Cancel Preloader

বাংলাদেশ, মহান স্বাধীনতা ও সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী


ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে যে নামটি স্মরণীয়, বরণীয় ও স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে তিনি হলেন মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান। এই মহামানব দেশ মাতৃকার জন্য যুদ্ধ করে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।


প্রকৃতপক্ষে মহামানবগণ মানুষকে প্রভুর সাথে যোগাযোগ করার শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মানবতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। প্রয়োজনে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন করতেও তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করেন না। মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের জীবন দর্শন ও আদর্শ মানুষের চিন্তা চেতনাকে করে উন্নত, দেশ প্রেমে উজ্জীবিত করে এবং সংকট মোকাবিলায় অসীম সাহস ও প্রেরণা জোগায়। যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করে বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে ও ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে।


ইতিহাস গবেষণা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছিল স্বাধীনতার পথ। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভাষার অধিকার এবং স্বাধীনতাসহ সকল অধিকার বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে বাঙালিদের। যদিও আমরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অধিকারী হই ১৯৭১ সালে, প্রকৃতপক্ষে আমাদের সার্বিক মুক্তির যে অঙ্কুর, তার বিকাশপ্রক্রিয়া শুরু হয় বহু আগে। একাত্তরের নয় মাসের যুদ্ধ ছিল আমাদের সেই চলমান মুক্তি সংগ্রামেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
বাঙালি জাতি বিশ্বের মধ্যে সমৃদ্ধ একটি জাতি। শুধু তাই নয়, বাঙালি সমৃদ্ধি সংস্কৃতির অধিকারী একটি প্রাচীন জাতি। ধর্ম, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, উচ্চতর প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্ম-ভাবসাধনার ক্ষেত্রে বাঙালির ঐতিহ্য সুদূরপ্রসারী। বাঙালি জাতিকে চিনতে হলে এর ইতিহাস জানা খুব জরুরি। তাই বিষয়টি বিশদভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেন, বাঙালির একাত্মতার ভিত্তি প্রধানত রাজনৈতিক নয়। বরং সাহিত্য, কাব্য, সঙ্গীত এবং চিন্তা নির্ভর সভ্যতার উপর ভিত্তি করে বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রচিত হয়েছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির মর্যাদা প্রসঙ্গে বলেন, বাঙালির মতো জ্ঞান-শক্তি ও প্রেম শক্তি (ব্রেইন স্টোর ও হার্ট সেন্টার) এশিয়ায় কেন বুঝি পৃথিবীতে কোনো জাতির নেই। বাঙালি আজন্ম দিব্যশক্তি সম্পন্ন। বাংলার মাটি নিত্য-উর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে।
তাইতো কবি আবদুল লতিফ তার গানে বলেন,
“সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা
সোনা নয় ততো খাঁটি
বলো যতো খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি
বাংলাদেশের মাটি রে
আমার বাংলাদেশের মাটি
আমার জন্মভূমির মাটি।

জন-ধন বলো, যতো ধন দুনিয়াতে
হয় কি তুলনা বাংলার কারও সাথে
কতো মার ধন মানিক-রতন
কতো জ্ঞানী-গুণী কতো মহাজন
এনেছে আলোর সূর্য এখানে আঁধারের পথ কাটি রে
আমার বাংলাদেশের মাটি
আমার জন্মভূমির মাটি।”


বাঙালি জাতির সোনালি অতীত সম্পর্কে মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তাবোধ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ আল্লাহ্ ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের মাতৃভূমি পৃথিবীর স্বর্গ, নিত্য সবৈশ্বর্যময়ী।’’ শুধু তাই নয়, আমরা দেখতে পাই রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি গভীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাংলার কোটি কোটি লোক রাসুলের শানে মিলাদ পড়ে থাকেন। যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে লক্ষ্য করা যায় না।


অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) তাঁর লেখাতে সেই যুগে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধরেছিলেন।
অমর্ত্য সেন তার লেখায় উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে উৎপাদন এবং বাণিজ্যভিত্তিক যোগাযোগ রাখতে খুবই উদগ্রীব ছিলেন সেই সময়কার পর্তুগিজ, ডাচ্, ফরাসি, ইংরেজ, ডেনিশ ও বহু ইউরোপীয় দেশ। ১৭০৩ সালে প্রসিদ্ধ মানচিত্রশিল্পী থর্নটন (Thornton) খুব জোর দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন সেদিনের বাংলাদেশী মানচিত্র; সেটিকে বলেছিলেন, The Rich Kingdom of Bengal. অর্থাৎ ধনী বাংলাদেশের ছবি। আমাদের সাহিত্যের এবং কৃষ্টির অনেক উৎস অবশ্য ধনমুখী নয় যেমন বাউল সংস্কৃতি এবং অন্যান্য হাজার রকমের সুন্দর পল্লি সঙ্গীত আর পল্লিকাব্য। কিন্তু তারই পাশাপাশি চলেছিল শহরমুখী বর্ধিষ্ণু সংস্কৃতির প্রসার প্রবন্ধ, সমালোচনা, কবিতা, কাহিনী, গানবাজানার সুব্যবহার করে। সেই ইতিহাসটিকেও মানার প্রয়োজন আছে, কারণ বাঙালির চিন্তাধারার সাবলীলতার মধ্যে যেমন আছে আমাদের পল্লিজীবনের সামর্থ্য, তেমনি আছে আমাদের শহুরে জীবনের সমৃদ্ধির পরিচয়। বাঙালির চিন্তাধারার ঐতিহ্যের মধ্যে কয়েকটি দিকের ওপর নজর দেওয়ার কারণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি গুণ বাঙালি সভ্যতার গ্রহণশক্তি এবং সমন্বয় প্রীতি।”


উল্লেখ্য বাংলাদেশের সুফি ভাবধারার বাউল সংস্কৃতিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো (UNESCO) ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘ এই সংস্কৃতিকে বিশ্ব ঐতিহ্য মানবতার অধরা সম্পদ (Intangible Cultural Heritage) বলে আখ্যায়িত করেছে। বাউল কথাটি ‘বা’ এবং ‘উল’ শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এখানে ‘বা’ দ্বারা বাতাস এবং ‘উল’ শব্দ দ্বারা সন্ধান বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ বাতাসের সন্ধান করা তথা মানুষের ভিতরে যে প্রভুর অস্তিত্ব বিরাজমান সেই প্রভুর সন্ধানের জন্য বাউল সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে। বাউল একটি দর্শন। বাউল গানে সুফি ভাবধারা বিদ্যমান রয়েছে। বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে অমর্ত্য সেন বলেন, বাংলা সভ্যতার নানা উৎস নানাদিক থেকে এসেছে, সেটি আমাদের স্বীকার করার প্রয়োজন আছে। যেমন আছে আমাদের গ্রহণশীলতা এবং সমন্বয় প্রীতির মর্যাদা।


বাঙালিরা হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উদার হৃদয়ের মানুষ। এ প্রসঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা বলেছেন, বাংলাদেশ এক মহান রাষ্ট্র, বাঙালি হাজার বছরের বেশি সময়ের পুরাতন এক গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। আমরা কে এবং কোথা থেকে এসেছি তা জানতে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস জানা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই সমৃদ্ধ ইতিহাস আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশীদার হতে পেরে গর্বিত; ঠিক যতটা গর্বিত বাঙালিরা তাদের এই সুমহান ঐতিহ্যের জন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, আমি বাংলাদেশের যেখানে যাই সবখানেই চমৎকার মানুষ দেখি, আর আমার মতে তারাই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪খ্রি.)
কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধটি ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের ৩ বৈশাখ প্রকাশিত হয়। লেখক তাঁর প্রবন্ধে বাঙালি জাতির সোনালি অতীত স্মরণ করে বলেছেন। এ দেশে মুনি, ঋষি, যোগী, ফকির, দরবেশ, অলী-আউলিয়া, সুফিদের পীঠস্থান। এখানকার মানুষ শত শত বছর নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মবোধ জাগ্রত রেখে সম্প্রীতিময় পরিবেশে বসবাস করছে।
পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে। নবি-রাসুলদের সময়েও যুদ্ধ হয়েছে তবে সে যুদ্ধ ছিল আল্লাহর নির্দেশিত পথে। এমনকি বহু আওলিয়ায়ে কেরাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যার বিনিময়ে বহু জাতি স্বাধীনতা লাভ করে পরাধীন থেকে মুক্ত হয়েছে। যেমন আমাদের এই বাংলা-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সিলেটে হযরত শাহ্ জালাল (রহ.), রাজশাহীতে হযরত শাহ্ মকদুম রূপোস (রহ.), বগুড়ায় হযরত মাহী শাওয়ার (রহ.) এবং ময়মনসিংহে হযরত শাহ্ সুলতান রুমী (রহ.) প্রমুখ।


এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে যে মহামানবের সশস্ত্র সংগ্রামের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে তিনি হলেন, মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান, যিনি দেশকে শত্রু মুক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনেন। যে মহামানবের অসিলায় বাঙালি জাতি অলৌকিকভাবে মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মূলত বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানিদের যুদ্ধটা ছিল একটি মিথ্যা ও অন্যায়ের যুদ্ধ। তবে এটা বলা যায় অন্যায় যুদ্ধে আক্রমণকারী কখনো জয়লাভ করতে পারে না। নৈতিক জয় হিংসার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় দুই যুগ পরে, যখন সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানিরা নিশ্চিত হেরে যায়। তখন ১৯৭১ সনে পাকিস্তানি জান্তা পূর্ব বাংলার মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান তখন ইসলামের নামে সুসংগঠিত সেনাবাহিনী নিয়ে বাঙালির উপর আকষ্মিক আক্রমণ চালায়। ফলে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের পরে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়।


১৯৭১ সালে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তখন ২২ বছর বয়সের যুবক। তিনি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তালশহর কারিমিয়া আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র। দলীয় রাজনীতি হতে প্রভাবমুক্ত থাকলেও তার নেতৃত্বসুলভ আচরণে মাদ্রাসার সকল ছাত্র মিলে তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত করেন। এমনি সময় ডাক আসলো স্বাধীনতা যুদ্ধের। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র বাঙালির উপর। অসহায় নিরস্ত্র মানুষ জীবন বাঁচাতে দিক বেদিক ছোটাছুটি শুরু করল। ঢাকা হতে ছুটে আসা মানুষের পাশে দাঁড়ালেন মানব দরদি সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর ছাত্র-যুবকদের সাথে নিয়ে। অসহায় মানুষের খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।


একদিকে নিরস্ত্র মানুষের করুণ আর্তনাদ, অপর দিকে পাক হানাদারদের দেশ হতে বিতাড়িত করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সমরযুদ্ধে অংশ গ্রহণের। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল রবিবার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তার ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে চলে গেলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থাপিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েকমাস তিনি প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে ৩নং সেক্টর ও ‘এস’ ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন।
পরবর্তীকালে তিনি ভারতের হেজামারায় অবস্থিত ৩নং সেক্টর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সেসময় তিনি ভারতে দুটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য আক্রমণগুলোর মধ্যে অন্যতম মাধবপুরের যুদ্ধ, সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে অ্যাম্বুশ, বাগসাইর গ্রামে অ্যাম্বুশ, তেলিয়াপাড়া অ্যাম্বুশ, তেলিয়াপাড়ার ভয়াবহ যুদ্ধ, মনতলার যুদ্ধ ইত্যাদি।


