রোজার ফজিলত ও তাৎপর্য – হযরত তরিকুল ইসলাম তারিফ
আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান। বছর ঘুরে আবার এলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানুল মোবারক। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। কালিমা (ইমান), নামাজের পর এটি ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। আত্মশুদ্ধিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসংযম ধৈর্য ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় রোজা। এ ইবাদতের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। আল্লাহ্র প্রেম, আল্লাহ্ভীতি বা তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনেও রোজা অপরিহার্য ইবাদত। রোজা শুধু আবশ্যকীয় ইবাদতই নয়; বরং আত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনেও এর ভূমিকা ব্যাপক। কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মানবিক কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে রোজা। শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মাকে হেফাজত রাখতেও রোজার ভূমিকা অপরিসীম।
রোজার সংজ্ঞা: সাওম আরবি শব্দ। এ শব্দের বহুবচনে সিয়াম। এর আভিধানিক অর্থ উপবাস, বিরত থাকা, পানাহার পরিত্যাগ করা, আত্মসংযম ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদেক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার কামাচার থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোজা বলা হয় ।
রোজার বিধান: মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে রোজার বিধান ফরজ করে আয়াত নাজিল করে বলেন, “তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা মোত্তাকি হতে পারো।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১৮৩) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিস শরীফে মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) রমজান মাসের রোজাকে ফরজ আখ্যায়িত করে বলেছেন, “আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের ওপর রমজান মাসের রোজাকে ফরজ করে দিয়েছেন। আমি তোমাদের জন্য (রমজানে কিয়ামুল লাইল) তারাবিহ নামাজকে সুন্নত করে দিয়েছি।” (মুসনাদে বাযযার, ৩য় খণ্ড, নাসাঈ, পৃষ্ঠা ২৫৭, হাদিস নং ১০৪৮)
যাদের উপর রোজা ফরজ: রমজান মাসে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ-সবল জ্ঞানসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর ওপর রোজা রাখা ফরজ। অবশ্য রোজা পালনে অক্ষম, অসুস্থ, মুসাফির বা পর্যটক ব্যক্তিদের পরবর্তীকালে রোজা পালনের সুযোগ দিয়েছে ইসলাম। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমজান মাসে উপস্থিত হয় সে যেন রোজা রাখে। আর যে ব্যক্তি অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে সে যেন পরবর্তী দিনগুলোতে তা আদায় করে।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১৮৫)
রোজার স্তরের শ্রেণিবিন্যাস: আল্লাহ্র মহান বন্ধু মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান রোজাকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। ১. সাধারণ শ্রেণির রোজা । ২. মধ্যম শ্রেণির রোজা । ৩. উত্তম শ্রেণির রোজা ।
রোজার ফজিলত ও তাৎপর্য
১. রোজার প্রতিদান মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন নিজেই দিবেন এবং বিনা হিসাবে দিবেন: মহান আল্লাহ্ রোজাদারদেরকে নিজেই পুরস্কৃত করবেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেন, বান্দা একমাত্র আমার জন্য তার পানাহার ও কামাচার বর্জন করে, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেবো আর (অন্যান্য) নেক আমলের বিনিময় হচ্ছে তার দশগুণ। (সহীহ বুখারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪; হাদীস: ১৮৯৪)
রোজার ফজিলত প্রসঙ্গে অন্য বর্ণনায় আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘‘রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, পক্ষান্তরে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো।” (বোখারী শরীফ হাদীস ১৯০৪) প্রত্যেক আমলের পুরস্কার আমলকারীর জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, কিন্তু পুরস্কার এতো বেশি যে, মহান আল্লাহ্ রোজাদারদের উপর অধিক খুশি হয়ে রোজাদারদেরকে নিজেই পুরস্কৃত করবেন।
২. আল্লাহ্ তায়ালা রোজাদারকে কেয়ামতের দিন পানি পান করাবেন: মহান আল্লাহ্ রোজাদারদের জন্য একটি বিশেষ পানির হাউজের ব্যবস্থা করে পানি পান করাবেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো। … কেয়ামতের দিন রোজাদারদের জন্য একটি বিশেষ পানির হাউজ থাকবে, যেখানে রোজাদার ব্যতীত অন্য কারো আগমন ঘটবে না। (মুসনাদে বাযযার, হাদিস: ৮১১৫)
৩. রোজা হলো জান্নাত লাভের উপায়: রোজা রাখার ফলে রোজাদারগণ জান্নাত লাভ করেন। রোজাদারদের জন্য জান্নাত অর্জন সহজ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হযরত হুজায়ফা (রা.) বলেন, “আমি আল্লাহ্র নবি (সা.)-কে আমার বুকের সাথে মিলিয়ে নিলাম, তারপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনায় একদিন রোজা রাখবে, পরে তার মৃত্যু হয় সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো দান-সদকা করে তারপর তার মৃত্যু হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসনাদে আহমদ ১৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৯০ ও ৫৯১, হাদিস নং ২৩২১৭)
