মোর্শেদের দরবারে গোলামির প্রয়োজনীয়তা
ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। আর এ মানুষকে মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে জগতের বুকে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু মানুষ যখন নানাবিধ পাপকর্মে জড়িয়ে পড়ে মহান আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদা হারিয়ে ফেলে, তখন দয়াময় খোদা সেই পাপাচারী মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য তাঁর বন্ধুদেরকে হেদায়েতকারী মহামানবরূপে জগতের বুকে প্রেরণ করেন। হেদায়েতকারী মহামানবদেরকে মোর্শেদ বা পথপ্রদর্শক বলা হয়। নবুয়তের যুগে যাঁরা মোর্শেদের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদেরকে নবি-রাসুল ও বেলায়েতের যুগে যাঁরা এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন তাঁদেরকে অলী-আল্লাহ্ বলা হয়।
মোর্শেদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর অনুসরণ ও গোলামি করে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। কেননা, মোর্শেদের সাথে রয়েছে আল্লাহর যোগাযোগ। তাই মোর্শেদের দরবার হলো আল্লাহ্কে পাওয়ার আধ্যাত্মিক তথা এলমে তাসাউফের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যখন কোনো ব্যক্তি মোর্শেদের সান্নিধ্যে আসেন, তখন তিনি ঐ আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র তথা মোর্শেদের মুরিদ সন্তান হয়ে যান। মোর্শেদ হলেন মুরিদের আত্মার পিতা আর মুরিদ হলো মোর্শেদের রূহানি সন্তান। স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যেমন শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন যথাযথভাবে পালন করতে হয়, তদ্রুপ আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মোর্শেদের দরবারেও মুরিদকে (শিক্ষার্থী) বেশ কিছু নিয়ম পালন করতে হয়।
আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের নিকট যখন কেউ মুরিদ হওয়ার জন্য আসেন, তখন তিনি তার ক্বালবের ছুদুরের মোকামে সবক দিয়ে ‘আল্লাহ্’ নামের জি¦কির জারি করে দেন। এর ফলে ক্বালবের ছুদুরের মোকামে ‘আল্লাহ্’ ‘আল্লাহ্’ জি¦কির জারি হয়, আর তখনই শয়তান তীরের গতিতে পালিয়ে যায়। আল্লাহ্কে পাওয়ার পথে ৩৭টি ক্লাস রয়েছে। সেই পথ পরিক্রমায় লতিফায়ে ক্বালব হলো আল্লাহ্ প্রাপ্তির প্রথম ক্লাস। এ ক্লাসে ভর্তির মধ্য দিয়ে মুরিদের সাধনা জীবন শুরু হয়। সাধনা জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য মোর্শেদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় নিয়মিত আধ্যাত্মিক অনুশীলনের সিলেবাস, যাকে ওয়াজিফা বলা হয়। এ ওয়াজিফাতে বর্ণিত রয়েছে- সাধনার পূর্ণতা লাভের প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিসমূহ। মোর্শেদের দেওয়া ওয়াজিফা বিশ্বাস, মহব্বত, আদব ও সাহসের সাথে পালনের মাধ্যমে একজন মুরিদ সত্যিকার আশেকে রাসুল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন। তবে মুরিদকে সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ওয়াজিফা নিয়মিত আমল করা যেমন বাধ্যতামূলক তেমনি মোর্শেদের দরবারে খেদমত বা গোলামি করাও অত্যাবশ্যক।
মোর্শেদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ওয়াজিফার আমল ও মোর্শেদের দরবারে গোলামি সমভাবে অপরিহার্য। ওয়াজিফার আমল ও মোর্শেদের দরবারে গোলামি উভয় বিষয় দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। গোলামি বাদ দিয়ে শুধু ওয়াজিফা আমল করলে যেমন চলবে না, ঠিক তেমনি নিয়মিত আমল না করে শুধু গোলামি করলেও চলবে না। আমল ও গোলামি উভয়ের সংমিশ্রণই মুরিদকে দিবে কাঙ্খিত ফলাফল, যা তার পরকালে মুক্তির জন্য পাথেয় হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। উল্লেখ্য, ওয়াজিফার নিয়মিত আমল ও মোর্শেদের দরবারে গোলামির মাধ্যমে ছুদুরের মোকাম অতিক্রম করতে পারলে মুরিদের দ্বারা পাপ কাজ সংঘটিত হয় না।
