রোজা: একটি পর্যালোচনা – ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা
রোজার সংজ্ঞা
রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি শব্দ হলো1 ‘সাওম’। ‘সাওম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ1 উপবাস, বিরত থাকা। মোহাম্মদী ইসলামের পরিভাষায় মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে যাবতীয় পানাহার, কামাচার থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোজা বলা হয়। আরবি বারো মাসের মধ্যে অন্যতম হলো রমজান মাস। এ রমজান মাসে রোজা রাখা প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর ও নারীর জন্য ফরজ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- “ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানূ কুতিবা ‘আলাইকুমুস সিইয়ামু কামা কুতিবা ‘আলাল্লাযীনা মিন ক্বাবলিকুম লা‘আল্লাকুম তাত্তাক্বূন।” অর্থাৎ- “হে মু’মিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা মোত্তাকি হতে পারো।” (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ১৮৩)
সুতরাং রোজা কেবল উম্মতে মোহাম্মদীর উপরই ফরজ করা হয়নি, বরং পূর্ববর্তী নবি ও রাসুলগণের যুগেও রোজা ফরজ ছিল। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন1 “আমাদের রোজা ও আহলে কিতাব তথা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো ‘সাহরি’ খাওয়া।” (আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২০) আবার ইফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- “দ্বিন জয়ী থাকবে ততদিন, যতদিন লোকেরা শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করবে। কেননা ইহুদি ও খ্রিষ্টানগণ বিলম্বে ইফতার করে।” (আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২১) অতএব পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উপরও মহান আল্লাহ্ রোজা ফরজ করেছিলেন।
রোজাদারের শ্রেণিবিন্যাস
সুফিদের মতে, রোজাদার তিন শ্রেণিতে বিভক্ত, যথা-
১। সাধারণ শ্রেণির রোজাদার: যে ব্যক্তি সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকে তাকে সাধারণ শ্রেণির রোজাদার বলে।
২। মধ্যম শ্রেণির রোজাদার: যে ব্যক্তি সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকে এবং যাবতীয় পাপ কর্ম থেকে বিরত থাকে তাকে মধ্যম শ্রেণির রোজাদার বলে।
৩। উত্তম শ্রেণির রোজাদার: যে ব্যক্তি সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার কামাচার পরিত্যাগ করে যাবতীয় পাপ কর্ম থেকে বিরত থাকে এবং পাপের কল্পনা থেকে মনকে পবিত্র রেখে সর্বক্ষণ আল্লাহ্র স্মরণে নিমগ্ন থাকে সে হলো উত্তম শ্রেণির রোজাদার। এটিই নবি, রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের রোজা। এ রোজাই হাকিকতে রোজা বা প্রকৃত রোজা। হাদিসে কুদসিতে এ রোজা প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে- “আসসিইয়ামু লী ওয়া আনা আজঝী বিহী।”অর্থাৎ- “রোজা আমার জন্য এবং আমি এর প্রতিদান।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪)
হাকিকতে রোজা
রোজার নিয়তে শুধুমাত্র উপবাস থাকলেই মানুষের আত্মশুদ্ধি হয় না এবং মানুষ সংযমী হতে পারে না। রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া তথা পাপ কাজ থেকে বিরত থেকে সংযমী চরিত্র অর্জন করে আত্মশুদ্ধি লাভ করা। রোজার হাকিকত হচ্ছে- আত্মশুদ্ধি লাভ করে মহান আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করার মাধ্যমে আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা হওয়া। হাকিকতে রোজা পালন করে পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়, এমনকি পাপের কল্পনা থেকেও মুক্ত থাকা যায়। হাকিকতে রোজা আদায়ের মাধ্যমে রোজাদার আল্লাহ্র হুকুম পালন করে পানাহার ও কামাচার এবং পাপাচার থেকে বিরত থাকার ফলে মহান আল্লাহ্র পূর্ণ আনুগত্য করতে সক্ষম হয়। মু’মিন আল্লাহ্কে ভালোবেসে তাঁরই হুকুমে রোজা পালনের কারণে, তিনি দয়া করে রোজাদারের প্রতিদান হয়ে থাকেন। যে রোজাদার রোজার পুরস্কারস্বরূপ মহান আল্লাহ্কে পেয়ে যান, তিনি হাকিকতে রোজার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন। রোজা পালনের মাধ্যমে যে ব্যক্তি নিজের নফস বা জীব প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে হৃদয়ে আল্লাহ্কে লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন, কেবল তিনিই হাকিকতে রোজা পালনের মাধ্যমে সফলকাম হয়েছেন। রোজা মানুষের আমিত্বকে দূর করে আল্লাহ্র চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ্কে পাওয়ার অর্থ হলো1 নিজের মাঝে আল্লাহ্র চরিত্র বিকশিত করা। অতএব হাকিকতে রোজা হচ্ছে1 অন্তরের পাপ কালিমা বিদূরিত করে হৃদয় মাঝে বিরাজমান আল্লাহ্র সুপ্ত নুর বিকশিত করে আল্লাহ্র আলো দ্বারা নিজেকে আলোকিত করে নেওয়া।
রোজার ফরজসমূহ
রোজার ফরজ ২টি। যথা1 ১। নিয়ত করা, ২। পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকা। স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, আল্লাহ্ তায়ালা রমজানের রাতে পানাহার ও স্ত্রী গমনকে বৈধ করেছেন। কিন্তু রোজা অবস্থায় তিনি স্ত্রী গমনকে নিষিদ্ধ করেছেন।
রোজার নিয়ত
নিয়ত বলতে বুঝায়1 অন্তর দিয়ে কোনো কাজের সংকল্প করা। আর অন্তরের এ বিষয়টি মুখে প্রকাশ করা উত্তম। মূলে রোজা রাখার নিয়ত বা সংকল্প থেকেই সাহরি খাওয়া হয়। রোজা রাখার নিয়ত আপনি আরবিতে করতে চাইলে বলবেন1 “নাওয়াইতু আন আসূমা গাদাম মিন শাহরি রামাদ্বানাল মুবারাকি ফারদ্বাল লাকা ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাব্বাল মিন্নী ইন্নাকা আনতাস সামী‘উল ‘আলীম।” অর্থাৎ- “হে আল্লাহ্! আমি আগামীকাল মাহে রমজানের রোজা রাখার নিয়ত করলাম, যা আপনার পক্ষ থেকে ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছু শুনেন ও জানেন।” তবে নিয়ত আরবি ভাষায় করা শর্ত নয়। আপনার অন্তরে আল্লাহ্কে স্মরণ করে আপন ভাষায় এতটুকু বললেই নিয়ত হয়ে যাবে1 “হে আল্লাহ্! আমি আপনার সন্তুষ্টির জন্য আগামীকাল মাহে রমজানের রোজা রাখার নিয়ত করলাম।”
সাহরি ও ইফতারের বিবরণ
সাহরি শব্দটি আরবি। এটির বহুবচন সুহূর এসেছে। এর অর্থ ঊষা বা ভোর বেলার খাবার, শেষ রাতের খাবার।
পরিভাষায় রোজা রাখার উদ্দেশ্যে সুবহে সাদেকের পূর্বে যা কিছু পানাহার করা হয়, এটিকে সাহরি বলা হয়। রোজা পালনের জন্য সাহরি খাওয়া সুন্নত ও অধিক পুণ্যের কাজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন1 “ওয়া কুলূ ওয়াশরাবূ হাত্তা ইয়াতাবাইয়্যানা লাকুমুল খাইত্বুল আবইয়াদ্বু মিনাল খাইত্বিল আসওয়াদি মিনাল ফাজরি, ছুম্মা আতিম্মুস সিইয়ামা ইলাল লাইল।” অর্থাৎ- “আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ না (রাতের) কালো রেখা থেকে ভোরের সাদা রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। তারপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত।” (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ১৮৭) সাহরি বিলম্বে গ্রহণ করা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়)। হযরত হুযায়ফা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন1 “আমরা আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-এর সাথে এমন সময় সাহরি খেয়েছি যে, তখন দিন হয়ে গিয়েছিল, তবে সূর্য উদিত হওয়া বাকি ছিল।” (সুনানে নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও মুসনাদে আহমদ-এর সূত্রে তাফসীরে ইবনে কাছীর ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২০)
হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন1 “দা‘আনী রাসূলুল্লাহি (সা.) ইলাস সুহূরি ফী রামাদ্বানা ফাক্বালা হালুম্মা ইলাল গাদাইল মুবারাক।” অর্থাৎ- “একদা আল্লাহ্র রাসুল (সা.) আমাকে রমজান মাসে সাহরির সময় আহ্বান করলেন, এবং বললেন1 বরকতময় খাবারের দিকে (সাহরির দিকে) সত্বর আগমন করো।” (আবু দাউদ শরীফ, পৃষ্ঠা ৩২০; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪২ ও ২৪৩, হাদিস নং ২৩৩৭)
অন্য হাদিসে হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন1“বিলালের আজান এবং পূর্ব আকাশের এরূপ শুভ্র আলো যতক্ষণ না তা পূর্ব দিগন্তে প্রসারিত হয়, যেন তোমাদেরকে সাহরি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে।” (আবু দাউদ শরীফ, পৃষ্ঠা ৩২০, ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৩, হাদিস নং ২৩৩৮) এমনিভাবে হযরত কায়স ইবনে তালক (রহ.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন1 “তোমরা খাও এবং পান করো, আর তোমাদেরকে যেন সুবহে কাযিবের উচ্চ লম্বা রেখা (যা পূর্ব থেকে পশ্চিমে দৃশ্যমান) সাহরি খাওয়া হতে বিরত না রাখে। আর তোমরা ততক্ষণ পানাহার করো, যতক্ষণ না সুবহে সাদিকের লম্বা লাল আলোকরশ্মি (যা পূর্বাকাশে উত্তর-দক্ষিণে দৃশ্যমান) প্রকাশ পায়।” (আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড: পৃষ্ঠা ৩২০ ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৩, হাদিস নং ২৩৪০)
উল্লিখিত কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, সূর্যোদয়ের পূর্বে ভোরের আলোকিত সাদা রেখা প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত সাহরি খাওয়া উত্তম।
ইফতার
ইফতার অর্থ1 রোজা ভঙ্গ করা বা সমাপ্ত করা। শরিয়তের পরিভাষায় রোজাদার ব্যক্তির জন্য সূর্য অস্ত যাওয়ার পর কিছু খেয়ে বা পান করে রোজা ভঙ্গ করাকে ইফতার বলে। সূর্যাস্তের পর বিলম্ব না করে সাথে সাথে ইফতার করা উত্তম। মাগরিবের আজানের সাথে ইফতারের সময়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ইফতারের সময়ের সম্পর্ক সূর্যাস্তের সাথে। সূর্যাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত হলে সাথে সাথে ইফতার করা সুন্নত। যে কোনো হালাল খাদ্য দ্রব্য দ্বারাই ইফতার করা যায়। তবে খেজুর দ্বারা ইফতার করা উত্তম। খেজুর না পেলে পানি দ্বারাই ইফতার শুরু করতে পারেন। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “তিনটি বিষয় নবিগণের সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। যথা1 ১। শীঘ্র ইফতার করা, ২। বিলম্বে সাহরি গ্রহণ করা, ৩। মিসওয়াক করা।” (শামী ২য় খণ্ড) স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, বিলম্বে ইফতার করা মাকরুহ (অপছন্দনীয়, ঘৃণিত বিষয়)। পক্ষান্তরে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার সামনে নিয়ে বসে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়, কাক্সিক্ষত বিষয়)। এর ফলে আল্লাহ্ তায়ালা সন্তুষ্ট হন। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন1 “লিসসাইমি ফারহাতানি ফারহাতুন ‘ইনদা ফিত্বরিহী ওয়া ফারহাতুন ‘ইনদা লিক্বাই রাব্বিহী।” অর্থাৎ- “রোজাদার ব্যক্তির জন্য দুটি আনন্দ। একটি তার ইফতারের সময়, অন্যটি তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়।” (বোখারী ও মুসলিমের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৭৩) ইফতারের সময়টি দোয়া কবুল হওয়ার জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত। আপনি মোহাম্মদী ইসলামের অনুসারী একজন আশেকে রাসুল হিসেবে ইফতারের পূর্বে দোয়া কবুলের এ বিশেষ মুহূর্তে একাগ্রচিত্তে মিলাদ শরীফ পাঠ করে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করুন। অতঃপর যথাসময়ে ইফতার করুন।
ইফতারের দোয়া
আপনি যখন ইফতার গ্রহণ করবেন, তখন এ দোয়া পাঠ করবেন1 “আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া‘আলা রিঝক্বিকা আফত্বারতু।” অর্থাৎ- “হে আল্লাহ্! আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্যই রোজা রেখেছি এবং তোমারই রিজিক দিয়ে ইফতার করছি।” (আবু দাউদ শরীফ, পৃষ্ঠা ৩২২)
রোজা ভঙ্গের মূল কারণসমূহ
১। সহবাস করা। ২। পানাহার করা। ৩। মহিলাদের হায়েজ ও নিফাস হওয়া।
যে সব কারণে রোজা না রাখা বৈধ
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন1 “ফামান কানা মিনকুম মারীদ্বান আও ‘আলা সাফারিন ফা‘ইদ্দাতুম মিন আইয়্যামিন উখারা, ওয়া ‘আলাল্লাযীনা ইউত্বীক্বূনাহূ ফিদইয়াতুন ত্বা‘আমু মিসকীনি, ফামান তাত্বাওয়্যা‘আ খাইরান ফাহুওয়া খাইরুল লাহূ, ওয়া আন তাসূমূ খাইরুল লাকুম ইন কুনতুম তা‘লামূন।”
অর্থাৎ : “তবে তোমাদের মধ্যে কেউ অুসুস্থ হলে কিংবা সফরে থাকলে, সে অন্য সময়ে রোজার সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর রোজা যাদের জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক, তারা এর পরিবর্তে ফিদইয়া দেবে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করে। যে ব্যক্তি খুশির সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। যদি তোমরা রোজা রাখো, তবে তা হবে তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে।” (সূরা আল বাকারাহ ২ : আয়াত ১৮৪)
অতএব উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, যেসব কারণে রোজা না রাখা বৈধ সেগুলো হলো1
১। রোগাক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তি, রোজা রাখতে যার কঠিন কষ্ট ভোগ করতে হয় অথবা রোজা রাখলে রোগ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
২। মুসাফির বা ভ্রমণ অবস্থায় অব্যাহতি রয়েছে। এক্ষেত্রে কসরের নামাজে মুসাফিরের যে শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে, কেবল এরূপ ব্যক্তিই মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন। তবে রুগ্ন বা মুসাফির ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় কিংবা সফরে যে কয়টি রোজা রাখতে পারবেন না, সেগুলো অন্য সময়ে হিসাব করে কাযা হিসেবে আদায় করে নিতে হবে।
রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া
অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি যে রোজা রাখতে অক্ষম অথবা এমন রুগ্ন ব্যক্তি, যার সুস্থতার আশা করা যায় না, তাদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান হলো1 তারা রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া দেবে। ফিদিয়া হলো ঐ বিনিময়, যা আদায় করলে রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা থেকে আল্লাহ্ বান্দাকে মুক্তি দিয়ে দেন। রোজার ফিদিয়া হলো1 প্রত্যেক দিনের রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে দু’বেলা পেট ভরে আহার করাবেন অথবা সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা সমপরিমাণ খাদ্যদ্রব্য অথবা তার বাজার মূল্য কোনো মিসকিনকে প্রদান করে দেওয়া।
ফিতরা
ফিতরাকে হাদিসের ভাষায় যাকাতুল ফিতর বা সাদাকাতুল ফিতর বলে। এটি আদায়ের মাধ্যমে রোজার দোষ-ত্রুটি দূর হয়ে রোজা পবিত্র হয় এবং গরিব, মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থা হয়। ঈদুল ফিতরের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই ফিতরা আদায় করে দেবেন। তবে এ সময় ফিতরা আদায় করতে অসুবিধা হলে পূর্বেও ফিতরা আদায় করা যায়। হযরত রাসুল (সা.)-এর যুগে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা হতো। তখন খেজুর, কিসমিস, যব, পনির ও গম দ্বারা ফিতরা আদায় করা হতো। আরব দেশে খেজুর সহজলভ্য হলেও গম ছিল দু®প্রাপ্য। আর তখন খেজুরের চেয়ে গমের দাম অনেক বেশি ছিল। এজন্য খেজুর, কিসমিস, যব ও পনির দ্বারা ফিতরা আদায় করার ক্ষেত্রে বিধান দেওয়া হয়, এক সা‘ বা তিন কেজি তিনশ গ্রাম। অর্থাৎ উল্লিখিত তালিকা থেকে তিন কেজি তিনশ গ্রাম পরিমাণ খাদ্য ফিতরা হিসেবে গরিব, মিসকিনকে দিতে হবে। অন্যদিকে শুধুমাত্র গম দিয়ে ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে বিধান দেওয়া হয়েছে1 অর্ধ সা‘ বা ১৬৫০ গ্রাম গম দিয়ে ফিতরা আদায় করতে
হবে।
হযরত ছা‘লাবা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবী সুআইর তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন1 “ছোটো কিংবা বড়ো, স্বাধীন কিংবা দাস-দাসী, পুরুষ অথবা নারী তোমাদের প্রতি দুই জনের পক্ষ থেকে এক সা’ গম নির্ধারণ করা হলো (সুতরাং একজন হলে অর্ধ সা’)। তোমাদের মধ্যে যারা ধনী, (ফিতরা আদায় করার ফলে) তাদের আল্লাহ্ পবিত্র করবেন। আর যারা গরিব, তাদেরকে আল্লাহ্ তাদের দানের তুলনায় আরো অধিক দান করবেন।” (আবু দাউদ শরীফ, পৃষ্ঠা ২২৮; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত আবু দাউদ শরীফ, পৃষ্ঠা ৪১০, হাদিস নং ১৬১৯)
তবে আপনি যদি উল্লিখিত খাদ্য দ্রব্যের নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য নিরূপণ করে নগদ টাকা ফিতরা হিসেবে গরিব, মিসকিনদের প্রদান করেন, তবে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।
[লেখক: মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম; পরিচালক, সমন্বয়ক ও সমস্যার ফয়সালাকারী, দেওয়ানবাগ শরীফ; প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।]