Cancel Preloader

মোরাকাবার আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা, ৩য় পর্ব


এমনিভাবে হযরত ইউনুস (আ.) নিনুয়াবাসীকে আল্লাহ্’র ইবাদতের দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি হিজরত করে অন্যত্র গমনকালে মাছের পেটে মহাবিপদে পড়লেন। অতঃপর তিনি মাছের পেট থেকে আল্লাহ্’র সাহায্য কামনা করলেন। মোরাকাবার মাধ্যমে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার লাভের জন্য আল্লাহ্’র নিকট এভাবে প্রার্থনা করলেন- “লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনাজ্ব জ্বালিমীন।” অর্থাৎ- “আপনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। আপনি পবিত্র মহান। আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১: আয়াত ৮৭) হযরত ইউনুস (আ.)-এর দোয়া মহান আল্লাহ্ কবুল করলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন, “তখন আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম এবং তাঁকে মুক্তি দিলাম দুশ্চিন্তা থেকে। আমি এভাবেই মু’মিনদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১: আয়াত ৮৮) হযরত ইউনুস (আ.) বিপদ থেকে উদ্ধারের পর আবারো মানুষকে আল্লাহ্’র ইবাদতের দাওয়াত দেন। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লাহ্কে ভয় করার এবং মোরাকাবা শিক্ষা দেন।

হযরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন হযরত মুসা (আ.)-এর শ্বশুর। তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহ্’র ইবাদতের শিক্ষা যেমন দিয়েছেন, তেমনি অন্য নবিদের ন্যায় আল্লাহ্কে ভয় করার এবং মোরাকাবার তালিম প্রদান করেন। হযরত মুসা (আ.) তাঁর শ্বশুর হযরত শোয়াইব (আ.)-এর নিকট দীর্ঘ ১০ বছর অবস্থান করে সাধনা করেন। অতঃপর হযরত মুসা (আ.)-কে মহান আল্লাহ্ উচ্চস্তরের রাসুল হিসেবে মনোনীত করেন। তিনি মহান আল্লাহ্’র সাথে মোরাকাবার মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। হযরত মুসা (আ.) মহান আল্লাহ্’র সাথে সরাসরি কথা বলতেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন, “ওয়া কাল্লামাল্লাহু মূসা তাকলীমা।” অর্থাৎ- “আর মুসার সাথে আল্লাহ্ সরাসরি কথা বলেছিলেন।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ১৬৪) হযরত মুসা (আ.) মহান আল্লাহ্’র সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। তাই তাঁকে মুসা কালিমুল্লাহ (আল্লাহ্’র সাথে বাক্যালাপকারী) বলা হয়। তিনি এ মোরাকাবার শিক্ষা তাঁর অনুসারীগণকে দিয়েছেন। হযরত মুসা (আ.)-এর ভাই হযরত হারুন (আ.) তাঁর সহবতে থেকে মোরাকাবার সুমহান শিক্ষা গ্রহণ করেন। এমনিভাবে হযরত মুসা (আ.)-এর খাদেম হযরত ইউশা ইবনে নুন (আ.) হযরত মুসা (আ.)-এর কাছে থেকে মোরাকাবার তালিম গ্রহণ করেন। অনুরূপভাবে হযরত হিযকিল (আ.) হযরত মুসা (আ.)-এর অনুসারী নবি ছিলেন। তিনিও হযরত ইউশা ইবনে নুন (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের নবি ও খলিফা ছিলেন। তিনিও হযরত মুসা (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে মোরাকাবার সুমহান শিক্ষা লাভ করেন।

হযরত হিযকিল (আ.) বনি ইসরাইলের তৃতীয় খলিফা হিসেবে তাঁর অনুসারীগণকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মোরাকাবার শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত হিযকিল (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের মধ্য থেকে হযরত ইলিয়াস (আ.) নবুয়ত লাভ করেন। তিনি ছিলেন হযরত মুসা (আ.)-এর ভাই হযরত হারুন (আ.)-এর বংশধর। তিনি মোরাকাবায় আত্মনিমগ্ন থাকতেন। হযরত ইলিয়াস (আ.)-এর সাধনার জীবনে সংঘটিত মোরাকাবার ঘটনাটি উল্লেখ করছি।
হযরত ইলিয়াস (আ.) তাঁর জাতিকে দাওয়াত দেওয়ার পর বাদশাহ আজুব তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এদিকে হযরত ইলিয়াস (আ.) গুহায় অবস্থান করে মোরাকাবারত ছিলেন। বাদশাহ আজুব একদল লোককে ইমান আনার মিথ্যা ছল-চাতুরীর মাধ্যমে হযরত ইলিয়াস (আ.)-কে হত্যার জন্য প্রেরণ করে। হযরত ইলিয়াস (আ.) মোরাকাবা অবস্থায় আল্লাহ্’র সাহায্য চেয়ে বললেন, হে আল্লাহ্! তারা যদি ইমানদার হতে না আসে, আর প্রতারণা করে তবে তাদেরকে অগ্নিবৃষ্টি দিয়ে ধ্বংস করে দাও। অতঃপর মহান আল্লাহ্ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। বাদশাহ ক্ষোভে দ্বিতীয় দলকে প্রেরণ করে আল্লাহ্’র নবিকে হত্যার জন্য। হযরত ইলিয়াস (আ.) মোরাকাবায় পুনরায় আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগ করার ফলে এ দলটিকেও আল্লাহ্ অগ্নিবৃষ্টির মাধ্যমে ভস্মীভূত করে দেন। বাদশাহ আজুব তৃতীয়বার হযরত ইলিয়াস (আ.)-এর একজন ভক্ত, যে রাজ দরবারের সচিব তাকেসহ তৃতীয় দলকে প্রেরণ করে আল্লাহ্’র নবিকে রাজ দরবারে নেওয়ার জন্য। হযরত ইলিয়াস (আ.) মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্’র নিকট জানতে চাইলে আল্লাহ্ জানালেন রাজদরবারে গেলেও বাদশাহ আজুব তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমি তার পুত্রকে আরো বেশি অসুস্থ করে দেবো এবং পরে তাকে মৃত্যু দেবো। পরে হযরত ইলিয়াস (আ.) রাজ দরবারে গেলেও বাদশাহ তাঁর কোনো ক্ষতি করতে পারল না। তিনি গুহায় এসে বনি ইসরাইলের জন্য দুর্ভিক্ষের দোয়া করলেন। আল্লাহ্ তাঁর দোয়া কবুল করে ৩ বছরের জন্য দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দেন।

হযরত ইলিয়াস (আ.) এভাবে মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগ করতেন। এমনিভাবে হযরত আল ইয়াসা (আ.), হযরত ইলিয়াস (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের নবি হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ছিলেন হযরত ইলিয়াস (আ.)-এর খলিফা। তিনি হযরত ইলিয়াস (আ.)-এর সান্নিধ্যে থেকে মোরাকাবা ও ধ্যান-সাধনার শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। হযরত ইলিয়াস (আ.) মোরাকাবা করতেন এবং বংশপরম্পরায় তাওরাত কিতাবের ধর্মীয় শিক্ষাগুলোর পাশাপাশি অনুসারীগণকে আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত শামুয়েল (আ.) হযরত আল ইয়াসা (আ.)-এর ওফাতের পর বনি ইসরাইলের নবি মনোনীত হন। হযরত শামুয়েল (আ.)-এর পিতা হালকান সন্তানকে শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের জন্য ইমাম আলীর নিকট সোপর্দ করেছিলেন। হযরত শামুয়েল (আ.) সেখানে ইবাদতখানায় মোরাকাবায় মশগুল থাকতেন। অতঃপর তিনি নবুয়ত লাভ করেন। তিনিও তাঁর জাতিকে ওহির কিতাব তাওরাত অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করেন এবং তাঁর অনুসারীদেরকে মোরাকাবার তালিম প্রদান করেন।

এমনিভাবে হযরত দাউদ (আ.) হযরত শামুয়েল (আ.)-এর পর বনি ইসরাইলের নবি হন। হযরত দাউদ (আ.) হযরত শামুয়েল (আ.)-এর সাথে বাদশাহ জালুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তিনি মহান আল্লাহ্’র মোরাকাবায় মশগুল থাকতেন। হযরত দাউদ (আ.)-এর উপর আসমানি কিতাব যাবুর নাজিল হয়। হযরত দাউদ (আ.) যাবুর কিতাব অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তিনি মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে মনে এমন শক্তি লাভ করেন যে, তিনি যখন লোহা ধরতেন, তখন সেটি গলে যেত। তিনি মোরাকাবার বিদ্যার ফলে লোহা দিয়ে অস্ত্র তৈরি করতেন। তিনি আল্লাহ্’র মনোনীত রাসুল হওয়ায় আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগ করে ধর্ম করতেন এবং অনুসারীদেরকেও আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগ করে তাঁর ইচ্ছায় পরিচালিত হওয়ার জন্য মোরাকাবা শিক্ষা দেন। হযরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন হযরত দাউদ (আ.)-এর সম্মানিত সাহেবজাদা। তিনি একদিকে রাসুলের পুত্র ও নবি ছিলেন, অপরদিকে তিনি আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে বাদশাহি লাভ করেন। হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁর পিতা হযরত দাউদ (আ.)-এর নিকট থেকে মোরাকাবার শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে পিতার উপর অবতীর্ণ ‘যাবুর’ কিতাব অনুযায়ী ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তাঁর নিকট থেকে তাসাউফ বিদ্যা ও মোরাকাবার শিক্ষা নিয়ে তাঁর শিষ্য আসিফ ইবনে বারখিয়া অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়েছেন। ফলে আসিফ রানি বিলকিসের রাজ সিংহাসন ইয়েমেনের সাবা থেকে জেরুজালেমের বাইতুল মুক্বাদ্দাসে চোখের পলকের চেয়েও কম সময়ে আত্মিক শক্তির বলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। হযরত সোলায়মান (আ.) মোরাকাবার মাধ্যমে এমন জ্ঞান লাভ করেন যে, ফলে বাতাস তাঁর নির্দেশ পালন করে সিংহাসন নিয়ে আকাশপথে উড়ে বেড়াতেন। এমনকি তিনি পশু-পাখি ও পিপীলিকার ভাষাও বুঝতেন। এমনিভাবে হযরত ইয়ারমিয়া (আ.) বনি ইসরাইলের নবি ছিলেন। তিনিও তাঁর অনুসারীগণকে পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের অনুসরণের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মোরাকাবা শিক্ষা দিতেন।

