Cancel Preloader

বিশ্বনবি সম্পর্কে বিখ্যাত মনীষীদের সুউচ্চ মন্তব্য

ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহমত হলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা (সা.)। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।”(সূরা আম্বিয়া-২১: আয়াত ১০৭)

যাকে সৃষ্টি না করলে মহান আল্লাহ্ কোনো কিছুই সৃষ্টি করতেন না। হাদিসে কুদসিতে এরশাদ হয়েছে, “লাওলাকা লামা খালাকতুল আফলাক।” অর্থাৎ- হে হাবিব! আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে, সৃষ্টিকুলের কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না। (তাফসীরে মাজহারী-১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০) তাঁর পবিত্রতা, চরিত্র, মানব প্রেম, দেশপ্রেম, বুদ্ধি, ব্যবহার, কৌশল, পাণ্ডিত্ব নিয়ে সব মুসলিমের অন্তরে সুউচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তাই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “হে রাসুল! আমি আপনার জিকিরকে (আলোচনা) সমুন্নত করেছি।” (সূরা আল ইনশিরাহ-৯৪: আয়াত ৪)

হযরত রাসুল (সা.) নিজে নিজের পরিচয়ের উপমা দিয়ে বলেন, “আমার উদাহরণ হলো যেন একটি অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত দালান, যার সৌন্দর্য দেখে দর্শকরা অভিভূত হয়, কিন্তু এর উপরিভাগে একখণ্ড ইটের স্থান খালি পড়ে ছিল, যা দ্বারা দালানটির সৌন্দর্য ব্যহত হচ্ছিল। আমি সেই সুদর্শন ইট খণ্ডটি, যা দালানের শূন্যস্থান পূর্ণ করে এর সৌন্দর্য নিখুঁতভাবে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” তাই তিনি হলেন ইসলামের পরিপূর্ণতাদানকারী। যে কারণে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল মায়িদাহ-৫: আয়াত ৩)

হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনের প্রাক্কালেও অনেকে তাঁকে শেষ নবি বলে চিহ্নিত করেন। তাওরাতে যাঁর শুভাগমনের বার্তা সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাবুরে যিনি ‘শ্রেষ্ঠ সংস্কারক’, ইঞ্জিলে যিনি ‘পরম প্রশংসিত’ বেদে ও পুরানাদিতে যিনি ‘মহাজন’, ‘কুন্তাপ’, ‘শুক্ত’, কল্কিপুরানে যিনি জগদ্গুরু, ত্রিপিটকে যিনি মৈত্তেয় বা মৈত্রেয়-ইনিই চির প্রতিশ্রুত নিখিল মানবতার মহা মুক্তি দূত।

লা-ইলাহা হরতি পাপম,

ইল্লা-ইলাহা পরম পদম

জন্মে বৈকুণ্ঠ অপ ইনুতি

ত-জপি নাম মুহাম্মদ (উত্তরায়ন বেদ)

ভাবানুবাদ: ‘লা-ইলাহা’-এর আশ্রয় ব্যতীত পাপ মুক্তির কোনো উপায় নেই। ইলাহ (আল্লাহ্)-এর আশ্রয়ই প্রকৃত আশ্রয়। আর চিরকাল স্বর্গ লাভের আশা করলে নাম মুহাম্মদ (সা.) জপ।

উপনিষদের অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘আল্লো মহমদকং বরস্য (অল্লোপনিষদ)

অনুবাদ: আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-কে সবাই অনুকরণীয় হিসেবে গ্রহণ করো।

বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) সম্পর্কে বিশ্বের ভিনড়ব ধর্মাবলম্বী, দার্শনিক, রাজনৈতিক, মনীষীদের যে সুউচ্চ মন্তব্য রয়েছে তা এখানে উল্লেখ করা হলো:

হযরত রাসুল (সা.)-এর পূতপবিত্র জীবন ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা হয় তবে এ কথা স্পষ্টভাবে জানা যায়, তিনি শ্রেণি বৈষম্যের বিভেদ চূর্ণ করে সহিংসতামুক্ত সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে পারস্পরিক সহমর্মিতা পূর্ণ সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ জন্য তিনি শুধু আজ নয়, কেয়ামত পর্যন্ত যত মনীষী, দার্শনিক ও সমাজবিশ্লেষক জন্ম হয়েছে এবং হবে তাদের সবার জন্য অনুসরণীয় অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।

পৃথিবীখ্যাত পাশ্চাত্য ইতিহাস বিশ্লেষক P. K Hitti তার History of Arabs গ্রন্থে মহানবি (সা.)-এর অনুপম জীবনাদর্শের বৈপ্লবিক আদর্শকে পর্যালোচনা করে বলেন, মরণশীল জীবনের অতি স্বল্প পরিসরে মুহাম্মদ (সা.) বিশৃঙ্খল ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে এমন একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি ও সুশৃংখল রাষ্ট্র গঠন করেন, যা এর আগে ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ ছিল না।

স্যার জর্জ বার্নার্ড শ মহানবি (সা.)-এর অনুপম জীবনাদর্শের বৈপ্লবিক আদর্শকে পর্যালোচনা করে বলেন, “মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি আমি সব সময় সুউচ্চ ধারণা পোষণ করি কারণ এর চমৎকার প্রাণবন্ততা। আমার কাছে মনে হয় এটাই একমাত্র ধর্ম যেটা সদাপরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, যা প্রত্যেক যুগেই মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। আমি তাঁর (মুহাম্মদ) সম্বন্ধে পড়াশোনা করেছি- চমৎকার একজন মানুষ এবং আমার মতে খ্রিষ্টবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অবশ্যই মানবতর ত্রাণকর্তা বলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি তাঁর মতো ব্যক্তির কাছে যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়কতন্ত্র অর্পণ করা হতো তবে এর সমস্যাগুলো তিনি এমনভাবে সফলতার সঙ্গে সমাধান করতেন, যা বহুপ্রতীক্ষিত শান্তি ও সুখ আনয়ন করত। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, মুহাম্মদের ধর্মবিশ্বাস আগামী দিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যা ইতঃমধ্যে বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরম্ভ করেছে। যদি কোনো ধর্মকে ইংল্যান্ড তথা সমগ্র ইউরোপকে শাসন করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে যে ধর্মটি পরবর্তী ১০০ বছর ধরে রাখতে পারবে, তাহলো ইসলাম।” [দ্যা জেনুইন ইসলাম, ভলিয়ম-১, নং ৮, সন ১৯৩৬]

অন্যদিকে আরেক পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক রসওয়ার্থ তো আরও একধাপ এগিয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডকে সৌভাগ্য অভিহিত করে বলেন, ইতিহাসের একটি সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব সৌভাগ্য যে, মুহাম্মদ একাধারে তিনটির স্থপতি একটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জাতি, একটি সমুন্নত ধর্ম এবং একটি ন্যায় ইনসাফ ভিত্তিক সাম্রাজ্য। খোদা প্রদত্ত সর্বজনীন কল্যাণকর সমাজ নির্মাণের প্লাটফর্ম ছিল বালুকাময় আরবের মরুভূমি, আর মডেল ছিল সাহাবায়ে কেরামের সোনালি কাফেলা। যে কাফেলার প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ের কাবা পূর্ণ থাকত রাসুল প্রেমে। আর প্রতিটি ক্ষণ প্রস্তুত থাকত তার আদর্শ অনুযায়ী জীবন ধারণ করতে। বহু গ্রন্থ প্রণেতা Mr James A. Michener ‘দ্য রিডার্স ডাইজেস্ট’ পত্রিকার জুন ১৯৫৫ সংখ্যার ৭৯ পৃষ্ঠায় Islam the misunderstood

Religion নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, “ইসলাম যেভাবে অতি দ্রুতগতিতে গোটা বিশ্বে বিস্তৃতি লাভ করেছিল, সেভাবে অন্য কোনো ধর্ম বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই ইসলাম আরবের একটি বৃহত্তম অংশে কর্তৃত্ব লাভ করেছিল। পরবর্তী সময়ে অতি দ্রুতই তা সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, আধুনিক রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডগুলো-সহ উত্তর আফ্রিকার মধ্য দিয়ে স্পেনের প্রাচীর পর্যন্ত বিজয়াভিযান চালিয়েছিল। এর সবই সম্ভব হয়েছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বোত্তম স্বভাব ও অতিমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।”

কবি জন মিল্টন বলেছেন, “মুহাম্মদ আবির্ভূত হলেন ষষ্ঠ শতাব্দিতে এবং পৌত্তলিকতাকে নিশ্চিহ্ন করলেন। এশিয়া, আফ্রিকা ও মিশরের অনেকাংশ থেকে যার সর্বাংশেই আজ পর্যন্ত এক আল্লাহর উপাসনা প্রতিষ্ঠিত।”

ডব্লিউ মন্টোগুমারী ওয়াট বলেছেন, “মুহাম্মদ (সা.) তাঁর যুগে তিনি ছিলেন একজন সামাজ সংস্কারক, এমনকি নীতির শাস্ত্রের ক্ষেত্রেও। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন সামাজিক নিরাপত্তার এক নতুন পরিবার সংগঠন; আর উভয়টিই ছিল পূর্বেকার ব্যবস্থার ওপর বিরাট উনড়বতি সাধন।”

ফরাসি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ প্রফেসর লামার্টিন তার ‘তুরস্কের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব, উপায় উপকরণের স্বল্পতা এবং বিস্ময়কর সফলতা এ তিনটি বিষয় যদি মানব প্রতিভার মানদণ্ড হয়, তাহলে ইতিহাসের অন্য কোনো মহামানবকে এনে মুহাম্মদের সাথে তুলনা করবে এমন কে আছে? দার্শনিক, বাগ্মী, ধর্ম প্রচারক, আইন প্রণেতা, যোদ্ধা, আদর্শ বিজেতা, মানবিক রীতি-নীতির প্রবর্তনকারী এবং একটি ধর্মীয় সাম্রাজ্য ও বিশটি জাগতিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা যিনি, তিনি মুহাম্মদ। তিনি বিনম্র তবু নির্ভীক, শিষ্ট তবু সাহসী, ছেলে মেয়েদের মহান প্রেমিক, তবু বিজ্ঞজন পরিবৃত। তিনি সবচেয়ে সম্মানিত, সব চেয়ে উন্নত, বরাবর সৎ, সর্বদাই সত্যবাদী, শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসী এক প্রেমময় স্বামী, এক হিতৈষী পিতা, এক বাধ্য ও কৃতজ্ঞ পুত্র, বন্ধুত্বে অপরিবর্তনীয় এবং সহায়তায় ভ্রাতৃসুলভ, দয়ার্দ্র, অতিথিপরায়ণ, উদার এবং নিজের জন্য সর্বদাই মিতাচারী। কঠিন তিনি মিথ্যা শপথের বিরুদ্ধে, ব্যভিচারীর বিরুদ্ধে। খুনী, কুৎসাকারী, অর্থলোভী, মিথ্যা সাক্ষ্যদাতা এ ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে। ধৈর্যে, বদান্যতায়, দয়ায়, পরোপকারিতায়, কৃতজ্ঞতায়, পিতা-মাতা গুরুজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে এবং নিয়মিত আল্লাহর প্রার্থনা অনুষ্ঠানে এক মহান ধর্ম প্রচারক।”

জার্মানির প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত ড. গুস্তাভ উইল, মহানবি (সা.)-কে বিশ্বের আইনদাতা ও সমাজ সংস্কারকের মূর্ত প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসবিদ স্টানলি লেনপুল বলেছেন, ধর্ম ও সাধুতার প্রচারক হিসেবে মুহাম্মদ যে রকম শ্রেষ্ঠ ছিলেন, রাষ্ট্র নায়ক হিসেবেও অনুরূপ শ্রেষ্ঠ। তিনি অদ্ভুত শক্তিতে, হৃদয়ের উষ্ণতায়, অনুভূতির মাধুর্য ও বিশুদ্ধতায় ছিলেন বিশিষ্ট। জীবনে কখনো কাউকে তিনি আঘাত করেননি। সবচেয়ে খারাপ বাক্য যা তিনি কথাবার্তায় কখনো ব্যবহার করেছেন তা ছিল, “তার কি হয়েছে?’’

তার নাশিকা ধুলা মলিন হোক” তিনি (মুহাম্মদ) বলেছিলেন, “কাউকে অভিশাপ দেওয়ার জন্য আমি প্রেরিত হইনি, প্রেরিত হয়েছি বিশ্বজাহানের জন্য রহমত স্বরূপ।’’

বিশ্ব বিখ্যাত মহাবীর নেপেলিয়ান বোনাপার্ট তার ‘অটোবায়োগ্রাফি’তে বলেছেন, “আমি আল্লাহর মহিমা কীর্তন করি এবং পূতচরিত্র ও দিব্য প্রেরণা দীপ্ত মুহাম্মদকে আর পবিত্র কুরআনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।’মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সাহিত্যিক মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ গ্রন্থে বলেন, ‘‘মুহাম্মদকে আমি বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীদের তালিকার শীর্ষে স্থান দিয়েছি, এতে কেউ কেউ প্রশড়ব তুলতে পারেন। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও ধর্ম বহির্ভূত উভয় ক্ষেত্রে একযোগে বিপুলভাবের ও সর্বাধিক সফলকাম হয়েছেন।’’

ইংরেজ কবি জন কীটস বলেন, “পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই তিনি নিজেই।”

