মোরাকাবার গুরুত্ব ও ফজিলত
ইমাম প্রফেসর ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
মহান আল্লাহ সাথে যোগাযোগের পাঁচটি মাধ্যম রয়েছে, যথা- স্বপ্ন, মোরাকাবা, ফায়েজ, কাশ্ফ ও এলহাম। এই পাঁচটি মাধ্যমের মধ্যে আল্লাহ্কে পাওয়ার এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের সহজতর উপায় হচ্ছে মোরাকাবা। মোরাকাবা শব্দের বাংলা অর্থ ধ্যান, ইংরেজিতে একে Spiritual Meditation বলা হয়। যে ধ্যানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পরিচয় জানা যায়, তাঁদের নির্দেশমতো চলা যায় এবং সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে জানা যায় তাকেই প্রকৃত অর্থে মোরাকাবা বলে। মোরাকাবায় বসে মহান আল্লাহ নিকট নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, নিজের আপদ-বিপদ, বালা মসিবতের কথা মহান মালিকের নিকট বলা যায় এবং নিজের পাপ মোচনের জন্য দুই চোখের পানি ফেলে দয়াময় আল্লাহ নিকট ক্ষমা চাওয়া যায়। কিন্তু এই বিষয়গুলো স্বপ্ন, কাশ্ফ, ফায়েজ ও এলহামের মাধ্যমে সম্ভব নয়। ‘স্বপ্নে’ মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আল্লাহ্ তায়ালা যা দেখাবেন, তা দেখা যায়। নিজের বলার কোনো সুযোগ থাকে না। আবার কাশ্ফের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁর মারেফত তথা নিগূঢ রহস্য দেখিয়ে থাকেন। অন্যদিকে ফায়েজ আল্লাহ তরফ থেকে আসে। ফায়েজ খেয়াল করা যায়। এর মাধ্যমে ভালো-মন্দ বুঝতে পারা যায়। এলহাম আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে সংবাদ। উল্লিখিত চারটি মাধ্যম আল্লাহ পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, এখানে আল্লাহ সাথে বান্দার কথোপকথনের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু মোরাকাবার মাধ্যমে বান্দা তাঁর দয়াময় প্রভুকে দেখতে পারে। আল্লাহ্ চাইলে মোরাকাবারত বান্দার সামনে হাজির-নাজির হতে পারেন, বান্দা আল্লাহ কদম মোবারক জড়িয়ে ধরে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন এবং নিজের চোখের পানি ফেলে কাঁদতে কাঁদতে বলতে পারেন- আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার জীবন তোমাকে উৎসর্গ করলাম। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। সুতরাং সাধনা জগতে মোরাকাবার গুরুত্ব অপরিসীম।
মহান আল্লাহ দর্শন মোরাকাবার মাধ্যমে সম্ভব। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত সকল নবি ও রাসুল মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ সাথে যোগাযোগ করেছেন। নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ একই পদ্ধতিতে আল্লাহ সাথে যোগাযোগ করেন। মানুষের হৃদয়ে তথা ক্বালবের ৭ম স্তর নাফসির মোকামে আল্লাহ বাসস্থান। যুগ পরিক্রমায় যত মহামানব আল্লাহ্কে পেয়েছেন তাঁদের সকলেই হৃদয় মাঝে অনুসন্ধান করেই মহান আল্লাহ পরিচয় লাভ করেছেন। মোরাকাবার মাধ্যমে সাধক জীবাত্মাকে বেষ্টনকারী ষড়রিপু, যথা- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, ও মাৎসর্যকে দমন করে হৃদয়ের পরিশুদ্ধতা অর্জনের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করতে পারেন। সেজন্য সাধককে গভীর মোরাকাবার মাধ্যমে অন্তর চক্ষু জাগ্রত করতে হয়। তাইতো সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় লিখেছেন- “মিথ্যা শুনিনি ভাই; এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির কাবা নাই।” কোনো মসজিদ, মন্দির বা গীর্জায় প্রভু থাকেন না। এই হৃদয়ে ধ্যান করে হযরত ঈসা (আ.), হযরত মুসা (আ.) সত্যের পরিচয় পান, শ্রীকৃষ্ণ লাভ করেন মহাগীতা। এখানে ধ্যান করে মানবজাতির মুক্তির জন্য গৌতম বুদ্ধ তাঁর রাজ্য ত্যাগ করেন। এই হৃদয় কাবায় ১৫ বছর ধ্যান সাধনা করে সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.) আল্লাহ্ তায়ালার পরিচয় লাভ করত মানব মুক্তির বিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআন লাভ করেন। তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাম্যবাদী কবিতায় ক্বালবকে (হৃদয়) সকল কালের জ্ঞান আখ্যায়িত করে বলেন, “তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ।”
ধ্যানের কেব্লা হচ্ছে আপন ক্বালব এবং এ ক্বালবের ভিতরে প্রবেশের জন্য সাধককে পর্যায়ক্রমে ৭টি স্তর অতিক্রম করতে হয়। ক্বালবের ১ম স্তর সুদুরে মোকাম, যেখানে শয়তান অবস্থান করে সাধককে সাধনার কাজে বাধার সৃষ্টি করে। তাই মহান মোর্শেদের দয়া ও সাহায্য ব্যতীত ক্বালবের ৭টি স্তর অতিক্রম করা সম্ভব নয়। মোর্শেদের দেওয়া শিক্ষানুযায়ী মোরাকাবার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সুদুর, নশর, সামসি, নুরি, কুরব, মকিম এই ৬টি স্তর পার হয়ে নাফসির মোকামে পৌঁছতে হয়। আর তখনই মহান মালিকের রূপ দর্শন সম্ভব হয়। মূলত মোরাকাবার মাধ্যমে যিনি সাধনা করে হৃদয়ের মাঝে আল্লাহ্কে জাগ্রত করতে পারেন, তিনি হন আল্লাহ্ময় এবং পরিণত হন আল্লাহ বন্ধুতে। মোর্শেদের পবিত্র হৃদয় মুরিদের কাছে পরম প্রেমের পবিত্র কেব্লা। সাধক যখন আপন ক্বালবের গহীনে ডুব দিয়ে আপন মোর্শেদের জ্যোতির্ময় চেহারা মোবারক খেয়াল করে মোরাকাবা করেন, তখন ক্বালবের সুদুরের মোকাম থেকে শয়তান পালিয়ে যায়। অতঃপর মোর্শেদের চেহারা মোবারক খেয়াল করে মোর্শেদের কদম মোবারক জড়িয়ে ধরে একে একে ৬টি স্তর অতিক্রম করে নাফসির মোকামে পৌঁছাতে পারলে সাধকের পক্ষে মহান মালিকের সাক্ষাৎ লাভ সম্ভব হয়।
আমার মহান মোর্শেদ, মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)-এর ১ম শিক্ষা হলো আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধি লাভের সর্বোত্তম মাধ্যম হচ্ছে মোরাকাবা। আপন মোর্শেদের চেহারা মোবারক খেয়াল করে মোরাকাবা করলে মোর্শেদের পক্ষ থেকে মুরিদের ক্বালবে ফায়েজ বর্ষিত হয়। এর ফলে রিপুগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। মূলত ইরেজার দিয়ে যেমন লেখা মুছা যায়, ঠিক তেমনি মোর্শেদের ফায়েজ হচ্ছে ইরেজারের মতো, যা গুনাহ ময়লাকে ধীরে ধীরে হৃদয় থেকে মুছে দেয়। মুরিদ তখন পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হতে সক্ষম হয়। হযরত রাসুল (সা.) ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন, আর ৫২ বছর বয়সে মি‘রাজে গিয়ে উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য নামাজের বিধান নিয়ে আসেন। তাহলে প্রশ্ন জাগে, মিরাজের পূর্বে ১২ বছর সাহাবিরা কোন ইবাদত করেছেন? মূলত ১২ বছর তাঁরা হযরত রাসুল (সা.)-এর চেহারা মোবারকের মোরাকাবা বা ধ্যান করে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা লাভ করেছেন।
সুতরাং মোরাকাবার গুরুত্ব ও ফজিলত অত্যধিক। উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “একদা আমি রাতের শেষ প্রহরে বাতির আলোতে বসে আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর কাপড় মোবারক সেলাই করছিলাম। এ সময় হঠাৎ প্রদীপটি নিভে গেলা এবং সুঁচটি আমার হাত থেকে পড়ে গেলে আমি সেটি হারিয়ে ফেললাম। অতঃপর আল্লাহ রাসুল (সা.) ঘরে প্রবেশ করলেন। এ সময় তাঁর চেহারা মোবারকের নুরের জ্যোতিতে অন্ধকার ঘর আলোকময় হয়ে গেলো এবং ঐ আলোতেই আমার হারানো সুঁচটি খুঁজে পেলাম। অতঃপর আমি এ কথা রাসুল (সা.)-কে জানালাম- হে আল্লাহ রাসুল (সা.)! আপনার চেহারা মোবারক কতইনা আলোকিত! তখন তিনি বললেন- বড়ই পরিতাপ! তাদের জন্য, যারা আমার চেহারার প্রতি মহব্বতের নজরে তাকাল না (অর্থাৎ ধ্যান করল না)।” [ইমাম ইবনে হাজার হায়তামী (রহ.)-এর আন নি‘মাতুল কোবরা কিতাব, পৃষ্ঠা ৪১ ও ৪২) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, “আমি সর্বসময় রাসুল (সা.)-এর চেহারা মোবারক ধ্যান করতে ভালোবাসি।” (মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়, পৃষ্ঠা ১৯১) ইবনে আবেদ কায়েস হতে বর্ণিত আছে, “আমি সাহাবিদের একজন, দু’জন বা তিনজন নহে বরং বহু সাহাবা হতে শুনেছি যে, ইমানের নুর বা জ্যোতি হলো মোরাকাবা।” হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) তাঁর কিছু মুরিদ সন্তানকে লক্ষ্য করে বলেন, “আমি আল্লাহ্কে ডাক দিলে সাথে সাথে জবাব পাই, তোমরা পাও না? মোরাকাবার শিক্ষাটি লাভ করলে তোমরাও পাবে।” ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ চন্দ্রপুরী (রহ.) বলেন, “আমিত্ব ভুলে আল্লাহ নৈকট্য লাভের সহজ উপায় হলো মোরাকাবা।” (মোর্শেদের দরবারে মুরীদের করণীয়, পৃষ্ঠা ১৯২) সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজানবলেন, “মোরাকাবার মাধ্যমে মানুষ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতের জ্ঞান লাভ করতে পারে। তখন তার নিকট স্রষ্টা ও সৃষ্টির ভেদ রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়।”
মোরাকাবার মাধ্যমে ফায়েজ হাসিল করা যায়। ফায়েজ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতের বস্তু। এর আভিধানিক অর্থ প্রবাহ। পবিত্র কুরআনে একে ‘সাকিনা’ অর্থাৎ শান্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মহান আল্লাহ পক্ষ হতে প্রবাহিত প্রেমের জোয়ার, যার সাহায্যে রাব্বুল আলামিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃজন করে তা কায়েম রেখেছেন। ফায়েজই ধর্মের মূল। এই ফায়েজের দ্বারাই মানুষ আত্মশুদ্ধি লাভ করত আল্লাহ নৈকট্য লাভ করতে পারে। ফায়েজ হলো আল্লাহ্ তায়ালা হতে উৎসারিত প্রেমের প্রবাহ। ফায়েজ ‘রূহে আজম’ হতে এসে অবিরামভাবে সবসময় সৃষ্টি জগতের উপর অবতীর্ণ হচ্ছে। মহান আল্লাহ তরফ হতে সমকালীন যুগের ইমামের মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের সর্বত্র ৫ প্রকারের ফায়েজ পৌঁছে থাকে। এই ফায়েজের শক্তি দ্বারাই নবুয়তের যুগে নবি-রাসুল এবং বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহ্গণ মানুষের কুরিপু দমন করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আদর্শ চরিত্রবান করে গড়ে তোলেন।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর এবং রহমতের সময় আশেকে রাসুলদেরকে ফায়েজ হাসিলের শিক্ষা দিয়েছেন। আর এই ফায়েজ নিজ হৃদয়ে হাসিলের জন্য মোরাকাবার কোনো বিকল্প নেই। ফজরের নামাজের পর মোরাকাবার মাধ্যমে ‘কুয়াতে এলাহিয়ার ফায়েজ’ হাসিল করতে হয়; জোহর নামাজের পর ‘হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বতের ফায়েজ হাসিল’ করতে হয়; আসরের নামাজের পর ‘তওবার ফায়েজ’ ও মাগরিবের নামাজের পর ‘তওবা কবুলিয়াতের ফায়েজ’ হাসিল করতে হয় এবং এশার নামাজের পর ‘গাইরিয়াতের ফায়েজ’ হাসিল করতে হয়। এছাড়া রহমতের ওয়াক্তের সময় মোরাকাবা করে রহমতের ফায়েজ হাসিল করতে হয়। এভাবে প্রতিদিন ৬ বার মোরাকাবার মাধ্যমে ফায়েজ হাসিলের ফলে জীবাত্মা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, আর ক্বালবের মাঝে পরমাত্মার রাজত্ব কায়েম হয়।
