রূহ আল্লাহ্ প্রদত্ত আমানত
ড. হুমায়ুন কবীর
মানবের যে অংশটি তার দেহের অস্তিত্ব ও সত্তার বিকাশ ঘটায়, তাই আত্মা বা রূহ। এ মহামূল্যবান আত্মার উৎপত্তি হয়েছে খোদ আল্লাহর জাত-পাক থেকে। রূহ সরাসরি আল্লাহ্ হতে আগত আলমে আমর তথা আত্মাময় জগতের অংশ। আলমে আমর ও আলমে খালক হলো মানবদেহের আধ্যাত্মিক সবকের অংশ। আলমে আমর হলো মানবের রূহের জগৎ এবং আলমে খালক হলো মানবের সৃষ্টির জগৎ। মানুষকে সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য সর্বমোট ৩৭টি সবক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে মানবদেহের আলমে আমরের ৫টি, যথা- ক্বালব, রূহ, ছের, খফি ও আখফা এবং আলমে খালকের ৫টি, যথা- বাদ (বাতাস), আব (পানি), আতশ (আগুন), খাক (মাটি) ও নফ্স।
মহান রাব্বুল আলামিন ছিলেন গুপ্ত ধনাগার। তিনি যখন নিজেকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করলেন তখন তিনি সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই এরশাদ করেন, ‘‘আমি ছিলাম গুপ্ত ধনাগার, নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসলাম, তাই সৃষ্টিজগৎ সৃজন করলাম।’’ (তাফসীরে মাজহারী, ১০ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০)
মহান প্রভুর সীমাহীন রূপবৈচিত্র্য বিভিন্নভাবে তাঁর সৃষ্টিজগতের মাঝে ফুঁটে উঠেছে। কিন্তু তাঁর গুণসমূহের (সিফাত) সর্বোচ্চ প্রতিফলন হয় এমন সৃষ্টি হিসাবে মানুষকে সৃষ্টি না করা পর্যন্ত তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই ফেরেশতাদের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি প্রতিনিধি হিসেবে হযরত আদম (আ.)-কে তাঁর নিজ সুরতে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা আদম (আ.)-কে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং নিজের রূহ হতে রূহ আদমের ভিতরে ফুঁকে দেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ্ রূহকে নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করে বলেন, ‘‘নাফাখতু ফীহি মির রূহী’’ অর্থাৎ- “আমি (আল্লাহ্) আদমের ভিতর আমার রূহ হতে রূহ ফুঁকে দিবো।” (সূরা আল হিজর ১৫: আয়াত ২৯)
আল্লাহ্ তায়ালার রূহ হযরত আদম (আ.)-এর ভিতরে প্রবিষ্ট হওয়ার পর প্রাণহীন হযরত আদম (আ.) সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবে পরিণত হলেন। এই রূহ ধারণ করায় হযরত আদম (আ.) মর্যাদার দিক থেকে ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। ফেরেশতারা তাঁর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন হিসাবে মহান আল্লাহ্র নির্দেশে হযরত আদম (আ.)-কে সেজদা করলেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তায়ালার রূহ থেকে যে রূহ হযরত আদম (আ.)-এর ভিতরে ফুঁকে দেওয়া হয়েছে সেটাই মানুষের কাছে দেওয়া আমানত। অন্য সকল প্রাণীর মাঝে প্রাণ আছে বটে, কিন্তু এদের মাঝে রূহ নেই। প্রাণকে বলা হয় নফ্স। প্রাণের সৃষ্টি হয় পুরুষের শুক্রকীট থেকে। আর রূহ-কে বলা হয় আকেল বা বিবেক। তা আল্লাহ্ থেকে আগত। সকল প্রাণীর মাঝে নফ্স আছে। শুধু কেবল মানুষের মাঝে নফ্স ও রূহ উভয়ই আছে। এই রূহ ও নফ্সের মিলনকেই জীবন বলা হয়।
মানুষের মাঝে রূহ বিদ্যমান রয়েছে বলেই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা লাভ করে সমগ্র সৃষ্টিরাজির উপর আল্লাহ্ তায়ালার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। রূহের কারণেই মানুষ আল্লাহ্র নুরে আলোকিত হয়ে ফানাফিল্লাহ্ তথা মহান আল্লাহ্র সাথে মিশে একাকার হতে পারে এবং মানুষ নিজের ক্বালবকে আরশ বানিয়ে আল্লাহ্র মহাশক্তি ও গুণাবলি বিকশিত করতে পারে। রূহ আছে বলেই মানুষের মধ্য হতে আল্লাহ্ তায়ালা নবি, রাসুল ও অলী-আল্লাহ্ মনোনীত করেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর রূহ মোবারকের পরিচয় দিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন, যেমন- রূহী, রুহুম মিনহু, বিররূহ, রূহানা, রূহিনা, মির রূহিনা, মির রূহিহী, রূহান, বিরূহিম মিনহু, রূহুল কুদুস এবং আররূহুল আমিন শব্দ ব্যবহার করে সর্বমোট ২০টি আয়াত নাজিল করেন। রূহ আরবি শব্দ। বিশ^বিখ্যাত আরবি অভিধানে ‘রূহ’ শব্দটির অর্থ হয়েছে- রূহ, রূহু, পরম আত্মা, আল্লাহর সত্তা। আর ‘রূহুল কুদুস’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে- আল্লাহর পবিত্র রূহ মোবারক এবং ‘রূহুল আমিন’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে- আল্লাহর বিশ্বস্ত রূহ মোবারক।
মহান রাব্বুল আলামিন এই পবিত্র রূহকেই সমস্ত মানুষের অন্তরে আমানত স্বরূপ প্রেরণ করেন। আল্লাহ্ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ও প্রতিনিধি হলো মানুষ। তিনি মানুষের কাছে এমনই এক মহানেয়ামত আমানত হিসাবে দান করেন, যা অন্য কোনো সৃষ্টিকে দেওয়া হয়নি। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘‘আমি আসমান, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি আমানত পেশ করেছিলাম। তারা তা বহন করতে অস্বীকার করল এবং তাতে শঙ্কিত হলো, কিন্তু মানুষ তা বহন করল, সে কত জালিম, কত অজ্ঞ।” (সূরা আযহাব ৩৩: আয়াত ৭২)
মহান আল্লাহর প্রদত্ত আমানতই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মহিমায় উদ্ভাসিত করেছে। বস্তুত আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের ভিতরে স্বীয় রূহ ফুঁকে দিয়ে সৃষ্টিজগতে নিজের সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর প্রয়াস চালান। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘‘আল ইনসানু সিররি ওয়া আনা সিররূহু।’’ অর্থাৎ মানুষ আমার রহস্য, আর আমি মানুষের রহস্য।
রূহ হলো আল্লাহ্ তায়ালার পবিত্রময় সত্তা। মহান আল্লাহ্ মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি করে জগতে প্রেরণ করেন। কিন্তু মানুষ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রতিনিধিত্বের গুণ হারিয়ে ফেলে বিধায় আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন দেখা দেয়। মানুষের কুরিপুসমূহ আত্মার জীব প্রবৃত্তিকে শক্তিশালী ও বিপথগামী করে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর পবিত্রময় সত্তা রূহকে কলুষিত করে ফেলে। তাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আত্মা ও রূহকে অবশ্যই শুদ্ধ বা কুরিপু মুক্ত করা প্রয়োজন। কারণ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য কুরিপু মুক্ত হওয়া প্রথম শর্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- ‘‘ কীরূপে তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে কুফরি করছ? অথচ তোমরা ছিলে মৃত। তারপর তিনি তোমাদের জীবন দান করলেন, আবার তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন এবং আবার তিনি তোমাদের জীবন দান করবেন। পরিণামে তোমরা তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।’’ (সূরা আল বাকারা ২: আয়াত ২৮)
আল্লাহর বাণী অনুযায়ী বলতে হয় এই পবিত্র সত্তা অর্থাৎ রূহকে অবশ্যই পুতঃপবিত্র অবস্থায় মহান আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে, নতুবা আল্লাহ্ তায়ালা অশুদ্ধ বা কালিমাযুক্ত রূহকে গ্রহণ করবেন না, অথবা তাঁর পবিত্র রূহের সাথে রূহ মিশাবেন না। তাই মানুষকে এই পবিত্র রূহের পূর্বের রূপ অর্থাৎ ষড়রিপুর বেড়াজাল ছিন্ন করে নিজেকে পবিত্র করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের সক্ষম করার বিদ্যা অবলম্বন করতে হবে।
যুগ যুগ ধরে মহান আল্লাহর প্রেরিত নবি-রাসুলগণই মানুষকে এই বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে আসছেন। নবি-রাসুলদের যুগ শেষ হওয়ার পরে অলী-আল্লাহ্, পির, মোর্শেদ তথা হযরত রাসুল (সা.)-এর হেদায়েতের নুরের ধারক-বাহক হয়ে প্রেরিত যুগশ্রেষ্ঠ মহামানবগণকে মহান আল্লাহ্ বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। তাঁরা জগতের পথভ্রষ্ট মানুষের দুর্দশা দেখে দয়ার পরবশ হয়ে মানুষের মুক্তির সহজ উপায় উদ্ভাবন করেন এবং আল্লাহ্ তায়ালার অনুমোদন লাভের পর সহজতর পদ্ধতি অনুসারে মানুষকে হেদায়েত করে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় যুগের ইমাম, মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) আগমন করেছিলেন।
সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান বলেন, রূহ মূলত আল্লাহর সত্তা বিশেষ। আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-এর ভিতরে যে পবিত্র রূহ ফুঁকে দিয়েছেন, তেমনি পবিত্র অবস্থায়ই রূহকে আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হলে সাধনার পথে আধ্যাত্মিক সবকের শিক্ষা নিতে হবে।
মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজানের শিক্ষা গ্রহণ করে, রূহের পবিত্রতা অর্জন করার তৌফিক ভিক্ষা দেন। আমিন।
[লেখক: ইসলামি গবেষক]