‘এখন গোলামি কী?- তা জানার প্রয়োজন রয়েছে। মোর্শেদের দরবারে হৃদয় উজার করে অহংকার ও আমিত্ব বিহীন কর্মকে খেদমত বলে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো- মোর্শেদের দরবারে ‘খেদমত’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘গোলামি’ শব্দটি ব্যবহার করা অধিক যুক্তিসঙ্গত। আমাদের দেশের সামাজিক প্রথা অনুযায়ী কনিষ্ঠ বয়সের কেউ যখন বয়োজ্যেষ্ঠের সেবায় নিয়োজিত থাকে, তাকে খেদমত বলা হয়। আর এ খেদমত কনিষ্ঠের ইচ্ছা, আকাঙ্খা, করা বা না করা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং এ ক্ষেত্রে খেদমতকারীর স্বাধীনতা কাজ করে অর্থাৎ ইচ্ছা হলে করবে নচেৎ নয়। খেদমত করার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মানুষ তার দায়িত্ববোধ থেকে খেদমত করে থাকেন। কিন্তু আপন মোর্শেদের দরবারে যখন কেউ খেদমতে নিয়োজিত থাকেন, তখন তাকে আত্মসমর্পণ করে একজন গোলামের মতো খেদমত করতে হয়। যিনি মোর্শেদের দরবারে গোলামি করেন তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা, আকাঙ্খা তথা স্বাধীনতা থাকে না। আপন মোর্শেদের হুকুম পালন করাই গোলামের একমাত্র লক্ষ্য। গোলাম যেমন সর্বদা তার মালিককে কিভাবে খুশি বা সন্তুষ্ট করা যায়, এ ভাবনায় বিভোর থাকে, ঠিক তেমনি মুরিদকে সর্বদা মোর্শেদের সন্তুষ্টি বা নেকদৃষ্টি লাভের জন্য গোলামের ন্যায় মোর্শেদের দরবারে গোলামি করতে হয়। কারণ যিনি গোলাম, তার ভেতর অহংকার বা অহমিকা থাকে না। গোলামি শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গোলাম+আমি= গোলামি। তাই তরিকতের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি খেদমতের পরিবর্তে গোলামি শব্দটি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাকে অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে করি।
গোলামির প্রয়োজনীয়তা
মোর্শেদের দরবারে মুরিদের গোলামি করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গোলামির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
প্রথমে জানতে হবে- একজন মুরিদ কেন মোর্শেদের সান্নিধ্যে আসেন? মোর্শেদের সাথে রয়েছে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর যোগাযোগ। মোর্শেদই পারেন মুরিদকে আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। আর এই পথে পৌঁছানোর জন্য মুরিদ যখন মোর্শেদের দেওয়া ওয়াজিফা পালনের মাধ্যমে সাধনা করতে থাকে, তখন আধ্যাত্মিক জগতের অনেক কিছু তার কাছে প্রকাশিত হয় বা উম্মোচন হয়ে পড়ে। তখন তিনি স্বপ্ন, মোরাকাবায় ও কাশফের মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের অনেক রহস্য সম্পর্কে অবগত হন। এর ফলে মুরিদের ভেতরে আমিত্ব বা অহংকার সৃষ্টি হতে পারে, যা সাধনার ক্ষেত্রে পূর্ণতা লাভের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ পর্যায়ে মুরিদ যদি ওয়াজিফা আমলের পাশাপাশি মোর্শেদের দরবারে গোলামিতে নিয়োজিত থাকে, তাহলে তার ভেতরকার আমিত্ব বা অহংকার মোর্শেদের দয়ার বরকতে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- সাধারণত যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। যোগ্যতার ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। কিন্তু মোর্শেদ এমনই দয়ার সাগর তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। পাপী-তাপী, ধনী-গরিব, শিক্ষিত- অশিক্ষিত নির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর মানুষ এই আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেন। আর প্রত্যেকেই এক ও অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি অর্থাৎ ক্বালবি বিদ্যার শিক্ষা নিজ হৃদয়ে ধারণ করে আলোকিত মানুষ অর্থাৎ- আশেকে রাসুল হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। উল্লেখ্য, একজন ধনী ব্যক্তি যার অধীনে অসংখ্য মানুষ কাজ করে থাকে, তিনি যখন মোর্শেদের দরবারে আসেন তখন তার মধ্যে অর্থের অহমিকা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তরিকত জগতে এই অহংকারই হবে তার পতনের মূল। এক্ষেত্রে মোর্শেদের দরবারে গোলামিই পারে তাকে অহংকারের পতন থেকে রক্ষা করতে। তাই আপন মোর্শেদের দরবারে যখন তিনি সর্বস্তরের মানুষের সাথে একত্রিত হয়ে গোলামি করবে তখন তার আমিত্ব ও অহংকার ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।
মোর্শেদের দরবারে সরকারি বা বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ, শরিয়তের আলেম, শিক্ষাবিদ তথা সমাজের উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা ক্বালবি বিদ্যা অর্জনের জন্য আসেন। সকলকে মনে রাখতে হবে, যদি পুঁথিগত বিদ্যাকে প্রাধান্য না দিয়ে ক্বালবি বিদ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তাহলে তরিকতের অগ্রগতির পথ সহজ হবে। ক্বালবি বিদ্যা পুঁথিগত বিদ্যা দ্বারা অর্জন করা যায় না। এ বিদ্যা অর্জন করতে হয় মোর্শেদের দেওয়া ওয়াজিফার নিয়মিত আমল ও মোর্শেদের দরবারে গোলামির মাধ্যমে।
উল্লেখ্য যে, পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি যে ব্যক্তি ক্বালবি বিদ্যার অধিকারী হন, তিনি পুঁথিগত জ্ঞান দ্বারা নয় বরং ক্বালবের জ্ঞান দ্বারা নিজের জীবনকে পরিচালিত করেন। ফলে সে ব্যক্তির জীবন হয় শান্তি ও কল্যাণময়।
হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- ‘আল ইলমু হেজাবুল আকবার’। অর্থাৎ- এলেম আল্লাহ্কে পাওয়ার পথে পর্দাস্বরূপ।
শরিয়তের বিদ্যা আর ক্বালবের বিদ্যা এক নয়। ক্বালবের বিদ্যা হচ্ছে আল্লাহ্কে পাওয়ার বিদ্যা। এ বিদ্যা নুরময় সত্তা হতে আগত। শরিয়তের বিদ্যা অর্জন করতে হয় কিতাব থেকে। এ বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে ইসলামের হুকুম-আহকাম তথা বিধিনিষেধ সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু এ বিদ্যা মানুষের চরিত্র সংশোধন করতে পারে না। যারা এ বিদ্যায় বিদ্বান তাদেরকে মুফতি, মোফাচ্ছের, মোহাদ্দেছ বলা হয়। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহ্র বন্ধুর সংস্পর্শে এসে ক্বালবি বিদ্যা নিজ হৃদয়ে ধারণ করেন, তাদেরকে মু’মেন বলা হয়। আবার পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ, শরিয়তের আলেম, শিক্ষাবিদ হতে পারেন, কিন্তু এ বিদ্যা তাদেরকে মু’মেন বানাতে পারে না। বরং শরিয়তের বিদ্যা তথা পুঁথিগত বিদ্যা মানুষের মাঝে আমিত্ব সৃষ্টি করে থাকে। মোর্শেদের দরবারে একনিষ্ঠভাবে গোলামির মাধ্যমে আমিত্বকে বিসর্জন দেওয়া সম্ভব। যেমনিভাবে চোখের মধ্যে পর্দা পড়লে অপারেশনের মাধ্যমে ছানি দূর করে পরিস্কার চোখে দেখা সম্ভব।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে, শুক্রবার সাপ্তাহিক আশেকে রাসুল (সা.) মাহ্ফিলে মোর্শেদের দরবারে গোলামির মাধ্যমে কিভাবে আমিত্ব দূর করা যায়, সেই বিষয়ে সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন, ‘‘যে পর্যন্ত নিজের ভিতরে আমিত্ব দূর করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের ক্বালবে আল্লাহর নুর প্রজ¦লিত করা সম্ভব নয়। একজন সাধক ক্বালবকে কলুষমুক্ত করতে পারলে, ক্বালবে আল্লাহর নুর প্রজ¦লিত হয়। তাই মোর্শেদের প্রতি অটল বিশ্বাস রেখে নিয়মিত তরিকার আমলের মাধ্যমে গোলামের মতো গোলামি করতে পারলে অবশ্যই এর সুফল লাভ করা সম্ভব।’’
মোর্শেদের দরবারে মুরিদ নিজেকে যত বেশি সাধারণ ভাবতে পারবে, মোর্শেদের অবারিত রহমত-বরকত তত বেশি সে লাভ করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সাবান দিয়ে যেমন ময়লা কাপড় পরিষ্কার করা যায়, তেমনিভাবে মুরিদ যদি মোর্শেদের দরবারে গোলামি করে, তখন মোর্শেদের পক্ষ থেকে তার হৃদয়ে ফায়েজ বর্ষিত হয়। এক্ষেত্রে মুরিদ হলো কাপড়ের ন্যায়, মোর্শেদ হলেন ধৌতকারীর ন্যায়, মোর্শেদের ফায়েজ হলো সাবান। আর মোর্শেদের সেই ফায়েজের প্রবাহে মুরিদের দিলের গুনাহর ময়লা দূর হয়।
মুরিদকে সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে- একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল ছাত্রই সমান। প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর সন্তানকে যে ইউনিফর্ম পরিধান করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে হয়, যে বেঞ্চে বসে ক্লাস করতে হয়, সাধারণ পরিবারের সন্তানের জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই ব্যবস্থা থাকে অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, মোর্শেদের দরবার আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও অনেক মুরিদ বা শিক্ষার্থীরা নিজের জাহেরি অবস্থা বিবেচনা পূর্বক কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রত্যাশা করেন। এ বিষয়টিও অশুদ্ধ নফসের কারণে হয়ে থাকে। তাই মুরিদ যদি নিজেকে মোর্শেদের নালায়েক মুরিদ সন্তান ভাবতে পারে, তাহলে মহান মোর্শেদের নেক দৃষ্টি সে লাভ করতে সক্ষম হবে।
শৈশব থেকে অদ্যাবধি মোর্শেদের দরবারে গোলামিতে নিয়োজিত থাকার ফলে লক্ষ্য করেছি- বিভিন্ন সময় আশেকে রাসুলেরা যিনি যেখানে গোলামি করছেন, তাদের অনেকেই মনে করেন তারাই সবচেয়ে বড় গোলামি করছেন। আবার কেউ কেউ ভাবেন যে, তাদের গোলামিই মোর্শেদ বেশি পছন্দ করছেন। কিন্তু মনের মধ্যে এ ধরনের ধারণা পোষণ করা আর নিজের বিপদ ডেকে আনা একই কথা। মোর্শেদের দরবারে বিভিন্ন ধরনের গোলামি করার সুযোগ রয়েছে। তাই গোলামির মধ্যে ছোটো, বড়ো পার্থক্য করা চরম বেয়াদবি। কেননা, মোর্শেদের দরবারে প্রতিটি গোলামি মোর্শেদের নির্দেশে হয়ে থাকে। যে কোনো গোলামি মোর্শেদের খেয়ালে, আজিজি ও নিয়মানুবর্তিতার সাথে সঠিকভাবে করতে পারলেই মোর্শেদ সন্তুষ্ট হন। সকলের মনে রাখা দরকার যে, মুরিদ কোনো গোলামি ক্ষুদ্র মনে করলেও মোর্শেদের নিকট হয়তো সেটাই বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে মোর্শেদ সেই গোলামি বেশি পছন্দ করছেন। তাই মোর্শেদের দরবারে গোলামির ব্যাপারে মুরিদের কোনো রকম সঙ্কোচ বা দ্বিধা থাকা তরিকার অগ্রগতির পথে অন্তরায়।
আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- মোর্শেদের দরবারে এমন কিছু গোলামি রয়েছে যা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য প্রয়োজনের তাগিদে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করতে হয়। এতে করে যারা এই গোলামি করছেন, তাদের কারো কারো মধ্যে আমিত্বের সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং এ থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, গোলামি যেমন আমিত্ব দূর করে, তেমনি কিছু গোলামি আবার আমিত্ব সৃষ্টিও করতে পারে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এক্ষেত্রে মুরিদের করণীয় কী? এরও সমাধান রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা অফিসে দেখা যায় যে, কর্মীদেরকে অফিসের এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে বদলী করা হয়। অনুরূপভাবে, ঐ সকল গোলামিতে নিয়োজিত মুরিদরা মাঝে মধ্যে মোর্শেদের দরবারে এমন কিছু গোলামিতে নিয়োজিত হবেন, যেখানে গোলামি করে নিজের অহমিকা এবং আমিত্বকে দূর করা যায়। আমাদের দরবার শরীফে দৈনন্দিন ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন বিভাগে গোলামির সুযোগ রয়েছে। সেখানে হাজার হাজার মোর্শেদ প্রেমিক গোলামি করে থাকেন। আপনিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে গোলামি করতে পারেন। বহু আশেকে রাসুল রয়েছেন যারা সমাজে উচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করেও মোর্শেদের দরবারে নিজেকে শুধু ওজু-এস্তেনজা, জুতা রাখার বিভাগ, রন্ধনশালা, খাবার মাঠ, নিরাপত্তা বিভাগ, দরবারে সিঁড়ি ধোয়া-মোছা ইত্যাদি বিভাগে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে গোলামি করে যাচ্ছেন, এটা তাদের জন্য কল্যাণকর। এর মাধ্যমে সত্যিকার গোলামির পরিচয় পাওয়া যায়। মূলত যে কাজগুলো বাড়িতে বা অফিসে আপনি আপনার গৃহপরিচারিকা বা অধীনস্থ কাউকে দিয়ে করিয়ে থাকেন, সেই সমস্ত কাজ মোর্শেদের দরবারে নিজে করলে নিজের মধ্যে গোলামের চরিত্র ধারণ হবে এবং আমিত্বও দূর হবে।
মোর্শেদের দরবারে গোলামি এমনই হওয়া দরকার যেন নিজের ভিতর অহংকার, আত্ম-অহমিকা, আমিত্ব জ্বলে পুড়ে একাকার হয়ে চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। আর যখন নিজের আমিত্ব বা অহংকার বিসর্জন হবে, তখন ইবাদত করে নিজ হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করা যাবে। গোলামির মাধ্যমে যিনি আমিত্বকে দূর করতে সক্ষম হন, তার মধ্যে আদববোধ জাগ্রত হয়। আর তরিকতের পূর্ণতা লাভের জন্য আদব অপরিহার্য। আমিত্ব বিসর্জনকারী মুরিদের আচার-আচরণে থাকে ভদ্রতা, সৌজন্যতা, শালীনতা, হৃদ্যতা ও মার্জিতভাব। আদব রক্ষাকারী মুরিদ মোর্শেদের নেক দৃষ্টির মাধ্যমে দয়াময় প্রভুর পক্ষ থেকে রহমত ও বরকত লাভ করতে সক্ষম হয়।
এ প্রসঙ্গে জগদ্বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন- “বেয়াদব মাহ্রুমে গাসত আজ ফাজলে রব।” অর্থা- বেয়াদব আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়।
গোলামির মাধ্যমে আমিত্ব দূর করে একজন মুরিদ পরিশীলিত আচরণের অধিকারী হয়ে থাকেন, যা তাকে মোর্শেদের দরবারে আদব রক্ষা করে চলতে সাহায্য করে। কারণ যার মধ্যে গোলামির চরিত্র থাকে তার আচার-আচরণ কখনো ঔদ্ব্যতপূর্ণ হয় না।
সাধনার পথে অগ্রগতির শ্রেষ্ঠতম উপায় হচ্ছে মোরাকাবা। মোরাকাবার সময় দুনিয়ার যাবতীয় চিন্তা ভাবনা ভুলে গিয়ে নিজ ক্বালবের মাঝে আপন মোর্শেদের নুরানীময় চেহারা মোবারক খেয়াল করতে হয়। অতঃপর তাঁর কদম মোবারক জড়িয়ে ধরে নিজের জীবনের সমস্ত ভুল-বেয়াদবির জন্য কাকুতি-মিনতি করে ক্ষমা প্রার্থনা করে মোর্শেদের ফায়েজ ভিক্ষা চাইতে হয়। যে মুরিদ মোর্শেদের দরবারে গোলামির মাধ্যমে নিজের আমিত্ব দূর করে গোলাম হতে সক্ষম হয়েছে, সে তখন মালিকের গোলাম হয়ে যায়। আর গোলাম যখন মোরাকাবায় বসে আপন মালিকের কাছে রোনাজারি করত ক্ষমা প্রর্থনা করে তখন মালিক তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন না।
আধ্যাত্মিক জগতের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মোর্শেদের দরবারে গোলামির ভূমিকা অপরিহার্য। মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করাও গোলামির অন্তর্ভূক্ত। আপনার নিজ এলাকায় মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান কর্তৃক প্রচারিত মোহাম্মদী ইসলামের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দিন। বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। ইন্টারনেট, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমেও আমাদের মহান মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করতে পারেন। এছাড়া নিজ বাড়ির ছাদে বা উঠানে মোহাম্মদী ইসলামের পতাকা উত্তোলন করে কিংবা বাড়ির দেয়ালে মোর্শেদের অমীয় বাণী মোবারক লিখে তাঁর আদর্শ প্রচার করা যেতে পারে। দেওয়ানবাগ শরীফ কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা, গ্রন্থ বা প্রকাশনাসমুহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। মহব্বত ও দায়িত্বশীলতার সাথে এরূপ প্রচার কাজও গোলামি।
আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো এই যে, আমাদের বহু আশেকে রাসুল যারা মোহাম্মদী ইসলামের সবক নিয়েছেন অথচ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের নিকট তা প্রকাশ ও প্রচার করেন না। অর্থাৎ- কামেল মোর্শেদের সান্নিধ্যে গিয়েছেন তা তিনি গোপন রাখতে চান। তা ঠিক নয়? মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। মোর্শেদের শিক্ষা গ্রহণ করে আপনি ধর্মের প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধি করছেন এবং এ শিক্ষার মাধ্যমে আপনার আত্মিক উন্নতি হচ্ছে, সুতরাং আপনি তা প্রচার করুন। এতে করে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ সূফী সম্রাট হুজুর কেব্লাজানের শিক্ষা গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত হবে এবং তাঁর সান্নিধ্যে এসে আত্মশুদ্ধি লাভের সুযোগ পাবে।
আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান বলেন- ‘‘সমাজ ব্যক্তিকে শুদ্ধ করতে পারে না, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি শুদ্ধ হয়, ব্যক্তি শুদ্ধ হলে সমাজ শুদ্ধ হয় আর সমাজ শুদ্ধ হলে গোটা জাতি শুদ্ধ হয়।’’
মোর্শেদের দরবারে প্রতি বছর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়। ঐ সকল অনুষ্ঠানের প্রচারের জন্য মাইকিং করা, লিফলেট বিতরণ করা, পোস্টার লাগানো, দেওয়াল লিখন, এলাকায় এলাকায় মিছিল করা এবং আশেকে রাসুল (সা.) মাহ্ফিলের আয়োজন করাও গোলামি। এছাড়া আপনার এলাকার অন্যান্য আশেকে রাসুল ভাইদের সাথে নিয়ে সময় ও সুযোগ বুঝে আশেকে রাসুল (সা.) মাহফিল ও মিলাদের মাধ্যমে মোর্শেদের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করতে পারেন। মুরিদকে এ সকল গোলামি করার সুযোগ দিয়ে মোর্শেদ তার ভাগ্যকে পরিবর্তন করে থাকেন। নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের উত্তম হাতিয়ার হলো মোর্শেদের দরবারে একনিষ্ঠ চিত্তে গোলামি করা।
মোর্শেদের দরবারে গোলামি করার রীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। নবি-রাসুল ও অলী-আল্লাহ্গণের জীবনী মোবারক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গোলামির বিষয়টি আবহমান কাল থেকে এলমে তাসাউফের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
সুলতানিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) বলেন- এলমে তাসাউফ ব্যতীত শরিয়ত পূর্ণ হয় না, আর মোর্শেদের খেদমত (গোলামি) ভিন্ন এলমে তাসাউফ হাসিল হয় না।’’
সুতরাং ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর এ বাণী মোবারক থেকে ষ্পষ্ট বুঝা যায় যে, এলমে তাসাউফ (আল্লাহ্কে জানার বিজ্ঞান) নিজ হৃদয়ে ধারণ করার জন্য আপন মোর্শেদের গোলামির বিকল্প নেই। ‘গোলাম’ ও ‘গোলামি’ এই শব্দ দুটি মোহাম্মদী ইসলামে কতটুকু তাৎপর্যময় তা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। ঘটনাটি এরূপ যে, ‘‘একদা হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বাল্য বয়েসে দোজাহানের বাদশা হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সাথে খেলা করছিলেন। খেলার এক পর্যায় তাদের দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে ইমাম হোসাইন (রা.) রাগের বশবর্তী হয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘তুমি তো আমার নানাজীর গোলামের ছেলে।’ সে সময় হযরত ওমর ফারুক (রা.) ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) ব্যথিত মনে তার পিতা দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর নিকট ছুটে গিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিরুদ্ধে নালিশ করেন। পুত্রের মুখে সমুদয় কথা শুনে হযরত ওমর ফারুক (রা.) বললেন- ইমাম হোসাইন (রা.) তোমাকে যে কথা বলেছেন, তুমি কি তা তাঁর স্বাক্ষরসহ লিখে আনতে পারবে? হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) পিতাকে বললেন- অবশ্যই আমি পারবো। হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন- তাহলে তুমি প্রমাণ নিয়ে আস। পিতার মুখে এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নিকট ছুটে গেলেন। তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)-কে বললেন, আপনি যে আমাকে আপনার নানাজীর গোলামের ছেলে বলে গালি দিয়েছেন, আপনি কি তা লিখিত দিতে পারবেন? তাহলে আপনি এ কথাটি লিখে দিন এবং প্রমাণ স্বরূপ এতে আপনার স্বাক্ষর প্রদান করুন। ইমাম হোসাইন (রা.) বিনা সংকোচে লিখে দিলেন- ‘তুমি আমার নানাজীর গোলামের ছেলে’ এবং স্বাক্ষর প্রদান করলেন।
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) লেখাটি নিয়ে তাঁর পিতা দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর হস্ত মোবারকে দিলেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর স্বাক্ষরসহ লেখাটি পেয়ে হযরত ওমর ফারুক (রা.) আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। পিতার এরূপ অভিব্যক্তি দেখে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) ভেবেছিলেন, তাঁর পিতা মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) ইমাম হোসাইন (রা.)-এর লেখাটি দেখে ইমাম হোসাইন (রা.)-এ উপর অসস্তুষ্ট হবেন এবং কেন তাকে গোলাম বলেছেন তা জানতে চাইবেন অথচ তাঁর পিতা এ লেখাটি পেয়ে যেন নবজীবন ফিরে পেলেন। তাই হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বিস্ময়ের সাথে আনন্দের কারণ জানতে চাইলেন।
হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন, ইমাম হোসাইন (রা.) হলেন দোজাহানের বাদশাহ্ রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র। আর তিনি যেহেতু আমাকে তাঁর নানাজীর গোলাম হিসেবে সত্যায়ন করে দিয়েছেন, তাহলে সত্যিই আমি হযরত রাসুল (সা.)-এর গোলাম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আজ পর্যন্ত আমি এমন কোনো কাজ করিনি, যার দ্বারা প্রামাণ হয় আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর গোলাম ছিলাম। হে সভাসদবৃন্দ! যেদিন আমি ওমর ধরাশায়ী হবো সেদিন ইমাম হোসাইন (রা.) কর্তৃক লিখিত প্রমাণ পত্রটি আমার কাফনের সাথে তোমরা দিয়ে দিবে। এ সত্যায়নই পরকালে আমার মুক্তির পথ নিশ্চিত করে দিবে।’’ হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর মর্মস্পর্শী বক্তব্য শুনে উপস্থিত সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।
প্রিয় পাঠক! যে রাহ্মাতুল্লিল আলামিনের গোলাম হওয়ার জন্য সাহাবিদের হৃদয় সর্বদা ব্যাকুল হয়ে থাকতো, সেই রাহ্মাতুল্লিল আলামিনের সিরাজাম মুনীরার ধারক, বাহক ও সুযোগ্য উত্তরসূরী হলেন আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান। আমরা যদি সবাই আমাদের মহান মোর্শেদের গোলাম হতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন হবে সার্থক ও সুন্দর। মালিকের গোলাম হতে পারলে মালিকই গোলামকে পরিচালনা করবেন। আর মালিক যাকে পরিচালনা করবেন দুনিয়া ও আখিরাতে তার কোনো চিন্তা থাকে কি?
প্রিয় পাঠক! আমরা যদি অলী-আল্লাহ্গণের গৌরবময় জীবনী পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে, প্রত্যেক অলী-আল্লাহ আপন মোর্শেদের দরবারে সাধনা ও গোলামি করেই অলী-আল্লাহ্ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সুলতানিয়া-মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর জীবনীতে দেখা যায়, তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই তাঁর মোর্শেদ শাহ্ সূফী হযরত ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (রহ.)-এর নিকট ছুটে যেতেন এবং মাসের পর মাস মোর্শেদের দরবারে কাটিয়ে দিতেন।
অপরদিকে, আমাদের মহান মোর্শেদ আল্লাহ্ প্রেরিত যুগের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ি প্রশাসনের বিধান অনুযায়ী স্বীয় মোর্শেদ ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর দরবারে দীর্ঘ এক যুগ কঠোর সাধনা করেছেন। একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন- সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান হলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ অলী-আল্লাহ্। তিনি ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মোজাদ্দেদের দায়িত্ব লাভ করেন; ২৪ আগস্ট, ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে যুগের ইমামের দায়িত্ব লাভ করেন; ৫ এপ্রিল, ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী’ খেতাবে ভূষিত হন, ২ অক্টোবর, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সমস্ত ‘আম্বিয়ায়ে কেরামের বেলায়েত’ প্রাপ্ত হন এবং ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর হতে অদ্যাবধি পূর্ণিমার চাঁদে তাঁর চেহারা মোবারকের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দেখিয়ে আল্লাহ্ তায়ালা প্রমাণ করেছেন বর্তমান যুগে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠবন্ধু।
আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের মতো এত আধ্যাত্মিক খেতাব মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোনো মহামানব ইতিপূর্বে লাভ করেছেন বলে আমার জানা নেই অথচ তিনিও তাঁর সাধনা জীবনের ১২টি বছর স্বীয় মোর্শেদের দরবারে অতিবাহিত করেছেন।