হযরত উযায়ের (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলের অন্যতম নবি। তিনি হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলায়মান (আ.) এবং হযরত যাকারিয়া (আ.) ও হযরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভূত হন। কথিত আছে যে, বনি ইসরাইলের মধ্যে কারো নিকট যখন তাওরাত কিতাব সংরক্ষিত ছিল না, তখন হযরত উযায়ের (আ.)-এর ক্বালবের স্মৃতিপটে আল্লাহ্ তায়ালা তাওরাত কিতাব প্রকাশ করে দেন। হযরত উযায়ের (আ.) মোরাকাবার মাধ্যমেই ক্বালবে তাওরাত কিতাব সুস্পষ্টভাবে দেখতে পান। তাঁর জাতির নিকট তা প্রকাশ করেন। তিনি বনি ইসরাইলকে তা তেলাওয়াত করে শোনান। হযরত উযায়ের (আ.) বনি ইসরাইলের নবি হিসেবে তাওরাত শিক্ষা দিয়েছেন, পাশাপাশি তিনিও স্বজাতিকে আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবার শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত যাকারিয়া (আ.) ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ.)-এর বংশধর। হযরত যাকারিয়া (আ.) একদিকে নবি ছিলেন, অন্যদিকে তিনি ছিলেন বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের কাহিন। আর ‘কাহিন’ বলা হতো, যার নেতৃত্বে বাইতুল মুক্বাদ্দাসে ধর্মের রীতিনীতি পালিত হতো। “হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর সাহাবিগণ যখন রাতের বেলায় নিদ্রা যেতেন, তখন তিনি ইবাদতে ও মোরাকাবায় মশগুল হতেন। অতঃপর তাঁর প্রতিপালককে ডাকতেন; চুপিসারে বলতেন, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! তখন আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে বলতেন, আমি হাজির, আমি হাজির, আমি হাজির।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৩) হযরত যাকারিয়া (আ.) বনি ইসরাইলের নবি হিসেবে নিজেও মোরাকাবা করতেন, অনুসারীদেরকেও মোরাকাবার শিক্ষা দিতেন।

হযরত ইয়াহইয়া (আ.) ছিলেন হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর সম্মানিত সাহেবজাদা। হযরত ইয়াহইয়া (আ.) তাঁর পিতা হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর কাছ থেকে আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবার শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনিও তাঁর পিতার মতো তাওরাত কিতাবের শিক্ষা স্বজাতিকে দিতেন। হযরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর হেদায়েতের দায়িত্ব পালন হলে তিনি যেমন একাকী ধ্যানমগ্ন থাকতে পছন্দ করতেন, তেমনি তিনি বনি ইসরাইলকে মোরাকাবা তথা ধ্যানমগ্ন হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগের পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। অনুরূপভাবে হযরত ঈসা (আ.) ছিলেন উচ্চস্তরের রাসুল। তাঁর উপর মহান আল্লাহ্ ইনজিল কিতাব অবতীর্ণ করেন। তিনি তাঁর উম্মতকে ইনজিল শরীফ অনুযায়ী ধর্মীয় তালিম দিতেন এবং স্বজাতিকে ও অনুসারীগণকে মোরাকাবার সুমহান পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। হযরত ঈসা (আ.) গভীর ধ্যান তথা মোরাকাবা সম্পর্কে বলেন, “সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান, যার কথার মধ্যে থাকে আল্লাহ্’র স্মরণ, সময় কাটে গভীর ধ্যানে এবং দৃষ্টিতে থাকে মহাসত্যের অনুসন্ধিৎসা।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৪১) হযরত ঈসা (আ.) মোরাকাবার জ্ঞানের মাধ্যমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে পারতেন। তিনি আল্লাহ্’র হুকুমে মৃতকে জীবিত করতেন। এমনকি তিনি মাটি দিয়ে পাখি বানিয়ে তাতে ফুৎকার দিলে আল্লাহ্’র হুকুমে সেটি জীবন্ত পাখি হয়ে যেত। তাঁর অনুসারীগণ গৃহে যা আহার করত এবং যাহা মওজুদ করত, তাও তিনি বলে দিতে পারতেন।

হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও মহামানব। তিনি হেরা গুহায় ১৫ বছর মোরাকাবা তথা ধ্যান-সাধনা করেছেন। তিনি যখন প্রভুর প্রেমে সেখানে যেতেন, তখন হযরত মা খাদিজা (রা.) তাঁর খাবার সরবরাহ করতেন। ধ্যান-সাধনা শেষ হলে আবার বাসায় প্রত্যাবর্তন করতেন। এভাবে ১৫ বছর আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভের জন্য মোরাকাবা করেছেন। অতঃপর তিনি মাহে রমজানে দীর্ঘদিন হেরা গুহায় গভীর সাধনায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। অবশেষে মহান আল্লাহ্ তাঁকে রাসুল হিসেবে মনোনীত করে রেসালাত দান করেন এবং পবিত্র কুরআন নাজিল করেন। মহান আল্লাহ্ সর্বপ্রথম ওহি করেন, “ইক্বরা’ বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক্ব, খালাক্বাল ইনসানা মিন ‘আলাক্ব, ইক্বরা’ ওয়া রাব্বুকাল আকরাম, আল্লাযী ‘আল্লামা বিলক্বালাম, ‘আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়া‘লাম।” অর্থাৎ : “হে রাসুল (সা.)! পড়–ন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে, পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক অতিশয় দয়ালু, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।” (সূরা আল আলাক্ব ৯৬: আয়াত ১ থেকে ৫) হযরত মোহাম্মদ (সা.) হেরা গুহায় মোরাকাবা অবস্থায় পবিত্র কুরআনের ওহি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি অলৌকিক মু‘জিজার মাধ্যমে এতো উচ্চস্তর লাভ করলেন যে, মহান আল্লাহ্ তাঁকে মি‘রাজে নিয়ে আরশে আজীমে সামনাসামনি কথা বলেছেন। তিনি উম্মতের জন্য মে’রাজস্বরূপ নামাজ নিয়ে আসেন। হযরত রাসুল (সা.) মু‘জিজার মাধ্যমে শাহাদত অঙ্গুলি মোবারকের ইশারায় আকাশের চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছেন। এছাড়াও তাঁর জীবনে অসংখ্য অলৌকিক মু‘জজার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, যা পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে বর্ণিত রয়েছে।
আল্লাহ্’র রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সা.) সাহাবিগণকে মোরাকাবার শিক্ষা দিতেন। আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্’র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন,‘লা ‘ইবাদাতা কাত্তাফাক্কুরি।’ অর্থাৎ- “গভীরভাবে চিন্তা করার বা মোরাকাবার সমতুল্য কোনো ইবাদত নেই।” (তাফসীরে মাজহারী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০০)
প্রিয় পাঠক! আপনারা অবগত হলেন যে, হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক যুগে নবি-রাসুলগণ মোরাকাবা ও সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্’র নৈকট্য লাভ করেছেন। তাঁরা তাদের অনুসারী উম্মতকে মোরাকাবার সুমহান শিক্ষা প্রদান করেছেন। বিশেষ করে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর যুগে মোরাকাবার ক্রমবিকাশ ও বিস্তার সাধিত হয়। আল্লাহ্’র রাসুল (সা.)-এর সাহাবিগণ বিশেষ করে আহলে সুফফার সদস্যগণ মসজিদে নববিতে মোরাকাবা, ধ্যান-সাধনায় ও ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। আল্লাহ্’র রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়ত ও রেসালাতের যুগের পরিসমাপ্তি হয়। এর পরে বেলায়েতের যুগের সূচনা হয়। হযরত রাসুল (সা.)-এর পর বেলায়েতের যুগে নবি-রাসুলগণের সুযোগ্য উত্তরসূরি হয়ে আউলিয়ায়ে কেরাম উম্মতে মোহাম্মদীকে মোরাকাবার তালিম প্রদান করছেন। আল্লাহ্’র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন,“আল‘উলামাউ ওয়ারাছাতুল আমবিইয়া।” অর্থাৎ- “আলেমগণ (আল্লাহ্ তত্ত্বের জ্ঞানে জ্ঞানী অলীগণ) নবিদের ওয়ারিস তথা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৪)
নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে তাঁরাই নবি-রাসুলগণের ওয়ারিস, যাঁরা রাসুলের নুরে হিদায়েতের শক্তির অধিকারী অলী-আল্লাহ্। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্’র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন,“উলামাউ উম্মাতী কাআমবিইয়াই বানী ইসরাঈল।” অর্থাৎ- “আমার উম্মতের আলেমগণের (আল্লাহ্’র অলীগণের) মর্যাদা ঐরূপ, যেরূপ মর্যাদা বনি ইসরাইলের নবিগণের।” (তাফসীরে রূহুল বয়ান ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮) হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পর বেলায়েতের যুগে আউলিয়ায়ে কেরাম যুগে যুগে মানুষকে যুগোপযোগী পদ্ধতিতে মোরাকাবা শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমান যুগে একজন মানুষ আল্লাহ্’র অলীর সান্নিধ্যে গমন করে মোরাকাবা, ধ্যান-সাধনা ও ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে অলী আল্লাহ্ হয়েছেন। বেলায়েতের যুগে আউলিয়ায়ে কেরামের মোরাকাবার বিশেষ কিছু ঘটনা তুলে ধরবো, যেন পাঠক এ সম্পর্কে আরো অবগত হতে পারেন।

