রবিউস সানি মাসের তাৎপর্য ও আমল
সাব্বির আহমাদ ওসমানী
মহান আল্লাহ্ সৃষ্টিজগতের মালিক, সর্বশক্তিমান একক সত্তা। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানব জীবনের সবকিছুই আল্লাহ্র দান। আল্লাহ্র দেওয়া নিয়ামতগুলোর মধ্যে প্রথম নিয়ামত হলো জীবন। জগতে জীবনের স্থিতিকাল হলো আয়ু। আয়ু হলো সময়ের সমষ্টি। সময় অনাদি-অনন্ত। সময়ের প্রকৃত জ্ঞান সম্পর্কে আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত। বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত করে সময়কে বিশেষ পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। জানা ইতিহাসের ও কল্পিত বিশ্বের নানা বিষয়ের সঙ্গে সময়কে সম্পৃক্ত করা হয়। ব্যবহারিক সুবিধার জন্য চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্র নানা প্রাকৃতিক, জাগতিক ও মহাজাগতিক বস্তু ও শক্তির সঙ্গে মিল রেখে সময়ের হিসাব বা ধারণা প্রকাশ করা হয়।
আল্লাহ্ তায়ালা কুরআন মাজিদে বলেন- “সূর্য ও চন্দ্র হিসাব মতো আবর্তন করে।” (সূরা আর রহমান ৫৫: আয়াত ৫) মানুষ সময়কে ব্যবহারিক পর্যায়ে বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন, রাত, প্রহর ও ঘড়ির ঘন্টায় বিভক্ত করে নিয়েছে। আরবি বর্ষপঞ্জি ও ইসলামি হিজরি সনের চতুর্থ মাস হলো রবিউস সানি। কেউ কেউ একে রবিউল আখির মাস বলে থাকেন। এটি রবিউল আউয়াল মাসের জোড়া মাস। ‘রবি’ অর্থ বসন্ত, আর আউয়াল অর্থ প্রথম; ‘সানি’ অর্থ দ্বিতীয়, ‘আখির’ অর্থ শেষ বা অন্য বসন্ত। হযরত রাসুল (সা.)-এর দুনিয়াতে আগমনের মাস, হিজরাতের মাস ও ওফাতের মাস রবিউল আউয়ালের জোড়া মাস হিসেবে রবিউস সানি মাস-ও বেশ তাৎপর্যমণ্ডিত।
রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ হযরত রাসুল (সা.)-এর ওফাত এবং রবিউস সানি মাসের ১১ তারিখে অলীকুল শিরোমণি বড়ো পির মুহিউদ্দিন হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর ওফাত দিবসকে ‘ফাতিহায়ে ইয়াজদাহম’ বলা হয়।
সময় মানুষের জীবনের মুলধন বা পুঁজি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ু কমতে থাকে। সময়কে কাজে লাগানো তথা সময়ের সদ্ব্যবহারই জীবনের সফলতা এবং সময়ের অপচয় বা অপব্যবহার হলো জীবনে ব্যর্থতা। কুরআন কারিমে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- “কসম জমানার, নিশ্চয় মানুষ তো রয়েছে ভীষণ ক্ষতির মধ্যে, তবে তারা নয়, যারা ইমান আনে ও নেক কাজ করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈযের্র উপদেশ দেয়। (সূরা আসর ১০৩: আয়াত ১-৩) বিশেষ সময়ের বিশেষ ফজিলত বর্ণিত আছে কুরআন ও হাদিসে। যেমন রমজান মাস, জিলহজ মাস ও হজের তিনটি মাস, মহররম মাস ও আশহুরে হুররুম বা হারাম ও সম্মানিত চারটি মাস এবং রজব মাস ও শাবান মাস। সপ্তাহের শুক্রবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার। বছরের বিশেষ রাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শবে কদর, শবে বরাত, ঈদের রাত ইত্যাদি। কিন্তু এসব ফজিলতপূর্ণ সময়ে কেউ যদি ফজিলত প্রাপ্তির আমল না করেন, তবে তা তার জন্য ক্ষেত্র বিশেষ ক্ষতির কারণেই হবে। যেমন রমজান পেয়ে ক্ষমাপ্রাপ্তির লাভে ব্যর্থ ব্যক্তির জন্য নবি কারিম (সা.) আল্লাহ্র অভিসম্পাতে সম্মতি দিয়ে আমিন বলেছেন। (তিরমিজী শরীফ, ই.ফা.বা. ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৭)
অতিসাধারণ সময়ও বান্দার ইখলাস ও তাকওয়াপূর্ণ সুন্নতভিত্তিক নেক আমল ও ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং শুভ উদ্যোগ ও সফল সার্থক অবদানের কারণে পুণ্যময় হয়ে উঠে। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন- হযরত রাসুল (সা.) প্রতিমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা পালন করতেন, এই আমল তিনি কখনও পরিত্যাগ করেনননি। (সহিহ বুখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৬) এই রোজাকে আইয়ামে বিয-এর রোজা বলা হয়। কারণ এই সময় পৃথিবী জ্যোৎস্নার শুভ্র আলোয় উদ্ভাসিত থাকে এবং এই রোজার মাধ্যমে বান্দার অন্তর আলোকিত হয়। সপ্তাহে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার প্রায়ই নবিজি (সা.) রোজা রাখতেন। কারণ এই দুই দিন বান্দার আমল আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছানো হয়। বিশেষত সোমবার হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওহি প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ তিনি এই আমল করতেন। (সহিহ মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৮)
প্রতিটি মাসের শুরু এবং শেষ বিশেষ দোয়া কালাম ও নামাজ, রোজা এবং বিশেষ নেক আমলের মাধ্যমে পালন করা নবিজি (সা.)-এর সুন্নত। আমল দ্বারা সময়কে রঙিন করা ও জীবনকে সাজানো বুদ্ধিমানের কাজ। রাসুলে পাক (সা.) বলেন- তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে মুল্যায়ন করো- (১) যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, (২) সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে (৩) স্বচ্ছলতাকে দারিদ্যের পূর্বে, (৪) অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে ও (৫) জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান)
পরিশেষে এ কথায় উপনীত হওয়া যায় যে, এ মাসের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তাই বেশি বেশি নফল ইবাদত ও মোরাকাবার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
[লেখক: ইসলামি আলোচক, সদস্য, দেওয়ানবাগীর দল ওলামা মিশন বাংলাদেশ; সাবেক খতিব, দারুল ফালাহ্ জামে মসজিদ, রিয়াদ, সৌদি আরব]