মোর্শেদের দরবারে গোলামির গুরুত্ব ও মর্তবা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন- “লাওলা সিনতানে হালাকা নুমান।” অর্থাৎ- ‘‘আমি (নুমান) যদি দুই বছর আমার মোর্শেদ ইমাম বাকের (রহ.)-এর গোলামি না করতাম, তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।
প্রখ্যাত তাসাউফ বিজ্ঞানী জালাল উদ্দিন রুমী (রহ.) এ সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করে বলেন- “মৌলভী হারগেয নাহ্ শোদ মাওলায়ে রোম, ত গোলামী শামসে তাবরীযী নাহ্ শোদ।” অর্থাৎ- আমি নিজে কখনও মৌলভী (মাওলানা) হবার সৌভাগ্য লাভ করতে পারতাম না, যদি আমার মোর্শেদ শামস্ তিবরীজী (রহ.)-এর গোলামি করার সৌভাগ্য না হতো।
গোলামির ফজিলত ও মাহাত্ব্য সম্পর্কে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজান কতিপয় অমীয় বাণী মোবারক নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-
- তরিকতের আসল উদ্দেশ্য গোলামি। গোলামির মাধ্যমেই তরিকতের উন্নতি সম্ভব। নফ্সকে গোলাম বানানো বা মোর্শেদের নির্দেশে নিজের নফ্সকে পরিচালিত করা।
- যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার আমিত্ব বিসর্জন না দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার ভিতর প্রভুর রাজত্ব কায়েম হবে না।
- অলী-আল্লাহর গোলামি ব্যতীত মারেফতের নুর হাছিল হয় না।
- আমিত্ব বিসর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সহজ উপায় মোরাকাবা।
আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের উল্লেখিত বাণী মোবারকের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নিজের ভিতর আমিত্ব থাকলে মুরিদ সন্তান মোর্শেদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হবে না। ফলে ঐ মুরিদ সন্তান নিয়মিত ওয়াজিফা আমল করেও সাধনার অগ্রগতি লাভ করতে পারে না। মূলত আমিত্ব-অহংকার তরিকতের উন্নতির অগ্রযাত্রার পথে বাধাস্বরূপ। এক কথায় আমিত্বের কারণে মুরিদ আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছাতে না পেরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। - সুতরাং মুরিদকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমিত্ব বিসর্জনের বিকল্প নেই। তাই নিজের ভিতরের আমিত্ব-অহংকার দূরীভূত করার জন্য মোর্শেদের দরবারে একনিষ্ঠ চিত্তে গোলামি করা আবশ্যক। মোর্শেদের দরবারে গোলামি একটি আবশ্যিক বিষয়, এটিকে ঐচ্ছিক বিষয় ভাবা যাবে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, বোর্ডের চূড়ান্ত পরীক্ষায় কোনো ছাত্র একটি বিষয়ে F Grade পেল কিন্তু বাকী সব বিষয়ে A+ পেলেও ঐ ছাত্রের চূড়ান্ত ফল F Grade অর্থাৎ-অকৃতকার্য বিবেচনা করা হবে। তদ্রুপ মোর্শেদের দরবারে সফলতার সাথে জীবনের ফলাফল ঐ উল্লেখিত ছাত্রের মতই হবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই মোর্শেদের দরবারে গোলামি করে আমাদের সবাইকে আমিত্ব দূর করত আত্মশুদ্ধি, দিল জিন্দা ও নামাজে হুজুরির প্রক্রিয়াকে সফলভাবে নিজ হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং সত্যিকার আশেকে রাসুল হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।
পরিশেষে এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের গোলাম হওয়ার মাঝেই আমি আমার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। তিনি যদি তাঁর গোলাম বলে আমাকে কবুল করে নেন, এটাই হবে আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। মহান আল্লাহর দরবারে এ প্রার্থনা- তিনি যেন দয়া করে আমার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত তাঁর বন্ধু সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের নির্দেশিত মত ও পথে পরিচালিত হওয়ার তৌফিক দান করেন। আমিন।
[লেখক: পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; সহকারী অধ্যাপক, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি]