্ষাতের জন্য আউসে যান। অতঃপর হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) যখন গজনি থেকে হিন্দুস্তানে ফিরে আসেন, তখন হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)-ও আউস থেকে হিন্দুস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
মুলতানে হযরত গঞ্জেশকর (রহ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ
১১৯৫ সালে হিন্দুস্তানে আসার সময় হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) পাকিস্তানের মুলতানে পৌঁছেন। মুলতান সেই সময় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল। ঘটনাক্রমে শিক্ষার্জনের জন্য হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) তখন মুলতানেই ছিলেন। মুলতানে অবস্থানকালে হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) সেখানে এক মসজিদে তাশরিফ আনেন, সেখানে হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) কিতাব পাঠে মশগুল ছিলেন। যখনই ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-এর দৃষ্টি হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর উপর পড়ল, তখনই তিনি কিতাব বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং যথাযথভাবে সালাম দিলেন। হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) জিজ্ঞাসা করলেন- কী পড়ছ? জবাবে তিনি আরজ করলেন, ‘কিতাব-এ-নাফি’ পড়ছি।’’ হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) বললেন, ‘কিতাব-এ-নাফি’ থেকে কি তুমি কাক্সিক্ষত উপকার পাবে?’’ এটা শুনা মাত্র তিনি অতি বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, ‘‘আমার জন্য তো আপনি হযরতের কদমবুসিই উপকারী হবে।’’ এটা বলে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) তাঁর কদমে পড়ে যান। প্রথম দৃষ্টিতেই হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর তাওয়াজ্জুহ দ্বারা এমনভাবে সিক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর একান্ত-অনুরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি রাতদিন হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর সান্নিধ্যে থাকতে লাগলেন। মুলতানে কিছু দিন থাকার পর হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) দিল্লি রওনা হন। হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-ও তাঁর সাথে দিল্লি চলে যেতে চাইলেন। তখন তিনি বলেন- ‘‘তুমি এখানে শিক্ষার্জনে মশগুল থাকো।’’ দিল্লিতে কিছুদিন অবস্থান করার পর হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর নির্দেশে আরো বেশি জ্ঞান অর্জনের জন্য কান্দাহার রওনা হন। সেখানে তিনি বহু পরিশ্রম করে জাহেরি ইলম অর্জন সমাপ্ত করেন। অতঃপর আপন মোর্শেদ হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর খেদমতে দিল্লিতে হাজির হন।
খাজা গরিবে নেওয়াজের শুভাগমন
ইতোমধ্যে গরিবে নেওয়াজ হযরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) আজমির শরীফ থেকে দিল্লিতে হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর খানকাহ শরীফে তাশরিফ আনয়ন করেন। হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) তাঁর মুরিদদেরকে খাজা গরিবে নেওয়াজের হুজরে পেশ করেন। তিনি সবাইকে যোগ্যতানুসারে মারেফাতের অমূল্য সম্পদ দ্বারা ধন্য করেন।
হযরত গঞ্জেশকর (রহ.)-এর কামালিয়াত অর্জন
হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) ও হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) উভয়ই ওখানে তাশরিফ আনেন। হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.) চিল্লায় বসে সাধনারত ছিলেন। লাগাতার কঠোর রিয়াজতের কারণে তিনি এত বেশি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, সম্মান প্রদর্শনের জন্য দণ্ডায়মান হতে পারছিলেন না। সুতরাং তিনি কেঁদে কেঁদে খাজায়ে খাজেগানের পদযুগলের উপর নিজের মাথা রেখে দিলেন। খাজা গরিবে নেওয়াজ তাঁর অবস্থা দেখে হযরত বখতিয়ার কাকি (রহ.)-কে বলেন- ‘‘কুতুবুদ্দিন! কতদিন পর্যন্ত এ বেচারাকে এমন কষ্টসাধ্য সাধনায় রত রাখবে? এসো তাকে কিছু দান করি।’’ এটা বলতে বলতে হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) ডান হাত এবং হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) বাম হাত ধরে হযরত ফরিদউদ্দিন (রহ.)-কে দাঁড় করালেন। খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) উপরের দিকে চেহারা তুলে আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে আরজ করলেন- ‘‘হে অমুখাপেক্ষী মালিক! আমাদের ফরিদকে কবুল করুন! আর তাঁকে পূর্ণাঙ্গ দরবেশের মর্যাদায় আসীন করে দিন!’’ গায়বি আওয়াজ আসলো, ‘‘আমি ফরিদকে কবুল করেছি। সে যুগের অনন্য (বুজুর্গ) হবে।’’
এরপর খাজা গরিবে নেওয়াজের নির্দেশে হযরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)-কে ‘ইসমে আজম’ শিক্ষা দিলেন। ইসমে আজমের বরকতে চোখের পলক মারার সাথে সাথে সমস্ত হিজাব (অন্তরাল) উঠে গেলো। আর তিনি আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পৌঁছার নিয়ামত পেয়ে ধন্য হলেন। এ খুশিতে হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ তাঁকে ‘অতি গর্বময় ‘খিলআত’ (চাদর বিশেষ) দান করে ধন্য করেন। এরপর হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.) তাঁকে পাগড়ি, শাল এবং খিলাফতের সনদ দান করলেন। হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (রহ.)-কে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন- ‘‘তুমি এক বড়ো ঘোড় সাওয়ার (অশ্বারোহী)-কে নিজের অধীনে নিয়ে এসেছো। তাঁর কুটির হবে সিদরাতুল মুনতাহায়।’’
দিল্লিতে কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর স্থায়ীভাবে অবস্থান
১২১৪ সালে হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) দিল্লিতে স্থায়ীভাবে কিলোকারীতে অবস্থান গ্রহণ করেন। তখন দিল্লির সিংহাসন মেহেরওয়ালিতে ছিল। সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশের আবেদনের ভিত্তিতে তিনি কিছুদিন পর কিলোকারী থেকে মেহেরওয়ালিতে স্থানান্তরিত হন।
শায়খুল ইসলাম পদে অধিষ্ঠিত হবার প্রস্তাব
তৎকালীন সরকারের দিক থেকে ‘শায়খুল ইসলাম’-এর পদে হযরত জামাল উদ্দীন বোস্তামি অধিষ্ঠিত ছিলেন। যখন তাঁর ইন্তেকাল হয়, তখন সুলতান ইলতুৎমিশ হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর দরবারে আবেদন করেন যেন তিনি এ মহান পদ কবুল করে তাঁদেরকে গর্বিত করেন! যখন তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, তখন নাজমুদ্দীন সুগরাকে ওই পদে অধিষ্ঠিত করেন।
