রহমত ও বরকতের দিন হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন
ড. মো. আরিফ হোসেন
ঈদ অর্থ খুশি বা আনন্দ। ঈদে মিলাদুন্নবি অর্থ হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের খুশি বা আনন্দ। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ্ বলেন, “আমি যদি আপনকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না। (তাফসীরে মাজহারী ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০) আল্লাহ্র এই বাণী থেকে স্পষ্ট হলো, একমাত্র হযরত রাসুল (সা.)-কে সৃষ্টির কারণেই মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন কুল কায়েনতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত, বরকত ও রহমতে পরিপূর্ণ।
যখন পৃথিবীময় ঘোর অন্ধকার, তখন মানবজাতিকে সত্য, আলো ও শান্তির পথে তুলে আনার জন্য মহান আল্লাহ্ তাঁর সেŸর্াত্তম সৃষ্টি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে ৫৭০ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার সুবেহ সাদেকের সময় হযরত মা আমেনা (আ.)-এর কোলে প্রেরণ করেন। দিনটি আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে পি্রয় এবং আনন্দের দিন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন- “নিশ্চয় আল্লাহ্ স্বয়ং ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপরে দরূদ পাঠ করেন। হে মু’মিনগণ তোমরাও তাঁর উপর দরূদ পড়ো ও শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬) তাই হযরত রাসুল (সা.)-কে পৃথিবীতে পাঠানোর আনন্দে আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় ফেরেশতাদের নিয়ে তার হাবিবের প্রতি দরূদ পাঠ করেছিলেন এবং মানুষকেও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করে শ্রদ্ধার সাথে সালাম জানাতে নির্দেশ করেছেন।
হযরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘মাওয়াহিবু লাদ্দুন্নিয়া’ কিতাবে বলা হয়েছে, হযরত আমিনা (আ.) বলেন, “প্রশংসিত সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সময় আমি তাঁকে সেজদা অবস্থায় দেখেছিলাম। উভয় হাতের তর্জনী অঙ্গুলী দোয়া ক্রন্দনকারীর ন্যায় আকাশের দিকে প্রসারিত ছিল।” মা আমেনা (আ.) আরো বলেছেন, “সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর কারা যেন তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে গিয়ে সমস্ত সৃষ্টিজগৎ পরিভ্রমণ করান। তিনি তাদের কথাবার্তা শুনেছিলেন। তিনি ঊর্ধ্বলোকের কথাবার্তার এক অংশে শুনেছিলেন যে, মোহাম্মদকে সকল নবির গুণাবলিতে বিভূষিত করো এবং সকল আম্বিয়াদের চরিত্র সাগরে ডুবিয়ে দাও।” (সূত্র: আত্মার বাণী, অক্টোবর ২০২০, পৃষ্ঠা ৫) ‘নুরে মোহাম্মদী’ নামক কিতাবে আছে, “ঐ রাতে কোরায়েশদের একটি মূর্তির মুখ দিয়ে কথা বের হয়েছিল। সে বলেছিল, একটি পবিত্র সন্তান প্রকাশ হওয়ায় চাদর পরিধান করেছি। এর জ্যেতিতে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের সমস্ত এলাকা আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁরই আগমনে সকল মূর্তি উপুড় হয়ে পড়েছে। আর তার ভয়ে প্রকিম্পত হয়ে বিশ্বের সমস্ত রাজা বাদশাহদের প্রাণ কেঁপে উঠেছে।” (আত্মার বাণী, অক্টোবর ২০২০, পৃষ্ঠা ৬)
হযরত রাসুল (সা.)-এর চাচা আবু লাহাব ছিল তাঁর ঘোর বিরোধী। এই আবু লাহাবের নামেই মহান আল্লাহ্ সূরা নাজিল করেছিলেন ‘সূরা লাহাব’। এর প্রথম আয়াতটির অর্থ ছিল, “আবু লাহাবের হস্তদ্বয় ধ্বংস হোক এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।” আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তার বিখ্যাত ফতহুল বারী কিতাবে বর্ণনা করেন- “হযরত সুহাইলি (রা.) কতৃর্ক হযরত আব্বাস (রা.) থেকে এক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আব্বাস (রা.) বলেন- যখন আবু লাহাব মৃত্যুবরণ করল, তার বছর খানেক পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখি, সে অত্যন্ত কষ্টকর অবস্থার মধ্যে আছে। অতঃপর আবু লাহাব তার অবস্থা সম্পর্কে জানায়, তোমাদের ছেড়ে আসার পর থেকে আমি শান্তির মুখ দেখিনি, তবে নিশ্চয় সপ্তাহের প্রতি সোমবার আমার আজাব লাঘব করা হয়। হযরত আব্বাস (রা.) বলেন- সোমবার আবু লাহাবের এ আজাব লাঘবের কারণ হলো- নিশ্চয় হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর শুভ জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুওয়াইবাকে সে খুশি হয়ে মুক্তি দিয়েছিল।” (ফতহুল বারী ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮)
আবু লাহাব একজন কাফের হয়েও হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মের সংবাদ পেয়ে খুশি হওয়ার কারণে কবর আজাব আল্লাহ্ মাফ করে দিতে পারেন, তাহলে আমরা যারা রাসুলে পাক (সা.)-কে ভালোবাসি, তার জন্মদিনটি ১২ই রবিউল আউয়াল আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দের সাথে উদ্যাপন করতে পারি নিশ্চয়ই মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রতি খুশি হবেন এবং আমাদের গুনাসমূহ মাফ করে দিতে পারেন।
