মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘মুক্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে লেখাটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক
অলী-আল্লাহ্গণের পরিচয়
‘অলী-আল্লাহ” আরবি শব্দ। অভিধানে শব্দটির অর্থ দেওয়া হয়েছে- আল্লাহর বন্ধু, আল্লাহ্ওয়ালা। এটি এক বচন, বহু বচনে আওলিয়াউল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধুগণ। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন- “আলা ইন্না আওলিইয়াআল্লাহি লা খাওফুন ‘আলাইহিম ওয়ালা হুম ইয়াহঝানূন।” অর্থাৎ- “জেনে রেখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৬২)
যিনি গভীর সাধনার মাধ্যমে আপন অন্তরের কালিমা দূর করে অন্তরকে আল্লাহর নুর দ্বারা আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছেন, নিজের ভিতরে আল্লাহর পরিচয় লাভ করত আল্লাহর চরিত্রে নিজেকে চরিত্রবান করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই অলী-আল্লাহ্ বা আল্লাহর বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। এক কথায় অলী-আল্লাহর অন্তরে আল্লাহর সত্তা জাগ্রত অবস্থায় বিরাজ করেন। এজন্য তাঁকে দেখলে বা তাঁর সান্নিধ্যে আসলে আল্লাহর প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর স্মরণে মানুষের আগ্রহ জন্মে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “মহান আল্লাহ্ বলেছেন- নিশ্চয় আমার বান্দাদের মধ্যে অলী-আল্লাহ্ হলো তাঁরা, আমাকে স্মরণ করলে যাঁদের কথা স্মরণ হয় এবং যাঁদেরকে স্মরণ করলে আমার কথা স্মরণ হয়।” (তাফসীরে মাজহারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৮) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- “আরজ করা হলো- হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! অলী-আল্লাহগণ কারা? তিনি বললেন- যাঁদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয় (তথা আল্লাহর প্রেমের ফায়েজ পাওয়া যায়)।” (তাফসীরে দুররে মানছুর, ১১নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৭০) এমনিভাবে ইমাম বগভী (রহ.) উল্লেখ করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে- “একদা রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো- অলী-আল্লাহ্ তথা আল্লাহর বন্ধু কারা? জবাবে তিনি বললেন- “যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়।” (তাফসীরে মাজহারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৮)
পৃথিবীতে তিন শ্রেণির অলী-আল্লাহ্ বিদ্যমান। যথা- ১। হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহ্। ২। মাজ্জুব শ্রেণির অলী-আল্লাহ্। ৩। দেশরক্ষক শ্রেণির অলী-আল্লাহ্।
যে সকল অলী-আল্লাহ্ নিজে সাধনা করে, আল্লাহর পরিচয় লাভের পর অন্য লোককে এই পদ্ধতি শিক্ষা দানের জন্য আল্লাহ্ কর্তৃক দায়িত্ব প্রাপ্ত হন, তিনি হাদি শ্রেণির অন্তর্গত। তিনি সাধারণ মানুষের মুক্তির দিশারি এবং পাপ মোচনের উপলক্ষ্য। আল্লাহ্ বলেন- “আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে এমন একদল আছে, যারা সত্য পথ দেখায় এবং সেই অনুযায়ী ন্যায় বিচার করে।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭ : আয়াত ১৮১) এ প্রসঙ্গে সুমহান আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন- “আর প্রত্যেক সম্পদায়ের জন্য আছে হাদি, অর্থাৎ পথপ্রদর্শক অলী-আল্লাহ।” (সূরা আর রা‘দ ১৩: আয়াত ৭)
মাজ্জুব শব্দের অর্থ আল্লাহর এশকে দেওয়ানা বা পাগল। যে সকল অলী-আল্লাহ্ আল্লাহর প্রেম সাগরে এমনভাবে ডুবে থাকেন যে, দুনিয়ার কোনো বিষয়ের প্রতি তিনি আর ফিরে তাকান না, তিনি মাজ্জুব শ্রেণির অন্তর্গত। মানুষের কাছে পাগল বলে গণ্য হলেও, আল্লাহর কাছে তারা বন্ধুর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এ শ্রেণির অলী-আল্লাহ দিব্যদৃষ্টিতে আল্লাহর রূপ উপভোগ করে থাকেন এবং ঐ রূপেই বিভোর থাকেন। এজন্য দুনিয়ার অন্য সকল কিছুর প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন। তাঁদের প্রসঙ্গে হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমি কি তোমাকে জান্নাতের বাদশাহদের সম্পর্কে অবহিত করব না? আমি বললাম- হাঁ। তিনি বললেন- দুর্বল লোকদের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা নি¤œস্তরের এবং দুটো ছিন্ন বস্তু পরিহিত ব্যক্তি, যাকে হিসাবে গণ্য করা হয় না। সে যদি আল্লাহর নামে কোনো শপথ করে, তা অবশ্যই আল্লাহ সত্যে পরিণত করেন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ৩০৩: ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে ইবনে মাজাহ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫৮, হাদীস নং ৪১১৫)
দেশরক্ষক অলী-আল্লাহর কাজ অনেকটা দেশের সেনাবাহিনীর মতো। যে সকল অলী-আল্লাহ্ আল্লাহর নির্দেশে সৃষ্টিজগত পরিচালনার বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন, তাঁরা এই শ্রেণির অন্তর্গত। তাঁদের প্রসঙ্গেই আল্লাহ বলেন- “তিনি তাদের ক্বালবে ইমান সুদৃঢ় করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন, তাঁর পবিত্র রুহ দ্বারা। তিনি তাদেরকে বেহেশতে দাখিল করবেন, যার নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হয়, সেখানে তাঁরা অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁরাই আল্লাহর বাহিনী। জেনে রেখো, আল্লাহর বাহিনীই সফলকাম হবে।” (সূরা আল মুজাদালাহ ৫৮: আয়াত ২২)
উল্লেখ্য যে, হাদি শ্রেণীর অলী-আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য অলীগণ যেমন- মাজ্জুব ও দেশরক্ষক অলী-আল্লাহ, সাধারণত হিদায়েতের কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। এজন্য মানুষকে আল্লাহ প্রাপ্তির সঠিক পথের সন্ধান পেতে হলে একমাত্র হাদি শ্রেণির অলী-আল্লাহর নিকট যেতে হয়।
নবি ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য
নবি অর্থ সুসংবাদদাতা। শব্দটি এক বচন, বহুবচনে আম্বিয়া বলা হয়, এর অর্থ পয়গম্বরগণ, সুসংবাদদাতাগণ। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে মহাকালের অবিরাম যাত্রায় যখন যে নবির আগমন ঘটেছে, তখন আল্লাহর নামের সাথে সমকালীন যুগের সেই নবির নাম সংযুক্ত করে, কালেমা পড়ে তৎকালীন যুগের মানুষকে ইমানদার হতে হয়েছে এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমলের মাধ্যমেই তাদের মুক্তির বিধান হয়েছে। নবিগণের যুগে তাঁদের কালেমা ও শিক্ষা পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও, মানুষকে হিদায়েত করা, অর্থাৎ আল্লাহর পথের সন্ধান দেওয়াই ছিল তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। একই মানবগোষ্ঠীর কাছে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নবি আবির্ভূত হয়ে এটিই প্রমাণ করেছেন, কিতাব মানুষকে হিদায়েত করতে পারে না; বরং হিদায়েতের জন্য অনুসরণযোগ্য আদর্শবান ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ মহামানব প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে হযরত যিয়াদ ইবনে লবীদ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একদা আল্লাহর রাসুল (সা.) একটি বিষয় আলোচনা করছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন- “এটি এলেম বিলুপ্ত হওয়ার সময় সংঘটিত হবে। তখন আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এলেম কী করে বিলুপ্ত হবে? অথচ আমরা নিজেরা কুরআন শিক্ষা করছি এবং আমাদের সন্তানদেরও শিক্ষা দিচ্ছি। অতঃপর আমাদের সন্তানগণ তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষা দিতে থাকবে, এভাবে (বংশপরম্পরায়) কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- যিয়াদ! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক। এতদিন তো আমি তোমাকে মদীনার একজন জ্ঞানী লোক বলেই মনে করতাম। (তুমি কি লক্ষ্য করনি?) এই ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্পদায় কি তাওরাত ও ইনজিল কিতাব পড়ছে না? অথচ এ কিতাবের মর্ম অনুযায়ী তারা কর্ম করে না।” (মুসনাদে আহমদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, তিরমিযী ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৮)
এজন্য সর্বশেষ নবি ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.) প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- “যারা অনুসরণ করে এমন রাসুলের, যিনি নিরক্ষর তথা কালির অক্ষরের জ্ঞান থেকে পবিত্র নবি, যাঁকে তারা লিখিত পায় নিজেদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইনজিলের মধ্যে, যিনি তাদের নেক কাজের আদেশ দেন এবং নিষেধ করেন মন্দ কাজে, যিনি হালাল করেন তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু এবং হারাম করেন অপবিত্র বস্তু এবং অপসারিত করেন তাদের থেকে সে গুরুভার ও শৃঙ্খল, যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি ইমান এনেছে, তাঁকে সম্মান করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে সে নুর বা আলোর, যা তাঁর সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, এরূপ লোকেরাই প্রকৃত সফলকাম।” (সূরা আল আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৫৭)
হযরত রাসুল (সা.) হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি। তাঁর আগমনের মাধ্যমে নবুয়তের যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। অর্থাৎ তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবি আসবেন না। কিন্তু এও সত্য, বিভিন্ন যুগে হিদায়েতের জন্য যোগ্য ব্যক্তির প্রয়োজন রয়েছে। অলী-আল্লাহ্গণ হচ্ছেন ঐ যোগ্য মহামানব। অর্থাৎ তাঁদের মাধ্যমে হিদায়েতের কাজ পরিচালিত হয়ে আসছে। এ হিসেবেই তাঁরা নবিগণের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “ইন্নাল ‘উলামাআ ওয়ারাছাতুল আনবিইয়াই।” অর্থাৎ- “নিশ্চয় আলেমগণই তথা আল্লাহ্ তত্তে¡র জ্ঞানে জ্ঞানী অলী-আল্লাহ্গণই নবিগণের ওয়ারিস তথা উত্তরসূরি।” (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৪) অলী-আল্লাহ্গণ সাধনার মাধ্যমে আপন অন্তরে আল্লাহর পরিচয় লাভ করেন এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা পদ্ধতির আলোকে সমকালীন যুগের মানুষদের আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ প্রদর্শন করেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায় তাঁদেরকে মোর্শেদ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে- “ওয়ামাইয়্যুদ্ধলিল ফালান তাজিদা লাহু ওয়ালিইয়্যাম মুরশিদা।” অর্থাৎ- “আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোনো (মোর্শেদ বা) পথপ্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবেন না।” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ১৭)
বেলায়েতের যুগে অর্থাৎ শেষ নবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পর অলী-আল্লাহ্গণই নবির হিদায়েতের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। নবিদের নিকট আল্লাহর যে নির্দেশ প্রেরিত হতো, সেটিকে ওহি বলা হতো। পক্ষান্তরে অলী-আল্লাহ্গণের নিকট যে নির্দেশ প্রেরিত হয়, সেটিকে এলহাম বলে। আর এ এলহাম সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন- “কসম মানুষের নফ্সের এবং তাঁর, যিনি তাকে সুঠাম করেছেন। অতঃপর মন্দ কর্ম ও সৎকর্মের বিষয়টি তার অন্তরে এলহাম করেছেন।” (সূরা আশ শামস ৯১: আয়াত ৭ ও ৮)
নবিগণ যেমন ছিলেন আল্লাহর মনোনীত বিশেষ ব্যক্তি, হিদায়েতকারী অলী-আল্লাহ্গণও ঠিক তেমনি আল্লাহর মনোনীত বিশেষ ব্যক্তি। এমনিভাবে নবুয়ত ও বেলায়েত সর্বযুগেই মহান আল্লাহ্ তাঁর মনোনীত এ সকল বিশেষ ব্যক্তির দ্বারা জগতে হিদায়েতের কার্যক্রম চালু রেখেছেন। এজন্য যে কোনো মানুষ সাধনা করে এ দায়িত্ব লাভ করতে পারে না। (চলবে)
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ানবাগ শরীফ]