খাজা গরিবে নেওয়াজের দিল্লিতে শুভাগমন
ইতোমধ্যে হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) গরিবে নেওয়াজ হযরত মুইনদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর দরবারে আজমির শরীফে আগ্রহভরে এ আবেদনপত্র পাঠান যেন তাঁর দরবারে আসার অনুমতি দেন। খাজা গরিবে নেওয়াজ তাঁকে আজমির শরীফে যেতে নিষেধ করলেন এবং কিছুদিন পর নিজেই দিল্লিতে তাশরিফ আনয়ন করেন। এখানে এসে হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এর দরবারে তিনি অবস্থান করলেন। তিনি যতদিন দিল্লিতে অবস্থান করেন ততদিন সত্যান্বেষীদের মধ্যে ইরফানের (মারিফাত) ভান্ডার বিতরণ করেন। কিছুদিন পর তিনি নিজ দরবার আজমির শরীফে তাশরিফ নেন।
শেষবারের মতো গরিবে নেওয়াজের দিল্লিতে শুভাগমন
এবার কোনো ঘোষণা ছাড়াই গরিবে নেওয়াজ হযরত মুইনদ্দিন চিশতি (রহ.) হঠাৎ দিল্লি আসেন। ওই সময় শায়খ নাজমুদ্দীন সুগরা দিল্লিতে ‘শায়খুল ইসলাম’-এর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। খাজা গরিবে নেওয়াজের সাথে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিল। যে কারণে খাজা গরিবে নেওয়াজ নিজেই তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য যান। তিনি খাজা মুইনদ্দিন চিশতি (রহ.)-কে অতি হৃদ্যতাপূর্ণ সংবর্ধনা দেন। খাজা গরিবে নেওয়াজ এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলেন, ‘‘আপনি আপনার এমন মুরিদকে দিল্লিতে বসিয়ে দিয়েছেন, সব মানুষ তাঁর দিকে দৌড়ে, আমার কথা কেউ জিজ্ঞাসাও করে না।’’ হযরত মুইনদ্দিন চিশতি (রহ.) বলেন, ‘‘হে নাজমুদ্দীন! যদি আমার কুতুবু তোমার অন্তরের বোঝা হয়ে যায়, তাহলে আমি তাকে আমার সাথে আজমিরে নিয়ে যাচ্ছি।’’ যখনই খাজা গরিবে নেওয়াজ কুতুবুদ্দিন কাকিকে সাথে নিয়ে আজমিরের দিকে রওনা হলেন, তখন সমগ্র দিল্লি শহরে এ খবর বিজলীর মতো পৌঁছে গেলো। যে যেখানে ছিল, ওখান থেকে দৌড়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত গরীবে নেওয়াজের সামনে হাজার হাজার মানুষ ক্রন্দনরত অবস্থায় সমবেত হলো। আর বুকভাসা কান্নার স্বরে আরজ করতে থাকে, ‘‘মেহেরবানি করে কুতুব সাহেবকে দিল্লি থেকে নিয়ে যাবেন না। কুতুব সাহেব এ শহরের সম্মান ও বরকত।’’ সুলতান ইলতুৎমিশ্ এ খবর পাওয়া মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে হাজির হয়ে যান। আর আরজ করলেন, ‘‘হুজুর! কুতুব সাহেবকে আজমিরে নিয়ে যাবেন না। এখানেই তাঁকে রেখে যান! এ শহরের লোকেরা তাঁর বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারবে না।’’ খাজা গরিবে নেওয়াজ যখন এরকম অবস্থা দেখলেন, তখন তিনি হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-এ উদ্দেশে বলেন-‘‘বাবা কুুতুব, তুমি এখানেই থাকো! তোমার চলে যাবার কারণে শহরের লোকেরা অস্থির হয়ে গেছে। তাদের মনে দুঃখ দেওয়া আমারও সহ্য হচ্ছে না। এ শহরের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমার হাতে দিলাম।’’ আপন মোর্শেদের নির্দেশের সামনে হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) তাঁর বরকতময় নির্দেশ মাথা পেতে নিলেন। আর দিল্লিবাসীদের উপর তাঁর ফায়েজ ও বরকতের বৃষ্টি বর্ষণ করতে থাকেন।
চির বিদায়ের অসহনীয় বেদনাদায়ক খবর