হযরত রাসুল (সা.) নবুয়তের প্রাপ্তির পর তাঁর সাহাবিদেরকে যে শিক্ষা দিয়েছেন, তা হলো তাঁকে বিশ্বাস করে তাঁর চেহারা মোবারকের মোরাকাবা করা এবং সমস্ত সৃষ্টিজগৎ ও তাঁর প্রতিপালক সম্বন্ধে চিন্তা করা। বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) মি‘রাজ পূর্বকালীন তাঁর সাহাবিদেরকে আল্লাহ সাথে যোগাযোগ করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। যে শিক্ষা নিজ হৃদয়ে ধারণ করে বর্বর আরবজাতি আল্লাহ নিকট আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হয় মু’মিন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবি হযরত দাহইয়াতুল ক্বালবি (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে অর্থাৎ প্রাক ইসলাম যুগে নিজ কন্যা সন্তানসহ ৭০ জন শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন। সেই দাহইয়াতুল ক্বালবি (রা.) পরবর্তীতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে মোরাকাবার শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের অশুদ্ধ নফসকে পরিশুদ্ধ করে বিখ্যাত সাহাবি হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।
ইসলাম ৫টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত যথা- কালেমা বা ইমান, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত। এই ৫টি মৌলিক বিষয়ের হাকিকত পালনের জন্য মোরাকাবার গুরুত্ব রয়েছে, অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে মোরাকাবা অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, মৌখিকভাবে কালেমা পাঠের অর্থ হলো মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের অঙ্গীকার। ভক্তি ও বিশ্বাসের সাথে মহান মোর্শেদের অসিলা ধরে হযরত রাসুল (সা.)-কে স্মরণ করে তাঁর আদর্শ অনুসরণ ও আনুগত্যের মাধ্যমে মোরাকাবা করলে উম্মতের হৃদয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর অন্তর থেকে মোর্শেদের অন্তর হয়ে আল্লাহ সূক্ষ্ম শক্তি ফায়েজ ওয়ারেদ হয়। মোরাকাবার মাধ্যমে এ ফায়েজ অর্জনের সাধনা অব্যাহত রাখলে মানুষের অন্তরের কুরিপু দমন হয়, অতঃপর তার মাঝে আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক সময় সাধকের আল্লাহপরিচয়, নৈকট্য এমনকি আল্লাহ দিদার লাভের সৌভাগ্য হয়। এভাবে সাধকের ইমান পূর্ণতা লাভ করে। কালেমা বা ইমানের পরই নামাজের স্থান। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন নামাজে দণ্ডায়মান হয়, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে গোপনে কথা বলে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৬) হযরত রাসুল (সা.)