বিশ্বের প্রধান ধর্মসমূহে রোজা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান
রোজা একটি ধর্মীয় বিধান। আত্মিক বিশোধনের জন্য স্বেচ্ছায় খাদ্য ও পানি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা অনেক ধর্মেরই একটি রীতি বহুদিন ধরে পৃথিবীতে চলে আসছে। পূর্বের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ (Repentance), আত্মার পরিশুদ্ধিতা (Purity of soul), ত্যাগের মানসিকতা এবং জ্ঞান ও চারিত্রিক উৎকর্ষ অর্জনই এই উপবাস যাপনের মূল উদ্দেশ্য। এমনকি প্রাচীন দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদগণ কোনো কোনো রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য রোজাকে পন্থা হিসেবে বেছে নিতেন। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টোটল, গ্যালেন, প্যারাসেলাস এবং হিপোক্রিটাসের মতো দার্শনিকগণ রোজা বা উপবাসকে রোগ নিরাময় থেরাপি হিসাবে ভাবতেন। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন- পবিত্র বাইবেলে উল্লেখ আছে যে, হযরত মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত দানিয়েল (আ.), হযরত ইলিয়াস (আ.) প্রমুখ নবিগণ আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আত্মিক সংশোধনের উপায় হিসেবে রোজা বা সংযম সাধনা করতেন। রোজা পবিত্র কুরআনেও উল্লেখ আছে, “হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর।” (সূরা বাকারাহ ২ : আয়াত ১৮৩) ইসলাম ধর্মে রমজান মাসের রোজা সর্বব্যাপী পরিচিতি পেলেও অন্যান্য ধর্মেও রোজার বিধান রয়েছে। মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন প্রকার ইবাদত-বন্দেগির বিধান দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রোজা অন্যতম। রোজা ফারসি শব্দ। আরবিতে সিয়াম বলা হয়। যার অর্থ বিরত থাকা। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় রোজাকে উপবাস বলে।
পবিত্র কুরআনে রোজাকে সিয়াম এবং এ মাসকে রমজান বলা হয়েছে। রমজান শব্দটি আরবি ‘রমজ’ ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ কোনো বস্তুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সোজা ও ঠিক করা। বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থে রোজার বর্ণনা পাওয়া যায়। ইনজিল কিতাবে রোজাকে ‘ত্বাব’ বলা হয়েছে; যার অর্থ পবিত্র হওয়া, নির্মল হওয়া, কলুষমুক্ত হওয়া। যাবুর কিতাবে রোজাকে ‘কোরবত’ বলা হয়েছে; যার অর্থ পাপ ধ্বংস করা। তাওরাত কিতাবে রোজাকে ‘হাত্ব’ বলা হয়েছে; যার অর্থ পাপ ধ্বংস করা। সনাতন ধর্মে উপবাস শব্দটির মধ্যে দু’টি বিষয় আছে; একটি হলো খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং অপরটি কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য অনুভব করা।
বিভিন্ন ধর্মসমূহে রোজা
বিশ্বের বিভিন্ন নবি-রাসুলের যুগে তাঁদের উপর রোজার বিধান ছিল। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবি-রাসুলের যুগে রোজার বিধান প্রচলন ছিল।
হযরত নূহ (আ.)-এর যুগেও রোজার বিধান ছিল। হযরত রাসুল (সা.) বলেন : হযরত নূহ (আ.) ১লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন। (ইবনে মাজাহ: ১৭১৪)
হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর যুগে ৩০টি রোজা ছিল বলে জানা যায়। হযরত দাউদ (আ.)-এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোজা হযরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন।
আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখতো যে, এ দিনে কাবাঘরের ওপর নতুন গিলাফ চড়ানো হতো। মদীনায় বসবাসকারী ইহুদিরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করতো। অর্থাৎ ইহুদিরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের ১০ম দিনে রোজা রাখতো।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই রোজার প্রচলন হয়েছে। বিভিন্ন নবির আমলে মু’মেন বান্দাদের অন্তরের কুলষতা দূর করার জন্য রোজা পালনের বিধান চালু ছিল।
ইসলাম ধর্ম
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার, কামাচার ও পাপাচার হতে বিরত থেকে আল্লাহর জ্বিকিরে নিমগ্ন থাকাকে রোজা বলা হয়। রমজান মাসে রোজা রাখা প্রতিটি সুস্থ ও প্রাপ্তবযস্ক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা করা হলো, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর, যাতে তোমরা সংযত হও।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১৮৩)
রোজা মানুষকে আত্মশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করে এবং পাপ প্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে। রোজা শুধু খাবার ও পানীয় বর্জন নয়। রোজা হচ্ছে কথা ও কর্মে মিথ্যা পরিহার করা, অশোভনীয় ভাষা পরিহার, ঝগড়া ফ্যাসাদ এবং কুপ্রবৃত্তি ও খারাপ চিন্তা থেকে দূরে থাকাই রোজা। তাই সব কিছু মিলিয়ে রমজান মাসে প্রকৃত মুসলমানগণ নিজেদের নৈতিক চরিত্র এবং আত্মার উন্নতি সাধনে কাজ করে চলেন।
রোজা মুসলমানদেরকে ধৈর্য এবং আত্মসংযম শিক্ষা দেয়।
রোজার হাকিকত
আল্লাহ্ প্রেমিক সুফিদের জীবন যাত্রায় চিরন্তন সিয়াম পালনের ধারা লক্ষ্য করা যায়। সুফিরা সিয়ামের হাকিকত উপলব্ধি করতে পারেন এবং সে অনুযায়ী আমল করে থাকেন। তাঁরা সিয়ামের মাধ্যমে নফ্সের পরিশুদ্ধতা লাভ করে থাকেন। তাঁরা রোজার মাধ্যমে জাগতিক লোভ লালসা, কামনা বাসনা থেকে নিজেকে মুক্ত করে প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। রোজার হাকিকত হচ্ছে নফ্সের কামনাকে সংযত রাখা। এজন্য রোজায় সিয়াম সাধনার প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় সুফি সাধক ও আওলিয়ায়ে কেরামে জীবনে। বড়পির হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেছেন, পানাহার এবং যা কিছু করলে সিয়াম ভঙ্গ হয় তা করা থেকে বিরত থাকা শরিয়তের বিধান মতে সিয়াম। অপরপক্ষে হারাম, কুপ্রবৃত্তি, লোভ লালসা ও নিষেধ হওয়া সব কাজ থেকে বিরত থাকাই তরিকতের সিয়াম। তাই শরিয়তের সিয়াম নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিন্তু তরিকতের সিয়াম আজীবন সর্বক্ষণ।
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) মর্যাদা হিসেবে সিয়ামকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন- (১) নিম্ন শ্রেণির সিয়াম- শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা। নানাবিধ পাপের কাজ থেকে নিজেকে বিরত থাকার চিন্তা থাকে না। (২) মধ্যম শ্রেণির সিয়াম- পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব পাপ থেকে আত্ম রক্ষা করা; যেমন- মুখ ও জিহ্বাকে সংযত রাখা, অনর্থক কথা বলা, মিথ্যা, গিবত ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা, চক্ষুকে হারাম দর্শন থেকে সংযত রাখা। (৩) উচ্চ শ্রেণির সিয়াম- এই শ্রেণির সিয়াম পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। অপরদিকে মনকেও কুপ্রভাব, কুচিন্তা থেকে পবিত্র রেখে আল্লাহ্র ধ্যান ও ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে সিয়ামকে সমৃদ্ধ করা হয়। এটিই সিয়ামের প্রকৃত হাকিকত।
মহান সংস্কারক যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, আল্লাহ্ নফসকে সৃষ্টি করার পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কে? আর আমি কে? নফস জবাব দিয়েছিল, তুমি তুমি, আমি আমি। তখন আল্লাহ্ নফসকে সত্তর হাজার বছর আগুনে জ্বালিয়েছেন। জ্বালানোর পরে আগুন থেকে উঠিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে, আর আমি কে? তার ঐ একই জবাব, তুমি তুমি, আমি আমি। এরপরে আল্লাহ্ নফসকে আরও সত্তর হাজার বছর বরফে চাপা দিয়ে রেখেছেন। বরফ থেকে বের করে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? আর আমি কে? তার ঐ একই জবাব, তুমি তুমি, আমি আমি। তখন আল্লাহ্ নফসের খাবার বন্ধ করে দিলেন। খাবার বন্ধ করে দেওয়ার পরে সত্তর হাজার বছর পর আল্লাহ্ জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে? আমি কে? নফস তখন বলেছে, তুমি আমার প্রভু, আমি তোমার দাস। সেখান থেকেই আমাদের নফসকে প্রভু মানানোর জন্য এই তালিমটা এসেছে। একমাত্র উপবাসের মাধ্যমেই নফ্স আল্লাহ্ তায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণ করে থাকে। তাই মহান আল্লাহ্ নফ্সকে এছলাহ্ করার জন্য বিভিন্ন নবি-রাসুলের জামানায় মু’মিন বান্দাদের জন্য রোজা ফরজ করেছেন। সকল নবি-রাসুল সিয়াম সাধনা করেছেন। তবে অন্য মাসে করেছেন, এমাসেও করেছেন। যেমন, আশুরার দশ দিন রোজা অন্য নবিরা করেছেন।
রোজা মানুষের আত্মার উন্নতি বিধানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষের জীব প্রবৃত্তিকে দুর্বল করতে মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধন করে আল্লাহ্র প্রতি পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে তাঁর গুণে গুণান্বিত হওয়ার শিক্ষাদানই রোজার মূল উদ্দেশ্য। রোজাদার ব্যক্তি স্বীয় জীব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়া অবস্থায় যখন আল্লাহর জ্বিকিরে নিমগ্ন থাকেন, তখন রোজার ফায়েজ, বরকত ও রহমত তার উপর অবতীর্ণ হয়। ফলে তার আত্মার জীব প্রবৃত্তি তথা বদ স্বভাবগুলো দূর হয়ে যায়। মানুষ যখন রোজা রেখে পরিপূর্ণভাবে আত্মশুদ্ধি লাভ করতে সক্ষম হয়, তখনই মানুষের মাঝে মানবীয় গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন হয়। এমতাবস্থায় তিনি প্রকৃত মু’মেনে পরিণত হন। তখন আল্লাহ্ তার সেই বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বান্দার হৃদয়ে আসন গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ তায়ালা ফরমান, “রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান।” হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “যারা একমাস পূর্ণভাবে রোজা পালন করে, তারা রমজান শেষে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় পুতঃপবিত্র হয়ে যায়।” এজন্যই অনাদিকাল থেকে নবি-রাসুল, মুনি ঋষি ও সুফি সাধকগণ রোজাকে তাঁদের সাধনকর্মে গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেন।
মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেব্লাজান হাকিকতে সিয়াম বা প্রকৃত রোজার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রোজাকে তিন ভাগে ভাগ করেন। যথা-(১) সাধারণ শ্রেণীর রোজা, (২) মধ্যম শ্রেণীর রোজা ও (৩) উচ্চ শ্রেণীর রোজা।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র পানাহার ও কামাচার হতে বিরত থাকা হলো- সাধারণ শ্রেণীর রোজা; পানাহার, কামাচার ও পাপাচার হতে বিরত থাকা হলো- মধ্যম শ্রেণীর রোজা এবং পানাহার, কামাচার ও পাপাচার হতে বিরত থেকে সার্বক্ষণিক আল্লাহর জ্বিকির বা স্মরণে নিমগ্ন থাকাকে উচ্চ শ্রেণীর রোজা বলা হয়। উচ্চ শ্রেণীর রোজাই হলো-হাকিকতে সিয়াম।
প্রত্যেক মানুষকে একজন অলী-আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে ক্বালব বা হৃদয়ে আল্লাহর জ্বিকির জারী করে পরিপূর্ণ ইমানদার হতে হয়। অতঃপর তাঁর শিক্ষানুযায়ী নামাজ আদায় করলে নামাজে হুজুরি বা একাগ্রতা সৃষ্টি হয় এবং তাঁর নির্দেশ মোতাবেক ধ্যান সাধনা বা মোরাকাবা করলে আত্মা শুদ্ধ হয়। অনুরূপভাবে রোজাকে সঠিকভাবে পালনের জন্যও অলী-আল্লাহ্গণের সহবতে দিয়ে তাঁদের শিক্ষা লাভ করা প্রয়োজন। কারণ শুধুমাত্র উপবাস থকলেই মানুষের রোজার ফরজ আদায় হয় না। যেমন, সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একটি পশুর পানাহার বন্ধ করে উপবাস রাখলে পশুর জন্য তা রোজা হবে না। কারণ রোজা ফরজ করা হয়েছে মানুষের জন্য তার পশু প্রবৃত্তিকে দমন করে মনুষ্য চরিত্র অর্জন করার জন্য।
প্রকৃত রোজা পালনের জন্য পানাহার, কামাচার ও পাপাচার হতে বিরত থেকে পরিশুদ্ধ অন্তঃকরণে আল্লাহ্র জ্বিকিরে নিমগ্ন থাকা শর্ত, যা একমাত্র খাঁটি অলী-আল্লাহর সাহচর্যে গিয়ে তাঁদের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সম্ভব।
রোজার শিক্ষা ও উপকারিতা
১। রোজা তাকওয়া অর্জন অর্থাৎ আল্লাহ্ ভীরু হতে সহায়তা করে।
২। শয়তানি শক্তি ও কুপ্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়।
৩। রোজা হলো আল্লাহ্র নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও ইবাদতের প্রশিক্ষণ।
৪। আল্লাহ্র আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ ও হারাম বস্তু থেকে দূরে থাকার সহনশীলতার প্রশিক্ষণ দেয় রোজা।
৫। ইমান দৃঢ়করণ এবং বান্দার প্রতি আল্লাহ্র সার্বক্ষণিক দৃষ্টির অনুভূতি সৃষ্টি করে দেয়। এ জন্য রোজাদার লোকচক্ষুর আড়ালে গোপনেও কোনো কিছু খায় না।
৬। দুনিয়ার ভোগ বিলাসের মোহ কমিয়ে রোজা পালনকারীকে আখিরাতমুখী হওয়ার দীক্ষা দেয় এবং ইবাদতের প্রতি তার ক্ষেত্র প্রসারিত করে দেয়।
৭। রোজা পালনের ফলে বান্দা সৎগুণাবলী ও সচ্চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে।
৮। রোজায় ক্ষুধার অনুভূতিতে অভাবী ও দারিদ্র মানুষের দুরবস্থা অনুধাবন করতে শিখায়। ফলে বঞ্চিত ও অনাহারী মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল করে তোলে।
৯। সৃষ্ট জীবের সেবা করার দায়িত্ব স্মারণ করিয়ে দেয়।
১০। রোজা পালন আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সাহায্য করে।
১১। বান্দাকে নিয়ম-খৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা শিক্ষা দেয়।
রোজার দৈহিক উপকারিতা
১। রোজা মানব দেহে নতুন সূক্ষ্ম কোষ গঠন করে থাকে।
২। রোজা পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দিয়ে থাকে। ফলে এগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং তা আবার সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
৩। মোটা মানুষের স্থুলতা কমিয়ে আনতে রোজা সাহায্য করে।
৪। রোজা চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে নিরাপদ রাখে।
৫। রোজা মস্তিষ্কের কার্যক্রম সুষ্ঠভাবে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬। মাত্রাতিরিক্ত ওজন কমিয়ে এনে অনেক রোগ বালাই থেকে হিফাজত করে।
৭। অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতে ডায়াবেটিস, গ্যাসট্রিক ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগ নিরাময়ে রোজা ফলদায়ক ও এক প্রকার সহজ চিকিৎসা।
৮। রোজায় শরীরের ক্ষতিকারক টক্সিনের মাত্রা কমে যায়। রোজা অবস্থায় কিডনি ও লিভার বিশ্রাম পায়।
৯। অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুস্থতার পাশাপাশি রোজায় মানসিক শক্তি, স্মরণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, আধ্যাত্মিক শক্তিসহ সবকিছুই বৃদ্ধি পায়। রোগ নিরাময়ের যতগুলো প্রতিকার এবং প্রতিষেধক রয়েছে, রোজা তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ।
যাদের জন্য রোজা পালন বাধ্য নয়:
১। হঠাৎ বমি হলে
২। মারাত্বক অসুস্থ ব্যক্তি
৩। ঋতুবতী নারী
৪। মুসাফির বা পর্যটক
৫। সন্তান জন্মদানের চল্লিশ দিন না হওয়া রমনী
৬। গর্ভবতী মহিলা
৭। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি
৮। যে সকল পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি রোজা রাখতে অসমর্থ হবে তাদের গরীব ব্যক্তিকে এক বেলার খাবার বা সমপরিমান মূল্যের টাকা দান করতে বলা হয়েছে।
মেডিক্যাল সাইন্সে রোজা-অটোফেজি
মুসলিমরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘সিয়াম’। খ্রিস্টানরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ফাস্টিং (Fasting)|। হিন্দু বা বৌদ্ধরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় ‘উপবাস’। আর মেডিক্যাল সাইন্সে রোজা রাখলে তাকে বলা হয় অটোফেজি (Autophagy)। খুব বেশি দিন হয়নি, মেডিক্যাল সাইন্স ‘অটোফেজি’র সাথে পরিচিত হয়েছে। ২০১৬ সালে নোবেল কমিটি জাপানের ডাক্তার ওশিনরি ওসুমি-কে অটোফেজি আবিষ্কারের জন্যে পুরষ্কার দেয়। এরপর থেকে আধুনিক মানুষেরা ব্যাপকভাবে রোজা রাখতে শুরু করে।
Autophagy
Autophagy শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ। Auto অর্থ নিজে নিজে এবং phagy অর্থ খাওয়া। সুতরাং, অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খাওয়া। শরীরের কোষগুলো বাহির থেকে কোনো খাবার না পেয়ে নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিক্যাল সাইন্সের ভাষায় তাকে অটোফেজি বলা হয়।
আরেকটু সহজভাবে বলা যায়-আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন থাকে অথবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে। সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে, ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায়।
এই অটোফেজি পদ্ধতিটি উদ্ভিদের ভিতরেও কার্যকরি রয়েছে। যেমন- তীব্র খাদ্যাভাবের সময় উদ্ভিদের ভিতর লাইসোসোম প্রাচীর ফেটে যায় এবং আবদ্ধকৃত এনজাইম বের হয়ে কোষের অন্যান্য অঙ্গানুগুলো বিনষ্ট করে দেয়। এ কাজকে বলে স্ব-গ্রাস বা অটোফেজি (Autophagy)। এভাবে সমস্ত কোষটিও পরিপাক হয়ে যেতে পারে। একে বলা হয় অটোলাইসিস (Autolysis)।
শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে। কান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর আমাদের মত অলস হয়ে বসে থাকে না, তাই প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। কোষগুলোর আমাদের মত আবর্জনা ফেলার জায়গা নেই বলে তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। মেডিক্যাল সাইন্সে এই পদ্ধতিকে বলা হয় অটোফেজি। এ জিনিসটা আবিষ্কার করেই জাপানের ওশিনরি ওসুমি ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কারটা নিয়ে গেল। শুনেছি প্রফেসর ওশিনরি নিজেও সপ্তাহে দুটি করে রোজা রাখেন। আফসোস হলো তাদের জন্যে যারা স্বাস্থ্যের কথা ভেবে রোজা রাখেন না। আমরা তো প্রতিবছর একমাস রোজা রেখে শরীরের অটোফেজি করে ফেলি।
খ্রিস্টান ধর্ম
খ্রিস্ট ধর্মের বাইবেলিকার বইয়ের মধ্যে ইসাইয়াহ (৫৮: ৬-৭), জাকারিয়াহ (৭:৫-১০), বুক অফ দানিয়েলে উপবাসের কথা বলা হয়েছে। তবে এখানে উপবাসে খাদ্য পানীয় পরিহারের বদলে সৃষ্টিকর্তার আদেশ পূর্ণরূপে প্রতিপালন করতে গরিব এবং দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। বুক অফ দানিয়েলে আংশিক উপবাসের কথা বলা হয়েছে।
খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন শাখা বা চার্চ উপবাস পালন করে থাকে। তবে কিছু শাখা এটাকে পালন করে না। ক্যাথলিক চার্চ এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স চল্লিশ দিনের আংশিক উপবাস পালন করে থাকে। ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বছরে কয়েকবার সপ্তাহব্যাপী আংশিক উপবাস পালন করে। উক্ত সময়ে তারা মাংস এবং দুগ্ধ আহার থেকে বিরত থাকে। বাইবেলে (লেভিক্টাস ২৩:২৭, ৩১) বলা হয়েছে, সবার উচিত সপ্তম মাসের নবম দিনের সন্ধ্যা থেকে দশম দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনোরূপ খাদ্য গ্রহণ না করা।
খৃষ্টান ধর্মে বর্তমান কালেও রোজার প্রভাব বিদ্যমান। যীশুও চল্লিশ দিন পর্যন্ত রোজা রেখেছেন। (মথি:৪:২)
যোহন যিনি যীশুর সমসায়য়িক ছিলেন, তিনিও রোজা রাখতেন এবং তাঁর অনুসারীগণের মাঝেও রোজা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্ক ২:১৮)
বাইবেল অনুসারে, যীশুর স্বীয় সময়কালে কিছু সংখ্যক রোজা রাখার অনুমতি বা অবকাশও ছিল। একবার কতিপয় ইহুদি সমবেত হয়ে হযরত ঈসা (আ.)-এর নিকট এই আপত্তি উত্থাপন করলো যে, তোমার অনুসারীরা কেন রোজা রাখছে না। হযরত ঈসা (আ.)-এর জবাবে বলেন, বর সঙ্গে থাকতে কি বিয়ে বাড়ির অতিথিরা উপোস করতে পারে? যেহেতু বর তাদের সঙ্গে তাই তারা উপোস করে না? কিন্তু এমন সময় আসবে যখন বরকে তাদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হবে; আর সেই দিন তারা উপোস করবে?
বলা হয় যীশু মোশির সময়ের রোজাসমূহকে নয়; বরং শোক পালনার্থে নব্য প্রচলিত রোজার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং তিনি স্বীয় অনুসারীদেরকে পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততার সাথে রোজা রাখার উপদেশ প্রদান করতেন। বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘যখন তোমরা উপবাস কর, তখন ভন্ডদের মতো মুখ শুকনো করে রেখো না। তারা যে উপবাস করেছে তা লোকেদের দেখাবার জন্য তারা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায় আমি তোমাদের সত্যি বলছি, তারা তাদের পুরস্কার পেয়ে গেছে। কিন্তু তুমি যখন উপবাস করবে, তোমার মাথায় তেল দিও আর মুখ ধুয়ো। যেন অন্য লোকে জানতে না পারে যে তুমি উপবাস করছ। তাহলে তোমার পিতা ঈশ্বর, যাঁকে তুমি চোখে দেখতে পাচ্ছ না, তিনি দেখবেন? তোমার পিতা ঈশ্বর যিনি গোপন বিষয়ও দেখতে পান, তিনি তোমায় পুরস্কার দেবেন? (মথি:৬:১৬-১৮)
এছাড়া অ্যাশ ওয়েনেসডে ও গুড ফ্রাইডেতে রোজা রাখেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। এছাড়া ইস্টার সানডের আগের দিন প্রায় ৪০ দিন তারা শুক্রবারগুলোতে মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
মর্মন : খ্রিস্টীয় সংস্কারবাদী ল্যাটার যে সেইন্ট ম্যুভমেন্টের সদস্যদের বলা হয় মর্মন। তারা প্রতি মাসের প্রথম রোববার রোজা রাখেন।
হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্মে উপবাস একটি আনুসংগিক অংশ। ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক রীতিনীতি অনুসারে হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন ধরনের উপবাস প্রচলিত আছে। অনেক হিন্দু মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন যেমন একাদর্শী, প্রদোষ অথবা পূর্ণিমাতে উপবাস পালন করেন।
সপ্তাহের কয়েকটি দিন নির্দিষ্ট দেবতার জন্য উপবাস পালন করার বিধান আছে অনেক অঞ্চলে। যেমন সোমবার শিবের জন্য বিষ্ণুর জন্য এবং শনিবার আয়াপ্পার জন্য উপবাস পালন করা হয়। মঙ্গলবারে দক্ষিণ ভারত এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে উপবাস পালন করা হয়। দক্ষিণের হিন্দু জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে মঙ্গলবার শক্তির দেবী মারিয়াম্মানের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। উপবাসকারীরা সূর্যোদয়ের আগে খাবার গ্রহণ করে মুসলিমরা যেমন সেহেরি খায় এবং সূর্যাস্তের পরে তারা উপবাস ভঙ্গ করে। তবে এই উপবাসকালীন সময়ে তারা পানীয় জল পান করে থাকে। উত্তর ভারতে মংগলবার দেবতা হনুমানের জন্য নির্দিষ্ট। উপবাসকারীরা এইদিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তকালীন সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র দুধ এবং ফল খেয়ে থাকেন। উত্তর ভারতে বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে। উপবাসকারী একটি গল্প বা শ্রুতি শ্রবণের মাধ্যমে উপবাস শুরু করে।
বৃহস্পতিবারের উপবাসকারীরা বৃহস্পতি মহাদেবের পূজা করে। তারা হলুদ কাপড় পরে এবং হলুদ রঙের খাবার খেতে পছন্দ করে। এদিন মহিলারা কলা গাছের পূজা করে এবং জল ঢালে। হলুদাভ বর্ণের ঘি দিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হয়। বৃহস্পতিবার গুরুর জন্য উৎসর্গ করা হয়। যে সকল হিন্দুরা গুরু মন্ত্র গ্রহণ করে তাদের অনেকেই বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে। ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষ্যেও উপবাস পালন করা হয়। যেমন মহাশিব রাত্রিতে অধিকাংশ হিন্দু উপবাস পালন করে এবং তরা একবিন্দু জল পর্যন্ত পান করে না। নভরাত্রিতে উপবাস পালন করে। ভারতের অনেক অঞ্চলের বিবাহিত হিন্দু রমনীরা স্বামীর সুস্বাস্থ্য, আয় উন্নতি, দীর্ঘায়ু কামনা করে উপবাস পালন করে থাকে। একটি ঝালরের মাধ্যমে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে তারা এই উপবাস ভংগ করে শ্রাবণ মাসে অনেকে শ্রাবণ উদযাপন করে। এ সময়ে অনেকেই সপ্তাহের একটি দিন তারা তাদের পছন্দের দেবতার জন্য উপবাস করে। আবার অনেকেই পুরো শ্রাবণ মাস উপবাস পালন করেন। অন্ধ্রপ্রদেশে কার্তিক মাসের শুরুর দিনে অনেক হিন্দু বিশেষ করে রমনীরা উপবাস পালন করে থাকে। এ মাসের সোমবার তারা শিবের জন্য, পূর্ণচন্দ্রের দিন কার্তিকের জন্য উপবাস পালন করে থাকে। শ্রী বিদ্যায় উপবাস করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই তান্ত্রিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে দেবী মানুষের মধ্যে বাস করেন। তাই কেউ যদি ক্ষুধার্ত থাকে তবে দেবীও ক্ষুধার্ত থাকে। শ্রীবিদ্যায় শুধু মাত্র পিতা মাতার মৃত্যুবার্ষিকীতে উপবাসের কথা বলা হয়েছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে একাধিকবার উপবাসের কথা বলা হয়েছে। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলেন, উচ্চজ্ঞানের উপবাস প্রথা পালন করো যার কথা সবাই জানে না।
হিন্দুধর্মে কাত্যায়ন স্মৃতি ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে উপবাসের লক্ষণ
উপাবৃত্তস্য পাপেভ্যো য¯ত্ত বাসো গুণৈ সহ। উপবাসঃ স বিজ্ঞেয় সর্বভোগবিবর্জিতঃ॥
অর্থাৎ নিখিল পাতক (সকল পাপ) থেকে নিবৃত্ত হয়ে গুণসহ মানবের যে অবস্থান, তাকেই উপবাস বলে। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খাদ্য গ্রহণ না করাকেই উপবাস বলে। বিবাহ, পূজা-অর্চনা এবং বিভিন্ন ব্রত উপলক্ষ্যে উপবাস পালন করা হয়। সাধনাক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় সংযম অত্যাবশ্যক কর্ম, আর এজন্য উপবাস একটি প্রধান উপায়। উপবাস শব্দটির মধ্যে দুটি বিষয় আছে; একটি হলো খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং অপরটি কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য অনুভব করা।
বেদে বলা হয়েছে যে, চন্দ্রমাসের একাদশীর দিন পুরোটাই উপবাস করতে হয়। শুধু পানি পান করা যাবে। সে হিসেবে মাসে দুবার এই উপবাসের রেওয়াজ আছে।
বরাহ উপনিষদে আছে
উপ সমীপে যো বাসঃ জীবাত্মা পরমাত্মাঃ। উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ো নতু কায়স্য শোষণম্॥ অর্থাৎ জীব যে (সংযম পালন করে) পরমাত্মার নিকটে বাস করে তাকেই নিকটে বাস বা উপবাস বলে। শুধু না খেয়ে শরীর শুকিয়ে ফেলার নাম উপবাস নয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ- এগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও উপবাস বিশেষ ভূমিকা রাখে। উপবাস দ্বারা সংযমী সাধক মন, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য অনুভবের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করে। তাই আত্মিক ভাবনায় ঋদ্ধ ব্যক্তিগণ দেহ ও মন উভয়টি সুস্থ রাখার জন্য সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে, একাদশী তিথিতে অথবা অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপবাস পালন করেন।
বৌদ্ধ ধর্ম
বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিনয় নীতি অনুসরণ করে যাতে সাধারণত দুপুরের আহারের পরে সেদিন আর কোন খাবার গ্রহণ করে না। যদিও এটাকে উপবাস বলা চলে না। তবুও শৃংখলিত আহার বিধি ধ্যান এবং সুস্বাস্থ্য অর্জনে সাহায্য করে। গৌতম বুদ্ধ প্রথম জীবনে অর্থাৎ রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দুজন গুরুর তত্ত্বাবধানে দীক্ষাগ্রহণ করেন। এসময়ে তিনি খুবই কম খাদ্য গ্রহণ করতেন। পরবর্তীতে তার উপদেশ মালায় তিনি কম খাদ্য গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের সপ্তাহের একটি দিনে অষ্টবিধান অনুসরণ করতে বলা হয়েছে যাতে দুপুর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত উপবাসের বিধান রয়েছে। বজ্রযান অনুসারীরা নুয়াং নে অনুসরণ করে যা তান্ত্রিক অনুশাসন চেনরেজিগের মত।
বৌদ্ধ ধর্মের সব সম্প্রদায়েরই উপবাসের বিধান রয়েছে। মূলত পূর্ণিমার দিনগুলোতে ও অন্য ধর্মীয় দিনগুলোতে তারা উপবাস করে।
ইহুদি ধর্ম
ইহুদি ধর্মে উপবাস মানে সকল ধরনের খাবার ও পানি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। ঐতিহ্যগতভাবে ইহুদিরা বছরে ছয়দিন রোজা পালন করে থাকে। ইয়ম কিপ্পুর (ণড়স করঢ়ঢ়ঁৎ) হচ্ছে ইহুদি বর্ষপঞ্জিকার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন সকল পূর্ণবয়স্ক নারী পুরুষ উপবাস পালন করে থাকে। এই পবিত্র দিনে তারা উপসনার চেয়ে উপবাসকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যদি কেউ উপবাস পালন করে বিছানায় শুয়ে থাকে তবুও সে পূর্ণ ধর্মীয় বিধান পালনের পূণ্য লাভ করবে। তাদের মতে ইয়ম কিপ্পুর (ণড়স করঢ়ঢ়ঁৎ) অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্তের দিন, এই একটিবারই উপবাসের দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে- “এটা তোমাদের ওপর একটা স্থায়ী বিধান হিসাবে অর্পন করা হয়েছে যে তোমরা বছরের ৭ম মাসের ১০ম দিনে তোমাদের অন্তরাত্মাকে সংশোধন করবে এবং সেদিন কোনো কাজ করবে না, না তোমার দেশের জন্য, না কোনো আগুন্তকের জন্য যে তোমাদের মাঝে অবস্থান করছে। কারণ সে দিনটি প্রভু তোমাদের প্রায়শ্চিত্তের জন্য নির্ধারণ করেছেন যাতে তোমরা নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করে নিতে পারো।” (লেভিটিসাস : ১৬ : ২৯-৩১)
ইহুদিরা রশ হাশানাহ অর্থাৎ নববর্ষের প্রথম দিন থেকে ইয়ম কিপুর অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্তের দিন পর্যন্ত ক্রমাগত দশ দিন অনুতাপ করে থাকে। এসময় তারা পূর্ববর্তী কৃতকর্মসমূহ স্মরণ করে দুঃখ প্রকাশ করে যাতে ভবিষ্যতে দিনসমূহে অনুরূপ কাজ না করতে হয়। এদিন তারা সূর্যাস্ত থেকে পরবর্তী দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত ২৫ ঘন্টা উপবাস যাপন করে। ইহুদি মতে এই উপবাস শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা নয়, বরং গোসল করা, সহবাস করা এবং অন্যান্য কাজকর্ম থেকেও বিরত থাকা বুঝায়। চামড়ার জুতা পড়া এবং মলম জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করাও এদিন তাদের জন্য নিষেধ।
ইহুদি ধর্মে কল নিদ্রে (Kol Nidre) অর্থাৎ ‘সংকল্প’ নামের এক বিশেষ সন্ধ্যা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের উপবাস শুরু হয়। পরদিন পুরোটা সময় কাটে সিনাগগ (ইহুদি উপসনালয়) কেন্দ্রিক উপাসনার মাধ্যমে এবং সূর্যাস্তের পর উপবাস ভঙ্গের আগ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ইয়ম কিপুর ছাড়াও আরও ৪দিন ইহুদিরা উপবাস থাকে তাদের বিভিন্ন দুঃখময় স্মৃতির স্মরণার্থে যা পরাধীন অবস্থায় তারা ভোগ করেছিল। তবে অনেক পণ্ডিতের মতে এই চারদিন উপবাস শুধু যখন কোনো জাতীয় দুর্যোগ নেমে আসে তখনই প্রযোজ্য, শান্তিকালীন সময়ে নয়। ইহুদি পুরোহিতগণ তাদের জাতির উপর মহামারি, দুর্ভিক্ষ বা দুষ্ট শাসক কর্তৃক জনগণের উপর অন্যায় আইন চাপিয়ে দেওয়ার মতো কোনো আপদ দেখলে তার প্রতিবাদ করতে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাউকে কাউকে উপবাস যাপনের দায়িত্ব দেন। এই উপবাসগুলো সুর্যোদয় থেকে শুরু করে সেদিনই সন্ধ্যায় আকাশে প্রথম তারা উদয় হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ সন্ধ্যাকাশে প্রথম তারা দেখার পর একজন সেদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন। কিন্তু ইয়ম কিপুর চলে এক সূর্যাস্ত থেকে আরেক সূর্যাস্ত পর্যন্ত। উপবাসের দিন গরিবকে সাযায্য প্রদান, বিশেষ করে সন্ধ্যায় খাবার বিতরণকে পূণ্যময় কাজ হিসাবে উৎসাহিত করা হয়।
ইহুদি ধর্মে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপবাসের দিন তিশা বাব। আনুমানিক ২৫০০ বছর আগে এই দিনে ব্যবিলনিয়রা জেরুজালেমের প্রথম পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয় এবং প্রায় ২০০০ বছর আগে রোমানরা জেরুজালেমের দ্বিতীয় পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয়। তিশা বাব দিবসে ইহুদিরা বিভিন্ন ট্রাজেডিতে পতিত হয়েছে। সেই উপলক্ষ্যে তারা এই দিনটিকে পালন করে। এমনকি দ্বিতীয় যুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্টও এই তিশা বারের সময়ে সংঘটিত হয়।
ইহুদিদের মাঝেও রোজা ছিল আল্লাহ্র আদেশ। মোশি তুর পাহাড়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুধা-পিপাসার ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। (যাত্রাপুস্ত ক:৩৪:২৮) মোশির অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ রোজা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হতো। ইহুদিদের অন্যান্য ছহিফাসমূহের মাঝে অন্যান্য দিনের রোজার হুকুম-আহকামও বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। (প্রথম শামুয়েল:৭:৬) এবং (যেরেমিয়া:৩৬:৬)
বাহাই ধর্ম
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে বাহাউল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত ধর্ম বাহা-এর অনুসারীরা তাদের পঞ্জিকার ১৯তম মাসে (২ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত) রোজা রাখে। বাহাই ধর্মানুসারীদের জন্য বাহাউল্লাহ্ কিতাবই আকদাসে বাহাই মাস আলা (২ মার্চ-২০ মার্চ) সর্বমোট ১৯ দিনের রোজা রাখার বিধানের কথা উল্লেখ করেছেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনোরূপ পানাহার এমনকি ধূমপান পর্যন্ত নিষিদ্ধ। ১৫ থেকে ৭০ বয়সী সকল বাহাইকে এই রোজা বা উপবাস পালন করতে হবে। অসুস্থ, গর্ভবর্তী, ঋতুবর্তী, পর্যটক, কঠোর পরিশ্রমকারীদের জন্য রোজার বিধান শিথিল করা হয়েছে। তবে যারা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদেরকে নির্জনে স্বাভাবিকের তুলনায় কম আহার করতে বলা হয়েছে।
জৈন ধর্ম
জৈন ধর্মে বিভিন্ন ধরনের উপবাস প্রথা প্রচলিত আছে। এর একটি হচ্ছে চৌবিহার উপবাস যাতে পরবর্তী দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত কোনো প্রকার খাবার বা পানি গ্রহণ করা যায় না। আরেকটি উপবাস ব্রত হচ্ছে ত্রিবিহার উপবাস যেখানে কোনো খাবার খাওয়া যায় না কিন্তু ফুটানো পানি পান করা যায়। জৈন ধর্মমতে যে কোনো উপবাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অহিংসা অর্জন। সাধারণত পাজ্জ্যশনে উপবাস পালন করা হয়। কোনো ব্যক্তি যদি পাজ্জ্যশনে আটদিন উপবাস পালন করে তবে তাকে বলা হতো আত্থাই এবং দশদিন উপবাস করলে বলা হয় দশ লক্ষণ। আর মাসব্যাপী উপবাস পালন করলে বলা হয় মশখমন। জৈনদের মধ্যে উপবাস পালন না করে খুবই কম খাবার আহার করার রীতি অতি সাধারণ দৃশ্য। যে সকল ব্যক্তিরা মসুরের ডাল এবং স্বাদহীন খাবার শুধুমাত্র লবণ ও মরিচ দিয়ে খেয়ে থাকেন তাদের বলা হয় আয়ামবলি। জৈনরা দিনে একবার মাত্র খাবার গ্রহণ করে একাসসন নামে উপবাস পালন করে। দিনে দুই বার খাবার খেয়ে বিয়াসন উপবাস পালন করে।
শিখ ধর্ম
শিখধর্মে উপবাস প্রথাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। গুরু গ্রন্থ সাহিবে বলা হয়েছে উপবাস কোন আত্মিক সুবিধা বয়ে আনে না। তাই শরীরকে কষ্ট দিয়ে কোন লাভ নেই। তবে শুধু মাত্র স্বাস্থ্যজনিত কারণে উপবাস করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
“I do not keep fasts, nor do I observe the month of Ramadaan. I serve only the One, who will protect me in the end (Guru Granth Sahib Ji, Ang 1136)
“Fasting on Ekadashi, adoration of Thakurs (Stones) one remains away from Hari engaged in the Maya and omens. Without the Guru’s word in the company of saints one does not get refuge no matter how good one looks.” (Bhai Gurdas Ji, Vaar 7)
ইয়াজিদি : মধ্যপ্রাচ্যে ইয়াজিদিরা ডিসেম্বর মাসে তিন দিন রোজা রাখেন।
রোজা নিয়ে বিভিন্ন মনিষীদের মন্তব্য
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট বলেন, আমার জীবনে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতার এবং ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। যে ব্যক্তি সকাল সন্ধ্যায় দুবেলা আহার করে সে রোগ মুক্ত স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে পারে। আমি ভারতে এরকম প্রচন্ড উষ্ণ এলাকা দেখেছি, যেখানে সবুজ গাছপালা খরতাপে পুড়ে গেছে, কিন্তু সেই তীব্র গরমের মধ্যেও আমি সকালে এবং বিকেলে দুবেলা খেয়েছি। সারাদিন কোনো প্রকার পানাহার করিনি। এর ফলে আমি নিজের ভেতর অনুভব করেছি এক ধরনের নতুন সজীবতা এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তি। (আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট- মাহফুজুর রহমান আখতারী, দিল্লী)
রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উজির চাণক্য অর্থশাস্ত্র নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, আমি উপোস থেকে বাঁচতে শিখেছি এবং উপোস থেকে উড়তে শিখেছি। আমি ক্ষুধার্ত পেটে শত্রুর চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছি।
মহাত্মা গান্ধীর উপোস থাকার ঘটনা সর্বজনবিদিত। ফিরোজ রাজ লিখিত গান্ধী জীবনের একথা লেখা রয়েছে যে, তিনি রোজা রাখা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, মানুষ খাবার খেয়ে নিজের দেহ ভারী করে ফেলে। এরকম ভারী অলস দেহ দুনিয়ার কোনো কাজে লাগেনা। যদি তোমরা তোমাদের দেহ সরল এবং কর্মক্ষম রাখতে চাও তবে দেহকে কম খাবার দাও। তোমরা উপোস থাকো। সারাদিন জপতপ করো আর সন্ধ্যায় বকরির দুধ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ কর। (দাস্তানে গান্ধী)
অক্সফোর্ড বিশ্বব্যিালয়ের মুখপাত্র প্রফেসর মোরপান্ড বলেছেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি লেখাপড়া করার চেষ্টা করেছি। রোজা অধ্যায়ে লেখাপড়া করার সময়ে আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক মহান ফর্মূলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদের অন্য কোনো বিধান না দিয়ে শুধু এ রোজাই দিতো তবু এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছু হতে পারতো না।
ক্যামব্রিজের ডাক্তার লোথার জিম সবকিছু গভীরভাবে দেখে এবং পর্যালোচনা করে বলেন- রোজা হচ্ছে দেহের অসুস্থতায় বিশেষত পাকস্থলীর রোগে স্বাস্থ্যের গ্যারান্টি। সিগমন্ড নারায়েড যাকে বিশিষ্ট মনস্তত্ববিশারদ হিসেবে মনে করা হয়। তিনি বলেন- রোজার মাধ্যমে মস্তিষ্কের এবং মনের যাবতীয় রোগ ভালো হয়ে যায়। মানুষ শারীরিকভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির দেহ ক্রমাগত বাহিরের চাপ সহ্য করার যোগ্যতা অর্জন করে। সে খিচুনি রোগ এবং মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি লাভ করে। এমনকি সে এ দুটি রোগের সম্মুখীন আর কখনো হয়নি।
প্যারা সাইকোলজির গবেষণায় দেখা যায়- মানুষ বস্তুবাদী জীবন ও সম্পর্কের কারণে মানসিক শান্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে শান্তির সন্ধানে ছুটে চলেছে। এ শান্তির উদ্দেশ্যই হচ্ছে প্যারা সাইকোলজি। মূলত বস্তুবাদী সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আত্মহত্যা, হত্যা প্রচেষ্টা, ট্রাফিক দুর্ঘটনা, সতীত্বহরণ, সমকামীতা, অপহরণ, হত্যা, প্রতিশোধ পরায়ণতা, বোমা সন্ত্রাস, সম্মিলিত হত্যাকান্ড, জারজ সন্তান, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি। এরকম ধ্বংসাত্মক ঘটনাবলী গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের অতলে তলিয়ে দিচ্ছে। গোটা ইউরোপ এবং পাশ্চাত্য সমাজ এ সকল ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় নিয়োজিত।
রোজা সম্পর্কে ইউরোপীয় গবেষকরা নিয়মিত গবেষণা করেছেন। তারা স্বীকার করেছেন, রোজা একদিকে শারীরিক জীবনকে যেমন নতুন প্রাণশক্তিতে সঞ্জীবিত করে, তেমনি এর মাধ্যমে নানারকম অর্থনৈতিক সমস্যাও দূর হয়। কারণ, যখন রোগ কম হবে তখন স্বাভাবিক ভাবেই হাসপাতালে রোগীদের সংখ্যাও কমে যাবে।
হজম শক্তির ওপর রোযার প্রভাব
রোজা একমাসের জন্যে হজম প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহের আরামের ব্যবস্থা করে। তবে হজমের ক্ষেত্রে লিভারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। রোজায় লিভারের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে। কারণ, লিভার খাদ্য হজম করা ছাড়াও আরো পনেরটি অতিরিক্ত কাজ সম্পন্ন করে। ফলে লিভার ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রোজার মাধ্যমে এই হজম প্রক্রিয়া চার থেকে ছয় ঘন্টা বিশ্রাম লাভ করে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দাবী করা হয় বছরে কমপক্ষে লিভারের জন্য বিশ্রামের সময়কাল একমাস রাখা উচিৎ। কিছু কিছু চিকিৎসকরা বলেন, লিভার যদি কথা বলতে পারতো তাহলে মানুষকে বলতো, তোমরা একমাত্র রোজা রাখার মাধ্যমে আমার ওপর বড়ো রকমের দয়া করতে পারো। কারণ লিভার তার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যে সময়টা দরকার তা নিহিত রয়েছ রমজান মাসে।
পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞদের সার্ভে রিপোর্ট মোতাবেক রমজান মাসে নাক, কান এবং গলার অসুখ কম হয়। জার্মানী, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি টিম এ সম্পর্কে গবেষণা করার জন্যে এক রমজান মাসে পাকিস্তানে আসে। গবেষণা কর্মের জন্য তারা পাকিস্তানের করাচী, লাহোর এবং ফয়সালাবাদ শহরকে মনোনীত করে। সার্ভে করার পর তারা যে রিপোর্ট প্রণয়ন করে তার মূল কথা ছিল। ‘মুসলমানরা যেহেতু নামাজ আদায় করে, বিশেষত রমজান মাসে অধিক পাবন্দীর সাথে নামাজ আদায় করে থাকে, এ কারণে ওযু করে। ওযু করার কারণে তাদের নাক, কান, গলার অসুখ কম হয়। খাদ্য কম খাওয়ার কারণে পাকস্থলী এবং লিভারের অসুখ কম হয়। রোজার মাধ্যমে এ ডায়েটিং করার কারণে তারা মস্তিষ্ক এবং হৃদরোগে কম আক্রান্ত হয়।
রোজা স্বাস্থ্য রক্ষার এক অতুলনীয় পদ্ধতি- রুশ শরীর বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ভি এন নিকটন দীর্ঘায়ু লাভের উপায় সম্পর্কে লন্ডনে ১৯৬০ সালের ২২ মার্চ একটি বক্তৃতা দেন। তিনি তার বক্তৃতায় তিনটি কথা বলেন। তার মধ্যে একটি কথা যে খাদ্য পছন্দ করবেন তাই খাবেন তবে প্রতিমাসে কমপক্ষে একদিন উপবাস থাকবেন।
রোজার সামাজিক প্রভাব : ইসলাম ন্যায় নীতি, সুবিচার এবং গরিবের প্রতি ভালবাসা শিক্ষা দেয়। পেট যখন ভরা থাকে তখন অন্যের ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করা যায় না। জিহবা যখন পানিতে ভেজা থাকে তখন অন্যের পিপাসার কষ্ট অনুভব হয় না। রোজা মুসলমানদের সহমর্মিতা, করুণা এবং গরিবের প্রতি সমবেদনা শিক্ষা দেয়। আর এর প্রত্যেকটিই ইসলামী সমাজের অংশ।
তথ্য সূত্র
১. আল কুরআন, ২: ১৮৩
২. আল হাদীস, ইবনে মাজাহ: ১৭১৪
8. Harderwijk, Rudz, The Eight Mahayana Precepts, Viewonbuddhism.org
9. Nyung Ne, Drepung.org
10. Nyungne Retreat with Lama Dudjom Dorjee, Ktcdallas.org
11. Ph.D, Randi Fredricks, Fasting: An Exceptional Human Experience
12. Bowker, John. Oxford Concise Dictionary of World Religions. Oxford: Oxford
University Press, 2000.
13. Haas, Elson M. Staying Healthy with Nutrition: The Complete Guide to Diet
and Nutritional Medicine. Berkeley, CA: Celestial Arts, 2000.
14. Jewish Encyclopedia, Vol.5, p.347-9.
15. Welsh, John W. Fasting in Earliest Christianity”. Insights (a publication of
FARMS), Vol.21, No. 9, 2001.
১৬. প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান, জীব বিজ্ঞান প্রথম পত্র (একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত, হাসান বুক হাউস, ঢাকা।
১৭. প্রবোধন, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ধর্মীয় দৃষ্টিতে রোযার (সংযমের) গুরুত্ব, মু. ইদরীস আলী খান, রামকৃষ্ণ মঠ, ২৭ রামকৃষ্ণ মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩, পৃষ্ঠা ১৬-১৮
১৮. আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট- মাহফুজুর রহমান আখতারী, দিল্লী
১৯. দাস্তানে গান্ধী
2 Comments
রোজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
পরে ভালো লগলো
What a beauty explanation about Fasting!