শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত – হযরত তরিকুল ইসলাম তারিফ
মাহে রমজানের পূর্ব প্রস্তুতির মাস পবিত্র শাবান মাস। এই শাবান মাসের এক মহা পুণ্যময় রজনিকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বরকতময় রজনি বা শবে বরাত বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসি থেকে এসেছে। ‘শব’ মানে রাত, ‘বরাত’ মানে মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবে বরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিসের আলোকে এ মহিমান্বিত বরকতময় রজনি হচ্ছে ‘নিসফুন মিন শা‘বান’ অর্থাৎ- ‘শাবান মাসের অর্ধ রজনি’। সেটি ১৪ই শাবান দিবাগত রাত। আরবি চান্দ্রবর্ষ পঞ্জিকানুযায়ী ১৪ই শাবান দিবাগত রাত্রিতে লাইলাতুল বারাআত (বরকতময় রজনি) হিসেবে মু’মিনগণ ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থেকে মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হন। মু’মিন হৃদয়ে বরকতময় রাতের ঐশ্বরিক বরকত লাভের সুযোগ নিয়ে বছর ঘুরে আবার এলো লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত।
মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলেন, “হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই রাসুল পাঠিয়ে থাকি।” (সূরা দুখান ৪৪: আয়াত ১-৫) কোনো কোনো মুফাস্সিরগণ বলেন: এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনি’ বলে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকেই বোঝানো হয়েছে। সূরা আদ দুখান-এর ৪ হতে ৬নং আয়াত পর্যন্ত লাইলাতুম মুবারাকাহ বা শবে বরাতের রজনি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি হলো অর্ধ শাবান বা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। উল্লেখ্য যে, আভিধানিক অর্থে (লাইলাতুম মুবারাকাহ)-এর অর্থ বরকতময় রজনি, কল্যাণময় রজনি, মঙ্গলময় রজনি ও প্রাচুর্যময় রজনি। তাফসীরে জালালাইনের ৪১০ পৃষ্ঠায় তাফসীরে সা’বীর সূত্রে এ রাতের চারটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- ১। (আল লাইলাতুল মুবারাকাহ) বরকতময় রজনি। ২। (লাইলাতুল বারাআত) মুক্তির রজনি। ৩। (লাইলাতুর রাহমাত) দয়াপ্রাপ্তির রজনি ও ৪। (লাইলাতুস সাক) বন্টনের রজনি।
এ রাতে লাওহে মাহ্ফুজে সংরক্ষিত কুরআন সপ্তম আকাশ হতে দুনিয়ার আকাশে একত্রে নাজিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত ইকরামা (রা.) বলেন- “অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রজনিতে আল্লাহ্ তায়ালা এ কুরআন লাওহে মাহ্ফুজ তথা সপ্তম আকাশ হতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে নাজিল করেন।” (তাফসীরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৪১০) উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, শবে বরাতে পবিত্র কুরআন প্রথম আকাশে একত্রে নাজিল হলেও হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নিকট ওহি নাজিলের সূচনা হয় পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে।
মেশকাত শরীফ-এর ১১৫ পৃষ্ঠায় ইবনে মাজাহ শরীফ-এর সূত্রে হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “ইন্নাল্লাহা তা‘আলা লাইয়াত্বত্বালিউ ফী লাইলাতিন নিসফি মিন শা‘বানা ফাইয়াগফিরু লিজামী‘ই খালক্বিহী ইল্লা লিমুশরিকিন আও মুশাহিন।” অর্থাৎ- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রজনিতে নিজেকে প্রকাশ করেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।”
হযরত উসমান ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আল মুগীরাহ ইবনে আখনাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “তুক্বত্বা‘উল আজালু মিন শা‘বানা ইলা শা‘বানা হাত্তা ইন্নার রাজুলা লাইয়ানকিহু ওয়া ইউলাদু লাহু ওয়া ক্বাদ খারাজাস মুহু ফিল মাওতা।” অর্থাৎ- “এক শা’বান হতে পরবর্তী শা’বান পর্যন্ত মানুষের হায়াতের ফয়সালা (শবে বরাতের রাতে) করা হয়। অনন্তর এক ব্যক্তি বিয়ে করছে, তার সন্তানও হচ্ছে অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় এসে গেছে।” (তাফসীরে তাবারী ২৫নং খণ্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা )
শবে বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে আল্লাহ্র মহান বন্ধু মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন, “প্রতি বছর শবে বরাতের বরকতময় এ মহিমান্বিত রজনিতে মহান আল্লাহ্ আগামী এক বছরের বাজেট নির্ধারণ করেন। যা আগামী বছরে বাস্তবায়িত হবে। ”
উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি এরশাদ করেন- “ইয়াফতাহুল্লাহুল খাইরা ফী আরবা‘ই লাইয়ালিন, লাইলাতিল আদ্বহা ওয়াল ফিত্বরি, ওয়া লাইলাতিন নিসফি মিন শা‘বানা ইউনসাখু ফীহাল আজালু ওয়াল আরঝাকু ওয়া ইউকতাবু ফীহাল হাজ্জু, ওয়া ফী লাইলাতি ‘আরাফাতা ইলাল আযান।” অর্থাৎ- “আল্লাহ্ তায়ালা চারটি রাতে সর্বপ্রকার কল্যাণের দরজা খুলে দেন। যথা-১. ঈদুল আজহার রাত ২. ঈদুল ফিতরের রাত ৩. অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রজনি; এ রাতে হায়াত, রিজিক লিপিবদ্ধ করা হয় এবং হাজিদের তালিকা তৈরি করা হয় এবং ৪. আরাফাতের রাত ফজরের আজান পর্যন্ত।” (তাফসীরে দুররে মানছুর-এর ২৫নং খণ্ড, ৪০২ পৃষ্ঠা ) এমনিভাবে অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। উন্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “হে আয়েশা! অর্ধ শা’বান বা শবে বরাতের রজনির ফজিলত জান কি? হযরত আয়েশা (রা.) আরজ করলেন, হে আল্লাহ্র রাসুল (সা.)! এ রাতের ফজিলত কি? তিনি বলেন, এ রাতে লিপিবদ্ধ করা হয় কোন কোন সন্তান এ বৎসর জন্ম নেবে। আর কে কে এ বৎসর মৃত্যুবরণ করবে। এ রাতে বান্দার আমল আল্লাহ্র নিকট পেশ করা হয় এবং এ রাতেই রিজিক বন্টন করা হয়।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১১৫) আল্লাহ্র রাসুল (সা.) শবে বরাতের এ মহিমান্বিত রজনি ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। এ প্রসঙ্গে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (কা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন- “রাআইতু রাসূলাল্লাহি (সা.) লাইলাতান নিসফি মিন শা‘বানা ক্বামা, ফাসাল্লা আরবা‘আ ‘আশারাতা রাক‘আহ।” অর্থাৎ- “আমি আল্লাহ্র রাসুল (সা.)-কে অর্ধ শাবান বা শবে বরাতের রজনিতে ১৪ রাকাত নামাজ আদায় করতে দেখেছি।” (তাফসীরে দুররে মানছূর ২৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৪) এমনিভাবে অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (কা.) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এরশাদ করেন। “অর্ধ শা‘বান বা শবে বরাতের রজনিতে তোমরা জাগ্রত থেকে ইবাদত করো, আর দিনে রোজা রাখ। কারণ এ রাতে আল্লাহ্ দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে এসে জগতবাসীকে আহবান করে বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক অণ্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেবো। কোনো রোগাক্রান্ত আছে কি? আমি তাকে সুস্থ করে দেবো। এভাবে অসীম দয়ালু আল্লাহ্ ভোর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।” (সুনানে ইবনে মাযাহ শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ-এর ১১৫)
পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফের আলোকে এই পবিত্র শবে বরাতের মহিমান্বিত রজনির অত্যধিক গুরুত্ব ও ফজিলত বিধায় আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) সারারাতব্যাপী নফল নামাজ, নফল আমল, মিলাদ শরীফ পাঠ, মোরাকাবা, ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে পালন করার সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন। মোর্শেদের শিক্ষা অনুযায়ী আশেকে রাসুল ভাই বোনেরা এ পবিত্র রজনিতে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করেন। এ বছরও এই শবে বরাতের বরকতময় রাত্রিটি দেওয়ানবাগ শরীফে পালিত হবে ইনশাআল্লাহ্। দেওয়ানবাগ শরীফের পরিচালক মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর এ বছরও ইবাদতের মাধ্যমে শবে বরাতের রজনি পালন করার দিক নির্দেশনা দিবেন।
পরিশেষে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা জানাই তিনি যেন দয়া করে শবে বরাতের এ বরকতময় মহিমান্বিত রজনি ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করে এর ফায়েজ রহমত আমাদের সবাইকে লাভ করার তাওফিক এনায়েত করেন। আমিন! ইয়া রাব্বাল আলামিন।
[লেখক: ইসলামি আলোচক এবং সদস্য, আল কুরআন গবেষণা কেন্দ্র, দেওয়ানবাগ শরীফ, ঢাকা।]