Cancel Preloader

বিশ্বের সকল ধর্ম মানবতা শিক্ষা দেয়


ড. সৈয়দ মেহেদী হাসান
পৃথিবীর সকল ধর্মেই মানবতার দর্শন নিহিত। যুগে যুগে ধর্ম প্রবর্তকগণ সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার কথা বলেছেন। স্রষ্টাকে ভালোবাসতে হলে প্রথমে তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। ধর্মের মূলেই রয়েছে প্রেম। কারণ যিনি সৃষ্টিজগতের মালিক, তিনি প্রেমের কারণেই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- “আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার, নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম, তাই জগৎ সৃজন করলাম।” (সিররুল আসরার, পৃ. ১০) অন্যত্র বিশ্ব নবী হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “তুমি যদি সৃষ্টজীবকে ভালোবাস, তাহলে ঊর্ধ্বলোকের মহান স্রষ্টা তোমাকে ভালোবাসবেন।” (তাফসীরে তাবারানী)


পৃথিবীর সকল ধর্মেই মানব প্রেমের কথা ব্যক্ত হয়েছে। সৃষ্টজীবের প্রতি ভালোবাসার জন্য মানবতার মূর্ত প্রতীক বিশ্ব নবি হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘‘সকল সৃষ্টজীবকে আল্লাহর একই পরিবারভুক্ত মনে করবে।’’ তাঁর সৃষ্টজীবকে যে ভালোবাসে সেই তাঁর প্রিয়। তিনি আরো বলেন, ‘‘মানবের সেবা আল্লাহরই সেবা।’’ প্রকৃতপক্ষে স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণই ইসলাম। যিনি তাঁর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পেরেছেন, তিনিই হৃদয়ে সত্যিকার শান্তি উপলব্ধি করে মুসলমান হতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- “সেই ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলমান যার হাত এবং জবান থেকে অন্য যে কোনো ব্যক্তি নিরাপদ।” (বোখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ পৃষ্ঠা ১২)


সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান বলেন, “মানব সেবার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব।”
কিন্তু আমরা আজ পৃথিবীতে প্রেম ভালোবাসা থেকে দূরে সরে গিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা, ধর্মান্ধতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহে ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এমনকি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলকে কলুুষিত করে ফেলেছি।
এই অবস্থাদৃষ্টে বিখ্যাত দার্শনিক কবি ম্যাক্সিম গোর্কি যথার্থই বলেছেন: “মানুষ আজ পাখির মতো আকাশে উড়তে, মাছের মতো পানিতে সাঁতার কাটতে শিখেছে, কিন্তু শিখেনি তার নিজ আবাস মাটির পৃথিবীতে শান্তিতে বাস করতে।”
কোনো সমাজে সনাতন মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নতুন মূল্যবোধের শূন্যতায় দুর্নীতির ব্যাপক প্রাদুর্ভাব, প্রবীণদের হতাশা ও তরুণদের লক্ষ্যহীনতা নিঃসন্দেহে মারাত্মক। বলাবাহুল্য, এ সংকট যে কোনো বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক সংকটের চেয়ে বেশি আশঙ্কাজনক। কারণ, কোনো জাতির অর্থনীতি ভেঙে পড়লে তাকে সহজেই পুনর্গঠিত করা যায়। কিন্তু নীতিবোধ ও মূল্যবোধের অবহেলা ও অবমাননা প্রসূত মানবীয় সংকট থেকে উত্তরণ লাভ তেমন সহজসাধ্য নয়। বর্তমান মানবসংকট থেকে পরিত্রাণ লাভ, তথা মানবতার জন্য যথার্থ নিরাপত্তা ও দীর্ঘস্থায়ী সুখ নিশ্চিত করতে হলে শুধু প্রযুক্তি ও বস্তুবিজ্ঞানে গবেষণা করলেই চলবে না, একই সঙ্গে ব্রতী হতে হবে মানুষের স্বরূপ সন্ধানে, তার সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও নান্দনিক সত্তা গবেষণায়।


এই প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন ব্যতীত যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।”
আপন প্রয়োজনেই মানুষকে আজ গভীরভাবে ভাবতে হবে তার নিজেকে নিয়ে, অন্ন-বস্ত্র-ভিটামিন অনুসন্ধানের সাথে সাথে তাকে অনুসন্ধান করতে হবে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও সুনীতির স্বরূপ। কারণ এসব মূল্যবোধের চর্চা ও অনুশীলন ব্যতিরেকে নিছক বিষয়-সম্পদ মানুষকে যথার্থ মানবোচিত জীবনের সন্ধান ও মর্যাদা দিতে পারে না।
মানবতাবাদ সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা নিজেদের জন্য যা প্রত্যাশা করো, তা অন্যদের জন্যও প্রত্যাশা করো, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কেউই প্রকৃত বিশ্বাসী নও।’’ ইসলাম বর্ণ সাম্যের উপর জোর দেয় এবং এই ধর্মে বিভিন্ন বর্ণের লোকদের উল্লেখযোগ্য সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। সাম্যবাদ ইসলাম ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বামী বিবেকানন্দ ইসলামের এই সাম্যবাদের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। তিনি বলতেন, ‘‘বেদান্তের অদ্বৈতবাদে যত উচ্চস্তরের সাম্য চিন্তা থাক না কেন, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইসলামে যেভাবে এই চিন্তা কার্যকর হয়েছে হিন্দুধর্মে তা হয়নি।’’ তাই স্বামীজির আশা বেদান্তের মস্তিস্ক (তত্ত্ব) ও ইসলামের দেহ (সামাজিক সংহতি), এই উভয়ের সমন্বয়ে সমাজ গড়ে উঠলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

মানবতা বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মের মূল্যায়ন নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
ইসলাম ধর্ম (Mohammadi Islam): বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করো, চিন্তা ও কার্যে পবিত্র থাকো, বিপদে ধৈর্য অবলম্বন করো, অহংকার ও ক্রোধ হতে দূরে থাকো। মানবের সেবা আল্লাহরই সেবা। তুমি যদি সৃষ্টজীবকে ভালোবাস, তাহলে ঊর্ধ্বলোকের মহান স্রষ্টা তোমাকে ভালোবাসবেন। (তাফসীরে তাবারানী) সকল সৃষ্টজীবকে আল্লাহ একই পরিবারভুক্ত মনে করবে। তাঁর সৃষ্টজীবকে যে ভালোবাসে সেই তাঁর প্রিয়।
ইসলাম যে প্রকৃতি ও মানবতার ধর্ম- এ সম্পর্কে প্রয়াত দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মন্তব্য করেছেন যে, ইসলামকে বলা হয় মানবতার ধর্ম। ইসলাম গোড়াতেই মানব জীবনের সবগুলো দিককে স্বীকার করে নিয়েছে বলে ইসলামকে বলা হয়েছে মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। মানব প্রকৃতির অনুকূলেই তার ভিত্তি গড়ে উঠেছে বলে মানুষের নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন- সদ্যোজাত শিশু সত্য ধর্মেই জন্ম নেয়- তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, ক্রিশ্চিয়ান বা সিরিয়ান করে তোলে।… ইসলামকে স্বাভাবিক ধর্ম বলতে একটি কুয়াশার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ প্রকৃতিবাদ (Paganism)-ও স্বাভাবিক ধর্ম বলেই দাবি করে। প্রকৃতির বিভিন্ন দিকের সঙ্গে একাত্ম হওয়া প্রকৃতিবাদীদের অর্থে স্বাভাবিক ধর্ম নয়। আবার স্বাভাবিক ধর্ম বলতে যদি মনে করা হয়, মানব জীবনের কোনো স্বাভাবিক বৃত্তির অনুশীলন, সে অর্থেও ইসলাম স্বাভাবিক ধর্ম নয়। ইসলাম বলতে মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের পথে সহায়ক ধর্মই বুঝতে হবে।
দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কাছে যদিও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষায় মানবতা তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে, তবু অন্যান্য ধর্ম, এমনকি দার্শনিক মতবাদেও মানবতার গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। তাঁর কথায় : ‘‘মানবতা এ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বলে সকল ধর্মেই স্বীকৃত। সকল ধর্মেই এ বিশ্বচরাচরে মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ আসন দান করা হয়েছে। এ প্রত্যয় কেবল প্রত্যেকটি ধর্মেই বর্তমান নয়, সকল দার্শনিক মতবাদেও পরোক্ষে স্বীকৃত।’’


মানবকিতার প্রসঙ্গে বার্নার্ড শ’ বলেছিলেন, তাকে কোনো ধর্ম বেছে নেওয়ার কথা বলা হলে তিনি নিশ্চিতভাবে ইসলাম ধর্ম বেছে নিতেন। কারণ এই ধর্ম মানবিক মহত্ত্বে ভরা। একই কথা বলেছেন মানবতাবাদী দার্শনিক এম. এন. রায় তার ‘মানব সভ্যতায় ইসলামের অবদান’ বইতে। তিনি ধর্ম ও ইজম প্রচারে শক্তি প্রয়োগ সম্পর্কে তার একটি ভাষণে ইসলাম প্রসঙ্গে বলেছেন, ইসলাম ধর্মের প্রচারক সম্পর্কে একটি কথা অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলতে হয় যে, তিনি তার গোত্র কোরাইশদের দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হওয়া, এমনকি তার জীবনের উপর বারংবার হামলা হওয়া সত্ত্বেও কখনো আত্মরক্ষা বা ধর্মপ্রচারের জন্য সন্ত্রাস, খুন, জখম, ধর্ষণের পন্থা গ্রহণ করেননি। তিনি ধর্মের জন্য, একটি নতুন সমাজ গঠনের জন্য সাহাবিদের নিয়ে সেনাবাহিনী গঠন করেছেন, নিজে সেনাপতি হয়ে যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু সন্ত্রাসের আশ্রয় নেননি।


মহানবির সমসাময়িক ইহুদি পণ্ডিতদের অনেকেই ইসলামের বিরোধিতা করেও হযরত রাসুল (সা.)-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি একটি বিজয়ী বাহিনী কোনো যুদ্ধে জয়ী হয়ে বিজিত দেশটিতে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়নি। একটি বিরাট ব্যতিক্রম মোহাম্মদের (সা.) যুদ্ধ। তিনি মক্কার কোরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কোনো প্রকার সন্ত্রাসের আশ্রয় নেননি। তিনি মদিনার খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের ডেকে সমনাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে (ঐতিহাসিক মদীনা চুক্তি) মক্কার কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন; কিন্তু মক্কায় সন্ত্রাসী পাঠিয়ে গুপ্তহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ দ্বারা প্রতিপক্ষকে নিপাত করার পন্থা গ্রহণ করেননি। একজন ইহুদি পন্ডিত লিখেছেন, মুহাম্মদ (সা.) মক্কাবিজয়ের পর বিজয়ী মুসলিম সৈন্যরা অতীতের গ্রিক ও রোমান সৈন্যদের পন্থা অনুসরণ করে শহরটিতে কী ঘটাতে পারতো, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। কিন্তু মহানবি (সা.) মক্কায় প্রবেশ করেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কায় এক ব্যক্তিও খুন হয়নি, একটি নারীও ধর্ষিত হয়নি।

হিন্দুধর্ম (Hinduism): ‘‘কারো সাথে এমন কিছুই করো না, যা তোমার সাথে করা হলে তুমি দুঃখ পেতে। এই হচ্ছে দায়িত্ব সমষ্টি।’’ (মহাভারত-৫:১৫১৭) হিন্দুধর্ম মতে অহিংসার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। কেবল খাদ্য বা মৃগয়ার উদ্দেশ্যে প্রাণী বধ হতে বিরত থাকা নয়, ‘অহিংসা’ অর্থ সর্বভূতের (মানুষ, পশু বা হীনতর প্রাণী), প্রত্যেকের প্রতিই শত্রুভাব, এমনকি ঘৃণাভাব ত্যাগ করা, শারীরিক বা মানসিক পর্যায়ে কারো অনিষ্ট ত্যাগ করা। সুতরাং যিনি অহিংসা সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন, তিনি নির্বৈর বা শত্রুহীন হন। হিন্দুধর্ম মতে, এই অহিংসা বেদান্তের নিগূঢ় তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। যদি পরমাত্মা সর্বভূতে থাকেন এবং এ সমদর্শন উপলব্ধ হয়, তখন এটাও বুঝা উচিত যে, অপর কোনো জীবকে হত্যা বা হিংসা করার অর্থ নিজের আত্মাকেই হিংসা করা। অপরদিকে, অহিংসা কেবল দ্বেষহীন তাই নয়, এর থেকে উপজাত হয় আরো দুটি স্বতন্ত্র গুণ, মৈত্রী ও করুণা। অপরদিকে, অহিংস ব্যক্তির দেহাত্মবোধ নেই, সুতরাং শত্রু-মিত্রভেদ জ্ঞানও নেই। তিনি সকলের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন এবং সকলের দুঃখে সমব্যথী। নব্য যুগে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রবক্তা স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, জীব সেবার চেয়ে আর ধর্ম নেই।

খ্রিষ্টধর্ম (Christianity): ‘‘সবকিছুর মধ্যে অপরের কাছ থেকে তোমরা যে ব্যবহার প্রত্যাশা করো, তাদের প্রতিও তেমনি ব্যবহার করো; কারণ এটাই বিধান এবং নবিগণের শিক্ষা।’’ (যিশু ম্যাথু-৭:১২) সূর্য যেমন সব জায়গাতেই কিরণ দেয়, বৃষ্টিধারা যেমন সবকিছুতেই সিঞ্চিত করে, তুমিও তেমনই ভেদাভেদ না করে সবাইকে সমান ভালোবাসবে। কারও উপর প্রতিশোধ নিতে যেও না। কেউ যদি তোমার এক গালে চড় মারে, তাকে আর একটি গাল ফিরিয়ে দিও। যারা সবার শান্তি কামনা করে, তারাই ঈশ্বরের প্রকৃত সন্তান। শক্রকেও ভালোবাসবে। যারা তোমার নিন্দা করে, তাদেরও তুমি উপকার করবে। যারা তোমার উপর অন্যায় অত্যাচার করে, তাদের ভালোর জন্যও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। তোমরা যারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করছ ও অতিরিক্ত ভারে আক্রান্ত, তারা সকলে আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের শান্তি দেব। তোমরা সত্যের স্বরূপ জানবে এবং সত্যই তোমাদের মুক্তি এনে দেবে। দরিদ্রকে যে খাওয়ায়, সেই অন্ন ভগবানের উদ্দেশেই নিবেদিত হয়। বস্ত্রহীনকে যে বস্ত্র দেয়, সে- বস্ত্র ভগবানের কাছেই যায়। ধনের লোভ করো না। ঈশ্বর এবং ধন দুই দিকে মন দিও না।

বৌদ্ধধর্ম (Buddhism): কারো সাথে এমনভাবে আচরণ করো না, যা তোমার নিজের কাছে বেদনাদায়ক মনে হতে পারে। (উদার-বর্গ ৫:১৮)
যে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে পেরেছে, শান্তি এবং সত্যকে লাভ করেছে, সেই সুখী। তোমার দুঃখের কারণ যাই হোক না কেন, অপরকে আঘাত করো না। অপরের প্রতি শুভেচ্ছা প্রকাশই ধর্ম। সর্বপ্রাণীর প্রতি অন্তরে অসীম মৈত্রী পোষণ করো। সকলেই সুখ চায়, অতএব, সকলের প্রতি করুণা প্রদর্শন করো। দ্বেষের (হিংসা) দ্বারা দ্বেষকে জয় করা যায় না। একমাত্র ভালোবাসাতেই দ্বেষকে জয় করা যায়। এটাই চিরাচরিত নিয়ম।
দার্শনিক গোবিন্দ দেব বলেছেন- বর্তমান জগৎ ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ও দ্বিধা বিভক্ত। একদিকে বিজ্ঞানের বৈজয়ন্তী, অন্যদিকে বিজ্ঞান আবিষ্কৃত মারণাস্ত্রের দ্বারা মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ভু-লুণ্ঠিত হওয়ার পথে। বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। ধর্মের অপব্যবহার, কলুষিত রাজনীতি, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ মানুষের জীবনকে করেছে বিপর্যস্ত। এরূপ অবস্থায় দেবের প্রত্যাশা ধর্ম ও বিজ্ঞানের মহামিলন জড়বাদ ও অধ্যাত্মবাদের সমন্বয়। অন্য কথায় বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি মানবজীবনের নিয়ন্ত্রণকারী বিষয়গুলোকে মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গড়ে তুলতে হবে, দিতে হবে একটি মানবিক রূপ, যা হবে সমস্ত প্রকার সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত, বিশ্ব-মানবপ্রেম ও মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ ও উৎসর্গিকৃত। খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইসলাম-সহ বিভিন্ন ধর্ম এই মানবেরই জয়গান। আর বহুপূর্বে এই মানুষের জয়গান গেয়েছেন, মানুষকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা ও ঐক্যের সুর প্রদান করেছেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ।

কনফুসিয়াস ধর্ম (Confucianism): একটি শব্দ বা সকল ভালো আচরণের ভিত্তিকে তুলে ধরে.. প্রেমময় দয়া; যা তুমি চাও না নিজের সাথে ঘটুক, তা তুমি অন্যের সাথে করো না। (কনফুসিয়াস, সম্পাদিত কথোপকথন- ১৫:২৩) আরও বলছেন- লোকের হৃদয় যদি জয় করতে চাও, উদার হও। লোকের বিশ্বাস পেতে চাও তো সত্যবাদী হও। লোকের শ্রদ্ধাভাজন হতে চাও তো আত্মমর্যাদা হারিও না। বিদ্বেষহীনতার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন- সেই মানুষটিই কি খাঁটি দার্শনিক নয় যে জীবনে পরিচিতি না পেলেও মনে কোনো বিদ্বেষ পোষণ করে না?

তাওবাদ (Taoism): উদার মানবিক ভালোবাসা প্রসঙ্গে বলে- তোমার প্রতিবেশীর উন্নতিকে বিবেচনা করো তোমার নিজের উন্নতি হিসেবে এবং তোমার প্রতিবেশীর ক্ষতিকে বিবেচনা করো তোমার নিজের ক্ষতি হিসেবে। (ত’আই শ্যাংক্যান ঈং পি’য়েন, ২১৩-২১৮)
জীবন কখনো সরল রেখায় এগিয়ে চলে না অথবা কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধেয়ে যেতে পারে না। জীবন তার চলার পথে বাঁক নিয়ে চক্রবৎ ফিরে আসে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখানেই। এই পথ চলার মাঝে আমাদের মধ্যে যে-বোধ গভীরভাবে জেগে ওঠে তা হচ্ছে, ‘সমস্ত মানুষই এক এবং মহান।’

শিখ ধর্ম (Sikhism): মানবিকতা প্রসঙ্গে বলে: আমি কারো কাছেই একজন অপরিচিত ব্যক্তি নই এবং কেউই আমার কাছে অপরিচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে আমি সকলেরই বন্ধু। (গ্রন্থসাহেব, পৃ. ১২৯৯) আরও আছে: তোমার অন্তরে রয়েছে ঈশ্বর, তাঁকে অন্যত্র খুঁজছ কেন? সবার ওপরে সত্যের স্থান। কিন্তু সত্যজীবন আরও ওপরে। যিনি সকলের মাঝে সেই পরম পিতাকে দেখতে পান তিনিই ধার্মিক। পার্থিব সকল প্রলোভনের মাঝে থেকেও যিনি শুদ্ধচিত্ত, তিনিই ধর্মের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব উপলব্ধি করেছেন। সততা হোক তোমার এবং সংযমের পোশাকে ভূষিত হয়ে সত্যের তলোয়ার ও ঢাল নিয়ে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হও তুমি।
গুরুনানক বিশ্বের সকলকে শান্তির বার্তা এবং ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ধর্মের ভিতরে কুসংস্কারকে দূরীভূত করেছেন। তিনি মানুষকে পবিত্রতা, ন্যায়বিচার, উত্তম কর্ম এবং ঈশ্বরকে ভালোবাসার শিক্ষাই দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, মানবতার সেবা প্রদানের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জন করতে হয়।

খ্রিষ্টিয় একেশ্বরবাদ (Unitarianism): ঘোষণা করে- সকল অস্তিত্বের আমরা যার একটি অংশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতার সম্মান আমরা ঘোষণা করি এবং প্রচার করি। –একেশ্বরবাদ মূলনীতি।

জরোথুস্ত্র (Zoroastrianism): যা কিছুই তোমার নিজের প্রতি ক্ষতিকর, তা অন্যের প্রতি করো না। (শায়াস্ত-না-শায়াস্ত, ১৩:২৯) আমাদের বর্তমান জীবন, ভবিষ্যৎ জীবনের একটি প্রাথমিক স্তরমাত্র; এটি উচ্চতর জীবনের অধিকার লাভের একটি তীর্থযাত্রা। গতকাল আর ফিরে পাওয়া যায় না। আগামীকাল আমরা নাও দেখতে পারি। শুধু আজকের দিনটি আমাদের অধীনে। তাই আজকের দিনটিকে আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। জগতে যখনই অশান্তি ও সমস্যা দেখা যায়, অহুর মজদা তখনই মানবজাতিকে দেবত্বের পথে পরিচালিত করতে তাঁর বিশেষ দূতকে পাঠান।

জৈনধর্ম (Jainism): মানবতার প্রসঙ্গে বলে- পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির প্রতি একজন ব্যক্তির সেরূপ আচরণ করা উচিত, যেরূপ আচরণ সে নিজের প্রতি প্রত্যাশা করে। (মহাবীর, সূত্রকৃতঙ্গ) যাকে তুমি মারতে চাইছ, সে তুমি ছাড়া আর কেউ নয়, আবার যাকে তুমি দাসের মতো তোমার কর্তৃত্বাধীন রাখতে চাইছ, সেও তুমি ছাড়া অন্য কেউ নয়। যে কোনো প্রাণী হত্যা আত্মহননই বটে, আবার জীবের প্রতি করুণা প্রদর্শন নিজের প্রতিকরুণা প্রদর্শন ছাড়া কিছু নয়। প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর চেয়েও নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি ও দ্বেষ (হিংসা) মানুষের বড়ো শক্র।


পরিশেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের সকল ধর্মই মানবতার কথা বলে। পৃথিবীতে দশ হাজার ধর্ম রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান ধর্ম ও দর্শনের প্রত্যেকটিতেই মানবতা নিহিত রয়েছে। তাই যুগে যুগে আল্লাহ প্রেরিত মহামানবগণ তাঁদের ঐশী দর্শনের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করেছেন এবং তারা হয়েছেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। যাদের দ্বারা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. ড. প্রদীপ রায়, ঐতিহ্যের ত্রিশ বছর: উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র ১৯৮৪-২০১৪, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, পৃষ্ঠা ১৫০-১৫১
২. জগতের ধর্মমত, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্ক, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৮০
৩. আনিসুজ্জামান, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ: একজন অসাম্প্রদায়িক ইসলামী চিন্তাবিদের প্রতিকৃতি; দর্শন ও প্রগতি : ২৩ বর্ষ : ১ম ও ২য় সংখ্যা : জুন-ডিসেম্বর, ২০০৬
৪. সূফী সম্রাট স্মরণিকা, ২০১৩, তাসাউফ পাবলিকেশন্স, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০
৫. মালবিকা বিশ্বাস, গোবিন্দ দেবের দৃষ্টিতে গৌতমবুদ্ধ ও তাঁর দর্শন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় পত্রিকা, সংখ্যা-৮৮, জুন ২০০৭
৬.www.notablebiographies.com/Co-Da/Gurunanak.html
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক]

সম্পর্কিত পোস্ট