বান্দার হক আদায়ের গুরুত্ব
ড. পিয়ার মোহাম্মদ
আমরা যত ধরনের ইবাদত করি তা মূলত দুধরনের। একটি হলো হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক এবং অন্যটি হলো হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক। হক অর্থ অধিকার, দাবি বা পাওনা। সে হিসেবে হাক্কুল্লাহ্ অর্থ আল্লাহর অধিকার, দাবী বা পাওনা। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত এসব হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক হিসেবে পরিগণিত হয়। ইবাদ শব্দটি আরবি আবদ শব্দের বহুবচন, যার অর্থ দাস বা বান্দা। কাজেই হাক্কুল ইবাদ বলতে বুঝায় বান্দার হক, বান্দার অধিকার বা বান্দার পাওনা। লেনদেনে ধোঁকা, বাটপারি, কথা দিয়ে কথা না রাখা, কথায় কথায় অভিশাপ দেওয়া, কথার খোঁটা বা গালিগালাজ করা, হিংসা বা নিন্দা করা, কাউকে হেয় মনে করে মিথ্যা কথা বলা, কারো প্রতি মিথ্যারোপ করা, সালাম না দেওয়া, জানাজায় অংশ না নেওয়া, অন্যের ছবি বিকৃত করা, অন্যের ক্ষতি করা, কাউকে ধোঁকা দেওয়া, কারো সঙ্গে প্রতারণা করা, অন্যের অর্থের লোভ করা, গীবত বা পরচর্চা করা, শত্রুতা করা, অন্যের ঘুম বা ইবাদতের ব্যাঘাত ঘটানো, নিজকে জাহির করার জন্য অহংকার করা এসব হলো হাক্কুল ইবাদের পরিপন্থী কাজ। এ সকল বিষয়ে সচেতন থেকে বান্দার প্রতি সঠিক আচরণ করায় বান্দার হক আদায় যা হাক্কুল ইবাদ হিসেবে গণ্য। মানুষকে কষ্ট দেয় এ ধরনের সকল কাজ থেকে বিরত থাকা হাক্কুল ইবাদ।
মহান আল্লাহ বলেন- “তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করোনা আর সদ্ব্যবহার করো মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, ইয়াতিম, মিসকিন, প্রতিবেশি, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ্ পছন্দ করেন না তাদেরকে, যারা দাম্ভিক ও অহঙ্কারী’ (সূরা আন নিসা : আয়াত ৩৬)। এ আয়াতের নির্দেশনায় বুঝা যায় আল্লাহর হক হিসেবে যেমন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কোরবানি এসব ইবাদত করতে হবে, তার সাথে সাথে বান্দার নানান ধরনের হকও গুরুত্ব সহকারে আদায় করা জরুরি। মাতা-পিতার হক সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন- মা সবার আগে সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার। এভাবে তিনি পর পর তিনবার জিজ্ঞাসার জবাবে মাকে সর্বোত্তম হকদার বলে চতুর্থবার পিতাকে হকদার হিসেবে উল্লেখ করেন। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ) মাতা পিতার পরে প্রথমেই আত্মীয় স্বজনের অধিকার বা হক আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।” (বুখারী শরীফ) ইয়াতিম ও মিসকিনদের জন্য পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে “কখনো যেন এরূপ না হয় যে, তোমরা ইয়াতিমদের সন্মান করোনা; আর মিসকিনদের খাদ্যদানে উৎসাহিত করোনা।’’ (সূরা: ফজর : আয়াত ১৭ ও ১৮) যারা দুনিয়ার জীবনে ইয়াতিম, মিসকিন, দুস্থ ও অসহায়দের ওপর ইহসান করে, আল্লাহ্ তায়ালা তাদেরকে পরকালে জান্নাতের বহু নিয়ামত প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিবেশি মানব সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেজন্য প্রতিবেশির হককে ইসলামে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তদ্রুপ যারা মুসাফির হিসেবে আশপাশে থাকবেন তারাও প্রতিবেশির ন্যায় হকদার হবেন। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “যে আল্লাহ্ ও আখেরাতের প্রতি ইমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশির সাথে সদাচারণ করে।” (মুসলিম শরীফ) আমাদের পরিবারে যারা কাজের লোক হিসেবে নিয়োজিত থাকেন তাদেরও একই ধরনের খাবার, পরিধানের বস্ত্র এবং ভালো আচরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
মহান আল্লাহ্ হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক সম্পর্কে বেশ কয়েকটি আয়াত নাজিল করেছেন। ঝগড়া হলে মিমাংসা করে নেওয়ার ব্যপারে বলা হয়েছে- “নিশ্চয় মুমিনরা পরষ্পর ভাই ভাই, তাই তোমাদের ভাইদের মধ্যে মিমাংসা করে দাও আর আল্লাহ্কে ভয় করো যেন তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।’’ (সূরা আল হুজরাত: আয়াত ১০)। বিবাদ মিমাংসা করা একটি উত্তম কাজ হিসেবে বিবেচিত। বিবাদকারীদের আশপাশে যারা থাকেন তাদের দায়িত্ব মিমাংসা করে দেওয়া। সমস্যাকে না বাড়িয়ে নিষ্পত্তি করে দেওয়াই উত্তম। কারো সাথে বিবাদ করে পর পর তিন দিন কথা না বললে সে আর মুমিন দাবী করতে পারে না। যত বিবাদই হোক না কেন পারষ্পারিক সালাম বিনিময় অব্যাহত রাখতে হবে। কেউ সালামের জবাব না দিলেও সালাম দিয়ে যেতে হবে। এগুলি বান্দার হক এবং সর্বদা তা আদায় করার চেষ্টা করতে হবে। মানুষকে ঠাট্টা বিদ্রুপ না করা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে “হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে, হতে পারে যাদের বিদ্রুপ করা হচ্ছে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম, আর কোনো নারী যেন অন্য নারীকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে। হতে পারে যাদের বিদ্রুপ করা হচ্ছে তারা বিদ্রুপকারীণীদের চেয়ে উত্তম।” (সূরা আল হুজরাত : আয়াত ১১) আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত এবং কেউ কারো আত্মিক উন্নতি সম্পর্কে জানি না। না জেনে কারো সম্পর্কে বিদ্রুপাত্মক কথা বললে তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ কাজ করলে তাকে শেষ বিচারের দিন জবাবদিহী করতে হবে। দোষারোপ করা সম্পর্কে বলা হয়েছে “তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ইমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা ফাসেকী কাজ আর যারা এ ধরনের কাজ হতে বিরত না হয় তারাই জালিম।’’ (সূরা আল হুজরাত : আয়াত ১১) সমাজে অনেক সময় না জেনে আন্দাজ করে অন্যকে দোষারোপ করা হয় যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে সচেতন থাকা আবশ্যক।
গীবত না করার জন্যও আল কুরআনে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে- “হে মুমিনগণ! তোমরা অত্যধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক, নিশ্চয় সে ধারণা পাপ; আর তোমরা কারো দোষ সন্ধান করো না এবং তোমরা একে অপরের গীবত করো না; তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? আসলে তোমরা তো একে ঘৃণাই করো এবং আল্লাহ্কে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’’ (সূরা আল হুজরাত : আয়াত ১২) পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে “দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য, যে সামনে নিন্দাকারী ও পিছনে গীবতকারী।” (সূরা আল হুমাযাহ : আয়াত ১) আর তুমি তার অনুসরণ করোনা, যে বেশি বেশি শপথ করে, লাঞ্ছিত, যে পশ্চাতে নিন্দা করে, একের কথা অপরের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়, যে ভালো কাজে বাধা দেয়, সীমালঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ, কঠোর স্বভাবের, তদুপরি কুখ্যাত।’’ (সূরা আল ক্বালাম : আয়াত ১০ ও ১৩) কোনো বান্দা সম্পর্কে মিথ্যা কথা পরিহারের জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। “আর মিথ্যা কথা পরিহার করো।’’ (সূরা আল হাজ্জ্ব : আয়াত ৩০) মহান আল্লাহ্ বলেন- “যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’’ (সূরা আযহাব : আয়াত ৫৮) বান্দার হক সম্পর্কে এত সতর্কবাণী থাকতেও বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। অথচ আল্লাহর বাণীসমুহ থেকে বুঝা যায় মানুষ নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কোরবানি যতই করুক না কেন কিংবা নফসের হক মানুষ যত সুন্দর ভাবেই আদায় করুক না কেন, নিজের মধ্যে চারিত্রিক উন্নতি যতই ঘটুক না কেন, যতক্ষণ না সে অন্য মানুষের হক এর প্রতি মনোনিবেশ করবে, ততক্ষণ সে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবে না।
বান্দার হকের গুরুত্ব সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি যার জবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।” (বোখারী শরীফ)। অন্যত্র রাসুল (সা.) বলেন- “একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় মনে করে। এক মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও মান-সম্মান অন্য মুসলিমের জন্য হারাম।” (মুসলিম শরীফ)। কোনো বান্দাকে অভিশাপ দিতেও নিষেধ করা হয়েছে। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, কোনো ব্যক্তি অন্য মুমিনের ওপর অভিশাপ দিলে, তা তাকে হত্যা করার শামিল হবে আর কোনো মুমিনকে কাফির বলে অপবাদ দিলে, তাও তাকে হত্যা করার শামিল হবে।” (বোখারী শরীফ) হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, “আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড়ো গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারপর তিনি বললেন সবচেয়ে বড় গুনাহ মিথ্যা কথা বলা কিংবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।” (মুসলিম শরীফ)। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে আল্লাহ্ তার অভাব পূরণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের বিপদ দূর করবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ তার বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ তার দোষ গোপন করবেন।” (বোখারী শরীফ)। কাজেই আখিরাতে মুক্তি পাওয়ার জন্য বান্দার হক আদায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
হযরত আইয়ুব আনসারী (রা.)-এর বাসভবনে হযরত রাসুল (সা.) বান্দার হক সম্পর্কে যে বক্তব্য রাখেন, তা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়। তিনি বলেন- “হে মানুষ আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি যে, তোমরা আল্লাহ্ তায়ালার এবং তাঁর বান্দাদের হক আদায় করো। তোমরা কি জান, বান্দার হক কী? স্মরণ রেখ, প্রত্যেক মুসলমানের চারটি হক রয়েছে: অসুস্থ হলে তার শুশ্রƒষা করা, বিপদে তার সাহায্য করা, মুত্যু হলে তার দাফন-কাফনে শরীক হওয়া এবং সাহায্য চাইলে সাহায্য করা। যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ, কোনো লোক ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান হতে পারে না, যতক্ষণ না সে তার নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তাই-ই পছন্দ করে। হে মুমিনগণ! যতদূর সম্ভব নিজের ভাইদের সাহায্য করো। একে অপরের ওপর জুলুম করো না। অপরের মাল অবৈধভাবে আত্মসাত করো না, একে অপরের অসম্মান করো না। প্রতিবেশিদের সাথে উত্তম ব্যবহার করো এবং তাদের কষ্ট দিওনা। সে মুমিন নয় যে তৃপ্তির সঙ্গে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশি উপোস থাকে। যে ব্যক্তি সারাদিন নামাজ আদায় করে ও রোজা পালন করে এবং সারারাত ইবাদত করে অথচ তার চরিত্র উত্তম নয় এবং তার প্রতিবেশি তার অনিষ্ঠ থেকে নিরাপদ নয়, সে ব্যক্তি দোষী। মাতা পিতার সাথে সুন্দর ব্যবহার করো, তারা বৃদ্ধ হলে তাদের সামনে উহ্ পর্যন্ত বল না, তাদের সাথে কঠোর ভাষায় কথা বল না, আদবের সঙ্গে কথা বল, তাদের জন্য দোয়া করো; হে রব! তারা যেভাবে আমাকে লালন পালন করেছেন আমার ওপর রহম করেছেন ঠিক সেভাবে তুমিও তাদের ওপর রহম কর। হযরত রাসুল (সা.)-এর এসব বাণী থেকে পরিস্কার হয়ে যায় বান্দার হক কি এবং তা কত গুরুত্বপূর্ণ।”
বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ ক্ষমা করার এখতিয়ার আল্লাহ্ নিজ হাতে রাখেননি। এ গুনাহ মাফ করার জন্য যার প্রতি জুলুম করা হয়েছে তার কাছে গিয়েই ক্ষমা পেতে হয়। কিন্তু হাক্কুল্লাহ পালনে কিছু গাফিলতি থাকলে মহান আল্লাহর দরবারে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তা ক্ষমা করে দিতে পারেন। বিষয়টি পুরোপুরি উপলদ্ধি করতে না পারায় আমরা হাক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হকের ব্যপারে সচেতন হলেও অনেক সময় হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকের ব্যাপারে গাফিলতি করি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর সঙ্গে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না, আর এ ছাড়া অন্যান্য পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন।” (সূরা আন নিসা : আয়াত ১১৬) কোনো ব্যক্তি নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ঠিকমত আদায় করেও বান্দার হক যথাযথভাবে আদায় না করার কারণে সমস্যায় পতিত হতে পারেন। হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “তোমরা কি জানো অভাবী কে? সাহাবীগণ বলেলেন আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী, যার টাকা-পয়সা ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসুল (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত আদায় করে আসবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই লোকেরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে মেরেছে। এই হকদারদের তার নেকী থেকে এক এক করে দেওয়া হবে। যদি কাউকে দিতে বাকি থাকে অথচ নেকী শেষ হয়ে যায়, তবে বাকি হকদারদের গুনাহসমুহ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। অতপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’’ (মুসলিম শরীফ) বিষয়টি কত মারাত্মক তা অনুধাবন করা একান্ত প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ্ আল-গাফূর নাম ধারণ করে মানুষের প্রতি পরম ক্ষমাশীল ও মার্জনাকারী হিসেবে বিদ্যমান আছেন। তিনি তাঁর এ গুণের কথা আল কুরআনের ১৮৩ জায়গায় বিভিন্ন আঙ্গিকে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- বান্দার জন্য তাঁর ক্ষমার দরজা সব সময় উন্মুক্ত। প্রকৃতপক্ষে মহান প্রভুর ক্ষমা অসীম যা জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত বিস্তৃত। কেউ যদি পৃথিবীসম গুনাহ নিয়ে তাঁর দরজায় হাজির হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ্ বলেন- “আমি পৃথিবীসম ক্ষমা নিয়ে আমার ঐ বান্দার সামনে হাজির হই এবং তাকে ক্ষমা করে দেই। কেউ যদি মহাসমুদ্রের সংখ্যাতীত ঢেউসম গুনাহ করে অত:পর স্মরণ করে যে আমার একজন মহান প্রভু আছেন, যিনি আমার সকল গুনাহ ক্ষমা করতে সক্ষম, তবে এ মহাপাপীও আমার ক্ষমা পাবে।’ ‘কেউ আমার দিকে এক কদম এগিয়ে আসলে আমি দশ কদম এগিয়ে যাই, কেউ আমার দিকে হেঁটে আসলে আমি তার দিকে দৌঁড়িয়ে যাই’। মহান আল্লাহ্ পাক এমনই মহান। আল্লাহ্ পাকের যে পরিমান রহমত রয়েছে তার একশত ভাগের একভাগ সারা সৃষ্টি জগতের মধ্যে বন্টন করেছেন আর নিরানব্বই ভাগ রহমত তাঁর কাছে রেখেছেন। এতে মহান আল্লাহর রহমত সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।” তিনি বলেন- “ইন্নাল্লাহা লা ইয়াগফিরু আইয়্যুশরাকা বিহী ওয়া ইয়াগফিরু মা দূনা যালিকা লিমাইয়্যাশা।’’ অর্থাৎ- “নিশ্চয় আল্লাহ্ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তবে তিনি এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” (সুরা আন নিসা : আয়াত ৪৮) তিনি যে কাউকে ক্ষমা করতে পারেন যত পাপীই হোক না কেন। এতে আশা করা যায় আমরা হাক্কুল্লাহ্ আদায়ে হাজারো পাপী হলেও মহান আল্লাহর কাছ থেকে তা থেকে মাফ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে কিন্তু হাক্কুল ইবাদ আদায় না করার কারণে যে পাপ তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। কেননা বান্দার হক আদায় না করায়, যার প্রতি জুলুম হয়েছে সে মাফ না করা পর্যন্ত আল্লাহ্ পাক মাফ করবেন না।
বুঝার ভুলের কারণে অনেক সময় বিতর্ক দেখা দেয় যে আল্লাহর হক নাকি বান্দার হক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসলে ব্যপারটি এমন নয়। কেননা আল্লাহর হক এবং বান্দার হক আদায় করা উভয়ই আল্লাহর নির্দেশ। সে কারণে দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্নতা হলো ক্ষমা পাওয়ার বিষয়ে। মহান আল্লাহর হক আদায়ে গাফিলতি থাকলে আমরা বুঝতে পারি তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু বান্দার হকে ঘাটতি থাকলে অনেক সময় বুঝা যায় না কিভাবে কার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এমনও অনেক কাজ আছে, যা দ্বারা অসংখ্য মানুষের হক নষ্ট হয়। তখন বান্দা কার কাছে মাফ চাইবে। অনেক ক্ষেত্রে মাফ চাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া বান্দার প্রতি জুলুম করে তার কাছে মাফ পাওয়া অনেক কঠিন। মানুষ মানুষের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করবে এবং মাফ চাইলে মাফ করে দিবেন, এটা প্রত্যাশিত কিন্তু মানুষের মহব্বত যেহেতু মহান আল্লাহর রহমতের তুলনায় খুবই নগন্য, সেহেতু মাফ পাওয়াও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর রহমতের ভাণ্ডার অসীম। তিনি আমাদের মহান মালিক, যার রহমত আমাদের সবার প্রতিই অনেক বেশি। আমরা যদি মনে করি মহান আল্লাহর হক আদায় করলে তিনি সন্তষ্ট থাকবেন এবং তাতেই পার পাওয়া যাবে, তাহলে ভুল হয়ে যাবে। বান্দা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি সে বান্দার হক আদায় না করলে মহান আল্লাহ্ সন্তষ্ট হন না। বরং কোনো সৃষ্টির সেবা করলে বা হক আদায় করলে আল্লাহ্ সন্তষ্ট হন। এ সন্তষ্টি আল্লাহর হক আদায়ের ঘাটতি মাফের ক্ষেত্রে অসিলা পর্যন্ত হতে পারে। সেজন্য আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক আদায়ের বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন- মানুষের ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো, মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-কে পাওয়া। আর তা পেতে হলে আল্লাহর আরাধনার সাথে সাথে মানুষের চরিত্র সংশোধন প্রয়োজন। তাকে শান্তির চরিত্র অর্জন করতে হবে। তবেই মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। শান্তির চরিত্র অর্জন করা অর্থই সকল প্রকার বান্দার ও অন্যান্য সৃষ্টিকুলের হক আদায় করা। এ হক আদায়ের বিষয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমান আচরণ করা আবশ্যক। তিনি বলেন, মানুষের মৃত্যুর সময় যে তিনটি প্রশ্ন করা হবে তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ’ওয়া মা দীনুকা’ অর্থাৎ তোমার ধর্ম কী? এ ধর্মের অর্থ হলো জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির ধর্ম কী সবার জন্য শান্তির ছিল নাকি অশান্তির ছিল। কেউ যদি বান্দার হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে, তবে তার ধর্ম শান্তির হবে এবং সে নাজাত পাবে। তিনি আরো বলেন- বান্দাসহ সকল সৃষ্টির হক আদায়ের মাধ্যমেই সমাজ জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম তার মর্মবাণী এখানেই নিহিত রয়েছে। যে কোন বিপদসংকুল অবস্থায় তিনি আশেকে রাসুলদের বিপদগ্রস্থদের সহায়তার জন্যও আহ্বান জানিয়ে থাকেন। যেন তারা বান্দার হক আদায় করে সফল হতে পারে। তাঁর নির্দেশেই দরবার শরিফ থেকেও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে থাকে নানান সহায়তা নিয়ে অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে চলছে করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক। দেশের অনেক অভাবী মানুষ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। এ বিষয়গুলো আমাদের সবার দেখার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন না করলে বান্দার হক আদায় না করার অপরাধে আমরা দায়ী হয়ে যাব। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তা বিধান করে আশপাশের লোকজনের অসুবিধা দূরীকরণে সবার কাজ করা দরকার। শুনা যাচ্ছে- কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবা মাকে সন্তান ফেলে চলে যাচ্ছে। বাবা মা মৃত্যুবরণ করলেও তার খোঁজ নিচ্ছে না। এটা হতে পারে না। এ কাজ করলে মহান আল্লাহর কাছে কি জবাব হবে তা চিন্তার বিষয়। এক্ষেত্রে উত্তম হলো নিজেদের নিরাপত্তা বিধান করে বাবা মায়ের সেবা করা এবং যথানিয়মে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এ বিপদের দিনে যদি আমরা বান্দার হক আদায় করতে না পারি, তাহলে নাজাত মিলবে কিভাবে? ইমানদার মানুষ এসব বিপদকে পাপ মোচনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন, আর ইমানে দুর্বলেরা এড়িয়ে চলেন। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা মেনে চলাও রাষ্ট্রের হক আদায় করার শামিল। সেটাও আমাদের সবার করা উচিৎ। শুধু মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণির প্রতিও খেয়াল করা দরকার। তাদেরও হক আছে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের কাছে। সবার সহযোগিতায় এ করোনা দুর্যোগ থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি, সে বিষয়ে সবার চিন্তা করা এবং মহান আল্লাহর দয়া কামনা করা আবশ্যক।
আমাদের উচিৎ, মনের অজান্তে হলেও বান্দার হক আদায় না করে যে যত পাপ করেছি তার জন্য এ দুনিয়াতেই ব্যক্তিগতভাবে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া। অন্যথায় পরকালে আমাদের পূণ্যের ভাণ্ডার খালি হয়ে যাবে। মহান আল্লাহর ন্যায় বিচারে আমাদের পূণ্য সব চলে যাবে যাদের জুলুম করেছি তাদের খাতে, আর তাদের পাপ জমা হবে আমাদের আমলনামায়। বিষয়টি খুবই আতঙ্কের। এ সম্পর্কে সবার সচেতন হওয়া জরুরি। শুধু মাত্র নামাজ রোজা করে, জাকাত দিয়ে আর কোরবানি করে সন্তষ্ট থাকলে বিপদে পড়তে হবে। এসব ইবাদতের সাথে সাথে হাজারো বান্দার হক আদায়েও সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের মহান মোর্শেদ দয়াল বাবাজানের কদম মোবারকে ফরিয়াদ, আমরা যেন তাঁর নির্দেশনা মোতাবেক হাক্কুল্লাহ্ এর সাথে সাথে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হকও আদায় করে নাজাত পেতে পারি। আমিন।
[ লেখক : অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার]