Cancel Preloader

মোরাকাবার আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা, ২য় পর্ব

মোরাকাবার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন মানব জাতির শান্তি ও মুক্তির পথ প্রদর্শনের জন্য এবং মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ এবং তাঁর সাথে যোগাযোগের জন্য নবুয়তের যুগে ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। বেলায়েতের যুগে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরাম নবি-রাসুলগণের উত্তরসূরি হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। নবি-রাসুলগণ তাঁরা মোরাকাবা করে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করে সাহায্য লাভ করেছেন এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁদের অনুসারী উম্মতদেরকে মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহ্র সাহায্য লাভের শিক্ষা দিয়েছেন।


মহান আল্লাহ্ পৃথিবীতে প্রথম নবি ও রাসুল করে হযরত আদম (আ.)-কে প্রেরণ করেছেন। তিনি জান্নাতে থাকাকালীন আল্লাহ্র হুকুমের ব্যতিক্রম করায় মহান আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। অতঃপর তিনি মহান আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এভাবেÑ“ক্বালা রাব্বানা জ্বালামনা আনফুসানা, ওয়া ইল লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকূনান্না মিনাল খাসিরীন।” অর্থাৎ- তাঁরা উভয়ে (আদম ও হাওয়া) বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের উপর জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব। (সূরা আল আ‘রাফ ৭ : আয়াত ২৩)


হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) দীর্ঘ ৩৬০ বছর দোয়া করার পর হযরত রাসুল (সা.)-এর উসিলায় তাঁদের তওবা কবুল হয়। হযরত আদম (আ.)-এর দোয়া যখন আল্লাহ্ কবুল করলেন, তখন তিনি তাঁর পরিষ্কার ক্বালবে মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভের ঘোষণা পেলেন। সেই সাথে মহান আল্লাহ্ তাঁকে পৃথিবীবাসীর জন্য প্রথম নবি হিসেবে মনোনীত করলেন। হযরত আদম (আ.) আপন ক্বালবে মোরাকাবা ও ধ্যানের মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পাশাপাশি তিনি তাঁর বংশধর ও উম্মতকে এই মোরাকাবা বা গভীর ধ্যানের সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আউলিয়ায়ে কেরামের নিকট অধিক প্রচলিত শিক্ষা এই যে, লতিফায়ে ক্বালব হযরত আদম (আ.)-এর জিরে কদম বা কদমের অধীন।
হযরত শিশ (আ.) ছিলেন হযরত আদম (আ.)-এর সাহেবজাদা। তিনি মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্কে লাভ করার বিদ্যা তাঁর পিতা হযরত আদম (আ.)-এর নিকট থেকে শিখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর যুগের মানুষকে আল্লাহ্কে লাভ করার বিদ্যা মোরাকাবার শিক্ষা দিয়েছিলেন। হযরত শিশ (আ.)-এর নিকট মোরাকাবার বিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন হযরত ইদ্রিস (আ.), পরবর্তীতে মহান আল্লাহ্ হযরত ইদ্রিস (আ.)-কে নবুয়ত দান করেন। হযরত ইদ্রিস (আ.)-ও তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ্কে লাভ করার লক্ষ্যে মোরাকাবা শিক্ষা দিয়েছিলেন।


এমনিভাবে হযরত নূহ (আ.)-এর পর হযরত হূদ (আ.) এবং হযরত সালেহ (আ.) তাঁদের যুগের মানুষকে মোরাকাবা শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহ্র সাথে মোরাকাবার মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাঁদের যুগের অবাধ্যদের মহান আল্লাহ্র শাস্তির ও ভয়-ভীতির সংবাদ দিয়েছেন। তাঁদের সংবাদ সত্যে পরিণত হয়। আদ ও সামুদ জাতিকে আল্লাহ্ অবাধ্যতার কারণে ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড় দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন।


হযরত নূহ (আ.)-এর পর হযরত হুদ (আ.) আদ জাতির নিকট রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তিনি তাঁর যুগের মানুষকে মহান আল্লাহ্র ধর্মীয় ইবাদতের পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। পাশাপাশি হযরত হুদ (আ.) আল্লাহ্র রাসুল হওয়ায় তাঁর ক্বালবে মহান আল্লাহ্ ওহি নাজিল করতেন, এর ফলে তিনি ছিলেন এলমুল ক্বালবের বিদ্যায় বিদ্বান। ফলে তিনি তাঁর অনুসারীগণকে মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগের পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন।


হযরত হুদ (আ.)-এর পর হযরত সালেহ (আ.) ছিলেন আল্লাহ্র নবি ও রাসুল। মহান আল্লাহ্ কওমে সামুদের হিদায়েতের জন্য তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। হযরত সালেহ (আ.) হিজর শহরের উপকণ্ঠে এক পাহাড়ের গুহায় ইবাদতের জন্য একটি কুঠুরি তৈরি করেছিলেন। তিনি সেখানে ধ্যান-সাধনা, মোরাকাবা ও প্রার্থনা করতেন। সামুদ জাতির লোকেরা হযরত সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রীটিকে হত্যা করার পর তাঁকেও হত্যা করতে গুহার দিকে অগ্রসর হলো। তারা বলছিল যে, যখন সে প্রার্থনার জন্য গুহায় আগমন করবে, তখন আমরা তাকে হত্যা করব। অতঃপর আমরা তাঁর পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদেরকে হত্যা করব। এসব কথা বলতে বলতে তারা গুহার ভেতরে প্রবেশ করল। এদিকে মহান আল্লাহ্ তাদের উপর বৃষ্টির ন্যায় পাথর বর্ষণ করতে লাগলেন। তারা অবস্থা বেগতিক দেখে পাহাড়ের গুহা থেকে পলায়নের চেষ্টা করল, কিন্তু সম্ভব হলো না। পাথরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে গুহার ভেতরেই তারা চর্বিত ঘাসের ন্যায় মরে পড়ে রইলো।


হযরত সালেহ (আ.) হিজর এলাকার পর্বত গুহায় মোরাকাবা তথা ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হন। এজন্য তিনি তাঁর অনুসারী মু’মিনদেরকে মোরাকাবার মাধ্যমে এলমুল ক্বালবের বিদ্যা শিক্ষা দিতেন।


হযরত ইব্রাহীম (আ.) মুসলিম জাতির পিতা, তাঁর যুগের মানুষেরা মূর্তিপূজার পাশাপাশি নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্যের পূজায় লিপ্ত ছিল। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে মোরাকাবার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্যের উপাসনা না করে একমাত্র আল্লাহ্র উপাসনা করার দাওয়াত স্বজাতিকে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেনÑ “আর এরূপেই আমি ইব্রাহীমকে দেখিয়েছি আসমান ও জমিনের অত্যাশ্চর্য বস্তুসমূহ, যেন তিনি দৃঢ় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তারপর রাতের অন্ধকার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল, তখন তিনি তারকা দেখতে পেলেন এবং বললেন, ‘এটি আমার প্রতিপালক। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হলো, তখন তিনি বললেন, ‘আমি অস্তগামীদের ভালোবাসি না।’ তারপর তিনি যখন চাঁদকে দীপ্তিমান অবস্থায় দেখতে পেলেন, তখন বললেন, ‘এটি আমার প্রতিপালক।’ যখন তাও অস্তমিত হলো, তখন তিনি বললেন, ‘যদি আমার প্রতিপালক সঠিক পথ না দেখান, তবে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্ট লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব।’ অবশেষে যখন তিনি সূর্যকে প্রদীপ্ত অবস্থায় দেখলেন তখন তিনি বললেন, ‘এটি আমার প্রতিপালক, এটি বৃহত্তম।’ তারপর যখন তাও ডুবে গেল, তখন তিনি বললেন, ‘হে আমার কওম! নিশ্চয় আমি তা থেকে মুক্ত তোমরা যাকে শরিক করো।’ ‘নিশ্চয় আমি একাগ্রচিত্তে শুধু তাঁরই দিকে মুখ ফেরাচ্ছি, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন, আর আমি মুশরিকদের দলভুক্ত নই।” (সূরা আল আন‘আম ৬ : আয়াত ৭৫ থেকে ৭৯) হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মহাসত্যের জ্ঞান লাভ করেছেন, তখন স্বজাতিকে মুর্তিপূজা ত্যাগ করে এক আল্লাহ্র উপাসনা করার দাওয়াত স্বজাতিকে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা-আল আন‘আমের ৭৫ থেকে ৭৯ আয়াতসমূহে মোরাকাবা বা সৃষ্টি রহস্যের গভীর ধ্যান করার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে।


এমনিভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত মোরাকাবার শিক্ষা তাঁর ভাতিজা হযরত লুত (আ.) তাঁর স্বজাতিকে দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে বংশ পরম্পরায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁর সম্মানিত বড়ো সাহেবজাদা হযরত ইসমাঈল (আ.) এবং ছোটো সাহেবজাদা হযরত ইসহাক (আ.) এবং হযরত যুলকারনাইন (আ.)-কে মোরাকাবার শিক্ষা দিয়েছেন। ফলে পরবর্তীতে তাঁরা তাঁদের যুগের মানুষকে এই মোরাকাবা তালিম দিয়েছেন।


হযরত ইয়াকুব (আ.) ছিলেন হযরত ইসহাক (আ.)-এর সম্মানিত সাহেবজাদা। তিনি হযরত ইসহাক (আ.) থেকে এই মোরাকাবার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে হযরত ইয়াকুব (আ.) মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অদৃশ্যের সংবাদ পেতেন। সেই সাথে তাঁর জাতিকে মোরাকাবাও শিক্ষা দিতেন। উক্ত ঘটনাটি পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে। মহান আল্লাহ্র বাণীÑ “তারপর যখন কাফেলা (মিশর থেকে) বেড়িয়ে পড়ল, তখন তাঁদের পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) বললেন, যদি তোমরা আমাকে প্রলাপ উক্তিকারী মনে না করো, তাহলে শোনো, ‘আমি তো ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি।’ তারা বলল, আল্লাহ্র কসম! আপনি তো আপনার পুরনো ভ্রান্তির মধ্যেই আছেন। তারপর যখন সুসংবাদাতা এলো, তখন সেই জামাটি তাঁর চেহারার উপর রাখল, অমনি তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। তিনি বললেনÑ ক্বালা আলাম আক্বুল লাকুম, ইন্নী আ‘লামু মিনাল্লাহি মা লা তা‘লামূন। অর্থাৎ- আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমি আল্লাহ্র তরফ থেকে জানি, যা তোমরা জান না। (সূরা ইউসুফ ১২ : আয়াত ৯৪ থেকে ৯৬)


হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর উক্তি ‘আমি তো ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি।’ দূর থেকেও ইউসুফ (আ.)-এর জামা মোবারক আনার কারণে তিনি দূর থেকে ফায়েজের মাধ্যমে ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আ.) নবি হিসেবে যেমন আল্লাহ্র সংবাদ পেতেন, তেমনি মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করে এমন কিছু জানতেন, যা অন্যদের জানা তো দূরের কথা কল্পনারও বাহিরে ছিল। তাই হযরত ইয়াকুব (আ.) স্বীয় পুত্রদের বলেছিলেন, “আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আমি আল্লাহ্র তরফ থেকে জানি, যা তোমরা জানো না।”


হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করতেন এবং মহান আল্লাহ্ তাঁকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্র বাণীÑ “ইউসুফ বলল, তোমাদেরকে যে খাদ্য দেওয়া হয় তা তোমাদের কাছে আসার পূর্বেই আমি এর ব্যাখ্যা তোমাদেরকে বলে দেবো। এ জ্ঞান আমাকে আমার প্রতিপালক শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা ইউসুফ ১২ : আয়াত ৩৭)


হযরত ইউসুফ (আ.)-কে তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর মোরাকাবা শেখানোর একটি বিশেষ ঘটনা উল্লেখ করছিÑ হযরত ইয়াকুব (আ.) পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.)-কে ডেকে নিজের কাছে বসালেন। তারপর তিনি নিজের মাথার পাগড়ি মোবারক প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র ইউসুফ (আ.)-এর মাথার উপর রেখে চেহারাসহ পুরো মাথা ঢেকে দিলেন। অতঃপর বললেনÑ ইউসুফ! তুমি যা দেখবে, তা হুবহু আমাকে বর্ণনা করবে। এ সময় ইউসুফ (আ.) অন্তর্দৃষ্টিতে বেহেশতের দৃশ্যসমূহ দেখতে পেলেন। তিনি বললেনÑ হে আমার আব্বা হুজুর! আমি দেখতে পাচ্ছি আমি আর জোলায়খা পরস্পর হাত ধরাধরি করে বেহেশতের বাগিচায় হাঁটছি। ইয়াকুব (আ.) বললেনÑ হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি যা দেখতে পাচ্ছো, এতে মহান আল্লাহ্র মর্জি এই যে, জোলায়খা তোমার স্ত্রী এবং তুমি তার স্বামী। ইউসুফ (আ.) ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অন্তর্দৃষ্টিতে এ দৃশ্য দেখতে দেখতেই পিতাকে প্রশ্ন করলেনÑ তাহলে প্রাক্তন আজীজ মিশির ও জোলায়খার মধ্যে কী সম্পর্ক ছিল পিতা? পিতা বললেনÑ তুমি তাকিয়ে দেখো, আজীজ মিশিরকে দেখতে পাও কি? ইউসুফ (আ.) বললেনÑ হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তার সাথে কোনো স্ত্রী লোক নেই, বরং রয়েছে কিছু সংখ্যক গেলমান। ইয়াকুব (আ.) বললেনÑ তুমি যথার্থ দেখতে পাচ্ছো। দুনিয়াতে আজীজ মিশিরের কোনো স্ত্রী ছিল না, জোলায়খা ছিল কাগজে-কলমে স্ত্রী, বাস্তবে সে জোলায়খার কাছ থেকে কোনোদিন স্ত্রীর সঙ্গ পায়নি। জোলায়খার অদৃষ্টের লিখন, সে একজন পয়গম্বরের স্ত্রী হবে, সুতরাং তাকে অন্য কোনো পুরুষের পক্ষে স্পর্শ করা সম্ভব ছিল না। তারপর পিতা ইয়াকুব (আ.) পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে নির্দেশ করলেন, তুমি তোমার ভাইদের দ্বারা কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বে পর পর দু’রাত্রি স্বপ্নে জোলায়খাকে সাক্ষাৎ দিয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কি? মোরাকাবায় এ বিষয়টি একটু দেখার চেষ্টা করো। আল্লাহ্র ইচ্ছায় পিতার নির্দেশে এ বিষয়টিও ইউসুফ (আ.) মোরাকাবায় অর্ন্তদৃষ্টিতে দেখতে পান। আর তা হলোÑ তিনি কেনানে থাকাকালীন বরকতময় স্বপ্ন দেখার পর তাইমুস বাদশাহর একমাত্র কন্যা জোলায়খাকে আল্লাহ্র ইচ্ছায় স্বপ্নযোগে আপন দিদার দান করেন। অতঃপর নিজ পরিচয় দিয়ে প্রতিশ্রুতি দেন যে, হে জোলায়খা! আমি ইউসুফ! তুমি আমাকে পাবে, আমি মিশরের বাদশাহ। তবে আমাকে পাওয়ার পথে তোমাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট বরণ করতে হবে এবং বহুদিন ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে। এ দৃশ্য দেখার সাথে ইউসুফ (আ.)- এর বুঝতে বাকি রইলো না যে, বিবি জোলায়খার এ প্রেম বস্তুজগতের কোনো কামনা-বাসনার প্রেম নয়, এটি আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত এক ঐশ্বরিক প্রেম, যা অলঙ্ঘনীয়। অতঃপর ইয়াকুব (আ.)-এর নির্দেশে ইউসুফ (আ.) মোরাকাবা ছেড়ে দিলেন। তাঁর ধ্যানমগ্নতা ভঙ্গ হলো। অতঃপর ইয়াকুব (আ.) নির্দেশ করলেনÑ হে ইউসুফ! আর দেরি নয়, তুমি জোলায়খাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে স্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করো।