ইমাম শা’রানী (রহ.) কর্তৃক বর্ণিত, “মহান আল্লাহ্ার ইচ্ছায় হযরত বড়ো পির (রহ.)-এর সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল সারা বাগদাদ নগরী। সারা মুসলিম জাহানেও তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান-গরিমা ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোকজন এসে তাঁর নিকট ইলমে শরিয়ত ও ইলমে মারেফাতের শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগল। তাঁর এরূপ প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে কতিপয় ঈর্ষাকাতর আলেম তাঁকে সহ্য করতে পারছিল না। তারা বড়ো পিরকে পরীক্ষা করার জন্য একশত জটিল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মনস্থ করে একদিন একযোগে তাঁর দরবারে হাজির হলেন। তাঁর দরবারে আসার পর হযরত বড়ো পির (রহ.) অবনত মস্তকে মোরাকাবা অবস্থায় রইলেন। এই সময় হঠাৎ তাঁর বক্ষ হতে একটি পবিত্র নুর বের হয়ে উপস্থিত আলেমদের প্রত্যেকের বক্ষ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করল। সাথে সাথে তাঁরা সকলে চেতনা হারিয়ে অস্থিরভাবে চিৎকার করতে লাগল। মাথার পাগড়ি দূরে নিক্ষেপ করল। কিছুক্ষণ পর বড়ো পির (রহ.) মোরাকাবা থেকে মাথা তুলে তাদেরকে বললেন, আপনারা এমন করছেন কেন? স্থির হন এবং আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করুন। তাঁর কথায় সকলে শান্ত হলেন। সহসা তাদের অস্থিরতা বিদূরিত হয়ে গেল। কিন্তু তারা গাওছুল আযম (রহ.)-এর কাছে যে প্রশ্নসমূহ জিজ্ঞেস করতে এসেছিলেন, তা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন। শত চেষ্টা করেও কেউই তাদের সেই প্রশ্নসমূহ স্মরণ করতে পারলেন না। তখন বড়ো পির (রহ.) নিজেই তাদের অন্তর্নিহিত প্রশ্নসমূহের সঠিক জবাব দান করলেন। এমন বিস্ময়কর ব্যাপার দেখে আলেমগণ মনে-প্রাণে বড়ো পির (রহ.)-এর বুজুর্গী এবং শ্রেষ্ঠ^ত্ব স্বীকার করে নিলেন এবং অত্যন্ত লজ্জিতভাবে হযরত বড়ো পির (রহ.)-এর নিকট ক্ষমা চেয়ে দরবার ত্যাগ করলেন।” (বড়ো পির হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর জীবনি ও আশ্চর্য কেরামত, পৃষ্ঠা ২০১ ও ২০২)
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মোরাকাবার মাধ্যমে বেলায়েতের যুগে আল্লাহ্ ও হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সাথে যোগাযোগ করা যায়। হযরত খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর কামালিয়াত লাভের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি,
“একদা কুতুবে আকবর হযরত শেখ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) ও হযরত খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.) উভয় আল্লাহ্’র অলী হজ করতে মক্কা গিয়েছেন। তাওয়াফ শেষে হযরত বড়ো পির সাহেব খাজা সাহেবের হাত ধরে বললেন, হে আল্লাহ্! আমি মঈনুদ্দিনকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসল, আমি তা কবুল করলাম। অতঃপর হযরত বড়ো পির সাহেব হযরত খাজা সাহেবকে নিয়ে হুজুর (সা.)-এর রওজায় গেলেন। খাজা সাহেব সেখানে গিয়ে হুজুরের রওজার সামনে বলেন, ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’ হুজুর (সা.)-এর পবিত্র রওজা শরীফ থেকে উত্তর আসল, ‘ওয়া আলাইকুম সালাম ইয়া কুতুবাই মাশায়িখিল বাররি ওয়াল বাহরি’, হে জল ও স্থলের পিরে কামেল তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। ইহা শুনে হযরত বড়ো পির সাহেব হযরত খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-কে বললেন, যাও এখন তোমার কাজ শেষ হয়েছে। তুমি তোমার কামালিয়াত পূর্ণ করেছ।” (হযরত খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম, পৃষ্ঠা ১৬৪ ও ১৬৫)
মোরাকাবার মাধ্যমে আউলিয়ায়ে কেরাম মহান আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে এলহাম প্রাপ্ত হন। হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)-এর জীবনে সংঘটিত এমন উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি উল্লেখ করছি,
“হযরত খাজায়ে খাজেগান সাইয়েদ বাহাউদ্দিন মোহাম্মদ নকশবন্দ বোখারী (রহ.) সদাসর্বদা নির্জনে একাকী বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে আল্লাহ্ তায়ালার মোরাকাবা ও মোশাহাদা করিতেন। একদিন তাঁহার কানে হঠাৎ একটি শব্দ আসিল, ‘হে বাহাউদ্দিন! সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া একমাত্র আমারই চিন্তায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করিবার সময় কি এখনও হয় নাই’?” হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.) বলিয়াছেন, “প্রাথমিক জজবাতেই আমার প্রতি এলহাম হইয়াছিল, ‘তুমি কীভাবে এই পথ এখতিয়ার করিতে চাও? আমি আরজ করিলাম, আমি যাহা আকাক্সক্ষা করি, তাহা যেন বাস্তবে পরিণত হয়। জবাব আসিল, ‘না, যাহা আমি হুকুম করিব তোমাকে তাহাই করিতে হইবে। আমি পুনরায় আরজ করিলাম, ইহা আমার পক্ষে সম্ভব নহে। আমি যাহা চাই তাহাই যদি হয়, তবেই হয়ত আমি এই পথে সাবেত কদম থাকিতে পারি। দুইবার এইরূপ সওয়াল জবাব হইল। ইহার পর পনের দিন যাবত আমার বাতেনি হালত খুবই খারাপ হইয়া গেল এবং আমি একেবারেই মুষড়াইয়া পড়িলাম। যখন নিরাশার ঘোর অন্ধকারে আমি হাবুডুবু খাইতেছিলাম, সেই সময় এলহাম হইল, ‘তুমি যেভাবে চাও সেইভাবে থাক’।” (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া রা. ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৫ ও ২২৬)

ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদ-ই-আলফ-ই সানী হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) স্বীয় মোর্শেদ হযরত খাজা বাকি বিল্লাহ (রহ.)-এর নিকট থেকে নকশবন্দিয়া তরিকার খাস নিসবত লাভ করার পর তাঁর নির্দেশে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিপূর্বে তাঁর সুখ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পেয়ে চারদিক থেকে দলে দলে লোক তাঁর খিদমতে হাজির হয়ে বাই‘আত হতে থাকে। এই সময় “একদিন তিনি স্বীয় হুজরায় ফজরের নামাজের পর মোরাকাবায় মশগুল আছেন, এমন সময় হযরত রাসুলে পাক (সা.) রুহানিভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশতা এবং আউলিয়া ও গাউস কুতুবদের নিয়ে সেখানে তাশরীফ আনেন এবং নিজ হাতে একটি অমূল্য ‘খিলআত’ অর্থাৎ স্বীয় প্রতিনিধিত্বের প্রতীকস্বরূপ এক বিশেষ পোশাক পরিয়ে দেন এবং বলেন, ‘শায়খ আহমদ! মুজাদ্দিদের প্রতীকস্বরূপ আমি তোমাকে এই ‘খিলআত’ পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় সহস্রাব্দের জন্য তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। (তোমার যুগের) আমার উম্মতের দ্বিন-দুনিয়ার বিষয়ের দায়িত্ব আজ থেকে তোমার উপর ন্যস্ত করা হলো।’ এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরির ১০ই রবিউল আউয়াল শুক্রবার ফজরের নামাজের সময় সংঘটিত হয়। আম্বিয়াগণ সাধারণত যে বয়সে পয়গম্বরি লাভ করতেন সেই বয়সে অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়সের সময় হযরত শায়েখ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিতে ভূষিত হন।” (ড. আ.ফ.ম. আবুবকর সিদ্দীক কর্তৃক প্রণীত ‘বিপ্লবী মুজাদ্দিদ (রহ.)’, পৃষ্ঠা ৪৯)
এমনিভাবে পিরানে পির দস্তগির, সুলতানুল মাশায়েখ, সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) ছিলেন জগদ্বিখ্যাত আল্লাহ্’র বন্ধু। তিনি ইমাম হুজুর হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। ইমাম হুজুরের ছবক শিক্ষা করার ইতিহাস অলৌকিক কারামতে পরিপূর্ণ। একদিন শাহ এনায়েতপুরী (কু. ছে.) হুজরা শরীফে বসা ছিলেন। এমন সময় তিনি মৌলভি মোহাম্মদ আছরউদ্দিন সাহেবকে ডেকে বললেন, “আপনি মাওলানা সাহেবকে (ইমাম হুজুরকে) সর্ব শরীরে ছবক দিয়ে দেন।” একথা বলে শাহ এনায়েতপুরী (কু. ছে.) বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। মৌলভি সাহেব ইমাম হুজুরকে বললেন, ‘আপনি আগামীকাল থাকবেন না?’ ইমাম হুজুর জানালেন যে, তিনি আগামীকাল থাকবেন। তখন মৌলভী সাহেব বললেন, ‘আজ আমার একটু কাজ আছে, আগামীকাল ছবক দিলে চলবে না?’ ইমাম হুজুর বললেন, ‘চলবে’। পরদিন সকাল বেলা শাহ এনায়েতপুরী (কু. ছে.) হুজরা শরীফে এসে বসলেন। ইমাম হুজুর তখন মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাহ্ এনায়েতপুরী তাঁকে বসতে হুকুম দিলেন। তারপর তিনি নিজেই ইমাম হুজুরের সর্বশরীরে ছবক দিলেন এবং বললেন, “বাবা মনে রাখবেন, আজ থেকে আপনার যত ছবক আছে সব আমি নিজেই দেবো।” (ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর জীবনী, পৃষ্ঠা ৮৫)

ইমাম হুজুর মোরাকাবা অবস্থায় দায়রার সবকগুলোর শিক্ষাগ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম হুজুর ফরমান, “হঠাৎ একদিন আমার খেয়াল হলো যে, হুজুর কেব্লাজান বলেছিলেন, আপনার যত সবক আছে সব আমি নিজেই শিক্ষা দেবো। তাহলে আমি অন্যের কাছে যাই কেন? আমি আর অন্য কারো কাছ থেকে সবক নিলাম না। বিশেষ এক পদ্ধতিতে সাধনা করতে শুরু করলাম।” ইমাম হুজুর বিশেষ নিয়মে আজিজি এনকেছারি শুরু করার কিছুদিন পর তাঁর কাছে আওয়াজ আসতে লাগল, “নোট করো, নোট করো।” ইমাম হুজুর বলেন, “আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আগা নাই, গোড়া নাই, কিসে কী নোট করব?” অর্থাৎ কোনো বিষয়ে নোট করবেন আর কেনই বা নোট করবেন, তা তাঁর জানা নাই। তাই তিনি কীভাবে নোট করবেন, তা তাঁর জানা নাই। তাই তিনি কীভাবে নোট করবেন? তিনি আরো ফরমান, “এই আওয়াজ কোত্থেকে আসলো, আমি প্রথমে বুঝতে পারলাম না।” এই আওয়াজ আসার পর থেকে তাঁর অন্য এক ভাব হয়ে গেল। তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসে নোট করা শুরু করে দিলেন। এভাবে তিনি ২৪ দায়রা ও তরিকার সমস্ত সবকগুলো নোট করে ফেললেন। যখন যে সবক তিনি নোট করতেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে ঐ সবকের হাকিকত খুলে যেত এবং ছায়ের ছুলুক ও ফানা বাকা হতে শুরু করত। তাঁর কাছে নতুন নতুন মাকামাতের সুসংবাদ আসতে লাগল এবং মাকামাতের ভেদ রহস্য খুলে গেল।” (ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর জীবনী, পৃষ্ঠা ৮৭ ও ৮৮)

প্রিয় পাঠক! আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) গভীর মোরাকাবা ও ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মহান আল্লাহ্’র সাথে যোগাযোগ করেছেন। মোর্শেদ কেব্লাজান মোরাকাবা অবস্থায় মহান আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে যোগাযোগের এবং তাঁর সাহায্য লাভের দুটি বিশেষ ঘটনা প্রসঙ্গে আমার মহান মোর্শেদ ফরমান,
“১৯৯২ সালের দুটি ঘটনা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে উল্লেখ করছি। যে ঘটনায় মহিমান্বিত আল্লাহ্ আমাকে স্বরূপে তাঁর দিদার দিয়েছেন এবং দয়া করে আমার সাথে কথা বলেছেন। আর তা হলো, ‘প্রথম ঘটনাটি ১৯৯২ সালে আয়োজিত বিশ্ব সূফী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল। আমি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতিঝিল টিএন্ডটি কলেজ সংলগ্ন সড়কে বিশ্ব সূফী সম্মেলন আহ্বান করি। এদিকে সম্মেলনের কয়েক দিন পূর্বে তরিকত ও অলী-আল্লাহ্ বিদ্বেষী একটি সংগঠন সম্মেলনকে নস্যাৎ করার গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হয়। ফলে আমি একদিন ফজরের নামাজের পর ‘বাবে রহমত’-এ বসে, সম্মেলনে কোনো রকম সমস্যা সৃষ্টি হয় কি না, এ বিষয়ে খুবই চিন্তামগ্ন ছিলাম। এমন সময় আমি দেখতে পাই, আমার মহান মালিক পরম দয়াময় আল্লাহ্ তায়ালা দয়া করে সম্মেলন চত্বরে তশরিফ নিয়েছেন। সাথে আমার মোর্শেদ, পিরানে পির, দস্তগির, সুলতানুল মাশায়েখ, সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) রয়েছেন।
অতঃপর পরম করুণাময় আল্লাহ্ দয়া করে সম্মেলন চত্বরের প্রধান তোরণ, মঞ্চ ও প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তারপর তিনি দয়া করে আমার সাথে কথা বললেন এবং অভয় দিয়ে সুসংবাদ দিলেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। সম্মেলনে কোনো রকম অসুবিধা হবে না। অতঃপর বাস্তবে হয়েছেও তাই। আমার আহ্বানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সূফী সম্মেলনটি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে স্বর্গীয় পরিবেশে সুসম্পন্ন হয়’।”

“দ্বিতীয় ঘটনাটিও ১৯৯২ সালের। বাবে জান্নাত, দেওয়ানবাগ শরীফ নিয়ে আমি তখন ভীষণ চিন্তিত। উল্লেখ্য, ১৯৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলাধীন দেওয়ানবাগ গ্রামে ‘বাবে জান্নাত’ নামে এ দরবার শরীফটি আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। ১৯৯০ হতে ১৯৯২ সাল এ দু’বছর স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্নভাবে দরবার শরীফকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অপচেষ্টা চালায়। ফলে এ দু’বছর সেখানে মোহাম্মদী ইসলামের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এমনি দুঃসময়ে একদিন আমি বাবে রহমতের হুজরা শরীফে খাটের উপর বসে দরবার শরীফ নিয়ে চিন্তা করছিলাম। এ সময়ে মহিমান্বিত আল্লাহ্ তায়ালা আমার প্রতি তাঁর দয়ার হস্ত মোবারক প্রসারিত করলেন। তিনি দয়া করে আমার সামনে স্বরূপে উপস্থিত হলেন এবং আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। এই যে দেখেন, আমার ডান হাতের তালুর নিচে আপনার দরবার শরীফ’। এ সময় আমি দেখতে পাই, পরম করুণাময় আল্লাহ্ আমার সামনে রয়েছেন। আর তিনি এখান থেকেই তাঁর ডান হাত মোবারক বাড়িয়ে দিলেন, সাথে সাথে তাঁর ডান হাত মোবারক এতটাই প্রসারিত হলো যে, অশেষ দয়াময় আল্লাহ্’র ডান হস্ত মোবারকের তালুর নিচে আমি নারায়ণগঞ্জের বাবে জান্নাত, দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ দেখতে পাই। মহিমান্বিত আল্লাহ্’র এরূপ দিদার ও অভয়বাণীতে আমি নিশ্চিন্ত ও আশ্বস্ত হলাম। এ ঘটনার পরই নারায়ণগঞ্জ জেলার বাবে জান্নাত, দেওয়ানবাগ দরবার শরীফে পুনরায় মোহাম্মদী ইসলামের কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়, যা বর্তমানেও অব্যাহত আছে।” (তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৫৩ ও ১৩৫৪)

প্রিয় পাঠক! আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান মোরাকাবার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভের শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রসার ও বিস্তৃতির জন্য এলমে তাসাউফকে ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন এবং তাঁর প্রস্তাবের যৌক্তিকতা উপলব্ধি করে ১৯৯৬ সালে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি শিক্ষায় তাসাউফ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মহান মোর্শেদ কেব্লাজান মোরাকাবার ব্যাপক ক্রমবিকাশের জন্য রাজধানীর বুকে বিশ্ব সূফী সম্মেলন ও পরবর্তীতে বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন আয়োজন করেছেন। এ সম্মেলনে এসে তাঁর সুমহান শিক্ষা গ্রহণ করে অগণিত মানুষ আশেকে রাসুল হয়ে স্বপ্ন ও মোরাকাবায় হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দিদার লাভ করেছেন। আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান তাঁর অনুসারী আশেকে রাসুলগণকে মোরাকাবা করে ফায়েজ হাসিলের সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন।

আমি আমার মহান মোর্শেদ কেব্লাজানের কাছ থেকে প্রাপ্ত মোরাকাবার শিক্ষা তাঁর ওফাতের পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে ক্রমবিকাশের লক্ষ্যে সকল দরবার ও খানকাহ শরীফ এবং জাকের মজলিশে মোরাকাবার শিক্ষাকে চলমান রেখেছি। মহান আল্লাহ্’র নিকট সাহায্য চাই, তিনি যেন দয়া করে মোরাকাবার এ সুমহান শিক্ষা ক্রমবিকাশের মাধ্যমে মানুষকে দয়াময় আল্লাহ্ ও রাসুলের নৈকট্য লাভ করাতে পারি। মহান রাব্বুল আলামিন দয়া করে কবুল করুন। আমিন। (চলবে)
[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।]

সম্পর্কিত পোস্ট