সততাই কল্যাণের পথ
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া
এ বিশ্বজাহানে যত মহান ব্যক্তির আগমন ঘটেছে, সততাই ছিল তাঁদের জীবনের মূল ভিত্তি। সততা বিহনে মিথ্যার উপরে প্রাচীর গড়ে কেউই মহান হতে পারেনি। মহান আল্লাহ্ প্রেরিত নবি-রাসুল এবং আউলিয়ায়ে কেরাম প্রত্যেকেই সত্য ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তাঁরা সকলেই মিথ্যা, ধোকাবাজি, ছলচাতুরী এক কথায়, সকল প্রকার অসৎ কাজ থেকে মুক্ত ছিলেন। আমাদের প্রিয়নবি, বিশ্বজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহান আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ (সা.) ছিলেন সততার এক মূর্তপ্রতীক। তিনি জীবনে একটিও মিথ্যা কথা বলেননি। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “আল কিযবু উম্মুজ যামবী।” অর্থাৎ-মিথ্যা হচ্ছে সকল পাপের জননী।আমরা ছোটোবেলায় স্কুলের শিক্ষকদের কাছে সত্য কথা বলার শিক্ষা পেয়েছি। বাড়িতে মায়ের কাছে সততার শিক্ষা পেয়েছি। মা বলতেন কখনো মিথ্যা বলবে না। মিথ্যা কথা বললে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ ফেরেশতাদের দিয়ে জিহ্বা টেনে লম্বা করে মাথার পিছনে পেরেক মেরে আটকে রাখবে। একথা শুনে বিশ্বাস করেছি এবং ভয়ও পেয়েছি। ফলে ছোটো বেলা থেকে মিথ্যা পরিহার করার একটা অভ্যাস গড়ে ওঠে। অবশ্য মা যা বলেছেন, তা হুজুরদেরই কথা। এভাবে মসজিদ ও মক্তবের ইমামগণও বলতেন। তখন মানুষ একথাগুলো বিশ্বাস করত। আবার ছোটো বেলায় খাওয়ার সময় ভাত থালা থেকে পড়ে যেত। মা বলতেন এই যে ভাত ফেলে দিয়েছ, কেয়ামতের দিন এক একটা ভাত বড়ো বড়ো ৭টি লাউ হবে। সেগুলো কাঁচা খেতে হবে। ভাত যা ফেলেছ, তাতে অনেকগুলো লাউ হবে। খেতে পারবে তো? একথা শুনে মনে ভয় পেয়েছি। তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়ে থাকা ভাতগুলো তুলে এনে ধুয়ে খেয়ে ফেলেছি। ফলে কাঁচা লাউ খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। এরকম অনেক কথা মুরব্বিরা আমাদের বলেছেন। আমরা তা বিশ্বাস করে, অন্যায় অপরাধের কাজ থেকে বিরত থেকেছি। বর্তমানে মিথ্যা-ধোকাবাজি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বলে শেষ করা যায় না। বিশেষ করে, সমাজের অবস্থা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যুবসমাজ অহরহ মিথ্যাচার করে চলেছে, একবার গাড়িতে মতিঝিল থেকে ফার্মগেট যাচ্ছিলাম। গাড়ি যখন শাহবাগে, এমন সময় পাশের সিটের একজনের ফোন বেজে উঠলো। কথায় বুঝলাম, তার বন্ধু ফোন করেছে। লোকটিকে বন্ধু জিজ্ঞেস করেছে, তুই এখন কোথায়? সে জবাব দিয়েছে, আমি এখন ঢাকায়। কিন্তু তার বন্ধু তার কথা বিশ্বাস করছে না। সে বলছে- মিথ্যা বলিস না, তুই ঢাকায় নেই। কোথায় যাচ্ছিস সত্যি করে বল। লোকটি বলছে খোদার কসম, আমি সত্যিই এখন ঢাকায়। বারবার খোদার নামে কসম করে যখন কথা শেষ করল তখন আমি তাকে বললাম, এতবার খোদার কসম খেয়েও আপনার বন্ধুকে বিশ্বাস করাতে পারছেন না। কারণ হলো- আপনি ঢাকায় থাকলে বলেছেন, চট্টগ্রামের কথা। খুলনায় থাকলে বলেছেন, ঢাকার কথা। ফলে আপনার কোনো কথাই আজ বন্ধু বিশ্বাস করছে না। মনে রাখবেন, খোদার নামে কসম করা ঠিক নয়। আপনি বরং মিথ্যা বলা ছেড়ে দিন। তাহলে বন্ধু আপনাকে আর অবিশ্বাস করবে না। আর একবার দুই বন্ধু মোবাইল ফোনে কথা বলছে। একজন বলছে দোস্ত! তুই কই? সে জবাব দিয়েছে আমি এখন গুলশানে আছি। দোস্ত! তুই কোথায় আছিস? সে জবাব দিলো আমি এখন মতিঝিলে আছি। বেশ তাহলে তোর সাথে আজ আর দেখা হচ্ছে না। একথা বলতে বলতে দুই বন্ধুর শরীরেই ধাক্কা লেগেছে। তাকিয়ে দেখে দুই বন্ধুই ফার্মগেটে। এমন মিথ্যা বলার কী প্রয়োজন? আপনি কোথায় আছেন, পূর্ণভাবে তা প্রকাশ করতে না চাইলে বা কোনো অসুবিধা থাকলে, অন্তত এভাবে বলা যেতে পারে আমি এখন ফার্মগেট এলাকায় আছি অথবা মতিঝিল বা মগবাজার এলাকায় আছি। একেবারে সুনির্দিষ্ট বলতে অসুবিধা থাকলে, যে এলাকায় থাকবেন, তার নাম বলে দিলে অন্তত মিথ্যা বলার হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়, জগতের সেই সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের কথা, যিনি মদীনার প্রথম ইসলামিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ১০ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই সময়সহ তাঁর ৬৩ বছরের জীবনে তিনি একটিও মিথ্যা কথা বলেননি। তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন মহান আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু, শান্তির দূত হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। তিনি যদি জীবনে অন্তত ১টা মিথ্যা বলতেন, তাহলে না হয় আমরা মিথ্যা বলার একটা দলিল পেতাম। কিন্তু না! মিথ্যা বলা দূরের কথা, মিথ্যাকে তিনি ঘৃণা করেছেন এবং মানবজাতিকে তা পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া পৃথিবীতে যত মহান ব্যক্তি ও অলী-আল্লাহ এসেছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন সত্যবাদী। তাঁদের জীবনেও মিথ্যার কোনো ঘটনা নেই। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ সততার জন্য তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছেন।
সুতরাং একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, সততাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। মিথ্যা কথা বলা যে জঘন্য অপরাধ এবং এর পরিণতিও যে চরম অনিষ্টকর, এ সম্পর্কে আল্লাহ মহান বন্ধু সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান তাঁর মহামূল্যবান বাণী মোবারক প্রদানকালে বলতেন, “মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ, একটা মিথ্যা কথা বললে ৪০ দিন পর্যন্ত তার কোনো দোয়া আল্লাহ দরবারে কবুল হয় না।” এখন চিন্তার বিষয়, আমরা যারা নিজেদেরকে ইমানদার, মুসল্লি কিংবা হাজি সাহেব বলে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করে থাকি, আমরা কি মিথ্যা বলা পরিত্যাগ করতে পেরেছি? যদি না পেরে থাকি; তাহলে নিজেকে এত পরিচিত করে লাভ কী? আল্লাহ কাছে ধন সম্পদের কোনো মূল্য নেই, মূল্য হচ্ছে সততার।
একজন মিথ্যাবাদী কোটিপতি ধনীর চেয়ে একজন সত্যবাদী কপর্দকহীন গরিবের মূল্য আল্লাহ কাছে অনেক বেশি। আমরা যদি আমাদের সমাজের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যার প্রচুর অর্থ সম্পদ রয়েছে, এককথায় কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছেন; তার চাহিদার কোনো শেষ নেই। তার আরো প্রয়োজন। দেখা যায়, অনেকের ছেলে মেয়েও তেমন একটা নেই, আর যা আছে তারা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। নিজেরাই যথেষ্ট রোজগার করেন, এমন সন্তানের পিতা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও খুশি নন। তার আরো চাই। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গিয়ে হালাল হারামের তোয়াক্কা না করে শুধু টাকা ও সম্পদের পিছনেই ছুটতে থাকেন। মানুষ ঠকিয়ে ব্যবসা করে অর্থ লুটতে থাকেন। একটিবারও ভাবেন না যে, আমার ৫০/৬০ বছর বয়স হয়ে গেছে, আর না হয় ১০/২০ বছরই বেঁচে থাকবো। তারপরে তো একদিন দুনিয়ার সকল সম্পদ ছেড়ে খালি হাতে চলে যেতে হবে। বহুতল বিশিষ্ট বিশাল বাড়ি ও উন্নত মানের বহু দামী গাড়ি সবকিছু ছেড়ে বিদায় নিতে হবে। তখন মৃত দেহটি পর্যন্ত বাড়িতে উঠাতে দিতে আপত্তি উঠবে। তা জানা, বোঝা ও দেখা সত্তেও আমাদের চেতনা ফিরছে না। হায়রে মানুষ! কবে ফিরবে হুঁশ। তাই তো শিল্পীর কণ্ঠে শোনা যায়, “হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুশ, দম ফুরাইলে ঠুঁশ! তবু তো ভাই কারোরই নাই একটুখানি হুঁশ।”
প্রাচীন গ্রিসের ম্যাসিডনের রাজা ছিলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। বলিষ্ঠ চেহারায় রূপ আর শক্তির মিশেলে তিনি অন্য সব রাজার থেকে ছিলেন স্বতন্ত্র। সিংহের মতোই বিক্রম ছিল তাঁর। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যেই অ্যাড্রিয়াটিক সাগর থেকে সিন্ধু নদ পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫৬ সালে তার জন্ম। মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের স্থলাভিষিক্ত হন তৃতীয় আলেকজান্ডার। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডারকে বলা হতো ‘অর্ধেক পৃথিবীর রাজা’। কারণ গ্রিসের ছোট্ট রাজ্য ম্যাসিডন ছাপিয়ে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন তিনি। অল্প বয়স হলেও সিংহাসন সামলানো তার পক্ষে কঠিন হয়নি। কারণ, লিওনিদাসের মতো একজন যোগ্য প্রশিক্ষকের কাছ থেকে তিনি শরীর বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। আর মাত্র ১৩ বছর বয়সে শিক্ষা পেয়েছিলেন মহান গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে। মূলত এই সুশিক্ষার কারণেই আলেকজান্ডার প্রচন্ড শারীরিক দৃঢ়তা ও মেধার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ছেলেবেলায় আলেকজান্ডারের বাবা ফিলিপ বলেছিলেন, ‘ম্যাসিডন বড়োই ছোটো তোমার পক্ষে। একদিন সারা পৃথিবী জয় করবে তুমি।’ বাবার সেই কথাটা সত্যি প্রমাণ করেছিলেন আলেকজান্ডার।
মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। এতে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে। প্রথম অভিপ্রায়, শুধু চিকিৎসকরা আমার কফিন বহন করবেন। দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে কোষাগারে সংরক্ষিত সোনা, রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। শেষ ইচ্ছা, কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।” তাঁর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত লোকজন মহাবীর আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলেন না কেউ। তখন আলেকজান্ডারের একজন প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, “হে মহামান্য, অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে; কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?” দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করে আলেকজান্ডার বললেন, “আমি দুনিয়ার সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে বলেছি এ কারণে যে, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে চিকিৎসকরা আসলে কোনো মানুষকে সারিয়ে তুলতে পারেন না। তাঁরা ক্ষমতাহীন আর মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। গোরস্থানের পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি কারণ মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনা-দানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক ধন-সম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা জানাতে যে, খালি হাতে আমি এই পৃথিবীতে এসেছিলাম, আবার খালি হাতেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি।”
চিন্তা করার বিষয় হলো- আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট অর্ধ পৃথিবীর রাজা হওয়া সত্তেও তাঁর অবস্থা যদি এমন হতে পারে, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ হয়েও কেন সেই কথা স্মরণ করছি না। শুধু সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য টাকার পিছনেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। চোখ দুটি বুঁজে গেলে এই ধন সম্পদ আমার সামান্য কোনো কাজে আসবে না। এই চিরন্তন সত্যটি জানার পরেও আমরা কেন সেই ভুলটি করে যাচ্ছি?
আমরা আলেকজান্ডারের কাছ থেকে যে শিক্ষাটি পেয়েছি, তা যদি স্মরণ রাখি, তাহলে আমাদেরকে এই ভুলের সাগরে ডুবতে হয় না। মূলত সততাই কল্যাণের পথ। এই পথেই রয়েছে শান্তি ও মুক্তি। মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে সততার পথে পরিচালিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
[লেখক: সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল, জাতীয় আইন কলেজ, ঢাকা]