যে ঘটনার জন্য সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। সে ঘটনাটি হচ্ছে ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর। যুদ্ধের সময়কাল চলছিল ৭ মাস ২৩ দিন মাত্র। সামনে ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের জামাতে ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা জমায়েত হলেন। সেদিন প্রচণ্ড গোলাগোলির মধ্যে ঈদের জামাত হচ্ছিল। বিষণ্নমনে ঈদের জামাতে ইমামতি করতে হাজির হলেন সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান। ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলমান নামধারী পাকহানাদার সেনারা ঈদের দিনেও ক্ষান্ত হলো না আক্রমণ থেকে। দুঃখভরা মন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকরাও ঈদের জামাতে জমায়েত হলেন। জামাত শেষ করে ইমাম সাহেব খুৎবা দিতে দণ্ডায়মান হলেন। সকলের মনযোগ ইমাম সাহেবের খুৎবার দিকে। চিরাচরিত খুৎবার পরিবর্তে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘‘ঈদের চাঁদ ফিরে যাও তাদের কাছে, যারা আমার মা বোনদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।’’ হঠাৎ ইমাম সাহেবের মুখে ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য শুনে এবং নিজ আত্মীয় স্বজনদের কথা মনে পড়ে এবং র্দীঘ দিন আপনজনদের বিচ্ছেদ যাতনায় মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলেন মুক্তিযোদ্ধারা। অভাবনীয় কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। অনেক কষ্টে নিজ কান্না সংবরণ করে হঠাৎ এক ঐশী শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তাঁর পবিত্র জবান হতে উচ্চারিত হলো- ‘‘আল্লাহর কসম! আগামী বকরা ঈদের (কোরবানির ঈদ) আগে দেশ স্বাধীন হবে। আমি আপনাদের নিয়ে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করব।’’


মহান আল্লাহর অপার দয়ায় তাঁর পবিত্র জবান থেকে উৎসারিত এই ঐতিহাসিক ভবিষ্যদ্বাণীর মাত্র ২৭ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এবং তিনি ঢাকার তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ঈদুল আজহার জামাতে ইমামতি করেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান প্রদত্ত বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী এবং তা বাস্তবায়নের ঘটনাটি পরবর্তীতে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লিখিত গ্রন্থ এবং বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেন।


মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের গৌরবময় অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। পাশাপাশি স্বদেশ ভূমির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা মানুষকে প্রেরণা দান করবে। গর্বের বিষয় হচ্ছে এই বাংলা মায়ের গর্ভে এমন এক মহারত্নের জন্ম হয়েছে যিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি দান করে ইতিহাসে অমর অক্ষয় হয়ে আছেন। যাঁর প্রচারিত মোহাম্মদী ইসলামের আদর্শের অনুসারী সমগ্র বিশ্বে ৩ কোটি রয়েছে। পৃথিবীর যে প্রান্তে বাংলাদেশের আশেকে রাসুলেরা গিয়েছেন সেখানেই বাংলা ভাষার প্রচার করছেন। শুধু তাই নয় আজ বিশ্বের শতাধিক দেশে তাঁর জীবন দর্শন বাংলা ভাষায় গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। তাঁর জীবন দর্শন আত্মস্থ ও লালন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় লাভ করছে। আমরা এই মহামানবকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেই সাথে স্বাধীনতা দিবসের গর্বিত এই মাসে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে এবং মহান আল্লাহর দরবারে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
তথ্যসূত্র:
১। বাংলাদেশে দর্শন, ড. আমিনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২। বাঙালির বাংলা, কাজী নজরুল ইসলাম
৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট হলে ‘বিশ্ব বাঙালি সম্মেলনে’ নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন প্রদত্ত ভাষণ
৪। UNESCO-United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization
৫। বিশ্ব দর্শন দিবস, বিশেষ সংকলন, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৮
৬। সূফী সম্রাট স্মরণিকা ৭১তম জন্মবার্ষিকী
৭। সূফী সম্রাট স্মরণিকা ৬৪তম জন্মবার্ষিকী
৮। মাসিক আত্মার বাণী, ফেব্রুয়ারি ২০২১
৯। বাংলাদেশ প্রতিদিন, ইত্তেফাক ইত্যাদি দৈনিক পত্রিকা
১০। মোহাম্মদী ইসলামের ওয়াজিফা, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট