মহামানবগণের অবির্ভাব রহমতস্বরূপ
মুহাম্মদ জহিরুল আলম
মহান আল্লাহ্ নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলেন, তাই পরিচিত হওয়ার জন্য জগৎ সৃজন করলেন এবং তাঁর পরিচয় জগদ্বাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য মহামানব প্রেরণ করেন। তিনি পৃথিবীতে মানব জাতিকে হেদায়েতের জন্য হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের মাধ্যমে ৪টি আসমানি কিতাব অর্থাৎ তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল ও কুরআন এবং ১০০টি সহিফা নাজিল করেন। এ থেকে বুঝা যায়, শুধু মাত্র কিতাব বা সহিফাই যদি মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারতো, তাহলে মহান আল্লাহ্ পৃথিবীতে এত নবি-রাসুল পাঠাতেন না। মানুষ যখন পূর্ববর্তী কোনো নবির আদর্শ হারিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে, তখন নতুন নবি আবির্ভূত হয়ে মানুষকে মুক্তির সঠিক পথ দেখান। সমকালীন যুগের মানুষের একান্ত কর্তব্য ছিল, তাঁদের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা। তাঁদের বিধান মানাই ছিল ধর্ম। মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। আল্লাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষ যখন পথ হারিয়ে ফেলে, তখন মহামানবগণ পৃথিবীর পথহারা মানুষকে পরম স্রষ্টার সান্নিধ্যে নিয়ে আসেন। মহামানব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “আমার সৃষ্টির মাঝে একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা মানুষকে সৎ পথ দেখান এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭: আয়াত ১৮১) আল্লাহ্ তায়ালা মনোনীত এসকল মহামানবকে নবুয়তের যুগে বলা হতো নবি-রাসুল, আর বেলায়েতের যুগে বলা হয় অলী-আল্লাহ্। প্রকৃতপক্ষে, মহামানব বলতে নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্গণকে বুঝায়।
সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পর থেকে নবুয়তের যুগ সমাপ্ত হয়েছে, খুলে গেছে বেলায়েত বা বন্ধুত্বের দ্বার। এ যুগের মহামানব হলেন অলী-আল্লাহ্গণ। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই, আর তাঁরা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা ইউনুস ১০: আয়াত ৬২) নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্গণ দয়াল রাসুল (সা.)-এর ‘সিরাজুম মুনির’ হৃদয়ের মাঝে ধারণ করে সমকালীন যুগের মানুষকে হিদায়েত করেন। যুগের মহামানবগণের মঝে যিনি শ্রেষ্ঠ, তিনিই হলেন যুগশ্রেষ্ঠ মহামানব বা যুগের ইমাম। সর্বকালেই যুগের ইমাম খোদায়ি প্রশাসনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। হযরত মুসা (আ.) ছিলেন যুগের ইমাম। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন যুগের ইমাম। তেমনিভাবে হযরত নূহ (আ.), হযরত হুদ (আ.), হযরত সালেহ (আ.) যুগের ইমাম ছিলেন। বেলায়েতের যুগেও নুরে মোহাম্মদীর নুর বা সিরাজুম মুনির হৃদয়ে ধারণ করে যুগের ইমাম বা মোজাদ্দেদগণ সমকালীন যুগের মানুষকে আলোকিত করেছেন। এ কারণেই মহান আল্লাহ্ বেলায়েতের যুগে, যুগের ইমাম হিসেবে বড়ো পির মহিউদ্দিন হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.), পরবর্তীতে হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি আজমিরি (রহ.), হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশ্বন্দ (রহ.), হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.), ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর মতো মহামানবকে প্রেরণ করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় দয়াময় আল্লাহ্ বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী যুগের ইমাম সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানকে ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করে তোলার জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “নিশ্চয়ই মহাপরাক্রমশালী সম্ভ্রান্ত আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেক শতাব্দীর শিরোভাগে এ উম্মতের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিনি তাদের ধর্মকে সংস্কার করে সজীব ও সতেজ করবেন।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৬) মহান প্রভু সকল মহামানবকেই মানবজাতির শান্তি ও কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁদের শুভ আবির্ভাবে ত্রিভূবন আলোকিত হয়েছে, মানুষ পেয়েছে স্রষ্টার প্রেমের সন্ধান। হাদিস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে, “আল্লাহর রাসুল (সা.) কাবাঘরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- আল্লাহর নিকট মু’মিনের মর্যাদা তোমার মর্যাদার চেয়েও অনেক বেশি।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা ২৮২) জগদ্বিখ্যাত সুফিসাধক জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন, “সমস্ত আসমান ও জমিনের কোথাও আল্লাহর স্থান সংকুলান হয় না, একমাত্র মু’মেন ব্যাক্তির হৃদয়েই তাঁর সংকুলান হয়ে থাকে।” সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান বলেন, “মানুষ এলমুল ক্বালবের সাধনার মাধ্যমে নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে আত্মত্যাগের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন আল্লাহ্ তায়ালার বন্ধুতে পরিণত হয়, তখন তিনি আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব অর্জন করে মহামানবের মর্যাদা লাভ করেন।”
মহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-কে মানবজাতির জন্য সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর আগমনের দিন স্বয়ং মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। পৃথিবীতে যত নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্ এসেছেন সকলেই মানব কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “মহামানবগণের জন্ম, মৃত্যু ও পুনরুত্থান দিবস মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ।” যুগে যুগে মহামানবগণের আবির্ভাবই রহমত, বরকত ও কল্যাণের জন্য।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো: হযরত জাকারিয়া (আ.) ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)-এর বংশের একজন সম্মানিত নবি। তাঁর স্ত্রী বিবি ঈশাও ছিলেন একই পরিবারের বংশধর। তিনি বিবি মারইয়ামের খালু ছিলেন এবং তাঁর লালন-পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঘটনাক্রমে একদিন হযরত জাকারিয়া (আ.) বুঝতে পারলেন বিবি মারইয়াম নিঃসন্দেহে আল্লাহর অলী, তাঁর একান্ত প্রিয়ভাজন। সাথে সাথে তাঁর মনের ভিতর ভাবান্তর দেখা দিলো। তিনি ভাবলেন- যে মহান আল্লাহ্ অমৌসুমী ফল-ফলারি বিবি মারইয়ামকে সরবরাহ করেন, তিনি দয়া করে আমার বৃদ্ধ বয়সেও বন্ধ্যা স্ত্রীর গর্ভে আমার ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি দিতে সক্ষম। তিনি মারইয়ামের হুজরা শরীফে বসেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন- ‘‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে আপনার নিকট হতে পূতপবিত্র সন্তান দান করুন।’’ মহান আল্লাহ্ হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর প্রার্থনা কবুল করলেন এবং হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-কে দান করেন। বিবি মারইয়ামের হুজরা শরীফের পাশে (মুসলমানদের প্রথম কেবলা) বাইতুল মুকাদ্দাস থাকা সত্ত্বেও হযরত জাকারিয়া (আ.) বিবি মারইয়ামের হুজরা শরীফে বসেই প্রার্থনা করলেন। উল্লেখ্য, তিনি একজন নবি হয়েও বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদে প্রবেশ না করে পুত্রের জন্য প্রার্থনা করলেন বিবি মারইয়ামের হুজরা শরীফে বসে। হযরত জাকারিয়া (আ.)-এর এ কর্ম বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যেখানে মহান আল্লাহর দরবারে মহামানবগণের সম্মান ও মর্যাদা ফুঁটে উঠে। (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী, ১ম খণ্ড) মহামানবগণকে দয়াময় আল্লাহ্ শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির পথ নির্দেশক হিসেবে আমাদের জন্য দিয়েছেন, আর আমাদেরও কর্তব্য হলো তাঁদের শিক্ষা, আদর্শ ও চরিত্রকে হৃদয়ে ধারণ করে; তাঁদের ভালোবেসে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা। আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরমান, “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু সে তার যুগের ইমামের পরিচয় লাভ করতে পারেনি, সে জাহেলি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।” (মুসনাদে ইমাম জাফর সাদেক ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮ ও ৫১৯)
মহামানবগণ মোর্শেদরূপে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্ হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, “প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আমি হেদায়েতকারী পাঠাই।” (সূরা আর রা‘দ ১৩: আয়াত ৭) দয়াময় আল্লাহ্ আরো বলেন, “আমি রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না।” (সূরা বনি ইসরাঈল ১৭: আয়াত ১৫) মহামানবকে ছেড়ে দিয়ে ধর্ম পালন মূল্যহীন। সৃষ্টির শুরু হতে মহান আল্লাহ্ মানবজাতির মুক্তির জন্য মহামানব প্রেরণ করে মানুষকে মুক্তির পথে আহ্বান করেন, যুগে যুগে মহামানবগণের শিক্ষা ও আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করাই ছিল সমকালীন মানুষের ধর্ম। তাঁরা আলোকবর্তিকা হয়ে জগতকে আলোকিত করেছেন। মুক্তিকামী মানুষ তাঁদের নিকট নিজেকে সমর্পণ করে মুক্তির মোহনায় সামিল হয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে বিশ্বাসী বান্দারা! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো এবং আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য অসিলা অন্বেষণ করো।” (সূরা মায়েদা ৫: আয়াত ৩৫) বেলায়েতের যুগে অসিলা হলেন হিদায়েতের দায়িত্বে নিয়োজিত অলী-আল্লাহ্গণ।
সভ্যতার এ চরম ক্রান্তিলগ্নে দয়াময় আল্লাহ্ পথহারা মানবজাতির মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে এবং তাঁর পরিচয় জগদ্বাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ সম্পর্কে মানবজাতির ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করে আল্লাহর পরিচয় ও স্বরূপ প্রকাশ করার লক্ষ্যে তিনি ‘তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী’ তাফসীর শরীফ প্রণয়ন করেন। এখানে তিনি পবিত্র কুরআন ও মারফু হাদিসের আলোকে প্রমাণ করেন, “মহান আল্লাহ নিরাকার নন, তাঁর নুরের রূপ আছে।” স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাঁকে নিরাকার মনে করে, স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন মূল্যহীন। তাই তিনি স্রষ্টার অস্তিত্ব ও স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করে দেন। তিনি দয়াল রাসুল (সা.) সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত মত খণ্ডন করে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং ১৪০০ বছরে হারিয়ে যাওয়া দয়াল রাসুল (সা.)-এর মোহাম্মদী ইসলাম ও ধর্মের প্রকৃত সত্য মানবজাতির নিকট উপস্থাপন করেছেন। ইসলামের নামে পবিত্র কুরআন ও হাদিস বিরোধী যেসব বিধান মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে, তিনি তার সংস্কার করে যাচ্ছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য মানুষ যেন মহান আল্লাহ্ ও তাঁর হাবিবের সাথে যোগাযোগ করে ধর্ম পালন করতে পারেন। প্রতিদিন অগণিত মানুষ জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে বিপদে-আপদে, দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত হয়ে তাঁর শরণাপন্ন হয়ে শান্তির পরশ পাচ্ছেন। অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা মহান আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে সংঘটিত করে প্রমাণ করেছেন, যদি (আল্লাহ্)-কে পেতে চাও, তবে এই মহামানবের সংস্পর্শে আস। মহান আল্লাহ পূর্ণিমার চাঁদে বাবা দেওয়ানবাগীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দেখিয়ে মুক্তিকামী মানুষকে প্রমাণ করে দিলেন তাঁর এ বন্ধুর কাছেই রয়েছে শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির পথ। জগৎশ্রেষ্ঠ এ মহামানবের আবির্ভাব মানবজাতির জন্য দয়াময় আল্লাহর অশেষ রহমত।
[লেখক: পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]