রাহ্মাতুল্লিল আলামিনের শুভ জন্মদিনের ফজিলত এত বেশি যে, তাঁর জীবদ্দশাতেও সাহাবিগণের বাড়িতে ধুমধামের সাথে মিলাদ অনুষ্ঠিত হতো। এই মর্মে তাফসীরে জালালাইনের অন্যতম লেখক হযরত আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) প্রণীত ‘সাবীলুল হুদা ফি মাওলিদিল মুস্তফা’ কিতাবে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে- “বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, একদা আমি হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে হযরত আমের আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলাম, হযরত আমের (রা.) তার ছেলেমেয়ে ও আত্মীয় স্বজনকে একত্রিত করে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিনের বিবরণ শোনাচ্ছেন। অতঃপর তিনি বলছিলেন-আজ সেই দিন (পবিত্র জন্মদিন)। তাঁর এ কাজ দেখে হযরত রাসুল (সা.) অত্যন্ত আনন্দবোধ করলেন এবং বললেন- হে আমের! নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালা তোমার জন্য তার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। (যারা তোমার ন্যায় এমন কাজ করবে, তারাও তোমার মতো ফজিলত পাবে।)”
অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়- “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা তিনি তার ঘরে লোকদেরকে একত্রিত করে হযরত রাসুল (সা.)-এর জন্মদিন বর্ণনা করছিলেন, যা শুনে উপস্থিত সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করছিলেন। এমন সময় হযরত রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং খুশি হয়ে তাদের উদ্দেশে বললেন- তোমাদেরকে সাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে।’” (দুরর“ল মুনাজ্জাম)
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) সম্বন্ধে ইমাম আল্লামা শেহাবুদ্দীন আহম্মদ বিন হাযর আল-হায়াতামী আশ-শাফী (রহ.) প্রণীত (আন নিয়ামাতুল কুবরা ‘আলাল আলম’ নামক কিতাবের সাত পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে:
(১) ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি নবি (সা.)-এর মিলাদ শরীফ পাঠে অর্থ ব্যয় করবে, সে আমার সাথে বেহেশতে থাকবে।’
(২) হযরত ওমর (রা.) বলেন, “যে ব্যক্তি নবি (সা.)-এর মিলাদ শরীফকে ইজ্জত ও সম্মান দেবে, সে যেন ইসলামকে পুনর্জীবিত করল।”
(৩) হযরত ওসমান (রা.) বলেন, “প্রিয় নবি (সা.)-এর মিলাদ শরীফ পাঠ করতে গিয়ে যে ব্যক্তি অর্থ ব্যয় করবে, সে যেন বদর ও হুনাইনের মতো মহান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল।’
(৪) হযরত আলী কার্রামাল্লাহু ওয়াজহাহু বলেন, “যে ব্যক্তি নবি (সা.)-এর মিলাদ শরীফকে সম্মান করবে এবং তা পাঠের আয়োজন করবে, সে দুনিয়া থেকে ইমানের সাথে মৃত্যুবরণ করবে এবং বিনা হিসাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (আত্মার বাণী, অক্টোবর, ২০২০, পৃষ্ঠা ৮)
সামাজিকভাবে দেখা যায়, খ্রিষ্টানরা তাদের নবি হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিন মহাধুমধামের সাথে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে অন্য সকল ধর্মাবলম্বীরাও নিজ নিজ ধর্মের প্রবর্তকদের জন্মদিন সবার্ধিক গুর“ত্বের সাথে পালন করে থাকে। কিন্তু আমাদের নবি হযরত রাসুল (সা.) সমস্ত নবি রাসুলের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাঁর শুভ জন্মদিন পালন করি না। অথচ পৃথিবীর সমস্ত নবি-রাসুল ও ধর্মপ্রচারকগণ হযরত রাসুল (সা.)-এর শেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তাঁর দয়া কামনা করছেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- হযরত ঈসা (আ.) বলেন, “হে বনি ইস্রাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ্র রাসুল। আমার পূর্ববর্তী তাওরাতের আমি প্রত্যায়নকারী এবং আমি একজন রাসুলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন, তাঁর নাম আহমদ।” (সূরা আস সাফ ৬১: আয়াত ৬) এমনকি হযরত ঈসা (আ.) হযরত রাসুল (সা.)-এর উম্মত হওয়ার আঙ্খাক্ষাও ব্যাক্ত করেছিলেন।
পরিশেষে বলতে চাই-
ঈদে মিলাদুন্নবি আজ ঈদে মিলাদুন্নবি
চারিদিকে বইছে আজ আনন্দেরই ফুলঝুড়ি
ঈদে মিলাদুন্নবি আজ ঈদে মিলাদুন্নবি।
সৃষ্টিকুলের সৃষ্টিরাজি আনন্দেতে মাতোয়ারা আজি
আরও বেশি আনন্দিত সেইতো আমার মাওলাজি
ঈদে মিলাদুন্নবি আজ ঈদে মিলাদুন্নবি।
দরূদ পড়েন রাসুলেরই আশেক যারা
দরূদ পড়েন ফেরেস্তারা আরও বেশি দরূদ পড়েন
সেইতো আমার মাওলাজি
ঈদে মিলাদুন্নবি আজ ঈদে মিলাদুন্নবি।
৫৭০ খ্রি. ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার
হযরত মা আমেনার কোলে
সুবেহ সাদেরক সময় তাশরিফ নিলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.)।
৬৩ বছর হায়াতে জিন্দেগি সমাপ্তির পর
১লা রবিউল আউয়াল সোমবার
জগৎ থেকে বিদায় নিলেন দয়াল রাসুল (সা.)।
এই সত্য যিনি প্রকাশ করলেন যুগের
ইমাম সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী
হাজারও সালাম জানাই মুর্শিদ আমার নুরে নুরানি।
ঈদে মিলাদুন্নবি আজ ঈদে মিলাদুন্নবি।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]