Cancel Preloader

Sufi Samrat Hazrat Syed Mahbub-e-Khoda Dewanbagi (Maddazilluhul Ali) Hujur Quiblajan.

যাঁকে পেয়ে ধন্য জীবন (পর্ব-১০)

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া:

মোর্শেদেরদরবারে সূফী সম্রাটের শেষ ওরছ

মানুষ অনেক কিছু চিন্তা করে, অনেক কিছু ভাবে, কিন্তু মহান আল্লাহর যা ইচ্ছা, তাই বাস্তবায়িত হয়। আর আল্লাহর বন্ধু অলী আওলিয়াগণ হলেন আল্লাহর প্রিয়জন। তাঁরা আল্লাহর অশেষ দয়া প্রাপ্ত বলে ভবিষ্যতে ঘটতে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পূর্বেই তাঁদেরকে জানিয়ে দেন। ফলে অলী-আল্লাহ্গণ পূর্ব থেকেই অনেক ঘটনা সম্পর্কে অবগত থাকলেও, না ঘটা পর্যন্ত তাঁরা তা প্রকাশ করেন না। সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (মা. আ.) হুজুর কেবলাজানের জীবনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

১৯৮৪ সালের ২৮ মার্চ, বুধবার বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে সূফী সম্রাটের প্রাণপ্রিয় মোর্শেদ ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) হুজুর ওফাৎ লাভ করেন। তাঁর ওফাতের ২দিন পরে অর্থাৎ শুক্রবার বাদ জু’মা তাঁকে রওজা শরীফে সমাহিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, জানাজার পূর্বে ইমাম হুজুরের সহধর্মিণীদ্বয়, কন্যাগণ, জামাতা ও নিকট আত্মীয়গণ এই মর্মে একটা দলিল সম্পাদন করেন, যাতে সবার স্বাক্ষরসহ সর্বসম্মতিক্রমে সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা (মা. আ.) হুজুরকে চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। সেই মোতাবেক তিনি ইমাম হুজুরের দরবার শরীফ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন।

সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর প্রিয় মোর্শেদের ওফাৎ হওয়ায় মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়লেও মোর্শেদের দরবার শরীফ এবং মুরীদানদের দিক চিন্তা করে নিজের মনকে শান্ত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিলেন। কারণ সামনেই রয়েছে ইমাম হুজুরের ফাতেহাখানি। ওফাতের ৪র্থ দিনে যে অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়ে থাকে, তাকে চেহলাম বা ফাতেহাখানি বলা হয়।

সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান স্বীয় মোর্শেদের ফাতেহা খানি অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত বড়ো আয়োজকে পালন করার উদ্যোগ নিলেন। সেই মোতাবেক বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার জাকেরদের ফাতেহা খানিতে যোগদানের জন্য দাওয়াত করলেন।

যেহেতু আপন মোর্শেদ ইমাম হুজুর (রহ.)-এর ফাতেহার অনুষ্ঠান, সেহেতু সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ব্যাপক আয়োজনের ব্যবস্থা নিলেন। ফাতেহাখানি অনুষ্ঠানের বিশাল আকারের কয়েকটি গরুসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করলেন। এদিকে ইমাম হুজুরের দ্বিতীয় পক্ষের শ্বশুর ও জামাতাসহ বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন, সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ফাতেহাখানির অনুষ্ঠানটি সুন্দর ও সার্থকভাবে সফল করুন, এটা মোটেই পছন্দ করেননি। ইমাম হজুরের কিছুসংখ্যক মুরিদকেও তারা নিজেদের দলভূক্ত করে সূফী সম্রাটের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে তুললো। এই বিরোধী লোকগুলো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় নিজেরা গিয়ে, অথবা লোক পাঠিয়ে সূফী সম্রাটের কাজের সমালোচনা শুরু করে। শুধু তাই নয়, সূফী সম্রাট যেন ইমাম হুজুরের ফাতেহাখানির অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে করতে না পারেন সেজন্য অপপ্রচার চালাতে থাকে। এই দুষ্টমতি লোকগুলো এমন কিছু মিথ্যা ও আপত্তিকর কথা ছড়াতে থাকে, যা কোনো মুরিদের পক্ষে শোভনীয় নয়। তারা বলে বেড়াতো, ইমাম হুজুরের ফাতেহাখানি করবে কী দিয়ে? এতো মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছে খাওয়াবে কী? ভাতই তো পাবে না। এ কথাগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো।

সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান আপন মোর্শেদের ফাতেহার অনুষ্ঠানটি সুন্দরভাবে করার জন্য ব্যতিব্যস্ত রইলেন। ফাতেহাখানির আর বেশিদিন বাকী নেই। হঠাৎ একজন জাকের এসে সূফী সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানালেন, বিরোধিতাকারীরা সর্বত্রই অপপ্রচার চালাচ্ছে যে, এত জাঁকজমক সহকারে অনুষ্ঠান করবে কী দিয়ে? সর্বত্র মানুষ দাওয়াত দিচ্ছে- খাওয়াবে কী? ভাতই তো পাবে না। প্রাণপ্রিয় মোর্শেদের ফাতেহাখানির অনুষ্ঠান সম্পর্কে এমন কটাক্ষমূলক মন্তব্য শুনে সূফী সম্রাট হজুর কেবলাজান মনে কষ্ট পেলেন ঠিকই, কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ঐ জাকের ব্যক্তিকে বলে দিলেন- আপনি তাদেরকে জানিয়ে দিন, আমার মোর্শেদের ফাতেহা খানির অনুষ্ঠানে আমি ভাত খাওয়াবো না, বিরিয়ানি খাওয়াবো।

আল্লাহর বন্ধুদের কোনো কথাই বিফলে যায় না। যেই কথা, সেই কাজ। বিশাল সাইজের সেই গরুগুলো জবেহ করে, এর মাংস দিয়ে ঠিকই বিরিয়ানির ব্যবস্থা করা হলো। সত্যি বিরিয়ানি দ্বারাই ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর ফাতেহাখানির অনুষ্ঠান উদ্যাপন করা হয়। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর মোর্শেদের ফাতেহাখানিতে যে বিরিয়ানি চালু করলেন, পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় এসে নিজ দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করে, এখন পর্যন্ত সকল অনুষ্ঠানেই বিরিয়ানি দ্বারা তাবারুকের ব্যবস্থা করে থাকেন।

বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আজও তাবারুক হিসেবে বিরিয়ানি খাওয়ানোর ধারা অব্যাহত রয়েছে। সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান তাঁর মোর্শেদের দরবারে থাকা অবস্থায় স্বীয় মোর্শেদের ফাতেহাখানিতে যে বিরিয়ানির চালু করলেন, আজ ৩৫ বছর গত হতে চললো তাঁর দরবার শরীফে প্রতিটি সাপ্তাহিক ও মাসিক জলসা এবং বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলনের অনুষ্ঠানে তাবারুক হিসেবে বিরিয়ানি খাওয়ানো অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলনে যোগদানকারী লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিরিয়ানির তাবারুক খাওয়ানো আল্লাহর মহান বন্ধু সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজানের পক্ষেই সম্ভব।

এদিকে ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর একমাত্র পুত্র সন্তান মাত্র ১২ বছরের কিশোর; তাঁর লেখা-পড়াসহ যাবতীয় সব কিছুই সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর দেখা শুনা করতেন।

আমি তখন ঢাকায় অধ্যাপনা করি। দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজান ইমাম হুজুরের পুত্র জনাব কামরুজ্জামানকে পড়ানোর জন্য আমাকে নির্দেশ দিলেন। সেজন্য প্রতিমাসে ১০ দিন করে আমাকে চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে থাকতে হতো। সূফী সম্রাটের নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে আমি প্রতিমাসে ১০ দিন চন্দ্রপাড়া দরবারে অবস্থান করতাম। তখন কামরুজ্জামান সাহেব চন্দ্রপাড়া দাখিল মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন।

ইমাম হুজুর (রহ.)-এর ওফাতের পরবর্তী ওরছ আসার পূর্বেই সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান দেশের বিভিন্ন জেলায় ওয়াজ মাহ্ফিল করে মানুষের মাঝে ইমাম হুজুরের পরিচয় ব্যাপকভাবে তুলে ধরেন। পরবর্তী বছর ১৯৮৫ সালের ২৮ মার্চ তারিখে চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে ওরছ মোবারকের আয়োজন করা হয়। প্রাণপ্রিয় মোর্শেদের ওরছ মোবারক পালনের জন্য সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান সারাদেশব্যাপী আশেকানদের দাওয়াত দিয়ে ওরছের ব্যাপক আয়োজন করেন। আমি ঢাকা থেকে ওরছের দু’দিন আগেই চন্দ্রপাড়া গিয়ে পৌঁছি।

আমার দায়িত্ব ছিল দরবার শরীফের আলেম-ওলামা ও বক্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করা। আমি সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এদিকে সূফী সম্রাটের বিরোধী একটি দল, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন ইমাম হুজুরের মেজো জামাতা। আর তাকে সহযোগিতা করেছেন জনৈক আর্মি অফিসার। তাদের সাথে ঐক্য গড়ে তুলেছেন ইমাম হুজুরের আরো কিছু আত্মীয়স্বজন এবং কিছু মুরীদান।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান ইমাম হুজুরের ওফাতের ১ম বছরে ওরছের যে বিশাল আয়োজন করেন, শেষ পর্যন্ত চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধাচরণের ফলে তিনি মোর্শেদের দরবার শরীফে স্বীয় মোর্শেদ ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.)-এর ওরছ মোবারক পালন করতে পারেননি। উল্লেখ্য, ইমাম হুজুরের ওফাতের প্রথম বছর অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে ওরছ করার জন্য সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কয়েক লক্ষ টাকা ঋণ করে ওরছের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেন।

চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে নিয়ম ছিল, মুরীদানদের কাছ থেকে কর্জে হাসানা নিয়ে ওরছের কাজ সমাধা করে, ওরছের পরে তাদের ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া হতো। কিন্তু সেই বছর সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান কয়েক লক্ষ টাকা ঋণ করেন। কিন্তু ওরছের আগের দিন তাঁর সাথে শত্রুতাকারী ব্যক্তিরা চন্দ্রপাড়া দরবার শরীফে অস্ত্র শস্ত্রসহ উপস্থিত হয়ে এক বিরাট গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে নেতৃত্ব দেন কয়েকজন আর্মি অফিসার। এমনকি ষড়যন্ত্রকারীরা সূফী সম্রাটকে হত্যা করার জন্য ঘাতক পর্যন্ত নিয়োগ করে।

তাদের একজন নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে তার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছ থেকে আদিষ্ট হয়ে সূফী সম্রাটকে হত্যা করার জন্য তিন বার পিস্তলের গুলি ছুড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহর কী মহিমা, একটি গুলিও ছুড়তে পারেনি। সূফী সম্রাটের প্রতি ঐ অস্ত্রধারী ব্যক্তি পর পর তিন বার অতি কাছ থেকে পিস্তলের গুলি ছুড়তে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পিস্তল থেকে একটি গুলিও বের হয়নি। আল্লাহ্ তাঁর মহান বন্ধুকে এভাবে পরম শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সূফী সম্রাটের বিরোধিতাকারীদের চেয়ে তাঁর অনুগত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তারা শত্রুদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য সূফী সম্রাটের নির্দেশের অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু সূফী সম্রাট কাউকেই কোনো নির্দেশ দেননি, বরং তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমি আমার মোর্শেদের দরবারে কোনো রক্তপাত চাই না। সেই কারণেই তিনি ওরছের আগের দিন ঢাকার আরামবাগ থেকে যাওয়া রিজার্ভ লঞ্চে শুধুমাত্র পরিধানের বস্ত্র নিয়েই একদম খালি হাতে ঢাকায় চলে আসেন। এতটুকুই শেষ নয়, সূফী সম্রাটের সহধর্মিণী এবং তাঁর তিন সাহেবজাদি ও বড়ো সাহেবজাদা চন্দ্রপাড়ায়ই থেকে যান। তিনি ঢাকার আরামবাগে এসে আশেকে রাসুল মো. শফিউদ্দীন সাহেবের বাসার ৩ তলার ছাদে স্বীয় মোর্শেদের ওরছ শরীফ উদযাপন করেন। সেদিন একটা বিল্ডিং-এর ছাদে মাত্র ২/৩ শতাধিক লোক নিয়ে ওরছ পালন করেছেন, অথচ বর্তমানে সূফী সম্রাটের আহ্বানে তাঁর দরবার শরীফে যে ‘বিশ্ব আশেকে রাসুল (সা.) সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়, তাতে দেশ ও বিদেশের লক্ষ লক্ষ লোক যোগদান করে থাকেন।

আসলে আল্লাহ্ যাকে সম্মান ও প্রতিপত্তি দান করেন, দুনিয়ার কোনো মানুষ তাঁকে পিছু হটাতে পারে না। তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান। শুধু তাই নয়, একজন মহান সংস্কারক ও শ্রেষ্ঠ অলী আল্লাহ্ হিসেবে আজ বিশ্বব্যাপী তাঁর যশ, সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ আজ তাঁর ভক্ত অনুসারী, যারা সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুর কেবলাজানের প্রচারিত ‘মোহাম্মদী ইসলাম’ পালন করে ‘আশেকে রাসুল’ হিসেবে বিশ্বময় পরিচিতি লাভ করেছেন।

(চলবে)

[লেখক: সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, জাতীয় আইন কলেজ, ঢাকা]

আরও পড়ুন:

সম্পর্কিত পোস্ট