মানুষ কীভাবে আল্লাহ্’র খলিফা হয় – হযরত এম আমিরুল ইসলাম
মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- “ওয়া ইয ক্বালা রাব্বুকা লিলমালাইকাতি ইন্নী জা‘ইলুন ফিল আরদ্বি খালীফাহ।” অর্থাৎ- “স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করব।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ৩০)
মহান রাব্বুল আলামিনের বাণী শুনে ফেরেশতারা বলেন, আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা পৃথিবীতে অশান্তি দ্বন্ধ কলহ সৃষ্টি করবে। হে আল্লাহ্! আমরাই তো আপনার জিকির ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আর এই কথা শুনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “অবশ্যই আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।” মহান আল্লাহ্র উদ্দেশ্য কি ফেরেশতারা জানতো না। এর কারণ হলো অতীতে আল্লাহ্ অনেক জিন জাতি সৃষ্টি করেন। যারা ফেতনা ফ্যাসাদ করত। তাই ফেরেশতারা আপত্তি জানিয়ে ছিল। আমরাইতো আপনার প্রসংশা করছি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, “নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সব কিছুই আল্লাহ্র জ্বিকির করে।” (সূরা আত তাগাবুন ৬৪: আয়াত ১) কিন্তু মহান আল্লাহ্র পরিচয় লাভ এবং অন্তরে ধারণ করার মতো কেউ ছিল না। তাই তিনি বলেন- “আমি তো এ আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পর্বতমালার সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তা গ্রহণ করতে ভয় পেল, কিন্তু মানুষ তা বহন করল।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৭২) মানুষ এই আমানত গ্রহণ করার কারণেই সৃষ্টির সেরা জীব। এই আমানত হলো রুহ মোবারক। আল্লাহ বলেন- “ওয়া নাফাখতু ফীহি মির রুহী।” অর্থাৎ- “তার মধ্যে আমার রুহ থেকে রুহ ফুঁকে দেবা।” আল্লাহ্র নুরময় সত্তা রুহ মোবারক ধারণ করার জন্য আসমান, জমিন, পর্বতমালা অপরাগতা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু মানুষকে আল্লাহ্ তাঁর রুহু মোবারক দিয়ে সৃষ্টি করে খলিফার মর্যাদা দান করেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন “খালাকাল্লাহু আদামা আ‘লা সূরাতিহি।” অর্থাৎ- “মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-কে তাঁর নিজের সুরতে সৃষ্টি করেছেন।” (বোখারি ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৯৭) আর আদমকে আল্লাহ্ নিজ সুরত দান করেন এবং সৃষ্টির সকল কিছুর জ্ঞান দান করে সকল ফেরেশতার সামনে হাজির করলেন। মহান আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে বললেন- এই সব কিছুর নাম বলে দাও। তখন ফেরেশতারা বলল, হে দয়াময় মালিক! আপনি মহান ও পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বাইরে আর কোনো জ্ঞান নেই। তখন মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-কে সামনে আনলেন। আর বলেন, তুমি তাদেরকে সবকিছুর নাম বলে দাও। আদম (আ.) একে একে সবকিছুর নাম বলে দিলেন। তখন মহান আল্লাহ্ বলেন- আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না। রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশ্য তারা জানতো না। আদম (আ.)-কে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা দানের জন্য মহান আল্লাহ্ বলেন- “আর যখন আমি আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের বললাম। তখন ইবলিস ছাড়া সবাই সিজদা করল। সে আদেশ অমান্য করল এবং অহংকার করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ৩৪) আল্লাহ্ ফেরেশতাদের সামনে প্রমাণ করলেন যে, আদম আমার যোগ্য খলিফা বা জমিনের প্রতিনিধি। প্রতিনিধির কাজ হলো মালিকের সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর ইচ্ছায় পরিচালিত হওয়া। মহান আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-এর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে জান্নাতে প্রেরণ করেন। আল্লাহ্ বলেন, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী আমার সন্তুষ্ট চিত্তে এবং আমার ইচ্ছায় জান্নাতে বসবাস করো। কিন্তু হযরত আদম (আ.) নিজ ইচ্ছায় কাজ করে জান্নাত বা শান্তিময় স্থান থেকে দুনিয়ার মাঝে পতিত হয়। মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি অতিশয় সুন্দর গঠনে, অতঃপর আমি তাকে (পাপ কর্মের কারণে) ফিরিয়ে দেই হীন থেকে হীনতম অবস্থায়।” (সূরা আত তীন ৯৫: আয়াত ৪-৫) কর্মের কারণে হযরত আদম (আ.) খলিফার মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। আবার মহান আল্লাহ্ হযরত আদম (আ.)-কে হযরত রাসুল (সা.)-এর উসিলায় ক্ষমা করেন এবং খলিফা বা প্রতিনিধির মর্যাদা ফিরিয়ে দেন। কী কারণে মানুষ খলিফার মর্যাদা হারায়। এর কারণ হলো- প্রতিটি মানুষের মাঝে দুটি আত্মা বিরাজমান। যথা (১) নফ্স বা জীবাত্মা এবং (২) রুহ বা পরমাত্মা। এই নফ্স বা জীবাত্মা মানুষকে পাপের দিকে প্রভাবিত করে। মন্দ কাজে ইন্দন জোগায়।
এই নফ্স বা জীবাত্মাকেই নফ্স শয়তান বলে। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- “ইন্নান নাফসা লাআম্মারাতুম বিসসূই।” অর্থাৎ- “নিশ্চয় নফ্সে আম্মারা (মানুষের জীবাত্মা) মন্দা কাজেরই প্ররোচনা দিয়ে থাকে।” (সূরা ইউসুফ ১২: আয়াত ৫৩) মূলত এই নফ্স শয়তান হযরত আদম (আ.)-কে রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার প্ররোচনা দেয়। নফ্স শয়তান মানুষের মাঝে সক্রিয় থাকে। এ নফ্স শয়তান প্রসঙ্গে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) বলেন- “তোমাদের প্রত্যেকের সাথে শয়তান নিযুক্ত রয়েছে। এ কথা শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন- “ইয়া রাসুলাল্লাহ্! আপনার সাথেও কি আছে? আল্লাহ্র রাসুল (সা.) বললেন, হাঁ আমার সাথেও। তবে মহান আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করেছন, ফলে শয়তান আমার অনুগত হয়ে গিয়েছে। সে কেবল ভালো কাজের পরামর্শ দিয়ে থাকে।” (বোখারী ও মুসলিম শরীফের সূত্রে তাফসীরে ইবনে কাছীয় ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮১২) নফ্স শয়তান পবিত্র হলে সে আর পাপের প্ররোচনা দিতে পারে না, বরং ভালো কাজের সাহায্য করে। অন্য হাদিসে আল্লাহ্র রাসুল (সা.) বলেন- “আমার শয়তান আমার হাতে মুসলমান হয়ে গিয়েছে।” (তাফসীরে জিলানী ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৯) তাই আল্লাহ্র রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বলেন, “আমার নফ্স শয়তান আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাই আমার কাছে থেকে তোমাদের নফ্স শয়তানকে আত্মসমর্পণ করার বিদ্যা শিখে নাও। যাতে পবিত্র হতে পারো।” নফ্স শয়তানকে পবিত্র করতে আল্লাহ্র দয়া ছাড়া সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আমি ইউসুফ নিজেকে নির্দোষ মনে করি না, … তবে সে নয়, যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন।” (সূরা ইউসুফ ১২: আয়াত ৫৩) সুতরাং নফ্সের প্ররোচনা থেকে আল্লাহ্র দয়া ছাড়া মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল আর বেলায়াতের যুগে অলী-আল্লাহ্দের শিক্ষা নিয়ে সাধনা করলে এই নফ্সের মন্দ কাজ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। অলী-আল্লাহ্র নির্দেশ মতো সাধনা করলে, সাধকগণ পরিশুদ্ধি লাভের সাধনায় নফ্সের ৫টি অবস্থা প্রাপ্ত হন। যথা- (১) নফ্সে আম্মারা বা অসংযমী নফ্স, (২) নফসে লাওয়ামা বা অনুশোচনাকারী ও তিরস্কারকারী নফ্স, (৩) নফ্সে মুতমায়িন্না বা শান্তিপূর্ণ নফ্স, (৪) নফসে মুলহেমা বা এলহামপ্রাপ্ত নফ্স এবং (৫) নফসে রহমানিয়া বা রহমানের নফ্স।
(১) নফ্সে আম্মারা: নফ্সে আম্মারা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন- “নিশ্চয়ই নফ্সে আম্মরা (মানুষের জীবাত্মা) মন্দ কাজেরই প্ররোচনা দিয়ে থাকে।” (সূরা ইউসুফ ১২: আয়াত ৫৩) নফ্সে আম্মরার অধিকারী মানুষ সর্বদা খারাপ কাজে নিমজ্জিত থাকে যে, তার কাছে ভালো মন্দ পার্থক্য থাকে না।
(২) নফসে লাওয়ামা বা অনুশোচনাকারী ও তিরস্কারকারী নফ্স: নফ্সে লাওয়ামা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ওয়ালা উক্বসিমু বিন্নাফাসিল লাওয়্যামাহ্।” অর্থাৎ- আরও কসম করছি সেই আত্মার, যে নিজেকে (কর্মের জন্য) তিরস্কার করে থাকে।” (সূরা কিয়ামাহ্ ৭৫: আয়াত ২) নফ্সে লাওয়ামা বা অনুশোচনাকারী নফ্সের মানুষ পাপ কাজও করে এবং পাপ কর্মের জন্য অনুশোচনা করে।
(৩) নফ্সে মুতমায়িন্না বা শান্তিপূর্ণ নফ্স: নফ্সে মুতমায়িন্না সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ইয়া আইয়্যাতুহান্নাফসুল মুত্বমাইন্না তুরজিই ইলা রাব্বিকি রাদ্বিইয়াতাম মারদ্বিইয়্যাহ। ফাদখুলী ফী ইবাদী ওয়াদ খুলী জান্নাতি।” অর্থাৎ- “হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে এসো এমন ভাবে যে, তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। অতঃপর তুমি শামিল হয়ে যাও আমার বিশিষ্ট বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।” (সূরা ফজর ৮৯: আয়াত ২৭-৩০) নফ্সে মুতমাইন্নার সাধক কখনো পাপ কাজ করতে পারে না, কারণ সে মোকাম্মেল মু’মিনের স্তর অর্জন করেছে। তাই সর্বসময় রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে সাকিনা বা শান্তির মাঝে বিরাজ করে।
(৪) নফসে মুলহেমা বা এলহাম প্রাপ্ত নফ্স: এ নফ্স সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে – “ফাআলহামাহা ফুজূরাহা ওয়া তাক্বওয়াহা।” অর্থাৎ- অতঃপর তাকে তার মন্দ কর্ম ও তার তাকওয়ার জ্ঞান (এলহাম) দান করেছেন।” (সূরা শামস ৯১: আয়াত ৮) নফ্সে মুলহেমার অধিকারী সাধককে মহান আল্লাহ্ প্রতিনিধির মর্যাদা দান করেন। তখন সে আল্লাহ্র কাজ থেকে ভালো মন্দের খবর পেয়ে থাকে এবং সে মহান রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়।
(৫) নফ্সে রহমানিয়া বা রহমানের নফ্স: নফ্সে রহমানিয়ায় উপনীত হলে সাধক নিজের মাঝে মহান আল্লাহ্র অস্তিত্ব দেখতে পান। তখন সে ব্যক্তির সাথে আল্লাহ্ মিশে একাকার হয়ে যান। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- “ওয়ামা রামাইতা ইজ রামাইতা ওয়ালা কিন্নাল্লাহা রামা।” অর্থাৎ- হে রাসুল (সা.)! আর আপনি (বালি) নিক্ষেপ করেননি, যখন আপনি (বালি) নিক্ষেপ করেছিলেন বরং আল্লাহ্ই (বালি) নিক্ষেপ করেছিলেন।” (সূরা আনফাল ৮: আয়াত ১৭) সাহাবায়ে কেরাম দেখলেন বালি নিক্ষেপ করেন নবিজি। কিন্তু আল্লাহ্ বলেন আমি বালি নিক্ষেপ করেছি। মহান আল্লাহ্ তখন হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে মিশে একাকার ছিলেন। এ প্রসঙ্গে হযরত মুসা (আ.)-কে আল্লাহ্ বলেন- “ওয়াস্ত্বানা‘ তুকা লিনাফ্সী।” অর্থাৎ- “আমি তোমাকে আমার নিজের নফ্সের জন্য মনোনীত করেছি।” (সূরা ত্বা’হা ২০: আয়াত ৪১) আল্লাহ্ যাকে নিজের নফ্সের জন্য মনোনীত করেন তিনি হন জগতের বুকে তাঁর শ্রেষ্ঠ খলিফা বা প্রতিনিধি।
মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আমাদেরকে নফ্সের পবিত্রতা অর্জন করে তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন।
[লেখক: সদস্য, আল কুরআন গবেষণা কেন্দ্র, পেশ ইমাম, বাবে রহমত দেওয়ানবাগ শরীফ।]