শাওয়ালের ৬ রোজা রাখার ফজিলত ও মর্যাদা
হযরত সাব্বির আহমদ ওসমানী: সারা বছরে একটি বরকতময় মাস হচ্ছে রমজান। যে মাসে আমল করা অধিক ফজিলতপূর্ণ কাজ। পবিত্র রমজান মু’মিনের আমলের সঠিক সময়। এ মাসের আমলগুলো যেন সারা বছর অব্যাহত থাকে সেটাই এর প্রধান শিক্ষা। পবিত্র কুরআনে রোজা রাখার নির্দেশের পরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা এসেছে। এরশাদ হয়েছে- “তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার দরুন আল্লাহ্র মহিমা বর্ণনা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।” (সূরা বাকারাহ ২: আয়াত ১৮৫)
শাওয়াল মাসের ৬ রোজা: কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম দিক হলো আমল অব্যাহত রাখা। এরমধ্যে রমজানের পর শাওয়ালের ৬ রোজা রাখা গুরুত্বপূর্ণ আমল। হযরত রাসুল (সা.) এ রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের তা রাখার নির্দেশ দিতেন। হযরত আবু আইউব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে এবং পরবর্তী সময়ে শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবে সে যেন পুরো বছর রোজা রাখলো।” (মুসলিম শরীফ, হাদিস ১১৬৪)
রমজান মাসে রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোজা রাখলে পুরো বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়। হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- মহান আল্লাহ্ সব ভালো কাজের প্রতিদান ১০ গুণ করে দেন। তাই রমজান মাস ১০ মাসের সমতুল্য এবং পরবর্তী (শাওয়াল মাসের) ছয় রোজার মাধ্যমে রোজা এক বছর পূর্ণতা লাভ করে। (নাসায়ী ২/১৬২)
পুরো বছর সওয়াব হয় যেভাবে: মূলত রমজান মাসের রোজার পর অতিরিক্ত ছয় রোজা মিলে সাধারণত ৩৬টি রোজা হয়। আর তা ১০ গুণ করলে মোট ৩৬০টি অর্থাৎ এক বছর হয়। কারণ মু’মিনের যে কোনো আমালের সওয়াব ১০ গুণ করে দেওয়া হয়। এরশাদ হয়েছে- “যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করবে সে তার দশগুণ পাবে এবং যে ব্যক্তি একটি মন্দ কাজ করবে তাকে শুধু তার কর্ম পরিমাণই প্রতিফল দেওয়া হবে। আর তাদের উপর জুলুম করা হবে না।” (সূরা আনআম ৬: আয়াত ১৬০)
রমজানের ৩০ রোজার মাধ্যমে আমরা ৩০০ দিনের সওয়াব বা প্রতিদান পেলাম। বাকী ৬০ দিন এর পরিপূরক হিসাবে হযরত রাসুল (সা.) শাওয়ালের ৬ রোজার বিধান করেছেন। ৬ী১০= ৬০+৩০০=৩৬০ পুরো ১ বছর। আরবি ১ বছর হয় ৩৫৪ দিনে। কারণ একজন লোকের উপর সারা বছর রোজা রাখা প্রায় অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “তোমার উপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে, কাজেই তুমি সারা বছর রোজা না রেখে রমজানের রোজা রাখো এবং রমজানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের ছয় রোজা রাখো, তাহলেই তুমি সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাবে।” (তিরমিজি ১/১৫৩৪) অত্র হাদিসে প্রিয় নবি (সা.) শাওয়াল মাসের প্রথম দিকে, মধ্যভাগে বা শেষাংশে নির্দিষ্ট করে রোজা রাখার কথা বলেননি। এক কথায় এ মাসের মধ্যে রাখলেই হলো- মোট একাধারে বা ফাঁকে ফাঁকে কোনো সমস্যা নেই।
রমজানের রোজার পরিপূরক: নফল আমলের মাধ্যমে ফরজের ত্রæটি বিচ্যুতি দূর করা হয়। তেমনি শাওয়ালের রোজার মাধ্যমে রমজানের রোজার ত্রæটিগুলি পূর্ণ করা হয়। নামাজ প্রসেঙ্গ হাদিসে এসেছে, হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হযরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন- “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার ফরজ নামাজের হিসাব করা হবে। তা ঠিক থাকলে সে কামিয়াব ও সফলকাম হবে। আর তাতে সমস্যা হলে সে ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর কোনো ফরজ আমলে অপূর্ণতা দেখা দিলে মহান রব বলবেন, তোমরা দেখো আমার বান্দার কি কোনো নফল নামাজ রয়েছে? নফল থাকলে তা দিয়ে ফরজকে পরিপূর্ণ করা হবে। এভাবে সব ফরজ আমলের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ করা হবে।” (তিরমিজি ৪১৩)
যখন রাখতে হয় এই ছয় রোজা: বিজ্ঞ ফিকহবিদ ও আলেমদের অভিমত হলো- ঈদের দিনটি বাদ দিয়ে শাওয়াল মাসের যে কোনো ছয়দিনে রোজা রাখলেই হবে। ধারাবাহিকভাবেও এই ছয়টি রোজা রাখা যাবে। আবার বিরতি দিয়ে ছয়টি রোজা পূরণ করতে পারলেও হাদিসে বর্ণিত সওয়াব পাওয়া যাবে। তবে যত তাড়াতাড়ি আদায় করা যায় তত ভালো। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “তোমরা প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে ধাবমান হও তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে ক্ষমা এবং ঐ জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের ন্যায়, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে মুত্তাকিদের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১৩৩)
শাওয়ালের ৬ রোজা ভাংতি রোজার আগে না পরে
যাদের ভাংতি রোজা আছে, অসুস্থতা কিংবা নারীদের হায়েজ নেফাসের কারণে রমজানের রোজা অপূর্ণ থাকে, তাদের জন্য নিয়ম ও করণীয় হলো- শাওয়াল মাসে তাদের ভাংতি রোজাগুলো আগে পূর্ণ করে নিবে। তারপর তারা শাওয়ালের ৬ রোজা পালন করবে। কেননা যার উপর রোজা কাযা রয়ে গেছে সে রোজা পূর্ণ করেছে বলে গণ্য হবে না যতক্ষণ ঐ রোজাগুলো কাযা আদায় না করে। (আল মুগনি ৪৪০) সুতরাং আগে রমজানের রোজা পূর্ণ করতে হবে তারপর শাওয়ালের ৬ রোজা রাখবে। তবেই সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব মিলবে।
নফল রোজার মধ্যে আছে সাপ্তাহিক দুই রোজা (সোম ও বৃহস্পতিবার) মাসিক তিন রোজা (আইয়ামে বীজ তথা চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা) মহররম ও আশুরার রোজা, শাবান মাসের রোজা, শাওয়াল মাসের ৬ রোজা, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের রোজা, জিলহজ মাসের ৯ তারিখের বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করতেন।
নফল ইবাদতের গুরুত্ব বর্ণনায় পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, “অতএব যখনই আপনি অবসর পাবেন তখনই নফল ইবাদত করবেন এবং স্বীয় রবের প্রতি মনোনিবেশ করবেন।” (সূরা ইনশিরাহ ৯৪: আয়াত ৭-৮)
মহান আল্লাহ্ হাদিসে কুদসিতে এরশাদ করেন, “রোজা আমার জন্য এবং আমি তার প্রতিদান।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৫) আল্লাহ্কে প্রতিদান স্বরূপ পাওয়ার জন্য মূলত হাকিকতে রোজা রাখা হয়। ফরজের পাশাপাশি নফল বা মুস্তাহাব রোজা ও ঠিক একই নিয়মে রাখতে হবে। তবেই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব হবে। তাই অলী-আল্লাহ্র সান্নিধ্যে গিয়ে হাকিকতে রোজা পালনের শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা রোজা রাখতে পারি তাহলেই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে স্রষ্টাকে হাসিল করা সম্ভব।
[লেখক: হযরত সাব্বির আহমদ ওসমানী – ইসলামি আলোচক; সদস্য, দেওয়ানবাগীর দল ওলামা মিশন বাংলাদেশ; সাবেক খতিব, দারুল ফালাহ্ জামে মসজিদ, রিয়াদ, সৌদি আরব]