এরপর আপন মোর্শেদের সাথে সশরীরে সাক্ষাৎ দীর্ঘ দিন যাবৎ হয়নি। তাই হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) আবার একটি চিঠি খাজা গরিবে নেওয়াজের পবিত্র দরবার আজমির শরীফে প্রেরণ করেন। তাতে (সেখানে গিয়ে) কদমবুসির অনুমতি চান। জবাব আসলো, ‘‘আমি চাচ্ছিলাম যে, হে প্রিয় বৎস, তোমাকে ডেকে আনবো, ইত্যবসরে তোমার চিঠি এসে গেছে। তুমি শীঘ্রই চলে এসো! এ দুনিয়ায় তোমার সাথে আমার এটা সর্বশেষ সাক্ষাৎ।’’ হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) এ চিঠি পড়া মাত্র কালবিলম্ব না করে আজমির শরীফের উদ্দেশে রওনা হন। আপন মোর্শেদের দরবারে হাজির হন এবং কদমবুসির সৌভাগ্য অর্জন করেন।
একদিন খাজা গরিবে নেওয়াজ বলেন- ‘‘ওহে দরবেশ! আজমির শরীফের ভূখণ্ডে আমাকে এ জন্য প্রেরণ করা হয়েছে যে, এখানেই আমার কবর হবে। আমার এমন অনুভব হচ্ছে যেন আমার পরকালে সফর করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।’’ এটা বলতে বলতে তাঁর দু’নয়ন অশ্রু সজল হয়ে গেলো। পূর্ণ মজলিসে কান্নার রোল পড়ে গেলো। আজমির শরীফে অবস্থানকালে হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) আপন মোর্শেদের আখেরি মজলিসের যে বয়ান ফারসি ভাষায় বর্ণনা করেন, সেটার বঙ্গানুবাদ- ‘‘শায়খ আলী সানজারী হাজির ছিলেন। তাকে নির্দেশ দেওয়া হলো-এ বাণী লিপিবদ্ধ করা হোক! অতঃপর সেটা আমার কুতুবুদ্দিনের নিকট হস্তান্তর করা হোক, যাতে সে দিল্লি চলে যায়। আমি তাকে আমার খলিফা নিযুক্ত করলাম এবং দিল্লিকে তাঁর চূড়ান্ত অবস্থানস্থল সাব্যস্ত করলাম।’’
যখন বাণী লিপিবদ্ধ করা সমাপ্ত হলো, তখন সেটা হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.)-কে দান করলেন। তিনিও আদব, সম্মান ও কৃতজ্ঞতার যাবতীয় নিয়ম পালন করেন। অতঃপর খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) বলেন, ‘‘কুতুব, আমার নিকটে এসো।’’ হযরত কুতুব বলেন, ‘‘আমি হযরতের নিকটে গেলাম। তিনি নিজ বরকতময় হাতে টুপি সহকারে পাগড়ি আমার মাথায় পরিয়ে দিলেন। হযরত ওসমান হারুনি (রহ.)-এর লাঠি ও খিরকাহ্ মোবারক আমাকে দান করলেন এবং কুরআনে করিম আর মুসল্লাও দান করেন।’’ তারপর এরশাদ করেন, ‘‘এটা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র আমানত, যা খাজেগানে চিশতির মাধ্যমে আমার নিকট পর্যন্ত পৌঁছেছে। এসব আমানত আমি তোমাকে সোপর্দ করছি, তোমার উপর অপরিহার্য হচ্ছে- আমি যেভাবে এসব জিনিসকে নিজের নিকট সংরক্ষণ করেছি, তেমনিভাবে তুমিও নিজের নিকট সংরক্ষণ করবে, যাতে কাল কিয়ামতে খাজেগানে চিশতির সামনে লজ্জিত হতে না হয়। বিদায়ের মুহূর্তে এরশাদ করলেন- ‘‘যাও! আমি তোমাকে আল্লাহ্র রাস্তায় সোপর্দ করলাম। আর তোমাকে ইজ্জত ও বুজুর্গির আসনে অধিষ্ঠিত করলাম।’’ হযরত কুতুবুদ্দিন কাকি (রহ.) বলেন, ‘‘এ নিয়ামতের কৃতজ্ঞতায় আমি দু’রাকাত নামাজ পড়েছি এবং অতি আদব সহকারে তা গ্রহণ করেছি।’’
চলবে

তথ্যসূত্র:
১। তায্কেরাতুল আওলিয়া ৪র্থ খণ্ড, মাওলানা নূরুর রহমান, এমদাদিয়া পুস্তকালয় (প্রা.) লি. ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৫৬-১৭০
২। https://bn.wikipedia.org/wiki
৩। https://www.abswer.com/2022/04/biography-of-qutbuddin-bakhtiyar-kaki.html
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Qutbuddin_Bakhtiar_Kaki
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট