সম্পাদকীয়
ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে রোজা। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ্ রমজান মাসব্যাপী প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর জন্য রোজা পালন করাকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন, “হে মু’মিনগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা মোত্তাকি হতে পারো।” (সূরা আল বাকারা ২: আয়াত ১৮৩) রোজা বলতে বোঝায় সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও পাপাচার হতে বিরত থাকা। রোজার হাকিকত হলো মু’মিনগণ রোজা পালনের মাধ্যমে আত্মিক দোষত্রুটি সংশোধন করে পরিশুদ্ধ হতে পারেন। আত্মশুদ্ধি না হলে কোনো ইবাদতই শুদ্ধভাবে পালন করা সম্ভব নয়। কেননা নফস বা জীবাত্মা কুরিপু মুক্ত না হলে মহান আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য প্রয়োজনীয় এখলাস তথা একনিষ্ঠতা অর্জন করা যায় না। রোজা মানুষের কু-রিপুগুলোকে সংযমী করে শুদ্ধভাবে ইবাদতের পথ সৃষ্টি করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে রোজা পালনের মাধ্যমে যারা নিজের প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে হৃদয়ে আল্লাহ্কে লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন, তারাই সফলতা অর্জন করেছেন। হাদিসে কুদসিতে রোজা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন, “রোজা আমার জন্য এবং আমি এর প্রতিদান দেবো (আর প্রতিদান হলো মহান আল্লাহ্ নিজেই)।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪)
রোজার হাকিকত হলো রোজা পালনের মাধ্যমে লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ ও কাম মানসিকতা পরিহারের মাধ্যমে আত্মিক দোষত্রুটি সংশোধন করে পরিশুদ্ধ হওয়া যায়। রোজা হলো একজন ব্যক্তি ও তার মন্দ কাজের মাঝে ঢালস্ব^রূপ। এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান, “রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৪) রমজান মাসে আল্লাহ্ তায়ালা জগতের বুকে বিশেষ রহমত ও বরকতের ফায়েজ বর্ষণ করে থাকেন। ইবাদতকারীর উপর রমজানের ফায়েজের প্রভাব বর্ণনা করে হযরত রাসুল (সা.) এ মাসকে তিনটি অংশে বিভক্ত করে বলেছেন, “প্রথম দশ দিন রহমতের, দ্বিতীয় দশ দিন মাগফেরাতের এবং শেষ দশ দিন দোজখ থেকে মুক্তির।” (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৪) এ প্রসঙ্গে আমার মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেন, “মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহ ব্যতীত মানুষ ইবাদত করতে পারে না। রমজানের বিশেষ ফায়েজ মানুষের মধ্যে ইবাদতের স্পৃহাকে জাগ্রত করে, ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে আল্লাহ্র ইবাদতের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার পক্ষে আল্লাহ্র দয়া লাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। প্রথম দশ দিন এইভাবে অতিবাহিত করার পর তার মধ্যে আল্লাহ্র প্রেম সৃষ্টি হয়। এই প্রেমের প্রভাবে সে তার জীবনে কৃত অপরাধসমূহ ও আল্লাহ্র নাফরমানির জন্যে অনুতাপের আগুনে দগ্ধিভূত হতে থাকে; কাকুতি-মিনতি করে আল্লাহ্র দয়া ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে; পাপ কাজের প্রতি তার অন্তরে ঘৃণার উদ্রেক হতে থাকে। রমজানের দ্বিতীয় দশ দিন মানুষ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ্র ক্ষমা লাভ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। আল্লাহ্র দয়া হলে কৃত অপরাধের জন্য মার্জনা লাভ করে থাকে; পাপ কাজের প্রতি অন্তর থেকে ঘৃণাবোধ জন্মানোর ফলে নফসের কুরিপু তাকে সহজে আর পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। ফলে মানুষের আত্মার যে অনাবিল এক শান্তি অনুভব হতে থাকে, তা আর অশান্তির আগুন দ্বারা বিঘিœত হয় না। এজন্য রমজানের শেষ দশ দিনের ইবাদতকে বলা হয়েছে- দোজখ থেকে মুক্তির।”(মাসিক আত্মার বাণী, এপ্রিল ২০২২, পৃষ্ঠা ৬)
তিনি আরো বলেন, “মুসলমানদের অন্যান্য ইবাদত বন্দেগির মতো রোজাকে শুদ্ধভাবে পালনের জন্য অলী-আল্লাহ্গণের সহবত লাভ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ উপবাস থাকলেই মানুষের আত্মা শুদ্ধ হয় না এবং মানুষ সংযমী হতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন অলী-আল্লাহ্গণের ফায়েজের শক্তি। অলী-আল্লাহ্র সহবতে গিয়ে মানুষ যখন রোজা পালন করবে, তখন তার আত্মার কু-রিপু বা জীব-প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং অলী-আল্লাহ্র তরফ থেকে আত্মায় পরিপূর্ণভাবে ফায়েজ ওয়ারেদ হতে থাকবে। ফলে রোজাদারের আত্মা পরিশুদ্ধ লাভ করবে। অন্যথায় উপবাস থাকা ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না।” (মাসিক আত্মার বাণী, এপ্রিল ২০২২, পৃষ্ঠা ৬)
অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি যে রোজা রাখতে অক্ষম অথবা এমন রুগ্ন ব্যক্তি, যার সুস্থতার আশা করা যায় না, তাদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান হলোÑ তারা রোজার পরিবর্তে ফিদিয়া দেবে। ফিদিয়া হলো ঐ বিনিময়, যা আদায় করলে রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা থেকে আল্লাহ্ বান্দাকে মুক্তি দিয়ে দেন। রোজার ফিদিয়া হলোÑ প্রত্যেক দিনের রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে দু’বেলা পেট ভরে আহার করাবেন অথবা সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা সমপরিমাণ খাদ্যদ্রব্য অথবা তার বাজার মূল্য কোনো মিসকিনকে প্রদান করে দেওয়া।
উল্লেখ্য যে, ২৬শে রমজান দিবাগত রাতে লাইলাতুল কদর বা সম্মানিত রজনি। এই মহিমান্বিত রজনিতে মহান আল্লাহ্ পকিত্র কুরআন নাজিল করেন এবং এই রজনিকে হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। এই রাতে ফজর হওয়া পর্যন্ত মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে শান্তি বর্ষিত হয়ে থাকে। তাই শবে কদরে রাতব্যাপী ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করতে পারলে মহান আল্লাহ্র ক্ষমা ও দয়া লাভ করা সম্ভব।
পরিশেষে মহান আল্লাহ্র দরবারে প্রার্থনা- তিনি যেন দয়া করে আমাদেরকে সঠিকভাবে রোজা পালনের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার তৌফিক দান করেন।