ফায়েজের গুরুত্ব
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ নামক কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
ফায়েজ আরবি শব্দ। অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে- প্রবাহিত, প্রাচুর্য, প্লাবন, চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদি। যেহেতু আল্লাহর প্রেমের প্রবাহ প্রতিমুহূর্তে মহাপ্লাবনের অথৈ পানির স্রোতধারার ন্যায় সমস্ত সৃষ্টির উপর বর্ষিত হচ্ছে, এ কারণে একে ফায়েজ বলা হয়। সুফিদের ভাষায় ফায়েজ হলো- আল্লাহর প্রেমের প্রবাহ, যা সমকালীন যুগের প্রেরিত মহামানবের মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী বিতরণ করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ফায়েজ হচ্ছে- আল্লাহ্ প্রদত্ত বড়ো বখশিশ বা বিশেষ দান। এককথায় যাবতীয় সৃষ্টি পরিচালনায় নিয়োজিত আল্লাহর সূক্ষ্ম শক্তি বা নুর হলো ফায়েজ।
এই ফায়েজই ধর্মের মূল। কেবল এই ফায়েজের সাহায্যেই যেমন আত্মশুদ্ধি লাভ করা যায়, তেমনি মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে অলী-আল্লাহর স্তরে উন্নীত হতে পারে। এই ফায়েজের সাহায্যে রাব্বুল ইজ্জত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃজন করে, তা কায়েম রেখেছেন। ফায়েজ বিহনে সৃষ্টিজগৎ এক পলকও বিদ্যমান থাকতে পারে না। পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে মহামূল্যবান এই ফায়েজ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। কেবল ফায়েজ শব্দটি ব্যবহার করে পবিত্র কুরআনে ৬ (ছয়) খানা আয়াত আমি খুঁজে পেয়েছি। নিম্নে উক্ত ৬ (ছয়) খানা আয়াত উল্লেখ করা হলো-
১। প্রথম আয়াত: “আর তারা যখন শুনে রাসুলের প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে তা, তখন আপনি তাদের চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে দেখতে পাবেন, কারণ তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলে- হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ইমান এনেছি। সুতরাং আপনি আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন।” (সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৮৩)
সুতরাং সাহাবায়ে কেরাম হযরত রাসুল (সা.)-এর সহবতে এসে যখন তাঁর বাণী মোবারক শ্রবণ করতেন, তখন আল্লাহর মহব্বত তাদের অন্তরে এতই বৃদ্ধি পেতো, তারা আল্লাহ্ ও রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে নিজেদের ধনসম্পদ অকাতরে ব্যয় করতেন। কখনো যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতার জন্য এরূপ করতে না পারতেন, তবে তাদের মনের কষ্ট আরো বেড়ে যেতো।
২। দ্বিতীয় আয়াত: আল্লাহ্ বলেন- “আর তাদের কোনো অপরাধ নেই, যারা আপনার কাছে এসেছিল, যেন আপনি তাদের বাহন দেন। [হে রাসুল (সা.)!] আপনি বলেছিলেন- আমার কাছে এমন কোনো বাহন নেই, যার উপর তোমাদের সওয়ার করাব। তখন তারা (কাঁদতে কাঁদতে) ফিরে গেল, আর তাদের চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল এ দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না, যা [রাসুল (সা.)-এর সাহায্যার্থে] ব্যয় করতে পারে।” (সূরা আত তাওবাহ ৯: আয়াত ৯২)
অনুরূপভাবে মহিমান্বিত আল্লাহ্, যিনি হযরত রাসুল (সা.)-এর মাঝে বিরাজ করেন, হযরত রাসুল (সা.) ও মু’মিনদের অন্তরে ফায়েজ দান করেছেন, সেটিও আল্লাহ্ জানিয়ে দিয়েছেন।
৩। তৃতীয় আয়াত: আল্লাহ্ বলেন- “আর তুমি যে অবস্থায়ই থাকো এবং সে সম্পর্কে কুরআন থেকে যা কিছু তেলাওয়াত করো, আর তোমরা যে কাজই করো, আমি তোমাদের কাছে উপস্থিত থাকি, যখন তোমরা তাতে আত্মনিয়োগ করো (অর্থাৎ আমি আমার ফায়েজ দিয়ে তোমাদের হৃদয়কে প্রশান্ত করে দেই)।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৬১)
অতএব অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ ফায়েজ দ্বারা মু’মিনদেরকে হিদায়েতের পথে ধরে রাখেন। মানুষ হিসেবে মু’মিনদের দ্বারাও ভুল-ত্রুটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে তারা আলোর পথ হারিয়ে অশান্তির অন্ধকারে নিপতিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তাঁর রহমতের ফায়েজ দ্বারা মু’মিনদের আলোর পথে অবিচল থাকতে সাহায্য করেন।
৪। চতুর্থ আয়াত: আল্লাহ্ বলেন- “আর যদি তোমাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর দয়া ও তাঁর রহমত না থাকত, তবে যে ধারায় তোমাদের (সমালোচনার) কাজ প্রবাহিত হচ্ছিল, সেজন্য গুরুতর আজাব তোমাদেরকে গ্রাস করত।” (সূরা আন নূর ২৪: আয়াত ১৪)
সেই সাথে সুমহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-কে স্বীয় ফায়েজের বেষ্টনীতে রেখে সকল ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছেন। যেমন-
৫। পঞ্চম আয়াত: আল্লাহ্ বলেন- “তারা কি এরূপ বলে যে, এ ব্যক্তি নিজেই একে রচনা করে দিয়েছে? আপনি বলুন- যদি আমি নিজেই এটি রচনা করে থাকি, তবে তোমরা তো আমাকে আল্লাহর আজাব থেকে একটুও রক্ষা করতে পারবে না। এ বিষয়ে তোমাদের আলোচনা যে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, আল্লাহ্ সেটি সবিশেষ অবহিত।” (সূরা আল আহকাফ ৪৬: আয়াত ৮)
উপরন্তু প্রেরিত মহামানবের অনুসারী মু’মিনগণ দুনিয়াতে যেমন ফায়েজ লাভ করে থাকে, তেমনি আখিরাতেও তারা এ নিয়ামত লাভ করবে। আর দোজখবাসীরা বেহেশতবাসীদের কাছে এ নিয়ামতের জন্যই আবেদন করবে।
৬। ষষ্ঠ আয়াত: আল্লাহ্ বলেন-
“জাহান্নামীরা জান্নাতীদের ডেকে বলবে- ঢেলে দাও আমাদের উপর কিছু পানি (অর্থাৎ ফায়েজ), অথবা আল্লাহ্ তোমাদের রিজিক হিসেবে যা দিয়েছেন, তা থেকে কিছু দাও। বেহেশতবাসীরা বলবে- আল্লাহ্ তো এ দু’টিই কাফিরদের জন্য হারাম করেছেন।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ৫০)
এভাবেই মহান রাব্বুল আলামিন ওহির বাণী আল কুরআনে একের পর এক ফায়েজের পরিচয়, গুণ, কার্যকারিতা ও এর প্রয়োগ উপস্থাপন করেছেন। এমনিভাবে মহামূল্যবান এ ফায়েজের বর্ণনা কেবল ফায়েজ শব্দ ব্যবহার করেই যে উপস্থাপিত হয়েছে, তা নয়। বরং ‘সাকীনাহ তথা পরম শান্তি’ শব্দ ব্যবহার করেও মহিমান্বিত আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে আরো ৬ (ছয়) খানা আয়াত নাজিল করেছেন। এক্ষেত্রে সুমহান আল্লাহ্ সূরা আল ফাত্হ এর মাঝেই তিন খানা আয়াত নাজিল করেছেন। আর সেগুলো হলো-
১। প্রথম আয়াত-
“তিনিই আল্লাহ্, যিনি মু’মিনদের ক্বালবে প্রশান্তি (ফায়েজ) নাজিল করেন, যেন তারা তাদের ইমানের সাথে আরো ইমান বৃদ্ধি করে নেয়।” (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ৪)
২। দ্বিতীয় আয়াত-
“[হে রাসুল (সা.)!] অবশ্যই আল্লাহ্ মু’মিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, যখন তারা বৃক্ষের নিচে আপনার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করল, আর তাদের ক্বালব (অন্তরে) যা ছিল, তা তিনি জানতেন। অতঃপর তিনি তাদের ক্বালবে নাজিল করলেন পরম শান্তি (ফায়েজ) এবং তাদেরকে দান করলেন একটি নিকটবর্তী বিজয়।” (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ১৮)
৩। তৃতীয় আয়াত- “যখন কাফিররা তাদের অন্তরে জিদ, জাহেলি যুগের জিদ পোষণ করছিল, তখন আল্লাহ্ নিজের তরফ থেকে তাঁর রাসুল ও মু’মিনদের উপর নাজিল করলেন প্রশান্তি (ফায়েজ) এবং তাদেরকে তাকওয়ার কথার উপর সুদৃঢ় রাখলেন। আর তারা ছিল এর অধিক হকদার ও যোগ্য। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ২৬)
অনুরূপভাবে মহিমান্বিত আল্লাহ্ সাকীনাহ শব্দ দ্বারা ওহির বাণী আল কুরআনের সূরা আত তাওবায় একাধিক আয়াত নাজিল করেছেন। আর সেগুলো হলো-
৪। চতুর্থ আয়াত- “আল্লাহ্ (তাঁর নিকট থেকে) তাঁর রাসুল ও মু’মিনদের উপর পরম শান্তি (ফায়েজ) নাজিল করে তাদের সাহায্য করেন।” (সূরা আত তাওবাহ ৯: আয়াত ২৬)
৫। পঞ্চম আয়াত- “যখন তারা উভয়ে [হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সহচর আবু বকর (রা.)] গুহার মধ্যে ছিলেন, তিনি তখন তাঁর সঙ্গীকে বলেছিলেন- বিষণ্ন হবে না, নিশ্চয় আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন। তারপর আল্লাহ্ স্বীয় প্রশান্তি (ফায়েজ) তাঁর উপর নাজিল করলেন।” (সূরা আত তাওবাহ ৯: আয়াত ৪০)
সেই সাথে ওহির বাণী আল কুরআনের সর্ববৃহৎ সূরা, সূরা আল বাকারাহতেও মহান আল্লাহ্ সাকীনাহ শব্দ দ্বারা ফায়েজের কথা বলেছেন। আর তা হলো-
৬। ষষ্ঠ আয়াত- “আর তাদের নবি তাদের বলেছিলেন- নিশ্চয় তাঁর (তালুতের) রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট আসবে সেই তাবুত, যেটিতে থাকবে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের জন্য পরম শান্তি (ফায়েজ)।” (সূরা আল বাহারাহ ২: আয়াত ২৪৮)
এই সাকীনাহ বা ফায়েজের গুরুত্ব এত বেশি এ কারণে যে, আল্লাহর গোটা সৃষ্টিই ফায়েজ দ্বারা পরিচালিত। এটি এমনই মহামূল্যবান সম্পদ যে, মোর্শেদের পক্ষ থেকে এই ফায়েজ যখন সাধকের অন্তরে ওয়ারিদ হয়, সাধক তখন আল্লাহকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল-বেকারার হয়ে যায়। সে তখন আল্লাহর প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। ঐ অবস্থায় সাধকের দু’চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আসলে এ অবস্থা বিহনে ধর্মের প্রকৃত স্বাদ ও শান্তি পাওয়া যায় না। এজন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মাল্লা ওয়াজদা লাহূ লা দীনা লাহূ।” অর্থাৎ- যার অজ্দ বা প্রেম স্পন্দন নেই, তার কোনো ধর্ম নেই। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- “যে ব্যক্তির মধ্যে প্রেম নেই, সে বিশ্বাসী (মু’মিন) নয়।” (সূফী দর্শন, পৃষ্ঠা ১০৪)
আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন- “আল্লাহর প্রেমে স্পন্দিত একটি জজবার মূল্য, সমগ্র জিন ও ইনসানের আমলসমূহের সমতুল্য।” (তাফসীরে রূহুল বয়ান ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮৬)
ফায়েজের উৎস হচ্ছে- মহান রাব্বুল আলামিনের দু’কদম মোবারক। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তায়ালার জাত-পাক হতে, হযরত রাসুল (সা.)-এর দিল মোবারক হয়ে, যুগের ইমামের মাঝে বিরাজমান রূহে আজম হতে এই ফায়েজ এসে থাকে। এমনিভাবে এটি রূহে আজম হতে অসংখ্য ধারায় সব সময় অবতীর্ণ হচ্ছে। এখানে রূহে আজম প্রসঙ্গে একটু আলোচনা করা জরুরি মনে করছি। আর তা হলো- রূহে আজম কী এবং আল্লাহর জাত-পাক ও রূহে আজমের মধ্যে কি সংযোগ বিদ্যমান রয়েছে?
আসলে আল্লাহর জাত-পাক ও রূহে আজমের মধ্যে পাঁচটি বিষয়ে মিল রয়েছে। যথা-
১। আল্লাহর জাত-পাক বসিত অর্থাৎ আসল বা খালেস, অনুরূপভাবে রূহে আজমও বসিত অর্থাৎ আসল বা খালেস।
২। আল্লাহ্ এক, অনুরূপভাবে রূহে আজমও এক।
৩। আল্লাহর জাত-পাকের যেমন নুরের রূপ আছে, তেমনি রূহে আজমেরও নুরের রূপ আছে।
৪। আল্লাহকে যেমন প্রকাশ পাওয়া হিসেবে বহু প্রকার দেখা যায়, রূহে আজমও বাহ্যিক প্রকাশ পাওয়ার দিক দিয়ে বহু দেখা যায়।
৫। আল্লাহ্ এক হিসেবে বহু কিন্তু মূলে এক, তেমনি রূহে আজমও এক হিসেবে বহু কিন্তু মূলে এক; অর্থাৎ আল্লাহ্ সকল মানুষের মাঝে বিরাজ করলেও মূলে তিনি এক। বিষয়টি একটি উপমার মাধ্যমে পরিষ্কার হতে পারে। যেমন- একটি মাত্র সূর্য সমস্ত পৃথিবীকে দিনের আলোয় উদ্ভাসিত করে। যদি খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত প্রান্তরে শত শত প্লেট ভর্তি পানি রেখে লক্ষ্য করা হয়, তবে দেখা যাবে প্রতিটি প্লেটের মধ্যেই একটি করে সূর্য। এক্ষেত্রে সূর্যকে শত শত প্লেটে দেখা গেলেও সূর্য কিন্তু প্লেটের সংখ্যার ন্যায় বহু নয়, বরং একটিই। তদ্রুপ মহান আল্লাহ্ প্রতিটি মানুষের ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকামে বিরাজ করলেও, আসলে তিনি এক। এজন্য মানুষ উপযুক্ত মোর্শেদের শিক্ষা নিয়ে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে অধিক মোরাকাবা করলে, নিজের মাঝেই সে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে।
বিষয়টি অতীব সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম, যার ফলে এর নিগূঢ় রহস্য বুঝা সবার পক্ষে সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে আরো একটি উপমা পাঠকদের জন্য সহায়ক হতে পারে। আর সেটি হলো- সূর্যের কিরণ বিভিন্ন গাছপালার উপর পতিত হওয়ার কারণে গাছপালার আলাদা আলাদা ছায়া দেখা যায়। তদ্রুপ দেহের উপমা গাছপালার মতো এবং রূহের উপমা সূর্যের মতো। দেহের পার্থক্যের কারণেই একই রূহ বহুতে পরিণত হয়েছে। আর সাধনা ও রিয়াজত দ্বারা গাছপালা নিধন করার মতো দেহের বৈষম্য দূর করতে পারলে, রূহের কোনো পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ তখন পরিষ্কার হবে, সূর্য যেমন এক, তেমনি রূহও এক। এভাবেই মহান আল্লাহ্ প্রকাশ পাওয়া হিসেবে বহু হলেও মূলে তিনি এক।
যুগ পরিক্রমায় নবি, রাসুল ও আওলিয়ায়ে কেরামের মাঝে বিরাজমান রূহে আজম হতে ফায়েজ প্রধানত পাঁচ প্রকারে ওয়ারিদ হয়ে সৃষ্টিজগৎ কায়েম রাখছে এবং এদেরকে হেফাজত করছে। এদের মধ্যে সর্বনিম্নমানের ফায়েজ ওয়ারিদ হয়- আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের উপর। এ ফায়েজের শক্তিতে উক্ত চারটি উপাদান শক্তিমান হয়ে মানুষসহ অসংখ্য মাখলুকাতের উপকারে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে অশেষ দয়াময় আল্লাহ্ আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসকে ফায়েজ দ্বারা বেষ্টন করে হেফাজত করছেন। এর চাইতে একটি উন্নতমানের ফায়েজ ওয়ারিদ হয় গাছপালা, বৃক্ষ-লতা, উদ্ভিদ, তৃণলতা, ইত্যাদির উপর। এ ফায়েজের শক্তিতে এগুলো শক্তিমান হয়ে ফল-ফলারি, খাদ্যশস্য, ইত্যাদি সৃষ্টি করে মানুষসহ প্রাণীকুলের রিজিকের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। আর এভাবেই মহান আল্লাহ্ এ সকল সৃষ্টিকে ফায়েজ দ্বারা বেষ্টন করে রেখে হেফাজত করছেন।
এর চাইতে আর একটু উন্নতমানের যে ফায়েজ, তা ওয়ারিদ হয় জীবজন্তুর উপর। এর ফলে অথৈ জলরাশির মৎস্যকুল, বিস্তীর্ণ স্থলভাগের জীবজন্তু ও দিগন্তহীন আকাশে বিচরণশীল পাখিসমূহ, ইত্যাদি প্রাণী নড়াচড়া ও চলাফেলা করতে পারে। উল্লেখ্য, এ ফায়েজের চেয়ে নিম্নস্তরের ফায়েজ গাছপালা, বৃক্ষ-লতার উপর অবতীর্ণ হয়, যে কারণে তারা এক স্থান হতে অন্যস্থানে চলাফেরা করতে পারে না। এভাবেই মহিমান্বিত আল্লাহ্ স্বীয় সৃষ্টির প্রাণীকুলকে ফায়েজ দ্বারা বেষ্টন করে হেফাজত করছেন।
অনুরূপভাবে এর চাইতে আর একটু উন্নতমানের ফায়েজ ওয়ারিদ হয়- জিন জাতির উপর। এ উন্নত স্তরের ফায়েজ লাভ করার কারণে জিন জাতির বিবেক-বিবেচনা ও বিচার-বুদ্ধি আছে। এজন্য জিন জাতিকে আল্লাহর ইবাদত করতে যেমন বলা হয়েছে, তেমনি তাদের কাছ থেকে তাদের কৃতকর্মের হিসাবও নেওয়া হবে।
উপরন্তু সর্বোৎকৃষ্টমানের ফায়েজ ওয়ারিদ হয় আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের উপর। এটি এ কারণে যে, একমাত্র মানুষই আল্লাহ্ হতে আগত তাঁরই ফুঁকে দেওয়া রূহ আমানত হিসেবে ধারণ করে আছে। আর এ সবচেয়ে উন্নতমানের ফায়েজ মানুষের উপর ওয়ারিদ হওয়ার কারণে, মানুষের মধ্যে এশ্কে এলাহি, মারেফাতে এলাহি ও মহব্বত আছে। যে কারণে মানুষ সাধনা করে আল্লাহর নৈকট্য, অর্থাৎ ফানা-বাকা হাসিল করতে পারে এবং সে খালীফাতুল্লাহ্ তথা আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে।
এই ফায়েজের শক্তি দ্বারাই হযরত রাসুল (সা.) আইয়্যামে জাহেলিয়াতের বর্বর ও দুর্ধর্ষ আরবদের কুরিপুসমূহ দমন করেছেন এবং তাদেরকে পাপ থেকে মুক্ত করে আল্লাহ্ ও রাসুলের আশেকে পরিণত করেছিলেন। নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে এ ফায়েজের শক্তি দ্বারাই যুগের ইমাম, মোজাদ্দেদ ও অলী-আল্লাগনও পাপী মানুষের আত্মা শুদ্ধকরণ ও কুরিপুসমূহ দমন করে, তাদেরকে সৎ মানুষ তথা আদর্শ-চরিত্রবানরূপে গড়ে তোলেন। সেই সাথে এ ফায়েজ দ্বারাই আওলিয়ায়ে কেরাম অলৌকিক কারামতও দেখাতে পারেন।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]