ঊনিশ শতকের একজন বৃটিশ ইস্পেরিয়্যাল প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব স্যার উইলিয়াম মুয়ের, তার ‘ÔMohamet and IslamÕ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই যে, একত্ববাদ এবং মানবতা ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম বর্তমান মধ্য আফ্রিকার মানুষদের উচ্চতর মানবীয় গুণে ভূষিত করতে সক্ষম হয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ধৈর্য শিখিয়েছে, যার ফলে তাদের নৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।’’

তিনি আরো বলেন, “আবির্ভূত হলেন একটি মানুষ মুহাম্মদ, ব্যক্তিত্ব ও ঐশীনির্দেশ পরিচালনার দাবীতে যুদ্ধরত গোত্রগুলোর অসম্ভব মিলনকে প্রকৃতই সম্পন্ন করলেন।”

বিশ শতকের ভারতীয় হিন্দু মনীষী, ‘অহিংসা পরম ধর্মের’ প্রবক্তা মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহাত্মা গান্ধী, বলেন: “আমি এমন একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের জীবন সম্পর্কে জানি যিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে আপন আসন স্থাপন করে রেখেছেন। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, তখনকার দিনে ইসলামের জন্য রাজ্য দখল তলোয়ারের জোরে হয়নি। এটা সম্ভব হয়েছে, তাঁর অকপট সরলতা, নবুয়তের দায়িত্বের প্রতি নিজেকে বিলীন করে দেওয়া, তাঁর দায়িত্বের প্রতি অত্যধিক যতড়বশীলতা, বন্ধু-বান্ধব ও অনুসারীদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, তাঁর সাহসিকতা ও ভয়শূন্যতা, আল্লাহ্ ও তাঁর মিশনের প্রতি নিরঙ্কুশ আস্থার জন্য। তলোয়ারের জোরে নয়, এই সকল গুণাবলিই তাদেরকে (মুসলমানদেরকে) সকল প্রকার সফলতা এনে দিয়েছে এবং সকল প্রকার বাধা অপসারণ করেছে।” [Young Indian Quoted in the Light, Lahore, 16 Dec. 1924]

বিশ্ব ঐতিহাসিক এ. জে. টয়েনবীর মতে: “মুসলমানদের মধ্যে গোষ্ঠীচেতনার বিলুপ্তি ইসলামের একটি অনন্য সাধারণ অবদান এবং বর্তমান বিশ্বের চলমান ঘটনাবলি হতে প্রতীয়মান হয়ে যে, ইসলামি আদর্শের প্রচার করা আজকের দিনের অপরিহার্য প্রয়োজন।’’

Anne Basant তার ‘ÔThe Life and Teachings of MuhammadÕ গ্রন্থে লিখেন, “আরবের মহান নবির জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে যদি কেউ অধ্যয়ন করে এবং জানতে পারে যে তিনি কী শিক্ষা দিয়েছেন, তবে সেই শক্তিমান নবির প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও না বেড়ে পারে না, যিনি ছিলেন সর্বশক্তিমানের নিকট হতে প্রেরিত নবিগণের মধ্যে অন্যতম মহান নবি। যদিও আমি এখন যা বলতে চাই, তা হয়তো অনেকের কাছে আগে হতেই জানা, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি যে, আমি তাঁর সম্পর্কে যতবার পড়ি, ততবারই এই শক্তিশালী আরব শিক্ষকের প্রতি আমার নতুন করে শ্রদ্ধা ও ভক্তি ভাব জাগ্রত হয়।”

এইচ. এম. হিগোম্যান লিখেছেন, “তাঁর মিশনের কোনো পর্যায়ে তিনি ক্ষমতা দাবী করেননি। আল্লাহর এই ‘মানুষ নবি’সর্বপ্রথম দীক্ষিত করেন তাঁর সম্ভ্রান্ত গোত্রের লোকদের মধ্য হতে। যারা তাঁর সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে তাদের সকলের উপরেই তাঁর অবিস্মরণীয় ব্যক্তিগত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই প্রভাব কি তাঁর ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শত্রুবেষ্টিত দুঃসময়ে, কি তাঁর সর্বাধিক সমৃদ্ধির সময়ে, সর্বাবস্থায় অপরিবর্তিত ছিল। মুহাম্মদ তাঁর অনুসারী বন্ধু-বান্ধব ও ভক্ত পরিবৃত্ত হয়ে জীবনযাপন করেছেন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যু যেমন রহস্যময়তা বর্জিত, তেমনি তাঁর জীবনযাপনে ছিল না কোনো ছলনার আশ্রয়।”

