শরিয়ত ও মারেফাত
মহান সংস্কারক, মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী, সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান
[সূফী সম্রাট হুজুর কেবলাজান রচিত ‘শান্তি কোন পথে?’ এবং ‘মুক্তি কোন পথে?’ কিতাব থেকে প্রবন্ধটি সংকলন করা হয়েছে।-সম্পাদক]
আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালনীয় ইসলামের নীতি ও আদর্শসমূহকে শরিয়ত বলা হয়। এককথায় শরিয়ত ইসলামের লিখিত সংবিধান, যা হযরত রাসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন- “হে রাসুল (সা.)! আমি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি ধর্মের বিশেষ বিধানের উপর। অতএব আপনি এর অনুসরণ করুন এবং মূর্খদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না।” (সূরা আল জাছিয়াহ ৪৫ : আয়াত ১৮)
অপরদিকে যে পদ্ধতি অনুশীলন দ্বারা আল্লাহর সাথে বান্দার যোগসূত্র স্থাপিত হয়, আল্লাহর সঠিক পরিচয় লাভ হয় এবং তাঁর চরিত্র মানুষের ভেতরে বিকশিত করা সম্ভব হয়, তার নাম মারেফাত। এলমে মারেফাতকে পবিত্র কুরআনে এলমে লাদুন্নি বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন- “তারপর তাঁরা [মুসা (আ.) সঙ্গীসহ সেথায় পৌঁছে] আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এমন একজনের সাক্ষাৎ পেলেন, যাঁকে আমি আমার তরফ থেকে রহমত দান করেছিলাম এবং তাঁকে শিক্ষা দিয়েছিলাম আমার কাছ থেকে এলমে লাদুন্নি, তথা এক বিশেষ জ্ঞান। মুসা (আ.) তাঁকে বললেন- আমি কি এ শর্তে আপনার অনুসরণ করতে পারি, সত্য পথের যে জ্ঞান আপনাকে শেখানো হয়েছে, সেই থেকে আপনি আমাকেও শিক্ষা দেবেন?” (সূরা আল কাহ্ফ ১৮: আয়াত ৬৫ ও ৬৬)
আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “(আল্লাহতত্ত্বের জ্ঞানে জ্ঞানী) আলেমগণ নবিগণের ওয়ারিস তথা উত্তরাধিকারী।” (তিরমিযী, আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ ও দারেমী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৪) নবিগণ জগদ্বাসীর মাঝে যে এলেম রেখে গেছেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুটি। যথা- ১। এলমে শরিয়ত ও ২। এলমে মারেফাত।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন- “এলেম হলো দু’প্রকার। যথা- ১। ক্বালবি এলেম, আর এ এলেমই হচ্ছে পরম উপকারী এলেম, ২। মুখের এলেম তথা কিতাবি এলেম, আর এ এলেমই মাখলুকাতের উপর আল্লাহর দলিল।” (তিরমিযী শরীফের সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর ২২নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১)
অন্য হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন- “কুরআনের প্রতিটি আয়াতেরই জাহের ও বাতেন আছে।” (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ’র সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ৩৫) অনুরূপভাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো এরশাদ করেন- “আশশারী‘আতু আক্বওয়ালী আত্ত্বারীক্বাতু আফ‘আলী আলহাক্বীকাতু আহওয়ালী আল মা‘রিফাতু আসরারী।” অর্থাৎ- “শরিয়ত আমার কথা, তরিকত আমার কাজ, হাকিকত আমার অবস্থা ও মারেফাত আমার নিগূঢ় রহস্য।” (নূরুল আসরার বা নূর তত্ত্ব ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪) সুতরাং হযরত রাসুল (সা.)-এর কথাকে যেমন মেনে চলতে হবে, তদ্রুপ তাঁর নিগূঢ় রহস্যকেও বুঝবার চেষ্টা করতে হবে।
শরিয়ত ও মারেফাত ইসলামের দুটি অপরিহার্য অংশ বিশেষ। ইসলামকে যদি একটি ফলের সাথে তুলনা করা হয়, যেমন-কলা, তাহলে শরিয়ত হবে উপরের খোলস বা আবরণ এবং মারেফাত হবে ভিতরের অংশ, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। উপরের খোলস বা আবরণটি ছাগলের খাদ্য। খোলস বা আবরণ ব্যতীত কলার অস্তিত্ব যেমন থাকে না, তদ্রুপ ভেতরের শ্বাস ব্যতীত খোলস অর্থহীন। দু’টি অংশ নিয়ে যেমন একটি ফলের সার্থকতা, তেমনি শরিয়ত ও মারেফাত নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম। মোটকথা মারেফাত শরিয়ত ব্যতীত অর্জন হতে পারে না, তদ্রুপ শরিয়তও মারেফাত ব্যতীত অসম্পূর্ণ।
শরিয়ত পালন করলেই মারেফাত অর্জন হবে কি?
মারেফাত হলো ধর্মের মূল বিষয়। যে বিদ্যা অর্জন করার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় এবং তাঁর নিগূঢ় রহস্য তথা সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়, এটিই মারেফাত। এ মারেফাত সম্পর্কে হযরত হাসান (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আলইলমু ‘ইলমানি, ‘ইলমুন ফিল ক্বালবি, ফাযাকাল ‘ইলমুন নাফি‘উন, ওয়া ‘ইলমুন ‘আলাল লিসানি, ফাতিলকা হুজ্জাতুল্লাহি ‘আলা খালাক্বিহ।” অর্থাৎ-“এলেম হলো দু’প্রকার। যথা- ১। ক্বালবি এলেম, আর এ এলেমই হচ্ছে পরম উপকারী এলেম, ২। মুখের এলেম তথা কিতাবি এলেম; আর এ এলেমই মাখলুকাতের উপর আল্লাহর দলিল।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ২২নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১)
কারো কারো ধারণা যে, মারেফাত শিক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। শরিয়ত পালন করতে করতে মারেফাত এমনিতেই হাসিল হয়ে যাবে। আসলে এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কেননা হযরত রাসুল (সা.) নবুয়ত লাভের পূর্বেই দীর্ঘ পনের বছর জাবালে নুরের হেরা গুহায় গভীর ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্ প্রদত্ত যে মহাশক্তি অর্জন করেছেন এবং যার দ্বারা মানুষকে উত্তম চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মুসলমানে পরিণত করেছেন, মূলত এটিই মারেফাত। আল্লাহ্ বলেন- “তিনিই নিরক্ষরদের মধ্যে তাদের একজনকে রাসুল করে প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনান এবং তাদেরকে পবিত্র করেন। আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা ইতঃপূর্বে ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় নিপতিত।” (সূরা আল জুমু‘আহ ৬২: আয়াত ২)
অপরদিকে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর নবুয়ত ও রিসালাত প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে, তিনি মানুষকে ইসলামের যে সকল বিধিবিধান পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, এটিই শরিয়ত। এককথায় শরিয়ত হলো ইসলামের লিখিত সংবিধান। মারেফাত থেকেই এ শরিয়তের উৎপত্তি। যেমন পিতা থেকে সন্তানের জন্ম হয়, সন্তান থেকে কখনো পিতার জন্ম হতে পারে না। শরিয়ত পালন করতে করতে মানুষ জীবন শেষ করে দিলেও মারেফাত অর্জন হবে না।
হানাফি মাজহাবের ইমাম, ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন- “ফেকাহ (শরিয়ত) শাস্ত্র মানুষের জাহেরকে শুদ্ধ করে। তাসাউফ মানুষের বাতেনকে শুদ্ধ করে।” (নূরুল আসরার বা নূর তত্ত্ব শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮)
হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “ইসলাম হলো ধর্মের প্রকাশ্য বা বাহ্যিক বিষয়। আর ইমানের অবস্থান হলো- ক্বালবের ভেতরে।” (মুসনাদে আহমদের সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৮৩)
আমিরুল মু’মিনিন শেরে খোদা হযরত আলী ইবনে আবু তালেব কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “ইমান হচ্ছে ক্বালবের মারেফাত জানা তথা ক্বালবের ভেতরে আল্লাহর পরিচয় লাভ করা, অতঃপর মৌখিক স্বীকৃতি ও কর্মের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।” (ইবনে মাজাহ্ তাবারানী ও বায়হাকীর শু‘আবুল ঈমানের সূত্রে তাফসীরে দুররে মানছুর ২৬নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৮৩) এজন্য হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের শরীরের দিকে এবং তোমাদের চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করেন না, বরং তিনি তোমাদের ক্বালবের দিকে দৃষ্টি রাখেন।” (মুসলিম শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮, হাদীস নং ৭)
উল্লেখ্য যে, হযরত রাসুল (সা.) হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একদা রুহুল কুদ্দুস তথা আল্লাহর পবিত্র রুহ মোবারক তাঁর সামনে এসে আল্লাহর বাণী পড়তে বলায়, তিনি পড়তে পারলেন না। পরে রুহুল কুদ্দুস পর পর তিনবার হযরত রাসুল (সা.)-এর ভেতরে এক ঐশ্বরিক মহাশক্তি প্রবেশ করেন এবং বের হয়ে আসেন। ফলে হযরত রাসুল (সা.)-এর ভেতরে এক ঐশ্বরিক মহাশক্তি প্রবেশ করে, আর এটিই ছিল তাওয়াজ্জোহ।
এ তাওয়াজ্জোহ শক্তি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ভেতরে থাকার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সহবতে স্ব স্ব ক্বালবে পরম প্রশান্তি অনুভব করতেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি বলেন- “একদা সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনার সহবতে থাকলে আমরা আমাদের ক্বালবের মাঝে পরম প্রশান্তি অনুভব করি, (ফলে আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আমাদের অন্তর ব্যাকুল হয়ে ওঠে)। কিন্তু আপনার সহবত থেকে দূরে সরে গিয়ে আমরা যখন পার্থিব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন আমাদের ঐ সুন্দর হালতটি আর থাকে না (তবে কি আমরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে গেলে মুনাফিক হয়ে যাই?) এ কথা শুনে আল্লাহর রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন- তোমাদের প্রতিপালক সম্পর্কে তোমরা কীরূপ ধারণা পোষণ করো? উত্তরে সাহাবায়ে কেরাম বললেন- কেন, গোপনে ও প্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় তিনিই আমাদের প্রতিপালক। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- (তোমরা যদি সর্বাবস্থায় এ বিশ্বাস পোষণ করে থাকো, তবে আমার সহবত থেকে দূরে যাওয়ার ফলে তোমাদের মনের যে পরিবর্তন ঘটে) সেটি মুনাফিকির লক্ষণ নয়।” (তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬১)
উপরন্তু তাওয়াজ্জোহর এই শক্তির পূর্ব যুগের নবিগণের মধ্যেও ছিল। খাঁটি অলী-আল্লাহগণের ভিতরে এই শক্তি বিদ্যমান থাকে বলেই তাঁরা এর সাহায্যে কাজ করে থাকেন। তাঁদের সান্নিধ্যে গিয়ে গভীর সাধনার মাধ্যমে মানুষকে মারেফাত অর্জন করতে হয়। কেবলমাত্র শরিয়তের বিধিবিধান জানতে কোনো অলী-আল্লাহর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ ও মাদরাসার শিক্ষাই যথেষ্ট। অথচ দেখা যায় মাদরাসায় শরিয়ত শিক্ষা লাভ করা সত্ত্বেও অনেক আলেম মারেফাত শিক্ষার জন্য অলী-আল্লাহর নিকট গিয়ে থাকেন। তাহলে বুঝা যায় যে, শরিয়ত পালন করলেই মারেফাত অর্জন হয় না। অতএব মারেফাত অর্জনের জন্য অলী-আল্লাহর নির্দেশিত পথে সাধনা করতে হয়। আসলে শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করলে ধর্মের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জানা যায়। পক্ষান্তরে মারেফাত শিখলে ইমানদার হওয়া যায়, অথচ শুধু শরিয়ত পালনের মাধ্যমে ইমানদার হওয়া যায় না।
মারেফাত ছাড়া শরিয়ত অপূর্ণ কেন?
পৃথিবীতে যত নবি ও রাসুল এসেছেন, সকল নবি ও রাসুল মোরাকাবার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। অতঃপর মহান আল্লাহ্ যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেই নির্দেশের আলোকে তাঁরা ধর্ম পরিচালনা করেছেন। ইসলামের আত্মিক অনুশীলনের বিষয় হচ্ছে মারেফাত, যা হযরত রাসুল (সা.) তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের শিক্ষা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে মারেফাতের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে। কেননা হযরত রাসুল (সা.) দীর্ঘ পনের বছর যাবৎ হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান-সাধনায় মগ্ন থাকা অবস্থায়, তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান, তথা আল্লাহর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেন।
প্রকৃতপক্ষে ধ্যান-সাধনা তথা মোরাকাবার পথ ধরেই আল্লাহর সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। কুল-কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পূর্বেই উল্লেখ করেছি- হযরত রাসুল (সা.) দীর্ঘদিন হেরা পর্বতের গুহায় মোরাকাবা করে নিজের ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকামে মহিমান্বিত আল্লাহর পরিচয় লাভ করেন। অর্থাৎ হেরা পর্বতের গুহায় দীর্ঘদিন ধ্যান-সাধনা করার ফলে হযরত রাসুল (সা.)-এর ভেতর থেকে, তথা ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসির মোকাম থেকে ‘রুহুল কুদ্দুস বা আল্লাহর পবিত্র রুহ’ বের হয়ে এসে, পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন- “ইয়া মোহাম্মদ ইক্বরা” অর্থাৎ, “হে মোহাম্মদ (সা.)! আপনি পাঠ করুন।” জবাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন- “মা আনা বিক্বারী” অর্থাৎ “আমি পড়তে অভ্যস্ত নই।” অতঃপর রুহুল কুদ্দুস পরপর তিনবার রাসুলের ভেতরে প্রবেশ করে বের হয়ে এলেন। আর তখনই রাসুল (সা.) পড়তে শুরু করলেন। আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল (সা.)! পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার প্রতিপালক শ্রেষ্ঠ সম্মানিত, যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। আর তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।” (সূরা আল ‘আলাক্ব ৯৬: আয়াত ১ থেকে ৫)
সুতরাং ধ্যান-সাধনা তথা মোরাকাবার এ পথেই হযরত রাসুল (সা.) অশেষ দয়াময় আল্লাহর পরিচয় লাভ করেন। এ পথেই মহান মালিক আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সাথে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর যোগাযোগের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবের (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “একবার আমি দীর্ঘ এক মাস হেরা গুহায় অবস্থান করলাম। অবস্থান শেষে গুহা হতে অবতরণ করে আমি খোলা ময়দানে চলছিলাম। পথিমধ্যে আমাকে আহ্বান করা হলো। আমি একে একে সামনে ও পিছনে, ডানে ও বামে তাকাতে লাগলাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। অতঃপর আমাকে পুনরায় আহ্বান করা হলো, এবারও আমি কাউকে দেখলাম না। পুনরায় আহ্বান করা হলে, আমি মাথা উত্তোলন করে দেখলাম- আমার মহান মালিক ঊর্ধ্বাকাশে আরশের উপর অবস্থান করে আমায় ডাকছেন। আমার শরীরে ভীষণ কম্পন শুরু হলো। আমি হযরত খাদিজা (রা.)-এর নিকট পৌঁছালাম এবং বললাম- আমাকে কম্বল দ্বারা আচ্ছাদিত করো। অতঃপর আমাকে কম্বল দ্বারা আচ্ছাদিত করা হলো। তারপর আমার উপর পানি ছিটানো হলো। এ সময় মহামহিম আল্লাহ্ নাজিল করেন- “হে কম্বলাবৃত রাসুল! উঠুন, সতর্ক করুন এবং আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।” (তাফসীরে কুরতুবী ২১নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫৫)
সুতরাং মারেফাতই ইসলামের মূল। এটির অনুশীলন প্রত্যেক মানুষেরই একান্ত কর্তব্য। অতএব এ কথা অনস্বীকার্য, মারেফাত ছাড়া শরিয়ত ভিত্তিহীন এবং অর্থহীন। মারেফাত অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে আল্লাহর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা এবং কেবলমাত্র তখনই সম্ভব আল্লাহর নির্দেশে নিজেকে পরিচালিত করা। এটিই প্রকৃত ইসলামি শিক্ষা। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “রাত ও দিনের পরিবর্তনকারী আল্লাহকে নিয়ে এক ঘন্টা মোরাকাবা করা আশি বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। (তাফসীরে দুররে মানছুর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১০)
অন্য হাদিসে হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এক ঘন্টা মোরাকাবা করা ষাট বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (তাফসীরে দুররে মানছুর ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১০) সেই সাথে অন্য হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “এক ঘন্টা সময় মোবারাকা করা এক হাজার বছরের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা ২৪) মোরাকাবার গুরুত্ব এত বেশি এ কারণে, সকল নবি ও রাসুল মোরাকাবা তথা ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। আসলে মারেফাত থেকেই শরিয়তের জন্ম। শরিয়ত পরিবর্তনশীল। পক্ষান্তরে মারেফাত সর্বযুগেই অপরিবর্তনীয়। মারেফাতের মাধ্যমে শরিয়তের যথার্থতা ও বিশুদ্ধতা জানা যায়। আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “তুমি কীভাবে চলবে, এ বিষয়ের ফয়সালা তুমি তোমার নফ্স তথা নাফসির মোকাম থেকে জেনে নাও; যদিও মুফতিগণ তোমাকে ফতোয়া দিয়ে থাকে।” (কালিমাতুর রাসুলিল আ‘জাম (সা.), পৃষ্ঠা ৩৯৯)
নবুয়তের যুগে দেখা গেছে, যখন যে নবি আবির্ভূত হয়েছেন, তাঁর সময়কার লিখিত সংবিধানই সেই যুগের মানুষের জন্য শরিয়ত বলে গণ্য ছিল। কিন্তু পরবর্তী যুগের নবির জামানায় পূর্ববর্তী যুগের শরিয়ত রহিত হয়ে গেছে। যেমন নবি হযরত আদম (আ.)-এর শরিয়তে সহোদর ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েজ তথা বৈধ ছিল। কিন্তু হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শরিয়তে মোহাম্মদী ইসলামে এটি হারাম, অবৈধ তথা নাজায়েজ। অন্যদিকে সকল নবি ও রাসুলের মারেফাত ছিল এক ও অভিন্ন, অর্থাৎ- মারেফাতের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, মারেফাতই ইসলাম ধর্মের মূল। সুতরাং মারেফাত ছাড়া শরিয়ত যেমন অপূর্ণ, তেমনি ধর্মই অপূর্ণ থেকে যায়।
[লেখক: দেওয়ানবাগ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা]