Cancel Preloader

মহামানবগণের সুমহান মর্যাদা


ওফাতের ১৩শত বছর পরও সাহাবিদের দেহ মোবারক অক্ষত

ওফাত লাভের ১৩শ’ বছর পরে হযরত রাসুল (সা.)-এর দুজন সাহাবি জানালেন যে, তাঁদের মাজারের ভিতর পানি ঢুকে পড়েছে। ঘটনাটি ১৯৩২ সালের। তখন ইরাকের বাদশাহ ছিলেন ফয়সাল। ইরাকের একটি প্রধান নগরী মাদায়েন। সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি বিজড়িত দজলা নদীর তীরবর্তী এক সময়ের প্রসিদ্ধ নগরী মাদায়েন কালের বিবর্তনে আজ ক্ষুদ্র পল্লীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বহু ঘটনার সাক্ষী এ পল্লীটি আজও পর্যটকদের কাছে সমানভাবে আকর্ষণীয়। বিগত কয়েক দশক পূর্বে মাদায়েন নগরীতে হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) এবং হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি (রা.)-এর মাজার দুটি স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ইতঃপূর্বে এ দুই সাহাবির মাজার সালমান পার্ক থেকে আধা কিলোমিটার দূরে একটি অনাবাদী জায়গায় অবস্থিত ছিল।


এক রাতে হযরত হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) বাদশাহকে স্বপ্নের মাধ্যমে জানালেন, “আমাদের দুজনের লাশ বর্তমান কবর থেকে সরিয়ে নিয়ে দজলা নদী থেকে কিছু দূরে দাফন করা হোক। কেননা আমার মাজারে পানি ঢুকে পড়েছে এবং জাবেরের মাজারে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে।” বাদশাহ দিনের বেলা কর্মব্যস্ততায় স্বপ্নের কথা ভুলে গেলেন। দ্বিতীয় রাতে তিনি পুনরায় একই স্বপ্ন দেখলেন, কিন্তু দিনের বেলা তা ভুলে গেলেন। তৃতীয় রাতে হযরত হুজায়ফা (রা.) ইরাকের গ্র্যান্ড মুফতিকে স্বপ্নে একই সংবাদ জানিয়ে তাদের মাজার অনতিবিলম্বে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি মুফতিকে আরো জানালেন যে, বাদশাহকে একই স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, কিন্তু ব্যস্ততার জন্যে তিনি বারবার তা ভুলে যাচ্ছেন। এখন মুফতির দায়িত্ব হচ্ছে বাদশাহকে একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।


পরদিন সকালে মুফতি সাহেব প্রধানমন্ত্রী নূরী আস সাঈদকে টেলিফোনে বললেন, “আপনার সাথে দেখা করতে চাই, জরুরি আলাপ আছে।” তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। তারপর দুজনে মিলে বাদশাহর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মুফতির কাছে স্বপ্নের কথা শুনে বাদশাহ বললেন, “আমি পর পর দু’রাত অনুরূপ স্বপ্ন দেখেছি এবং প্রতি রাতে তাঁরা আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। এ স্বপ্ন দেখে আমি খুবই চিন্তিত ছিলাম। এখন আপনিই বলুন, কী করা যায়।” মুফতি সাহেব বললেন, “হযরত হুজায়ফা (রা.) পরিষ্কার বলেছেন, আমাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র দাফন করো- এ থেকে পরিষ্কার কথা আর কী হতে পারে?” বাদশাহ বললেন, “তবু সতর্কতার খাতিরে একবার পরীক্ষা করে দেখা হোক, সত্যিই তাঁদের মাজারে নদীর পানি প্রবেশ করেছে কি না।” মুফতি সাহেব এ পরামর্শে রাজি হলেন।


ইরাকি নির্মাণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে রাজকীয় নির্দেশ দেওয়া হলো- মাজার থেকে নদীর দিকে ২০ ফুট দূরে খনন করে পরীক্ষা চালিয়ে দেখুন- মাটি চুইয়ে নদীর পানি মাজারে প্রবেশ করেছে কি না। বিকেলের মধ্যে এর রিপোর্ট শাহি দরবারে পৌঁছাতে হবে। সারাদিন ধরে কয়েক স্থানে খননকার্য চালিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেলো, মাটিতে পানি কিংবা লবণাক্ততার কোনো চিহ্ন নেই। মুফতি সাহেব নিজেই সারাদিন ধরে ভূতত্ত্ববিদদের পরিচালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করেন। অবশেষে নিরাশ হয়ে সন্ধ্যায় বিষয়টি বাদশাহকে অবহিত করলেন। কিন্তু সেই রাতেই বাদশাহ পুনরায় একই স্বপ্ন দেখলেন, কিন্তু ভূতত্ত্ববিদদের রিপোর্টের কথা স্মরণ করে স্বপ্নের তেমন গুরুত্ব দিলেন না। পরবর্তী রাতে হযরত হুজায়ফা (রা.) স্বপ্নে হাজির হয়ে মুফতি সাহেবকে জোর দিয়ে বললেন, “দ্রুত আমাদের লাশ স্থানান্তরের ব্যবস্থা করো।”


মুফতি সাহেব সকালে উঠেই রাজ দরবারে গিয়ে বাদশাহর সাথে দেখা করে স্বপ্নের কথা জানালেন। বাদশাহ রাগান্বিত হয়ে বললেন, “হুজুর! আপনি নিজেই বলুন, আমি কী করতে পারি? আপনি নিজেও সারাদিন সেখানে ছিলেন। আপনার সামনেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ হয়েছে। ভূতত্ত্ববিদদের রিপোর্টে পানি তো দূরের কথা, লবণাক্ততার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেলো না। এখন আপনি আমাকে অস্থির করে এবং নিজে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কী লাভ?” মুফতি সাহেব বললেন, “সব খুলেই দেখা হোক।” বাদশাহ বললেন, ঠিক আছে, আপনি এ সম্পর্কে একটি ফতোয়া দিন।” মুফতি সাহেব সেখানে বসেই ফতোয়া দিয়ে দিলেন। শাহি ফরমান ও মুফতি সাহেবের ফতোয়া খবরের কাগজে দেখে সারা বিশ্বে চমক সৃষ্টি হলো। রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো গুরুত্ব সহকারে এ তথ্য পরিবেশন করল।
হজ উপলক্ষ্যে সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মুসলমান তখন মক্কা মোয়াজ্জামায় সমবেত। তারা এ সংবাদ পেয়ে ঈদের কিছুদিন পর কবর খোলার আবেদন জানালেন। এদিকে ইরান, তুরস্ক, মিশর, সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, হেজাজ, বুলগেরিয়া, উত্তর আফ্রিকার দেশসমূহ, রাশিয়া ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেশ থেকে বাদশাহর কাছে হাজারো টেলিফোন আসতে লাগলো, কবর খোলার কাজ একটু বিলম্বে করার জন্য। শুধু তাই নয়, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য এসব দেশ থেকে প্রতিনিধিদল আসার আগ্রহ ব্যক্ত করল।

সবার অনুরোধে অবশেষে ঈদের ২০ দিন পর কবর খোলা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। এ বিলম্বের কারণে যেন পানি ঢুকতে না পারে সেজন্য কবর থেকে ১০ ফুট দূরের মাটি খনন করে খুব মজবুত দেওয়াল করে দেওয়া হলো। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে মাদায়েনের নির্জন প্রাস্তরটি দ্বিতীয় বাগদাদে পরিণত হলো। মাঠে ঘাটে শুধু তাঁবু আর তাঁবু। রাস্তা-ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো। শত শত অস্থায়ী হোটেল ও রেস্তোরাঁ খোলা হলো। সরকারি উদ্যোগেও বহু পান্থশালা খোলা হলো। ইরাক সরকার কাস্টম ও পাসপোর্টের সব কড়াকড়ি তুলে নিলো। শাহি ফরমান জারি করা হলো- আগন্তুক শুধু নিজ দেশের অনুমতিপত্র নিয়ে আসলেই চলবে। অসংখ্য হাজিও মাদায়েনে এসে উপস্থিত হলেন।


নির্দিষ্ট দিনে কবর খননের কাজ শুরু হলো। চারপাশ খনন করা হলো, কিন্তু একপাশ ঢালু করে খনন করা হলো। বিশেষ পদ্ধতিতে ক্রেনের মাধ্যমে লাশ দুটি স্ট্রেচারে তোলার ব্যবস্থা করা হলো। প্রায় পাঁচ লাখ লোকের সামনে এ মাজার দুটি উন্মুক্ত করা হলো। দেখা গেলো, সত্যিই হযরত হুজায়ফা (রা.)-এর মাজারে কিছুটা পানি প্রবেশ করেছে এবং হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি (রা.)-এর মাজারে লবণাক্ততা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, ইরাকি পার্লামেন্টের সদস্যবৃন্দ এবং বাদশাহ ফয়সালের উপস্থিতিতে প্রথমে হযরত হুজায়ফা (রা.)-এর লাশ তোলা হলো। ক্রেন থেকে স্ট্রেচার পৃথক করে বাদশাহ ফয়সাল, প্রধানমন্ত্রী, তুর্কী মন্ত্রী এবং মিশরের রাজা ফারুক তা কাঁধে তুলে নেন। অতঃপর তা একটি সীসার তৈরি বাক্সে রাখা হয়। অনুরূপভাবে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারি (রা.)-এর লাশও তোলা হলো।


অবিশাস্য হলেও সত্য যে, লাশ দুটির কাফন এমনকি মাথার চুল ও দাড়ি পর্যন্ত সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত ছিল। ১৩শ বছর পূর্বের লাশ দুটি তখন দু/তিন ঘন্টা পূর্বের লাশ বলে মনে হচ্ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দুটি লাশের চোখই খোলা ছিল। তা থেকে এমন তীব্র আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল যে, তাঁদের চোখের দীপ্তির সামনে কারো দৃষ্টি স্থির রাখা সম্ভব হয়নি। অনেক নামী দামী ডাক্তার এ অবস্থা দেখে থমকে যান। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ তাঁদের দীপ্তিময় এ চোখ দেখে সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মুফতি সাহেবকে বলেন, “দ্বিন ইসলামের অকাট্যতা এবং সাহাবায়ে কেরামের পূর্ণ কামালিয়াতের চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কী হতে পারে।”
নতুন কফিনে লাশ রাখার পর মানুষের দেখার সুবিধার্থে তাঁদের চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে রাখা হয়। নতুন কবরে লাশ নেওয়ার জন্য জনগণকে দেখানোর জন্য একটি জার্মাান কোম্পানি টেলিভিশন ক্যামেরা স্থাপন করে তা সম্প্রচার করে। ফলে স্ত্রী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে অনেকে ঘরে বসে এ দৃশ্য দেখার সুযোগ পান। ৪ ঘন্টা সময়ের মধ্যে লাশ সালমান পার্কে পৌঁছে। যেখানে হযরত সালমান ফারসি (রা.)-এর মাজার শরীফ অবস্থিত। যারা প্রথমে লাশ দুটি কবর থেকে তুলেছিলেন,তারাই পূর্ণ ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে তা নতুন কবরে স্থাপন করেন। এভাবে ইসলামের দুই জীবন্ত শহিদকে পুনরায় দাফন করা হয়।
সূত্র: তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা. ১৯৪ থেকে ১৯৭

সম্পর্কিত পোস্ট