আরভিং ওয়াশিংটন তার ÔMohammet and His SuccessorsÕ গ্রন্থে লিখেন, “তাঁর সামরিক বিজয়সমূহ তাঁর মনে কোনো মিথ্যা ও অহংকার এবং গৌরাবানুভূতি জাগ্রত করেনি। কারণ এগুলি তাঁর নিজস্ব স্বার্থ চিন্তাপ্রসূত ছিল না। তাঁর দুঃখ-কষ্টের দিনসমূহের মতো তিনি তাঁর সর্বাধিক প্রতিপত্তির সময়েও স্বভাবে ও আচরণে সরলতা বজায় রেখেছিলেন। বাস্তব তথ্য থেকে যতটুকু জানা যায় তাঁর নিকট আগমনকারী কোনো অভ্যাগত অস্বাভাবিকভাবে সম্মান প্রদর্শন করলে তিনি খুবই বিরক্ত হতেন।

তিনি যদি কোনো শাশ্বত রাজ্য কায়েম করার উদ্যোগ নিয়ে থাকেন তবে তা ছিল ইমানের রাজত্ব। পার্থিব বিধানে তাঁর নিজ হাতে যে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল, তাকে তিনি আড়ম্বরহীনভাবে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু নিজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ধরে রাখার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।”

দানকন গ্রিনলেস বলেছেন, “এ ধর্মের মহত্ত্ব ব্যাপক সহনশীলতা এতই যে, পৃথিবীর সকল প্রত্যাদিষ্ট ধর্মকে স্বীকার করে। এ ধর্ম সবসময় মানবজাতির গৌরবময় ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য হবে। এই ভিত্তিতেই তৈরি করা যেতে পারে পরিপূর্ণ বিশ্ব ধর্ম।”

মারকুইস অফ ডাফরিনের মতে, “মুসলমানদের বিজ্ঞান, মুসলমানদের শিল্পকলা এবং মুসলমানদের সাহিত্যের কাছে ইউরোপ এত বেশি পরিমাণে ঋণী যে, এর দ্বারাই তারা মধ্যযুগীয় অন্ধকার হতে মুক্তি পেয়েছিল।”

বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-কে শ্রেষ্ঠ আইন প্রণেতা তা আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ১৯৩৫ সালে হযরত রাসুল (সা.)-কে একজন শ্রেষ্ঠ আইন প্রণয়নকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়াসহ বিশ্বের বিভিনড়ব বিশ্বকোষে ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সফল জীবনালেখ্য শ্রদ্ধার সাথে সনিড়ববেশিত হয়েছে।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বলা হয় যে, ÒMuhammad is the most successful of all prophets and religious personalities.Ó

বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর এই আলোকিত জীবনাদর্শ হতে দীপ্তি নিয়ে আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো- তবেই শান্তি, সমৃদ্ধি, উনড়বতি, অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। তাছাড়া বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর সুউচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে বিশ্বের বিভিনড়ব দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মনীষীদের মধ্যে আরো যারা আছেন তারা হলেন: জন ডেভেন পোর্ট, জোসেফ হেল, ডা. স্যামুয়েল জনসন, প্রফেসর স্টিফেন্স, জন উইনিয়াম ড্রেপার, আলফ্রেড মার্টিন, মরিস গড ফ্রে, আর্থার গিলম্যান, ওয়াশিংটন আরভিং, এডওয়ার্ড মুনন্ট, রেভারেন্ড ডব্লিউ স্টিফেন, রেমন্ড এলিয়ন নিকলসন, মানবেন্দ্র নাথ রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দেওয়ান চাঁদ শর্মা, পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী-সহ শতাধিক বিশ্বখ্যাত অমুসলিম ব্যক্তিত্বগণ মহানবি (সা.)-এর প্রতি প্রশংসার বাণী উচ্চারণ করেছেন।

[লেখক: প্রাবন্ধিক গবেষক]

তথ্যসূত্র:

১। আল কুরআন ৫:

২। আল কুরআন ২১:১০৭

৩। আল কুরআন ৯৪:

৪। তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০

৫। আল হাদিস

৬। উত্তরায়ন বেদ

৭। অল্লোপনিষদ

8| History of Arabs, P.K.Hitti

9| The Genuine Islam, Vol. 1, No. 8, 1936

10| The Hundred, Michael H Hart

11| Civilization on Trial, A.J Toynbee: New York, 1948, p. 205

12| The Awakening of Asia, H. M. Higgoman: London, 1919

13| The Gospel of Islam, Dancon Greenless: Adiar, 1948, p. 27

সম্পর্কিত পোস্ট