বর্ণিত আছে যে, এ বিবাহকালেই হযরত ইউসুফ (আ.)-এর প্রার্থনার বদৌলতে জোলায়খার অন্ধ চোখ ভালো হয়ে যায়, তাঁর বৃদ্ধকালের অবসান হয়ে পূর্ণ যৌবন ও পূর্বের সে অনুপম রূপ সৌন্দর্য ফিরে আসে। অর্থাৎ তার সৌন্দর্য ও লাবণ্য আবার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। অতঃপর সৌন্দর্যের মূর্তপ্রতীক ইউসুফ (আ.)-এর পাশে স্ত্রীরূপে জোলায়খাকে যথাযোগ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। এমনিভাবে পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর প্রস্তাবে পুত্র ইউসুফ (আ.)-এর সাথে ভুবন বিখ্যাত সুন্দরী জোলায়খার শুভ বিবাহ মহা ধুমধামের সাথে সম্পন্ন হয়।


হযরত আইয়ুব (আ.) মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র সাথে যোগাযোগ করতেন এবং তাঁর সাহায্য লাভের নির্দেশনা পেতেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্র বাণীÑ “স্মরণ করুন, আমার বান্দা আইয়ুবের কথা, যখন তিনি তাঁর রবকে আহ্বান করে বলেছিলেন, শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে। (আদেশ করলাম) আপনার পা দিয়ে জমিনে আঘাত করুন। (আঘাত করতেই একটি প্রস্রবণ উৎপন্ন হলো) তাতে ছিল সুশীতল গোসলের পানি এবং পানীয়।” (সূরা সাদ ৩৮ : আয়াত ৪১ ও ৪২)


হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর অসুস্থ থাকার পর মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাহায্য লাভ করে পুনরায় সুস্থ হয়েছিলেন। বংশ পরম্পরায় হযরত যুলকিফল (আ.) ছিলেন হযরত আইয়ুব (আ.)-এর সাহেবজাদা। তিনি হযরত আইয়ুব (আ.)-এর নিকট থেকে মোরাকাবার বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করেন। অনুরূপভাবে হযরত লুকমান (আ.) হযরত আইয়ুব (আ.)-এর ভাগিনা ও অনুসারী ছিলেন। হযরত লুকমান (আ.) হযরত আইয়ুব (আ.)-এর কাছ থেকে মোরাকাবার শিক্ষা গ্রহণ করেন। পাশাপাশি তাঁর যুগের মানুষকে মোরাকাবা শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত লুকমান (আ.) মোরাকাবা প্রসঙ্গে বলেছেনÑ “নির্জনতা যত গভীর হয় গবেষণা (মোরাকাবা) তত গভীরে পৌঁছে যায়। আর গভীর ও দীর্ঘ গবেষণা বেহেশতের বহু দরজার সন্ধান দেয়।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১) (চলবে)


[বি.দ্র. ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর ৭৪তম শুভ জন্মদিন। ডিসেম্বরের ‘আত্মার বাণী’র বিশেষ সংখ্যায় দয়াল বাবাজানের উপর আমার বিশেষ লেখা প্রকাশ হবে। তাই উল্লিখিত লেখাটির ৩য় পর্ব জানুয়ারি-২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হবে।


[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]

সম্পর্কিত পোস্ট