অন্য হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে আগমন করে বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন, যার দ্বারা আল্লাহ্ আমার উপকার করবেন (আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো)। তিনি বলেন, তুমি রোজা রাখো, কেননা এর সমতুল্য কিছু নেই। (ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত সুনানে নাসায়ী ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৩, হাদিস নং ২২২৩ এবং সহীহ ইবনে হিববান, হাদিস : ৩৪২৬)
৪. রোজাদারগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা দিয়ে: রোজাদারগণের প্রতি মহান আল্লাহ্ খুশি হয়ে ‘রাইয়ান’ নামক বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এ প্রসঙ্গে হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, “জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত এ দরজা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা করা হবে- কোথায় সেই (সৌভাগ্যবান) রোজাদারগণ? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। অতঃপর রোজাদারগণ যখন প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪, হাদিস নং ১৮৯৬)
৫. রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল ও দুর্গ: রোজাদারগণকে রোজা জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ঢাল হিসেবে রক্ষা করবে। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আমাদের মহান প্রতিপালক এরশাদ করেছেন- রোজা হল ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে। রোজা আমার জন্য আর আমিই এর পুরস্কার দেবো।” (মুসনাদে আহমদ ১১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১০, হাদিস নং ১৪৬০৪) এমনিভাবে হাদিস শরীফে আরো বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবি কারিম (সা.) এরশাদ করেন “রোজা হলো (জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের) ঢাল। (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪, হাদিস নং ১৮৯৪)
৬. রোজা কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে: রোজাদারগণের জন্য রোজা মহান আল্লাহ্র নিকট জান্নাতের সুপারিশ করবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন- “রোজা ও কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে খাদ্য ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, অতঃপর তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ৬৬২৬)
৭. রোজাদারের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়: মহান রোজাদারগণের জীবনের পূর্ববর্তী গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন “যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭০, হাদিস নং ২০১৪)
৮. রোজাদারের মুখের গন্ধ মিশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত: রোজাদারগণের রোজা থাকার ফলে মুখের গন্ধ মিশকের চেয়েও সুগন্ধিময়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন- “সেই সত্তার শপথ, যার হাতে মোহাম্মাদের জীবন, রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫; হাদিস নং ১৯০৪ এবং মুসনাদে আহমদ, হাসিন নং ৭১৭৪)
৯. রোজাদারের দোয়া কবুল হয়: মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন রোজাদারদের দোয়াসমূহকে কবুল করেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন- “ইফতারের সময় রোজাদার যখন দোয়া করে, তখন তার দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। (অর্থাৎ তার দোয়া কবুল হয়)।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৭৫৩)
১০. রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দের মুহূর্ত: রোজাদাগণ দুটি সময় মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অধিক আনন্দ লাভের মুহূর্ত রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, রোজাদারদের দুটি আনন্দের সময় আছে যে দুটি সময়ে তারা আনন্দিত হবে। একটি হলো, ইফতারের সময়। অপরটি হলো, আল্লাহ্ তায়ালার সাথে সাক্ষাতের সময়। (মুসলিম শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৬৩)
আল্লাহ্র মহান বন্ধু আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান মানুষকে হাকিকতে সিয়াম পালন করার সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষানুযায়ী আশেকে রাসুলগণ রোজা কবুলিয়াতের ফায়েজ হাসিল করতে সক্ষম হয়েছেন।
পরিশেষে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা জানাই তিনি যেন দয়া করে আমাদের সকলের মাহে রমজানের রোজাগুলোকে কবুল করে নেন। আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। আমিন!
[লেখক: গবেষক, আল কুরআন গবেষণা কেন্দ্র, দেওয়ানবাগ শরীফ]