-এর এই হাদিসের বাস্তবতা তখনই অর্জিত হবে, যখন মোরাকাবার হালতে অর্থাৎ একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা যাবে। হযরত রাসুল (সা.) আরো বলেন, “মনের একাগ্রতা ব্যতীত নামাজ কবুল হয় না।” [নূরুল আসরার (নূর তত্ত্ব) ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫] একাগ্রতা অর্জনের জন্য মোরাকাবার শিক্ষা অপরিহার্য। মু’মিন বান্দা মহান আল্লাহ্কে হাজির-নাজির ওয়াহেদ জেনে একাগ্রচিত্তে ধ্যানের মাধ্যমে নামাজ আদায় করতেন বিধায় তাঁদের নামাজ সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “নামাজ মু’মিন ব্যক্তির জন্য মি‘রাজ।” (তাফসীরে মাজহারী ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৩) বর্ণিত আছে এক যুদ্ধে হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু-এর দেহ মোবারকে ১৬টি ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং তাঁর কদম মোবারকে তিরবিদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে যখন সাহাবিরা তাঁর কদম মোবারক হতে তিরটি বের করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণার কারণে তিরে হাত দেওয়া যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় হযরত রাসুল (সা.) সাহাবিদের বললেন, “আলী (কা.) যখন নামাজরত অবস্থায় থাকবে, তখন তাঁর পায়ের তির বের করবে।” পরবর্তীতে হযরত আলী (কা.) যখন নামাজ আদায় করছিলেন, ঠিক সেসময় সাহাবিগণ তাঁর কদম মোবারক থেকে তির বের করে আনলেন। তিনি বিন্দুমাত্র টের পেলেন না। এতটা হুজুরি দিল অর্থাৎ একাগ্রচিত্তে তিনি নামাজ আদায় করছিলেন যে, নামাজ মহান প্রভুর এশকে দেওয়ানা হয়ে প্রভুকে হাজির নাজির জেনে সালাত আদায় করছিলেন। হযরত আলী (কা.) আল্লাহ ধ্যান তথা মোরাকাবারত অবস্থায় নামাজ আদায় করেছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের ভিতর অসংযমী রিপুকে পরিশুদ্ধ করতে পারলেই একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা সম্ভব হয় এবং প্রত্যেকটি ইবাদতেই আল্লাহ সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।”
ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোজা। হাকিকতে রোজা পালনের ক্ষেত্রে মোরাকাবার গুরুত্ব রয়েছে। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান রোজাদারকে ৩ শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন, যথা- ১। সাধারণ শ্রেণির রোজাদার ২। মধ্যম শ্রেণির রোজাদার ও ৩। উচ্চ শ্রেণির রোজাদার। মধ্যম শ্রেণির রোজাদারের প্রসঙ্গে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “যে ব্যক্তি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, কামাচার ও পাপাচার হতে বিরত থেকে রোজা পালন করেন, তাকে মধ্যম শ্রেণির রোজাদার বলে।” আর তিনি উচ্চ শ্রেণির রোজাদারের সংজ্ঞায় বলেন, “যে ব্যক্তি সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, কামাচার, পাপাচার ও পাপের কল্পনা হতে বিরত থেকে সর্বক্ষণ ক্বালবে আল্লাহ জিকির বা স্মরণে নিমগ্ন থেকে রোজা পালন করেন তাকে উচ্চ শ্রেণির রোজাদার বলে।” সুতরাং মধ্যম ও উচ্চ শ্রেণির রোজা পালনের জন্য পাপাচার থেকে মুক্ত থাকতে হয়। পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার উপায় হচ্ছে নিয়মিত মোরাকাবার মাধ্যমে ষড়রিপু দমন করা। তাই মধ্যম ও উচ্চ শ্রেণির রোজা পালনের জন্য মোরাকাবার শিক্ষা অত্যাবশ্যক।
পবিত্র হজ ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে ইহ্রামের সাথে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ কতগুলো নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন পূর্বক কাবা শরীফ জিয়ারত করে আরাফার ময়দানে সমবেত হয়ে ইসলামি জীবন বিধান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করার সংকল্প গ্রহণ করাকে হজ বলে। হজের আহকামসমূহ পালনের মাধ্যমে মূলত হাজিগণ মহামানবগণের অনুসরণ করে থাকেন। হজের আহকামসমূহ একাগ্রচিত্তে অর্থাৎ ক্বালবে খেয়াল করে বিশুদ্ধ চিত্তে পালনের জন্য মোরাকাবার প্রয়োজন রয়েছে।
জাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। শরিয়তের বিধান মোতাবেক নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী ব্যক্তির জন্যে প্রতিবছর তার মালের ৪০ ভাগের ১ ভাগ দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হলো জাকাত। নিজের সম্পদ গরিব-দুঃখীর মাঝে বিতরণ করার মানসিকতা সৃষ্টির জন্য মোরাকাবার প্রয়োজন রয়েছে। মোরাকাবার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি যখন নিজেকে আল্লাহ্ময় করে তুলতে সক্ষম হন, তখন তার মাঝে ‘আমি’ বলে কিছু থাকে না। সবকিছু মহান প্রভুর হয়ে যায়। ফলে নিজের সম্পদ থেকে স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে সে জাকাত প্রদান করে থাকে। জাকাতের মাধ্যমে সে আল্লাহ সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিল করতে পারে। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে একজন মানুষ তার আত্মিক ও সম্পদের পরিশুদ্ধতা লাভ করতে পারে।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, “আল্লাহ সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে মোরাকাবা। মোরাকাবায় সমস্ত লক্ষ্য চিন্তাভাবনা একত্রিত করে আল্লাহ সাথে যোগাযোগ করতে হয়। প্রত্যেক মানুষের ভিতরে রিপু আছে। কারো ভিতরে কোনো রিপুর প্রভাব বেশি, আবার কারো কম। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের ভিতরে শয়তান আছে, আমার ভিতরেও শয়তান আছে। আমার শয়তানকে আমি মুসলমান করেছি, সে আমাকে ধোঁকা দেয় না বরং আমাকে সাহায্য করে। তোমরাও তোমাদের শয়তানকে মুসলমান করে নাও।’ শয়তানকে বশে আনার পদ্ধতি হচ্ছে মোরাকাবা। মোরাকাবা এমন একটা পদ্ধতি, বিপদে পড়লে এর মাধ্যমে আল্লাহ সাহায্য লাভ করা যায়। সুতরাং আল্লাহ্কে পাওয়ার উত্তম পন্থা হচ্ছে মোরাকাবা। মোরাকাবার মাধ্যমে নিজের আমিত্ব দূর করা যায়। নিজের ভিতরের আমিত্ব দূর হয়। আল্লাহ রাজত্ব নিজের ক্বালবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষকে সুস্থ থাকার জন্য যেমন পানাহার করতে হয়. তেমনি রূহকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত মোরাকাবার মাধ্যমে ক্বালবে জিকির জারি করতে হয়। ক্বালবে জিকির জারি ও তাওয়াজ্জোহ্ দ্বারা ক্বালব সুস্থ হয়ে শক্তিশালী হয় এবং রূহের মধ্যে এর সুফল ভোগ করা যায়। মোরাকাবা ব্যতীত রূহ বা আত্মার রোগ দূর করা যায় না। রূহের বিমার দূর করার কৌশল হলো মোরাকাবা।”
পরিশেষে বলা যায় যে, একজন সাধককে মনজিলে মকসুদে পৌঁছানোর জন্য নিয়মিত মোরাকাবা করতে হয়। মহান আল্লাহ্কে পাওয়ার এটাই চিরন্তন বিধান। এই জন্য দেখা যায়, প্রতিটি ধর্মেই মোরাকাবার শিক্ষা রয়েছে। আশেকে রাসুলদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে- আমাদের মহান মোর্শেদ বাবা দেওয়ানবাগী আমাদেরকে প্রত্যেকদিন ৬ বার মোরাকাবা করার যে নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা যেন তা যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে নিজের মাঝে পরমাত্মার রাজত্ব কায়েম করতে পারি। আমিন।
[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]